এইমতে রাজগণ করিছে বিচার।
ধনুর নিকটে যান কুন্তীর কুমার।।
প্রদক্ষিণ ধনুকে করিয়া তিনবার।
শিবদাতা শিবে করিলেন নমস্কার।।
বাম করে ধরি ধনু তুলিল অর্জ্জুন।
নোয়াইয়া ফেলিলেন কর্ণদত্ত গুণ।।
পুনঃ গুণ দিয়া পার্থ দিলেন টঙ্কার।
সে শব্দে কর্ণেতে তালি লাগিল সবার।।
গুরু প্রণমিব বলি চিন্তেন হৃদয়ে।
সাক্ষাৎ কিরূপে হবে অজ্ঞাত সময়ে।।
পূর্ব্বে দ্রোণাচার্য্য কহিলেন যে আমারে।
বাঞ্ছা যদি আমারে প্রণাম করিবারে।।
আগে এক অস্ত্র মারি কর সম্ভোধন।
অন্য অস্ত্র ধরি পায় করিবা বন্দন।।
সেই অনুসারে পার্থ চিন্তিলেন মনে।
ভূমিতলে নাহি স্থল লোকের গহনে।।
বিশেষ সবারে বিদ্যা দেখাবার তরে।
শূন্যে স্থাপিলেন অস্ত্র পবনের ভরে।।
দুই অস্ত্র মারিলেন ইন্দ্রের নন্দন।
বরুণ অস্ত্রেতে ধৌত করিল চরণ।।
আর অস্ত্র প্রণাম করিল গিয়া পায়।
আশীর্ব্বাদ করিলেন, দ্রোণাচার্য্য তায়।।
বিস্মিত হইয়া দ্রোণ চিন্তেন তখন।
মম প্রিয়শিষ্য এই হবে কোন জন।।
কুরুশ্রেষ্ঠ পিতামহ গঙ্গার কুমার।
তাঁরে করিলেন পার্থ শত নমস্কার।।
দ্রোণ বলিলেন, দেখ শান্তনু-তনয়।
লক্ষ্যবেদ্ধা ব্রাহ্মণ তোমারে প্রণময়।।
ভীষ্ম বলে, আমি ক্ষত্র ও হয় ব্রাহ্মণ।
আমারে প্রণাম করে কিসের কারণ।।
দ্রোণ বলে, দ্বিজ এই না হয় কদাপি।
ক্ষত্র-কুল-শ্রেষ্ঠ এই দ্বিজ ছদ্মরূপী।।
যেই বিদ্যা দেখাইল তব বিদ্যমানে।
মম শিষ্য বিনা অন্যে কেহ নাহি জানে।।
বড় বড় রাজা ইহা কেহ নাহি জানে।
এ বিদ্যা পাইবে কোথা ভিক্ষুক-ব্রাহ্মণে।।
বিশেষ তোমাকে যে করিল নমস্কার।
তোমার বংশেতে জন্ম হয়েছে ইহার।।
এখনি বিদিত হবে আর মুহূর্ত্তেকে।
কতক্ষণ লুকাইবে জ্বলন্ত পাবকে।।
ভীষ্ম কহে, আমি হৃদে তাই ভাবিতেছি।
পূর্ব্বে আমি ইহারে কোথায় দেখিয়াছি।।
নিরখিয়া ইহার সুচারু চন্দ্রমুখ।
কহনে না যায় যত জন্মিতেছে সুখ।।
কহ কহ গুরু যদি জানহ ইহারে।
কেবা এ কাহার পুত্র, কিবা নাম ধরে।।
দ্রোণাচার্য্য বলেন, কহিতে আমি পারি।
স্বপক্ষ বিপক্ষ দেখি চিত্তে কিছু ডরি।।
বিশেষে অনেক দিন মরিল যে জনে।
দৃঢ় করি তার নাম লইব কেমনে।।
ভীষ্ম বলে, কহ গুরু কি ভয় তোমার।
কে মরিল বহু দিন কিবা নাম তার।।
দ্রোণ বলে, যে বিদ্যা দেখালে এ সভায়।
পার্থ বিনা মম ঠাঁই কেহ নাহি পায়।।
পূর্ব্বে আমি পার্থেরে করিলাম স্বীকার।
শিষ্য না করিব কেহ সমান তোমার।।
সেই হেতু এ বিদ্যা দিলাম ধনঞ্জয়ে।
