৯৫তম অধ্যায়
ধৰ্ম্মযুদ্ধের প্রশংসা–অধৰ্ম্মযুদ্ধের নিন্দা
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! বলবান্ ভূপতি দুর্বল ভূপতিকে পরাজয় করিবার বাসনা করিলে তাহাকে কিরূপে উহা। সম্পাদন করিতে হইবে?”
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! বলবান ভূপতি অন্যের রাজ্যে সমুপস্থিত হইয়া তত্ৰত্য প্রজাগণকে কহিবেন, আমি তোমাদিগের অধিপতি হইয়া তোমাদিগকে উত্তমরূপে রক্ষণাবেক্ষণ করিব; তোমরা আমাকে কর প্রদান ও আমার আশ্রয় গ্রহণ কর।’ বলবান্ আগন্তুক ভূপতি এই কথা বলিলে প্রজাগণ যদি তাঁহার বাক্যে সম্মত হয়, তাহা হইলে তিনি কোন বিবাদ না করিয়া তাহাদের উপর রাজত্ব করিবেন। আর যদি তাহারা তাঁহার বাক্যে সম্মত না হয়, তবে বলপূর্ব্বক তাহাদিগকে বশীভূত করিবেন। উহাদের মধ্যে ক্ষত্রিয় ভিন্ন অন্য জাতি যদি তাঁহার সহিত বিরোধে প্রবৃত্ত হয়, তাহা হইলে বিবিধ উপায়দ্বারা তাহাদিগকে শাসন করা তাহার কৰ্ত্তব্য। হীনব্যক্তিরাও ক্ষত্রিয়কে দুর্বল, আত্মত্রাণে অসমর্থ অরাতির নিকট ভীত দেখিলে শস্ত্রগ্রহণপূৰ্ব্বক তাহাকে পরাজয় করে।”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! নরপতি অন্য ক্ষত্রিয়কে আক্রমণ করিয়া তাহার সহিত কিরূপে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইবেন?”
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! বর্ম্মধারী না হইয়া ক্ষত্রিয়ের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হওয়া ও একাকী হইয়া অনেক ক্ষত্রিয়ের সহিত যুদ্ধ করা রাজার নিতান্ত অকৰ্ত্তব্য। কোন ব্যক্তি সমরে অক্ষম হইলে তাহাকে পরিত্যাগ করা ক্ষত্রিয়ের অবশ্য কর্ত্তব্য। প্রতিদ্বন্দ্বী বর্ম্মধারণ করিয়া আগমন করিলে নরপতিকে বৰ্ম্মধারণ এবং সৈন্যসমভিব্যাহারে আগমন করিলে তাঁহাকে সৈন্যের সাহায্য গ্রহণ করিয়া তাঁহার সহিত সংগ্রাম করিতে হইবে। বিপক্ষ যদি শঠতাসহকারে সংগ্রামে প্রবৃত্ত হয়, তাহা হইলে ভূপতি কপটতা আশ্রয় করিয়া তাঁহার সহিত যুদ্ধ করিবেন। আর যদি সে ধৰ্ম্মযুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়, তাহা হইলে নরপতিও ধৰ্ম্মানুসারে সংগ্রাম করিয়া তাহার নিবারণে যত্নবান্ হইবেন। অশ্বারোহী হইয়া কদাপি রথীর অভিমুখে গমন করিবেন না, রথারোহণ করিয়া রথীর অভিমুখীন হওয়া উচিত। বিপন্ন, ভীত বা জিত ব্যক্তির প্রতি কদাপি শস্ত্র নিক্ষেপ করা বিধেয় নহে। বিষলিপ্ত বা কুটিলবাণ [বিপক্ষের অলক্ষ্যে প্রয়োগযোগ] লইয়া যুদ্ধ করা নিতান্ত অনুচিত। অসাধুগণই এইরূপ অস্ত্র লইয়া যুদ্ধ করে। নরপতি জিঘাংসাপরতন্ত্র প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতি ক্রুদ্ধ না হইয়া ন্যায়ানুসারে যুদ্ধ করিবেন। দুর্ব্বল, অপত্যবিহীন, শস্ত্রহীন, বিপন্ন, ছিন্নকার্ম্মুক ও হতবাহন ক্ষত্রিয়গণকে বধ করা নিতান্ত অকৰ্ত্তব্য। যদি সাধুব্যক্তি সমরাঙ্গনে শরনির্ভিন্ন ও বিপদগ্রস্ত হয়েন, তাহা হইলে তাঁহাকে তাঁহার আবাসে প্রেরণ, না হয় আপনার আলয়ে আনয়নপূর্ব্বক চিকিৎসাদ্বারা তাঁহার স্বাস্থ্য-বিধান করিবেন। স্বায়ম্ভুব মনু ধৰ্ম্মযুদ্ধ করিতেই নির্দেশ করিয়া গিয়াছেন। সাধুদিগের সতত ধৰ্ম্ম আশ্রয় করাই কৰ্ত্তব্য, উহা বিনষ্ট করা বিধেয় নহে। যদি শঠতাসহকারে অধৰ্ম্মযুদ্ধে জয়লাভ করেন, তিনি আপনি আপনার বিনাশের মূলীভূত হয়েন। পাপাত্মারা অধৰ্ম্মযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া থাকে। সাধুগণ সৎপথ অবলম্বন করিয়াই অসাধুদিগকে জয় করিবেন। অধৰ্ম্মযুদ্ধে জয়লাভ করা অপেক্ষা ধৰ্ম্মযুদ্ধে প্রাণত্যাগ করাও শ্রেয়। অনেক স্থলে অধর্ম্মাচরণ করিলে সদ্য তাহার ফলভোগ হয় না বটে, কিন্তু সেই অধর্ম্ম ক্রমে ক্রমে অধার্ম্মিককে সমূলে নির্মূল করিয়া ফেলে। পাপপরায়ণ পুরুষ প্রথমতঃ পাপকাৰ্য্যদ্বারা অর্থ সংগ্রহ করিয়া পুলকিতচিত্তে চৌর্য্যবৃত্তি অবলম্বনে অধর্ম্ম নাই বিবেচনা করিয়া পুণ্যাত্মাদিগের প্রতি উপহাসবাক্য প্রয়োগ এবং বরুণের পাশে বদ্ধ হইয়াও আপনাকে অমর বলিয়া জ্ঞান করে; কিন্তু ঐ দুরাত্মাকে অচিরাৎ বিনষ্ট হইতে হয়। অধৰ্ম্মপরায়ণ ব্যক্তি প্রথমে বায়ুপূরিত চর্ম্মকোষের ন্যায় পরিবর্দ্ধিত হইয়া পরিশেষে নদীকুলস্থ পাপের ন্যায় সমূলে উম্মলিত হইয়া যায়; তখন সকল লোকেই তাহাকে প্রস্তরে নিপতিত কুম্ভের ন্যায় দেখিয়া তাহার ও তাহার কর্ম্মের নিন্দা করিতে থাকে। অতএব ধর্ম্মানুসারেই বিজয়লাভ ও কোষবৃদ্ধির চেষ্টা করা ভূপতিদিগের অবশ্য কর্ত্তব্য।”