শুন জন্মেজয় রাজা দৈবের ঘটন।
জয়দ্রথ গুপ্তভাবে রহে কাম্যবন।।
উঠিয়া প্রভাতে হেথা ভাই দুই জনে।
রাজার নিকটে রাখি মাদ্রীর নন্দনে।।
মৃগয়া করিতে যান ভীম ধনঞ্জয়।
স্নান হেতু যান ক্রমে বিপ্র সমুদয়।।
পরে চলিলেন স্নানে ভাই তিন জন।
বসিয়া দ্রৌপদী একা করেন রন্ধন।।
জয়দ্রথ দেখে, শূন্য হইল মন্দির।
সময় জানিয়া তথা গেল মহাবীর।।
কুটীর দুয়ারে গিয়া রাখিলেক রথ।
শূন্যালয় দেখি আনন্দিত জয়দ্রথ।।
রথ হৈতে ভূমিতলে নামে মহাবীর।
কুটুম্ব জানিয়া কৃষ্ণা হইল বাহির।।
মনেতে জানিল এই অপূর্ব্বা অতিথি।
অতিথির সেবা হেতু চিন্তি গুণবতী।।
শূন্যালয় তথা, আর নাহি কোন জন।
আপনি আনিয়া দিল দিব্য কুশাসন।।
পাদ প্রক্ষালন হেতু আনি দিল জল।
জিজ্ঞাসা করিল, কহ ঘরের কুশল।।
কোথা হৈতে এলে এবে, যাবে কোন্ দেশে।
এ বনে আসিলা কোন প্রয়োজনোদ্দেশে।।
জয়দ্রথ বলে, আর নাহি কোন কাজ।
ভেটিবারে আইলাম ধর্ম্ম মহারাজ।।
একমাত্র দেখি তুমি করিছ রন্ধন।
কহ দেখি, কোথা গেল ধর্ম্মের নন্দন।।
কোন্ কার্য্য হেতু গেল ভীম ধনঞ্জয়।
ব্রাহ্মণ-মণ্ডলী কোথা, মাদ্রীর তনয়।।
কৃষ্ণা বলে, স্নানে গেল ব্রাহ্মণ-সমাজ।
মাদ্রীপুত্র গেল সহ ধর্ম্মরাজ।।
ভীমার্জ্জুন গেল বনে মৃগয়া কারণে।
মুহূর্ত্তে এখনি সবে আসিবে এখানে।।
দ্রৌপদীর মুখে শুনি এ সব বচন।
দুষ্ট জয়দ্রথের সচঞ্চল হৈল মন।।
বিচার করিল মনে, সবে দূরে গেল।
উচিত সময় মোর বিধাতা মিলাল।।
চতুর্দ্দিকে চাহে, কেন নাহিক কোথায়।
চঞ্চল হইল বীর ঘন ঘন চায়।।
নিকটে আছিল কৃষ্ণা, তুলি নিল রথে।
শীঘ্রগতি চালাইল হস্তিনার পথে।।
কৃষ্ণা বলে, চৌর্য্যকার্য্য কর কুলাঙ্গার।
বুঝিলাম, কালপূর্ণ হইল তোমার।।
বড় বংশে জনমিয়া কর নীচকর্ম্ম।
মুহূর্ত্তে এখনি তার ফলিবেক ধর্ম্ম।।
যাবৎ পুরুষসিংহ ভীম নাহি দেখে।
প্রাণ লয়ে যাহ শীঘ্র ছাড়িয়া আমাকে।।
আরে দুষ্ট কি করিলি, হলি মতিচ্ছন্ন।
বুঝিনু তোমার এবে কাল হল পূর্ণ।।
আরে অন্ধ ভালমন্দ না জান সকল।
হেন কর্ম্ম কর যাতে ফলয়ে সুফল।।
পরপক্ষ জন যদি আসি করে রণ।
সাহায্য করিয়া তারে রাখে বন্ধুগণ।।
তোর ক্রিয়া শুনি লোক কর্ণে দিবে কর।
হেন দুরাচার দুই অধম পামর।।
হেনমতে তিরস্কার করে যাজ্ঞসেনী।
চোরা নাহি শুনে কভু ধর্ম্মের কাহিনী।।
ভালমন্দ জয়দ্রথ কিছু নাহি কহে।
চালাইয়া দিল রথ, তিলেক না রহে।।
দ্রৌপদী দেখিল, তবে পড়িনু বিপাকে।
গোবিন্দ গোবিন্দ বলি পরিত্রাহি ডাকে।।
কি জানি কৃষ্ণের পায় কৈনু অপরাধ।
