৯৩তম অধ্যায়
প্রিয়ব্যবহার প্রশংসাপ্রসঙ্গে বিবিধ নীতি-ইঙ্গিত
“বামদেব বলিলেন, “হে মহারাজ! রাজা দুৰ্ব্বলের উপর অধৰ্ম্মাচরণ করিলে তাঁহার বংশীয় অন্যান্য ব্যক্তিরাও সেই পাপপ্রবর্ত্তক দুৰ্ব্বিনীতের কুপ্রথার অনুসরণ করিয়া থাকে; তন্নিবন্ধন রাজ্য অচিরাৎ বিনষ্ট হইয়া যায়। মানবগণ স্বধৰ্ম্মনিরত ভূপতির ব্যবহারের অনুগমন করিলে উন্মার্গগামী নরপতির কথা দূরে থাকুক, তাঁহার আত্নীয়গণও তাহা সহ্য করিতে পারে না। অশাস্ত্রদর্শী রাজা ঔদ্ধত্যভাব অবলম্বনপূৰ্ব্বক অচিরাৎ বিনষ্ট হইয়া যায়। যে ক্ষত্রিয় চিরাচরিত প্রথার অনুবর্তী নহেন এবং যিনি সমরাঙ্গনে পূৰ্ব্বোপকারী শত্রুকে পরাজিত করিয়া সম্মানিত না করেন, তাঁহার ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্ম প্রতিপালন করা হয় না। সতত সামর্থ্য প্রকাশ, প্রফুল্লমুখে অবস্থান ও বিপৎকালে লোকের প্রতি অনুগ্রহ প্রকাশ করা রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। ঐরূপ ব্যবহার করিলে তিনি চিরকাল প্রিয় ও সম্পত্তিশালী হইয়া পরমসুখে কালযাপন করিতে পারেন। রাজা কোন কারণবশতঃ একবার যাহার অপ্রিয়াচরণ করিবেন, তাহার সহিত সতত প্রিয়ব্যবহার করা তাঁহার আবশ্যক। প্রিয়ব্যবহার করিলে শত্রুগণও উপকার করিয়া থাকে। মিথ্যাবাক্যের পরিহার ও লোকে প্রার্থনা না করিলে তাহার হিতচেষ্টা করা রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। কামক্রোধ বা বিদ্বেষনিবন্ধন ধর্ম্ম পরিত্যাগ করা কদাপি বিধেয় নহে। ভূপতি প্রশ্নকালে অনর্থক বাক্যপ্রয়োগ অথবা লজ্জা, ত্বরা বা অসূয়া প্রকাশ করিবেন না। প্রিয় ব্যক্তির প্রতি সন্তুষ্ট ও অপ্রিয় ব্যক্তির প্রতি বিরক্ত হইবেন। অর্থকৃচ্ছ্র[অর্থকষ্ট] উপস্থিত হইলে অনুতাপ করিবেন না এবং সতত প্রজাদিগের হিতসাধনে যত্নবান্ থাকিবেন। যে নরপতি নিয়ত প্রজাগণের হিতানুষ্ঠান করেন, তাঁহার সমুদয় কাৰ্য্য সুসম্পন্ন ও সম্পত্তি চিরস্থায়ী হয়। প্রতিকূলাচরণপরাঙ্মুখ [বিরুদ্ধাচরণে বিমুখ], হিতকারী ভক্তজনের প্রতি প্রীতি প্রকাশ এবং জিতেন্দ্রিয়, একান্ত অনুরক্ত, কাৰ্য্যকুশল, অপ্রমত্ত ব্যক্তিকে অর্থাধিকার প্রভৃতি গুরুতর কাৰ্য্যে নিয়োগ করা রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। মূর্খ, ইন্দ্রিয়পরবশ, অর্থলোলুপ, অসচ্চরিত্র, শঠ এবং মদ্য, দ্যূত, মৃগয়া ও স্ত্রীসম্ভোগে নিরত ব্যক্তির উপর গুরুতর কাৰ্য্যের ভারার্পণ করিলে নরপতিকে অচিরাৎ শ্রীভ্রষ্ট হইতে হয়।
‘যে রাজা জিতেন্দ্রিয় ও লোকরক্ষায় নিরত হয়েন, তাঁহার প্রজাবৃদ্ধি ও শাশ্বত সুখানুভব হইয়া থাকে। যে রাজা সুবিশ্বস্ত আত্মীয় চরদ্বারা অন্যান্য ভূপতিগণের আচার-ব্যবহার অবগত হয়েন, তিনি অচিরাৎ সমৃদ্ধিশালী হইয়া উঠেন। বলবান্ ভূমিপতির অপকার সাধনপূৰ্ব্বক “আমি উহা হইতে অতিদূরে অবস্থান করিতেছি” মনে করিয়া নিশ্চিন্ত থাকা রাজার কদাপি বিধেয় নহে। কারণ, বলবান্ নরপতি অপকৃত হইলে শ্যেনপক্ষীর ন্যায় সহসা দুৰ্ব্বলের রাজ্যে উপস্থিত হয়। নরপতি আপনার বাহুবল বিবেচনা করিয়া অপেক্ষাকৃত দুর্ব্বলদিগকে আক্রমণ করিবেন, বলবান ব্যক্তিকে আক্রমণ করা তাঁহার