আমারে দিলেন যাহা ভৃগুর তনয়ে।।
অশ্বত্থামা আদি ইহা কেহ নাহি জানে।
তাই পার্থ বলি ইহা লয় মম মনে।।
শুনিয়া পার্থের নাম ভীষ্ম শোকাকুল।
নয়নের জলে তিতে অঙ্গের দুকূল।।
কি বলিলা আচার্য্য, করিলা কোন্ কর্ম্ম।
জ্বালিলা নির্ব্বাণ অগ্নি দগ্ধ কৈলা মর্ম্ম।।
দ্বাদশ বৎসর নাহি দেখি শুনি কাণে।
আর কোথা পাইব সে সাধু পুত্রগণে।।
এত বলি ভীষ্মদেব করেন ক্রন্দন।
দ্রোণ বলিলেন, ভীষ্ম ত্যজ শোকমন।।
নিশ্চয় জানিহ এই কুন্তীর নন্দন।
দেব হৈতে জন্মিল পাণ্ডব পঞ্চজন।।
পাণ্ডুপুত্র মরিয়াছে, কহে সর্ব্বজনে।
সে কথায় আমার প্রত্যয় নাহি মনে।।
বিদুরের মন্ত্রণায় তারা গেল তরি।
এই কথা ভাবি আমি দিবস-শর্ব্বরী।।
হেন নীতি উক্ত আছে, মুনিগণ বলে।
পাণ্ডবের মরণ নাহিক ক্ষিতিতলে।।
এত শুনি ভীষ্মবীর ত্যজিলা ক্রন্দন।
দুই জনে কল্যাণ করেন হৃষ্টমন।।
যদি এই কুন্তী পুত্র হইবে ফাল্গুনী।
লক্ষ্য বিন্ধি প্রাপ্ত হৌক দ্রুপদ-নন্দিনী।।
তবে পার্থ প্রণমেন কৃষ্ণে যোড়হাতে।
পাঞ্চজন্য শঙ্খবাদ্য হয় যেই ভিতে।।
দেখিয়া কল্যাণ বাক্য কহেন শ্রীপতি।
হাসিয়া বলেন তবে বলভদ্র প্রতি।।
অবধানে দেখ হের রেবতী-রমণ।
তোমায়ে প্রণমে পার্থ ইন্দ্রের নন্দন।।
কল্যাণ করহ, যেন বিন্ধে পার্থ লক্ষ্য।
শুনি বলভন্দ্রের কম্পিত হৈল বক্ষ।।
রাম বলিলেন, পার্থ বিন্ধিবেক লক্ষ্য।
কন্যা লৈয়া যাইবার না হইবে শক্য।।
একা ধনঞ্জয়, এত সমূহ বিপক্ষ।
সসৈন্যেতে আসিয়াছে রাজা এক লক্ষ।।
অনুপম-রূপা কৃষ্ণা অনঙ্গ-মোহিনী।
সবাকার মন হরিয়াছে সে ভামিনী।।
এই হেতু সবাই করিব প্রাণপণ।
কন্যা লাগি দ্বন্দ্ব করিবেক রাজগণ।।
বিশেষ ব্রাহ্মণ বলি পার্থে সবে জানে।
এত লোকে কি করিবে পার্থ একজনে।।
কৃষ্ণ কন, অন্যায় করিবে দুষ্টগণ।
তুমি আমি বসিয়াছি কিসের কারণ।।
মম বিদ্যমানে করিবেক অত্যাচার।
জগন্নাথ নাম তবে কি হেতু আমার।।
জগৎজনের আমি অন্তে হেই ত্রাতা।
দুর্ব্বলের বল আমি সর্ব্ব ফলদাতা।।
যদি আমি সমুচিত ফল নাহি দিব।
তবে কেন জগন্নাথ এ নাম ধরিব।।
সুদর্শনে ছেদিব সকল দুষ্টমতি।
পূর্ব্বে যথা নিঃক্ষত্রিয়া কৈল ভৃগুপতি।।
বিশেষ করিতে নাশ অবনীর ভার।
তেঁই জন্ম অবনীতে হয়েছে আমার।।
গোবিন্দের বাক্যে রাম চিন্তাম্বিত মনে।
অর্জ্জুনে আশিস্ করে কৃষ্ণের বচনে।।
মহাভারতের কথা অমৃত-লহরী।
কাশী কহে, শুনিলে সে সর্ব্বপাপে তরি।।