সে কারণে হৈল মম এতেক প্রমাদ।।
কোথা গেল মহারাজ ধর্ম্ম-অধিকারী।
কোথা গেল মাদ্রীপুত্র বিক্রমে কেশরী।।
ভুবন বিজয়ী কোথা পার্থ মহামতি।
এস এস কোথা আছ, এস হে ঝটিতি।।
মধ্যম পাণ্ডব এস ভীম মহাবল।
দুষ্ট জনে আসি দেহ সমুচিত ফল।।
তোমরা যে পঞ্চ ভাই রহিলে কোথায়।
জয়দ্রথ মন্দমতি বলে লয়ে যায়।।
শূন্যালয়ে আছি, দুষ্ট জানিয়া ধরিল।
সিংহের বনিতা নিতে শৃগালে ইচ্ছিল।।
সকল দেবের সাক্ষী দেব বিকর্ত্তন।
আজন্ম জানহ তুমি সবাকার মন।।
কায়মনোবাক্যে যদি আমি হই সতী।
ইহার উচিত ফল পাইবে দুর্ম্মতি।।
এইমত যাজ্ঞসেনী পাড়িছে দোহাই।
হেনকালে আশ্রমেতে আসে তিন ভাই।।
শূন্যালয় দেখি মনে হইলেন স্তব্ধ।
শুনিলেন দ্রৌপদীর ক্রন্দনের শব্দ।।
ব্যগ্র হয়ে তিন ভাই ধনু লয়ে হাতে।
শব্দ অনুসারে শীঘ্র ধায় সেই পথে।।
চিন্তাকুল ধায় সবে, না দেখেন পথ।
দূর হৈতে দেখিলেন, যায় জয়দ্রথ।।
আকুল হইয়া কৃষ্ণা ডাকে ঘনে ঘন।
দূর হৈতে দেখিলেন, যায় জয়দ্রথ।।
আকুল হইয়া কৃষ্ণা ডাকে ঘনে ঘন।
দূর হৈতে আশ্বাসিয়া কহে তিন জন।।
ভয় নাই, ভয় নাই, বলয়ে বচন।
হেনকালে দেখ তথা দৈবের ঘটন।।
মৃগয়া করিয়া আসে ভাই দুই জন।
সেই পথে জয়দ্রথ করিছে গমন।।
দূর হতে শুনিলেন ক্রন্দনের রোল।
উদ্ধার করহ ভীম ডাকে এই বোল।।
অর্জ্জুন কহেন, ভীম শুনি বিপরীত।
হেথা যাজ্ঞসেনী কেন ডাকে আচম্বিত।।
কি হেতু আইল কৃষ্ণা নির্জ্জন কাননে।
না জানি হিংসিল আসি কোন্ দুষ্ট জনে।।
কিম্বা কেবা বিরোধিল ধর্ম্মের তনয়।
আকুল আমার মন গণিয়া প্রলয়।।
ভীম বলে, এ কথা না লয় মম মনে।
কে যাইতে ইচ্ছা করে শমন ভবনে।।
চল শীঘ্র, ভাল নহে এ সব কারণ।
সমুচিত ফল দিব জানি নিরূপণ।।
এত বলি দুই বীর যান বায়ুবেগে।
শব্দ অনুসারে যান দ্রৌপদীর আগে।।
হেনকালে দূরে দেখিলেন এক রথ।
ধ্বজা দেখি জানিলেন যায় জয়দ্রথ।।
তবে পার্থ মায়ারথ করেন স্মরণ।
চিন্তামাত্র কপিধ্বজ আসিল তখন।।
আরোহণ করিলেন দোঁহে হৃষ্টমতি।
চালাইয়া দেন রথ পবনের গতি।।
দেখিল নিকট হৈল অর্জ্জুনের রথ।
প্রাণভয়ে পলাইয়া যায় জয়দ্রথ।।
রথ হৈতে লাফ দিয়া পড়ে ভূমিতলে।
অধিক ধাইল বীর প্রাণের বিকলে।।
দেখিয়া ভীমের মনে হইল সন্তাপ।
ক্রোধভরে রথ হৈতে পড়ে দিয়া লাফ।।
বেগেতে ধাইল দুষ্ট অতি ভয়াকুলে।
চক্ষুর নিমেষে ভীম ধরে তার চুলে।।
মৃগেন্দ্র রুষিয়া যেন ধরে ক্ষুদ্র পশু।
ক্ষুধিত গরুড়মুখে যেন সর্পশিশু।।
সেইমত তার চুল ধরিলেন টানি।
ক্রোধভরে গেল যথা আছে যাজ্ঞসেনী।।
