পুনঃ পুনঃ ধৃষ্টদ্যুন্ন স্বয়ম্বর-স্থলে।
লক্ষ্য বিন্ধিবারে বলে ক্ষত্রিয় সকলে।।
তাহা শুনি উঠিলেন কুরুবংশপতি।
ধনুর নিকটে যান ভীষ্ম মহামতি।।
তুলিয়া ধনুকে ভীষ্ম দিয়া বাম জানু।
হুলে ধরি নত করিলেন মহাধনু।।
বলি করি ধনু তুলি গঙ্গার কুমার।
আকর্ণ পূরিয়া ধনু দিলেন টঙ্কার।।
মহাশব্দে মোহিত হইল সর্ব্বজন।
ঊচ্চৈঃস্বরে বলিলেন গঙ্গার নন্দন।।
শুনহ পাঞ্চাল আর যত রাজভাগ।
সবে জান আমি দারা করিয়াছি ত্যাগ।।
কন্যাতে আমার নাহি কিছু প্রয়োজন।
আমি লক্ষ্য বিন্ধিলে লইবে দুর্য্যোধন।।
এত বলি ভীষ্ম বাণ যুড়েন ধনুকে।
হেনকালে শিখণ্ডীকে দেখেন সম্মুখে।।
ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা আছে খ্যাত চরাচর।
অমঙ্গল দেখিলে ছাড়েন ধনুঃশর।।
শিখণ্ডী দ্রুপদপুত্র নপুংসক জাতি।
তার মুখ দেখি ধনু রাখে মহামতি।।
তবেত সভাতে ছিল যত রাজগণ।
পুনঃ ডাক দিয়া বলে পাঞ্চাল-নন্দন।।
ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র নানা জাতি।
যে বিন্ধিবে লবে সেই কৃষ্ণ গুণবতী।।
এত শুনি উঠিলেন দ্রোণ মহাশয়।
শিরেতে উষ্ণীষ শোভে শুভ্র অতিশয়।।
শুভ্র মলয়জে লিপ্ত শুভ্র সর্ব্ব অঙ্গ।
হস্তে ধনুর্ব্বাণ শোভে, পৃষ্ঠেতে নিষঙ্গ।।
ধনুক লইয়া দ্রোণ বলেন বচন।
যদি আমি এই লক্ষ্য বিন্ধি কদাচন।।
আমা যোগ্য নহে এই দ্রুপদ-কুমারী।
সখার কুমারী হয় আপন ঝিয়ারী।।
দুর্য্যোধনে কন্যা দিব যদি লক্ষ্য হানি।
এত বলি ধনু তুলি নিল বামপাণি।।
টঙ্গারিয়া গুণ পুনঃ দিলেন আচার্য্য।
খসাইয়া দিবে গুণ, এ কোন্ আশ্চর্য্য।।
বিন্ধিতে যে শক্ত, তার গুণেতে কি ভয়।
দুই স্থানে অধিকারী দুর্য্যোধন হয়।।
তাই গুণ ঘুচাইতে নাহি প্রয়োজন।
বিশেষ ভীষ্মের দত্ত, নহে অন্যজন।।
তবে দ্রোণ লক্ষ্য দেখে জলের ছায়াতে।
অপূর্ব্ব রচিল লক্ষ্য দ্রুপদ-নৃপেতে।।
পঞ্চক্রোশ ঊর্দ্ধতে সুবর্ণ-মৎস্য আছে।
তার অর্দ্ধ-পথে রাধাচক্র ফিরিতেছে।।
নিরবধি ফিরে চক্র অদ্ভুত নির্ম্মাণ।
মধ্যে রন্ধ্র আছে মাত্র যায় এক বাণ।।
ঊর্দ্ধে দৃষ্টি কৈলে মৎস্য না পাই দেখিতে।
জলেতে দেখিতে পাই চক্রচ্ছিদ্র-পথে।।
অধোমুখে চাহিয়া থাকিবে মৎস্য লক্ষ্য।
ঊর্দ্ধে বাণ বিন্ধিবেক শুনিতে অশক্য।।
টানিয়া ধনুক দ্রোণ জলচ্ছায়া চায়।
দেখিয়া হৃদয়ে চিন্তা করে যদুরায়।।
পরশুরামের শিষ্য দ্রোণ মহাশয়।
নানাবিদ্যা অস্ত্র-শস্ত্রে পূর্ণিত হৃদয়।।
বিশেষে সবার গুরু দ্রোণ ধনুর্ব্বেদ।
সকল লোকেতে খ্যাত সৃষ্টি করে ভেদ।।
লক্ষ্য বিন্ধিবে কিছু বিচিত্র নহে কথা।
এক্ষণে বিন্ধিবে লক্ষ্য, নাহিক অন্যথা।।
সুদর্শন-চক্রে আজ্ঞা হেন চক্রধর।
