৯৫তম অধ্যায়
পাণ্ডবগণের তীর্থযাত্ৰা
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! মহাবীর পাণ্ডবগণ সমবেত হইয়া স্থানে স্থানে অবস্থান করিয়া ক্রমশঃ নৈমিষারণ্যে উপস্থিত হইলেন। তথায় গােমতী নদীর অতিপবিত্র তীর্থসমূদয়ে স্নান এবং পুনঃ পুনঃ পিতৃগণ, বিপ্ৰগণ ও দেবগণের তর্পণ করিয়া প্রচুর অর্থ ও ; গোদান করিতে লাগিলেন। তৎপরে কন্যাতীর্থ, গোতীর্থ কালকোটি ও বিষপ্রস্থধরাধারে অধিবাস করিয়া বাহুদা-তীর্থে স্নান করিলেন। অনন্তর প্রয়াগে দেবগণের দেবযজনতীর্থে স্নান ও তথায় বাস করিয়া তপস্যায় অভিনিবিষ্ট হইলেন। পরে গঙ্গাযমুনা-সঙ্গম-স্থানে বিগত পাপ হইয়া ব্ৰাহ্মণগণকে অর্থদান করিলেন। তৎপরে ব্রাহ্মণগণ-সমভিব্যাহারে তপস্বিগণ-নিষেবিত পিতামহের বেদীতীর্থে উপনীত হইলেন এবং তথায় কতিপয় বাসর অবস্থান করিয়া নিরন্তর বন্য হবির্দ্বারা দ্বিজগণের তৃপ্তিসাধনপূর্ব্বক তপানুষ্ঠান করিতে লাগিলেন।
গয়াতীর্থ-গায়রাজের কীর্ত্তি
অনন্তর রাজর্ষি গায়কর্ত্তৃক অভিসংস্কৃত মহীধরতীর্থে উপস্থিত হইলেন; যে স্থানে গায়শিরনামক এক পর্ব্বত বিদ্যমান রহিয়াছে এবং বেতসপংক্তিশালিনী পুলিনশোভিতা অতিপবিত্ৰা মহানদীনাম্নী এক স্রোতস্বতী প্রবাহিতা হইতেছে। তথায় মহর্ষিসাৰ্থসেবিত পবিত্ৰশিখর পুণ্য ধরণীধর ও ব্রহ্মসরঃ-নামক তীর্থ আছে। যে স্থানে ভগবান অগস্ত্য যোগবলে কলেবর পরিত্যাগ করিয়াছিলেন; যে স্থানে চিরস্থায়ী ধর্ম্মরাজ স্বয়ং বাস করিতেছেন; যে স্থানে নদী-সকল সমুৎপন্ন হইয়াছে এবং যে স্থানে পিনাকপাণি ভগবান শঙ্কর নিরন্তর সন্নিহিত আছেন, তথায় মহাবীর পাণ্ডবেরা চাতুর্ম্মাস্যব্রত সাধনপূর্ব্বক ঋষি যজ্ঞ সমাধান করিলেন। যে স্থানে অক্ষয় বট ও অক্ষয় দেবযজন-ভূমি বিরাজমান আছে, পাণ্ডবেরা তথায় উপবাস করিয়া অক্ষয় ফললাভ করিলেন। অনন্তর শতসহস্ৰ তপোধন ব্ৰাহ্মণগণ তথায় সমাগত হইয়া আর্যবিধানানুসারে চতুর্ম্মাসসাধ্য যজ্ঞানুষ্ঠান করিলেন। তৎপরে বিদ্যাতপোবৃদ্ধ বেদবেদাঙ্গপারগ ব্ৰাহ্মণগণ সভা-মধ্যে সমাসীন হইয়া মহাত্মাদিগের অতিপবিত্ৰ কথা-সকল কীর্ত্তন করিতে লাগিলেন। ইত্যবসরে বিদ্যাব্রতাভিষিক্ত কৌমার-ব্ৰতধারী শমঠ অমূর্ত্তরয়ের তনয় রাজর্ষি গায়ের কথা আরম্ভ করিলেন।
শমঠ কহিলেন, মহারাজ! আমি অতি বিচিত্র গয়াচরিত্র কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। রাজর্ষি গয় অমূর্ত্তরায়ের পুত্র, তিনি এই স্থানে প্রচুরান্ন ও ভূরিদক্ষিণ এক যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়াছিলেন; ঐ যজ্ঞে শতসহস্ৰ অন্নাচল ও ঘৃতকুল্যা [ঘৃতের সরোবর—বৃহৎ আকার ঘৃতাধার] প্রস্তুত হয়; শত শত দধির নদী এবং শতসহস্র উত্তমোত্তম ব্যঞ্জনপ্রবাহ প্রবাহিত হইয়াছিল। গয়রাজ যাজকদিগকে প্রতিদিনই এইরূপ সমারোহে অন্নদান করিতেন এবং ব্রাহ্মণ ভিন্ন অন্যান্য জাতিও বহুবিধ অন্নব্যঞ্জন ভোজন করিত। দক্ষিণা-প্রদানকালে বেদধ্বনি গগন স্পর্শ করিয়াছিল; তখন অন্য আর কোন শব্দ কাহারও কর্ণগোচর হয় নাই। ঐ অদ্ভুত পুণ্যধ্বনি সঞ্চারিত হইয়া ভূলোক, দ্যুলোক ও দশদিক পরিপূর্ণ করিয়া সকলের বিস্ময়োদ্ভাবন করিয়াছিল; অনন্তর মনুষ্যেরা এই গাথা গান করিত যে, “মহাতেজাঃ গয়রাজের যজ্ঞে দেশে সকলেই অন্নপানে পরিতৃপ্ত হইয়াছেঃ অদ্য কে ভোজনাভিলাষী আছ বল, তথায় এখন পঞ্চবিংশতি অন্নাচল বিদ্যমান রহিয়াছে।” রাজর্ষি গয় যেরূপ সমারোহে যজ্ঞ সম্পন্ন করিয়াছিলেন, তদ্রূপ কেহই কখন করে নাই এবং করিবে, এমত বোধও হয় না। দেবগণ গয়দত্ত হবিৰ্দ্ধারা এরূপ পরিতৃপ্ত হইয়াছিলেন যে, অন্য-দত্ত দ্রব্যজাত-গ্রহণে নিতান্ত পরাঙ্মুখ হইয়া উঠিলেন। যেমন ভূতলের বালুকা, আকাশের তারকা ও জলধরের বারিধারা-সকল অসংখ্যোয়, তদ্রূপ তদীয় যজ্ঞের দক্ষিণাও সংখ্যাতীত হইয়াছিল। হে মহারাজ! গয়রাজ ব্ৰহ্মসরঃসন্নিধানে এইরূপ বহুবিধ যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়াছিলেন।