কহিল কৃষ্ণারে তবে আশ্বাস বচন।
স্থির হও যাজ্ঞসেনী ত্যজ দুঃখ মন।।
যেমত তোমাকে দুঃখ দিল দুষ্টমতি।
তাহার উচিত ফল, মুখে মার লাথি।।
আছিল মনের ক্রোধে দ্রুপদ-নন্দিনী।
সম্বরিতে নারে ক্রোধ, দহিছে পরাণী।।
তাহাতে ভীমের আজ্ঞা লঙ্ঘিতে নারিল।
অধর্ম্ম নাহিক ইথে বিচারে জানিল।।
তবে কৃষ্ণা আপনার মনের কৌতুকে।
তিন বার পদাঘাত করে তার মুখে।।
জয়দ্রথে কহে তবে ভীম মহাবল।
অবশ্য ভুঞ্জিতে হয় স্বকর্ম্মের ফল।।
আরে দুষ্ট, থাকে যার জীবনের আশা।
সে কভু করয়ে হেন দুরন্ত ভরসা।।
এই মুখে কৃষ্ণা হরি দিয়াছিলি রড়।
এত বলি গণি মারে দশটী চাপড়।।
বজ্রতুল্য খাইয়া ভীমের করাঘাত।
সঘনে কাঁপয়ে যেন কদলীর পাত।।
হেনমতে বৃকোদর মারিল প্রচুর।
চুলে ধরি টানি তবে লয় কত দূর।।
অনেক নিন্দিল তারে গভীর গর্জ্জনে।
পুনশ্চ টানিয়া তারে আনে কতক্ষণে।।
মুক্তকেশ ন্যস্তবেশ বহে রক্তধার।
ফাঁফর হইয়া কান্দে, নাহিক নিস্তার।।
চুলে ধরি ভূমিতলে ঘসে তার মুখ।
দেখি দ্রৌপদীর মনে পরম কৌতুক।।
পুনঃ পুনঃ প্রহারিল বীর বৃকোদর।
প্রাণমাত্র অবশেষ রহে কলেবর।।
মূর্চ্ছাগত হয়ে ভূমে পড়ে অচেতন।
হেনকালে উপনীত ধর্ম্মের নন্দন।।
দেখিয়া তাহার দুঃখ দুঃখিত হৃদয়।
রক্ষা হেতু বিচারিয়া ধর্ম্মের তনয়।।
কহিলেন, শুন ভীম, করিলে কি কর্ম্ম।
বিশেষে ভগিনীপতি, মারিলে অধর্ম্ম।।
ভাল হৈল দুষ্ট পাইল সমুচিত ফল।
দোষ মত যত দণ্ড হইল সকল।।
কিন্তু বধ্য নহে, রাখ ইহার জীবন।
ভগিনী করিয়া রাঁড়ি নাহি প্রয়োজন।।
ভগিনী ভাগিনা দোঁহে হইবে অনাথ।
কান্দিবে সকলে আর মোর জ্যেষ্ঠতাত।।
সে কারণে কহি ভাই শুনহ বচন।
ছাড়হ, লইয়া যাক নির্লজ্জ জীবন।।
রাজ-আজ্ঞা লঙ্ঘিবারে নারি বৃকোদর।
জয়দ্রথে এড়ি বীর হইল অন্তর।।
কতক্ষণে সংজ্ঞা পেয়ে সেই মূঢ়মতি।
মনে মনে চিন্তা করে, পেনু অব্যাহতি।।
নিঃশব্দে রহিল দুষ্ট হয়ে নম্রশির।
ভৎসিয়া কনেহ তারে রাজা যুধিষ্ঠির।।
কে দিল কুবুদ্ধি তোরে করিয়া কপটে।
কি হেতু মরিতে এলি এমন সঙ্কটে।।
ক্ষণেক না হৈত যদি মম আগমন।
এতক্ষণ যাইতিস্ শমন সদন।।
পলাইয়া যাহ লয়ে নিলর্জ্জ জীবন।
কুবুদ্ধি দিলেক তোরে যেই দুষ্ট জন।।
সেই সব জনে গিয়া কহিবে সকল।
কত দিনান্তরে হবে সে সবার ফল।।
তবে ধর্ম্ম কৃষ্ণারে কহিল এই কথা।
দুঃখ মন তেজহ দ্রুপদ রাজ সুতা।।
তোমারে দিলেক যত দুঃখ আর কষ্ট।
এইমত সর্ব্বজন হইবেক নষ্ট।।
এত বলি আশ্রমেতে যান ছয় জনে।
দুষ্ট জয়দ্রথ তবে বিচারিল মনে।।