মৎস্য-লক্ষ্য ঢাকি রহে সেই চক্রবর।।
তবে দ্রোণাচার্য্য বাণ আকর্ণ পূরিয়া।
চক্রচ্ছিদ্র-পথে বিন্ধে জলেতে চাহিয়া।।
মহাশব্দে উঠে বাণ গগন-মণ্ডলে।
সুদর্শনে ঠেকিয়া পড়িল ভূমিতলে।।
লজ্জিত হইয়া দ্রোণ ছাড়িল ধনুক।
সভাতে বসিল গিয়া হয়ে অধোমুখ।।
বাপের দেখিয়া লজ্জা ক্রোধে তবে দ্রোণি।
তুলিয়া লইল ধনু ধরি বামপাণি।।
ধনু টঙ্কারিয়া বীর চাহে জলপানে।
আকর্ণ পূরিয়া চক্রচ্ছিদ্র পথে হানে।।
গর্জ্জিয়া উঠিল বাণ উল্কার সমান।
সুদর্শনে ঠেকিয়া হেইল খান খান।।
দ্রোণ দ্রৌণি দোঁহে যদি বিমুখ হইল।
বিষম লজ্জার ভয়ে কেহ না উঠিল।।
তবে কর্ণ মহাবীর সূর্য্যের নন্দন।
ধনুর নিকটে শীঘ্র করিল গমন।।
বামহস্তে ধরি ধনু দিয়া পদভর।
খসাইয়া গুন পুনঃ দিল বীরবর।।
টঙ্কারিয়া ধনুকে যুড়িল বীর বাণ।
ঊর্দ্ধকরে অধোমুখে পূরিয়া সন্ধান।।
ছাড়িলেন বাণ, বায়ুসম বেগে ছুটে।
জ্বলন্ত অনল যেন অন্তরীক্ষে উঠে।।
সুদর্শন চক্রে ঠেকি চূর্ণ হয়ে গেল।
তিলবৎ হয়ে বাণ ভূতলে পড়িল।।
লজ্জা পেয়ে কর্ণ ধনু ভূতলে ফেলিয়া।
অধোমুখ হয়ে সভামধ্যে বসে গিয়া।।
ভয়ে ধনুপানে কেহ নাহি চাহে আর।
পুনঃ পুনঃ ডাকি বলে দ্রুপদ-কুমার।।
দ্বিজ হৌক, ক্ষত্র হৌক, বৈশ্য শূদ্র আদি।
চণ্ডাল প্রভৃতি লক্ষ্য বিন্ধিবেক যদি।।
লভিবে দ্রৌপদী সেই দৃঢ় মোর পণ।
এত বলি ঘন ডাকি পাঞ্চাল-নন্দন।।
আর কেহ নাহি ধায় ধনুকের ভিতে।
একবিংশ দিন তথা গেল হেনমতে।।
দ্বিজ৮-সভা মধ্যেতে বসিয়া যুধিষ্টির।
চতুর্দ্দিকে বেষ্টি বসিয়াছে চারি বীর।।
আর যত বসিয়াছে ব্রাক্ষণ-মণ্ডল।
দেবগণ মধ্যে যেন শোভে আখণ্ডল।।
নিকটেতে ধৃষ্টদুন্ন পুনঃ পুনঃ ডাকে।
লক্ষ্য আসি বিন্ধহ যাহার শক্তি থাকে।।
যে লক্ষ্য বিন্ধবে কন্যা লবে সেই বীর।
শুনি ধনঞ্জয় চিত্তে হইল অস্থির।।
বিন্ধিব বলিয়া লক্ষ্য করি হেন মনে।
যুধিষ্ঠির পানেতে চাহেন অনুক্ষণে।।
অর্জ্জুনের চিত্ত বুঝি কহেন ইঙ্গিতে।
আজ্ঞা পেয়ে ধনঞ্জয় উঠেন ত্বরিতে।।
অর্জ্জুন চলিয়া যান ধনুকের ভিতে।
দেখিয়া সে দ্বিজগণ লাগে জিজ্ঞাসিতে।।
কোথাকারে যাহ দ্বিজ কিসের কারণ।
সভা হৈতে উঠি যাহ কোন্ প্রয়োজন।।
অর্জ্জুন বলেন, যাহ লক্ষ্য বিন্ধিবারে।
প্রসন্ন হইয়া সবে আজ্ঞা দেহ মোরে।।
শুনিয়া হাসিল যত ব্রাহ্মণ-মণ্ডল।
কন্যারে দেখিয়া দ্বিজ হইল পাগল।।
যে ধনুকে পরাজয় পায় রাজগণ।
জরাসন্ধ শল্য দ্রোণ কর্ণ দুর্য্যোধন।।
সে লক্ষ্য বিন্ধিতে দ্বিজ চাহে কোন্ লাজে।
ব্রাহ্মণেরে হাসাইল ক্ষত্রিয় সমাজে।।
বলিবেক ক্ষত্র যত লোভী দ্বিজগণ।
হেন বিপরীত আশা করে সে কারণ।।
