৯৩তম অধ্যায়
ঘটোৎকচের সহিত দুৰ্য্যোধনের পুনর্বুদ্ধ
সঞ্জয় কহিলেন, “হে রাজন! মহাবীর দুৰ্য্যোধন সেই ঘটোৎকচনিক্ষিপ্ত, দানবগণেরও দুঃসহ শরজাল অনায়াসে সহ্য করিয়া ক্ৰোধকম্পিত্যকলেবর সাপের ন্যায় নিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া তাঁহার উপরে সুতীক্ষ্ন পঞ্চবিংশতি নারাচ নিক্ষেপ করিলেন। যেমন ক্রুদ্ধ আশীবিষগণ গন্ধমাদনপর্ব্বতে নিপতিত হয়, তদ্রূপ দুৰ্য্যোধননিক্ষিপ্ত নারাচনিচয় ঘটোৎকচের উপর নিপতিত হইল। মহাবীর ঘটোৎকচ দুৰ্য্যোধনের নারাচে দৃঢ়বিদ্ধ হইয়া মদস্রাবী মাতঙ্গের ন্যায় রক্তমোক্ষণ করিয়া ক্ৰোধাভরে দুৰ্য্যোধনকে সংহার করিবার মানসে প্রজ্বলিত উল্কাসদৃশ, মহাশনির ন্যায়, পর্ব্বতবিদারণক্ষম মহাশক্তি সমুদ্যত করিলেন।
“মহাবীর বঙ্গাধিপতি সেই মহাশক্তি সমুদ্যত দেখিয়া সত্বর শীঘ্রগামী পর্ব্বতসদৃশ কুঞ্জরে আরোহণপূর্ব্বক ঘটোৎকচের অভিমুখে দুৰ্য্যোধনের রথপথে উপস্থিত হইয়া, রথ আবরণ করিলেন। মহাবল ঘটোৎকচ তদ্দর্শনে ক্ৰোধে অধীর হইয়া সেই সমুদ্যুতশক্তি বঙ্গাধিপতির গজের উপর নিক্ষেপ করিলেন। করিবর ঘটোৎকচের শক্তিপ্ৰহারে আহত ও রুধিরধারায় অভিষিক্ত হইয়া ধরণীতলে নিপতিত ও পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইল। বঙ্গাধিপতি সত্বর গজ হইতে ধরণীতলে অবতরণ করিলেন। মহারাজ দুৰ্য্যোধন সেই মহাবারণকে নিপতিত ও কৌরব সৈন্যগণকে ভগ্ন দেখিয়া যৎপরোনাস্তি ব্যথিত হইলেন; কিন্তু ক্ষত্ৰিয়ধর্ম্ম ও স্বীয় অসাধারণ অভিমানিতা স্মরণ করিয়া সেই পলায়নযোগ্য সময়েও পর্ব্বতের ন্যায় অচলভাবে অবস্থান করিয়া এক কালাগ্নিসদৃশ সুশাণিত শর শরাসনে সন্ধানপূর্ব্বক ঘটোৎকচের উপর নিক্ষেপ করিলেন। মহাবীর ঘটোৎকচ সেই ইন্দ্রের অশনিসদৃশ শর সমাগত দেখিয়া স্বীয় লাঘবপ্রভাবে অনায়াসে উহা অতিক্রম করিলেন এবং পুনরায় ক্ৰোধসংরক্তলোচনে সমুদয় সৈন্যগণকে বিত্ৰাসিত করিয়া যুগান্তকালীন জলধরের ন্যায় গভীরস্বনে ঘোর নিনাদ করিতে লাগিলেন।
“শান্তনুনন্দন ভীষ্ম সেই ভীমপরাক্রম ভীমতনয়ের ভীষণ নিনাদ শ্রবণে দ্রোণের সমীপে গমনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে আচাৰ্য্য! আজি ঘোরতর রাক্ষসসিংহনাদ শ্রুত হইতেছে; বোধহয়, মহাবীর ঘটোৎকচ রাজা দুৰ্য্যোধনের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়াছে; মহাবলপরাক্রান্ত ঘটোৎকচকে পরাজয় করা কোন প্রাণীরই সাধ্য নহে; মহারাজ দুৰ্য্যোধন মহাবল রাক্ষসকর্ত্তৃক আক্রান্ত হইয়াছেন; অতএব সত্বর গমন করিয়া নিশাচরহস্ত হইতে তাঁহাকে বিমুক্ত করা আমাদের অবশ্য কর্ত্তব্য।’
