৯২তম অধ্যায়
দুৰ্য্যোধন ঘটোৎকচযুদ্ধ-কৌরবহতাশ
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! মহাবলপরাক্রান্ত পাণ্ডবগণ সংগ্রামে ইরাবানকে নিহত দেখিয়া কি করিলেন?”
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! ভীমসেনাতনয় ঘটোৎকচ ইরাবানকে রণে নিহত দেখিয়া ঘোরতর নিনাদ করিতে লাগিলেন। ভীমতনয়ের ভীষণনাদে পর্ব্বতসনাথ সকাননা মেদিনী, অন্তরীক্ষ ও সমুদয় দিগবিদিক বিচলিত হইতে লাগিল; সৈন্যগণের ঊরুস্তম্ভ [ভীতিবশতঃ ঊরুর গতিশক্তিরোধ], স্বেদ ও বেপথু হইল এবং বীরগণ দীনচিত্ত সিংহভীত গজের ন্যায় ভীত হইয়া সঙ্কুচিত ও কুণ্ডলিত [জড়সড় হইয়া কুণ্ডলী পাকাইয়া একত্র অবস্থিত] হইতে আরম্ভ করিল। মহাবীর ঘটোৎকচ এইরূপে নিৰ্ঘাতসদৃশ মহানাদ করিয়া ভীষণরূপধারণপূর্ব্বক জ্বলিত শূল সমুদ্যত করিয়া নানা প্রহরণধারী রাক্ষসসমূহে পরিবৃত হইয়া কালান্তক-যমের ন্যায় ক্ৰোধান্বিতচিত্তে আগমন করিতে লাগিলেন। সেই ভীমদৰ্শন ভীমতনয়কে ক্রুদ্ধচিত্তে সমাগত দেখিয়া কৌরবপক্ষীয় সেনারা ভীত ও সমরে বিমুখপ্রায় হইয়া উঠিল।
“তখন মহারাজ দুৰ্য্যোধন সশরশরাসনগ্রহণপূর্ব্বক সিংহের ন্যায় ধ্বনি করিয়া ঘটোৎকচের প্রতি ধাবমান হইলেন। বঙ্গাধিপতি মদস্রাবী পর্ব্বতসদৃশ দশসহস্ৰ কুঞ্জারসমভিব্যাহারে তাঁহার অনুগমন করিতে লাগিলেন। রাক্ষসশ্রেষ্ঠ ঘটোৎকচ দুৰ্য্যোধনকে গজসৈন্য পরিবৃত হইয়া আগমন করিতে দেখিয়া যৎপরোনাস্তি ক্রুদ্ধ হইলেন। তখন রাক্ষসগণ ও দুৰ্য্যোধনসৈন্যগণের ঘোরতর সংগ্ৰাম হইতে লাগিল। শস্ত্রপাণি নিশাচরগণ সেই মেঘবৃন্দসদৃশ গজসৈন্য সন্দর্শন করিয়া ক্রুদ্ধচিত্তে সবিদ্যুৎ জলধরের ন্যায় বিবিধ প্রকার শব্দ করিয়া ধাবমান হইয়া শর, শক্তি, নারাচ, ভিন্দিপাল, শূল, মুদগর ও পরশুদ্বারা গজযোধিগণকে এবং পর্ব্বতশৃঙ্গ ও বৃক্ষসমুদয়দ্বারা মহাগজদিগকে সংহার করিতে আরম্ভ করিল। সংগ্রামস্থলে নিশাচরগণকর্ত্তৃক নিহন্যমান [নিহত], ভিন্নকুম্ভ [বিদীর্ণ ব্ৰহ্মরন্ধ্র—ভগ্ন তালুদেশ], ভিন্নগাত্র, রক্তাক্তকলেবর অসংখ্য মাতঙ্গ দৃষ্ট হইতে লাগিল।
পাণ্ডবপক্ষীয় বিদ্যুজ্জিহ্ব বধ
“এইরূপে সেই গজযোধিগণ ভগ্ন হইলে মহারাজ দুৰ্য্যোধন ক্ৰোধাভরে জীবিতাশা পরিত্যাগপূর্ব্বক সেই রাক্ষসগণের প্রতি ধাবমান হইয়া তাহাদের উপর নিশিত শরনিকর নিক্ষেপ করিয়া প্রধান প্রধান রাক্ষসদিগকে বিনষ্ট করিতে লাগিলেন; ঐ মহাবীর নিশিত চারিবাণ নিক্ষেপপূর্ব্বক মহাবেগগামী বিদ্যুজ্জিহ্বনামক রাক্ষসকে সংহার করিয়া পুনরায় রাক্ষসসৈন্যমধ্যে শরবৃষ্টি করিতে আরম্ভ করিলেন।
“মহাবীর ঘটোৎকচ দুৰ্য্যোধনের সেই মহৎ কাৰ্য্য সন্দর্শনে ক্ৰোধানলে প্রজ্বলিত হইয়া বজ্রসদৃশ শরাসন বিস্ফারণপূর্ব্বক তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন। মহাবীর দুৰ্য্যোধন সেই ভীমপ্রতাপ ভীমতনয়কে কালোৎসৃষ্ট [কাল প্রেরিত] অন্তকের ন্যায় ধাবমান দেখিয়া কিছুমাত্র ব্যথিত হইলেন না। ঘটোৎকচ দুৰ্য্যোধনের সমীপে গমনপূর্ব্বক ক্ৰোধসংরক্তলোচনে কহিতে লাগিলেন, “হে নৃশংস দুৰ্য্যোধন! তুমি দূতক্ৰীড়ায় জয়লাভ করিয়া বহুদিন আমার মাতা ও পিতা এবং তাঁহার ভ্রাতাদিগকে প্রবাসিত [রাজ্যভ্রষ্ট-রাজ্য পরিত্যাগপূর্ব্বক বনপ্রবাসী] করিয়াছিলে, আমি তোমায় নিধন করিয়া তাঁহাদের নিকট আনৃণ্য [ঋণমুক্তি] লাভ করিব। তুমি যে পাণ্ডবগণকে দ্যূতে পরাজয় ও একবস্ত্ৰা রজঃস্বলা দ্রুপদতনায়াকে সভামধ্যে আনয়ন করিয়া অশেষ ক্লেশ প্রদান করিয়াছ, তোমার প্ৰিয়চিকীর্যায় দুরাত্মা সিন্ধুরাজ যে পাণ্ডবগণকে অপমান করিয়া দ্রৌপদীকে বনমধ্যে ক্লেশিত করিয়াছিল, আজি সেই সমুদয় অপমানের পরিশোধ করিব, তুমি রণস্থল পরিত্যাগ করিও না।” মহাবীর হিড়িম্বানন্দন এই বলিয়া মহাশরাসন বিস্ফারণপূর্ব্বক ওষ্ঠ দংশন ও সৃক্কণী লেহন করিয়া বর্ষাকালীন মেঘের পর্ব্বতোপরি বারিবর্ষণের ন্যায় দুৰ্য্যোধনের উপর শরবৃষ্টি করিতে লাগিলেন।”