বহুদূর হৈতে আসিয়াছে দ্বিজগণ।
বহু আশা করিয়াছে, পাবে বহু ধন।।
সে সব হইবে নষ্ট তোমার কর্ম্মেতে।
অসম্ভব আশা কেন কর দ্বিজ ইথে।।
অনর্থ না কর, আসি বৈসহ ব্রাহ্মণ।
এত বলি ধরি বসাইল দ্বিজগণ।।
পুনপুনঃ ডাকি বলে দ্রুপদ-তনয়।
শুনিয়া অস্থির চিত্ত বীর ধনঞ্জয়।।
পুনঃ উঠিবারে পার্থ করিলেন মতি।
হেনকালে শঙ্খনাদ করেন শ্রীপতি।।
পাঞ্চজন্য শঙ্খনাদে ত্রৈলোক্য পূরিল।
দুষ্ট-রাজগণ শব্দ শুনি স্তব্ধ হৈল।।
শঙ্খনাদ শুনি পার্থ হলেন উল্লাস।
ভয়াতুর জনে যেন পাইল আশ্বাস।।
উঠ উঠ ধনঞ্জয় ডাকে শ্ঙ্খবর।
লক্ষ্য বিন্ধি দ্রৌপদীরে লভহ সত্বর।।
গোবিন্দের ইঙ্গিতে উঠিলেন অর্জ্জুন।
পুনঃ গিয়া ধরিলেন যত দ্বিজগণ।।
দ্বিজগণ বলে, বিপ্র হইলে বাতুল।
তব কর্ম্ম দেখি মজিবেক দ্বিজকুল।।
দেখিলে হাসিবে যত দুষ্ট ক্ষত্রগণ।
বলিবেক লোভী এই যত দ্বিজগণ।।
সবা হৈতে সবাকারে দিবে খেদাইয়া।
পাবার থাকুক কার্য্য লইবে কাড়িয়া।।
এত বলি ধরাধরি করি বসাইল।
দেখি ধর্ম্মপুত্র দ্বিজগণেরে কহিল।।
কি কারণে দ্বিজগণ কর নিবারণ।
যার যত পরাক্রমে সে জানে আপন।।
যে লক্ষ্য বিন্ধিতে ভঙ্গ দিল রাজগণ।
শক্তি না থাকিলে তখা যাবে কোন্ জন।।
বিন্ধিতে না পারিলে আপনি পাবে লাজ।
তবে নিবারণে আমা সবার কি কাজ।।
যুধিষ্ঠির-বাক্য শুনি ছাড়ি দিল সবে।
ধনুর নিকটে যান ধনঞ্জয় তবে।।
হাসিয়া ক্ষত্রিয় যত করে উপহাস।
অসম্ভব কর্ম্মে দেখি দ্বিজের প্রয়াস।।
সভা-মধ্যে ব্রাহ্মণের মুখে নাই লাজ।
যাহে পরাজয় হৈল রাজার সমাজ।।
সুরাসুর-জয়ী যেই বিপুল ধনুক।
তাহে লক্ষ্য বিন্ধিবারে চলিল ভিক্ষুক।।
কন্যা দেখি দ্বিজ কিবা হইল অজ্ঞান।
বাতুল হইল কিবা করি অনুমান।।
কিম্বা মনে করিয়াছে দেখি একবার।
পারিলে পারিব, নহে কি হবে আমার।।
নিলর্জ্জ ব্রাহ্মণে মোরা অল্প না ছাড়িব।
উচিত যে শাস্তি হয়, অবশ্য তা দিব।।
কেহ বলে ব্রাহ্মণেরে না বল এমন।
সামান্য মনুষ্য বুঝি না হবে এ জন।।
দেখ দ্বিজ মনসিজ জিনিয়া মূরতি।
পদ্মপত্র যুগ্মনেত্র পরশয়ে শ্রুতি।।
অনুপম তনু শ্যাম নীলোৎপল আভা।
মুখরুচি কত শুচি করিয়াছে শোভা।।
সিংহগ্রীব বন্ধুজীব অধর রাতুল।
খগরাজ পায় লাজ নাসিকা অতুল।।
দেখি চারু যুগ্ম ভুরূ ললাট প্রসর।
কি সানন্দ গতি মন্দ মত্ত করিবর।।
ভুজযুগে নিন্দে নাগে আজানুলম্বিত।
করিকর-যুগবর জান সুবলিত।।
বুকপাটা, দন্তচ্ছটা জিনিয়া দামিনী।
দেখি এর ধৈর্য্য ধরে কোথা কে কামিনী।।
মহাবীর্য্য যেন সূর্য্য মেঘে আবরিত।
অগ্নি অংশু যেন পাংশু-ছায়ে আচ্ছাদিত।।
এইজনে লয় মনে বিন্ধিবেক লক্ষ্য।
কাশী ভণে, হেন জনে কি কর্ম্ম অশক্য।।