দ্রোণপ্ৰমুখ মহারথগণের দুৰ্য্যোধনসাহায্য
“তখন মহাবীর দ্রোণ, সোমদত্ত, বাহ্লীক, জয়দ্ৰথ, কৃপ, ভূরিশ্রবা, শল্য, অবন্তিরাজ, বৃহদ্বল, অশ্বত্থামা, বিকৰ্ণ, চিত্ৰসেন ও বিবিংশতি তাঁহাদের অনুযায়ী বহুসহস্র রথসমভিব্যাহারে ভীষ্মের বাক্যশ্রবণে দুৰ্য্যোধনকে রক্ষা করিবার নিমিত্ত সত্বর তাঁহার সমীপে গমন করিলেন। সেই মহারথগণসংরক্ষিত অপরিভবনীয় মহাসৈন্য তাঁহাকে নিধন করিতে সমুদ্যত হইয়াছে দেখিয়া, রাক্ষসসত্তম ঘটোৎকচ মৈনাকপর্ব্বতের ন্যায় কিছুমাত্র বিচলিত হইলেন না; প্রত্যুত শূল, মুদগর প্রভৃতি নানাপ্রহরণধারী জ্ঞাতিবর্গে পরিবৃত হইয়া বিপুল শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক অরাতিগণের অভিমুখে ধাবমান হইলেন।
“অনন্তর দুৰ্য্যোধনসৈন্যগণের সহিত রাক্ষসদিগের তুমুল সংগ্রাম আরম্ভ হইলে বীরগণের ভীষণ ধনুষ্টঙ্কার দহ্যমান বংশধ্বনির ন্যায় ও বর্ম্মে নিপতিত শরসমুদয়ের শব্দ ভিদ্যমান পর্ব্বতধ্বনির ন্যায় শ্রুত হইতে লাগিল। বীরগণবিসৃষ্ট আকাশগামী তোমারসমুদয় ভুজঙ্গকুলের ন্যায় বোধ হইল। রাক্ষসেন্দ্ৰ মহাবাহু ঘটোৎকচ ক্ৰোধাভরে ভীষণ ধ্বনি করিয়া মহাশরাসন বিস্ফোরণপূর্ব্বক অৰ্দ্ধচন্দ্রবাণে দ্রোণের কার্ম্মুক ও সুনিশিত ভল্লে সোমদত্তের ধ্বজচ্ছেদন করিয়া বীরনাদ করিতে লাগিলেন। পরে বাহ্লীকের বক্ষঃস্থলে তিনবাণ নিক্ষেপপূর্ব্বক কৃপকে একবাণে ও চিত্রসেনকে তিনবাণে বিদ্ধ করিয়া সম্পূর্ণরূপে শরাসন আকর্ষণ করিয়া বিকর্ণের জত্রুদেশে আঘাত করিলেন। মহাবীর বিকৰ্ণ ঘটোৎকচের শরাঘাতে রুধিরক্তকলেবর হইয়া রথোপস্থে উপবিষ্ট হইলেন।
“অনন্তর মহাবীর ঘটোৎকচ ক্রোধাভরে ভূরিশ্রবার উপর পঞ্চদশ নারাচ নিক্ষেপ করিলে সেই নিক্ষিপ্ত নারাচসকল ভূরিশ্রবার বর্ম্মভেদপূর্ব্বক ধরণীতলে প্রবিষ্ট হইল। তখন মহাত্মা বৃকোদরতনয় বিবিংশতির ও অশ্বত্থামার সারথিকে বাণবিদ্ধ করিলেন, সারথিদ্বয় শরাঘাতে নিতান্ত ব্যথিত হইয়া অশ্বরশ্মি পরিত্যাগপূর্ব্বক রথোপস্থে নিপতিত হইল। পরে মহাবীর হিড়িম্বানন্দন অৰ্দ্ধচন্দ্ৰবাণে সিন্ধুরাজের সুবৰ্ণবিভূষিত বরাহধ্বজ ও অপর বাণে তাঁহার শরাসন ছেদন করিয়া ক্ৰোধসংরক্তনয়নে নারাচ নিক্ষেপপূর্ব্বক অবন্তিরাজের চারি অশ্ব সংহার ও আকর্ণাকৃষ্ট শরাসনে সুতীক্ষ্ন শরসন্ধান করিয়া রাজপুত্র বৃহদ্বলকে বিদ্ধ করিলেন। মহাবল বৃহদ্বল ঘটোৎকচের বাণে নিতান্ত ব্যথিত হইয়া রথোপস্থে উপবিষ্ট হইলেন। তখন রথস্থ রাক্ষসেন্দ্র হিড়িম্বাতনয় ক্রোধকম্পিতকলেবরে আশবিষিসমৃশ নিশিত শরনিকর নিক্ষেপ করিয়া যুদ্ধবিশারদ শল্যের কলেবর ভেদ করিলেন।”