নিতান্ত অকৰ্ত্তব্য। ধর্ম্মপরায়ণ রাজা স্বীয় পরাক্রমপ্রভাবে পৃথিবী লাভ করিয়া ধৰ্ম্মানুসারে প্রজাপালন ও সমরাঙ্গনে শত্রুর বধসাধন করিবেন। ইহলোকে সমস্ত পদার্থই বিনশ্বর, কিছুই চিরস্থায়ী নহে; অতএব ধর্ম্মপরায়ণ হইয়া প্রজাপালন করা রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। দুর্গাদি রক্ষাবিধান, যুদ্ধ, ধৰ্ম্মানুশাসন, মন্ত্রচিন্তা ও প্রজাগণের সুখসাধন এই পাঁচ উপায়দ্বারা রাজার অধিকার পরিবর্দ্ধিত হয়। যিনি এই পাঁচ উপায় অবলম্বন করেন, তিনিই রাজশ্রেষ্ঠ এবং তাঁহার রাজ্য চিরকাল অক্ষত থাকে। কিন্তু নিরন্তর ঐ পাঁচ বিষয়ে স্বয়ং ব্যাপৃত থাকা একজনের সাধ্যায়ত্ত নহে; অতএব রাজা সুবিশ্বস্ত অবিকৃত [অনুগত বেতনভোগী] পুরুষদিগের উপর উহার ভার অর্পণ করিয়া চিরকাল পৃথিবী ভোগ করিবেন।।
‘যিনি দাতা, বিভাগকর্ত্তা [ন্যায্যদাবী অনুসারে বিষয়বণ্টনকারী], মৃদু ও পবিত্র এবং যিনি কদাচ প্রজাদিগকে পরিত্যাগ করিবার বাসনা করেন না, মানবগণ তাঁহাকেই নরপতিপদে অভিষেক করে। যে রাজা অন্যের নিকট হিতোপদেশ শ্রবণ করিয়া আপনার মত পরিত্যাগপূৰ্ব্বক তদনুসারে কার্য্যানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হয়েন, মানবগণ তাঁহারই অনুগত হইয়া থাকে। যিনি বিদ্বেষবশতঃ হিতপরায়ণ বন্ধুর বাক্যে অনাদর করিয়া অহিতকারীদিগের বাক্য শ্রবণ করেন এবং সাধুসমাদৃত ব্যবহারে পরাঙ্মুখ হয়েন, তাঁহার ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্ম প্রতিপালন করা হয় না। নিগৃহীত অমাত্য, পৰ্ব্বত [আত্মরক্ষার উপযোগী দুর্গম পৰ্ব্বত], ভীষণ[দুষ্প্রবেশ্য] দুর্গ, হস্তী, অশ্ব, সরীসৃপ এবং কামিনীগণের সহিত সতত সংস্রব রাখিয়া আত্মরক্ষা করা রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। যে রাজা রোষপরবশ হইয়া প্রধান প্রধান অমাত্যগণকে পরিত্যাগপূৰ্ব্বক অতি নিকৃষ্টদিগের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করেন এবং যিনি বিদ্বেষবশতঃ কল্যাণকর জ্ঞাতিগণের উপকারে বিরত হয়েন, তাঁহাকে অচিরাৎ বিপদগ্রস্ত, নিরাশ্রয় ও কালকবলে নিপতিত হইতে হয়। আর যিনি অসাধারণ গুণসম্পন্ন অপ্রিয়ব্যক্তিদিগকেও প্রিয়বাক্যদ্বারা বশীভূত করেন, তাহার যশঃশশধর অনন্তকাল অবনীমণ্ডলে দেদীপ্যমান থাকে। অকালে করগ্রহণ ও অপ্রিয়ব্যক্তির প্রতি বিরক্তিপ্রকাশ ও প্রিয়ব্যক্তিতে একান্ত অনুরাগ প্রদর্শন করা কদাপি বিধেয় নহে। শুভকর্ম্মের অনুষ্ঠানে সতত প্রবৃত্ত হওয়া উচিত। কোন কোন রাজা যথার্থ অনুরক্ত, কাহারা ভয়প্রযুক্ত শরণাগত এবং উহাদের মধ্যে কোন্ কোন ব্যক্তি দোষাক্রান্ত, তাহা প্রতিনিয়ত চিন্তা করা আবশ্যক। আপনাকে বলবান্ জ্ঞান করিয়া দুৰ্ব্বলের প্রতি বিশ্বাস করা রাজার কদাপি কৰ্ত্তব্য নহে। বলবান্ ব্যক্তি প্রমাদযুক্ত হইলে দুৰ্ব্বলেরা গৃধ্রকুলের ন্যায় তাঁহাকে আক্রমণ করে। পাপাত্মা ব্যক্তিরা সর্ব্বগুণান্বিত প্রিয়বাদী প্রভুরও অনিষ্টসাধন করিয়া থাকে; অতএব উহাদিগকে বিশ্বাস করা কদাপি বিধেয় নহে। নহুষপুত্ৰ যযাতি রাজরহস্য-কীৰ্ত্তনচ্ছলে কহিয়া গিয়াছেন যে, নরপতিগণ সামান্য শত্ৰুদিগের বিনাশেও অনাস্থা করিবেন না।”