৯২তম অধ্যায়
কৃষ্ণের কৌরবসভায় যাত্রা
বৈশম্পায়ন কহিলে, মহারাজ! কৃষ্ণ ও বিদুরের এইরূপ ধর্ম্মর্থযুক্ত বিচিত্র কথোপকথন হইতে হইতে সেই মঙ্গলদায়িনী বিচিত্ৰনক্ষত্ৰসম্পন্ন বিভাবরী [রাত্রি] অতিবাহিত হইল। সুমধুরস্বরসম্পন্ন বৈতালিকগণ [যাহারা যথাকলে জগাইয়া দেয়] শঙ্খদুন্দুভিনিৰ্ঘোষ করিয়া কেশবকে প্রতিবোধিত করিতে লাগিল, তখন মহাত্মা বাসুদেব গাত্ৰোত্থান করিয়া অবশ্যকর্ত্তব্য প্রাতঃকৃত্যসকল সম্পাদনপূর্ব্বক উদকক্রিয়া [সন্ধ্যাতর্পণাদি], জপ, হোম সমাপনান্তে অলঙ্কার পরিধান করিয়া নবেদিত আদিত্যের উপাসনা ও উত্তরসন্ধ্যায় [মধ্যাহ্ন-সন্ধ্যা] আরাধনা করিতেছেন, এমন সময় দুৰ্য্যোধন ও শকুনি তাঁহার সমীপে আগমন করিয়া বলিলেন, “হে মধুসূদন! মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, ভীষ্ম প্রভৃতি অন্যান্য কৌরবগণ ও ভূপতিসমুদয় সভায় সমুপস্থিত হইয়া আপনার গমনপ্রতীক্ষা করিতেছেন।”
মহাত্মা বাসুদেব সুমধুর সান্ত্ববাদদ্বারা তাঁহাদিগকে অভিনন্দন করিয়া ব্রাহ্মণগণকে গো, হিরণ্য, বাস ও বিবিধ রত্ন প্রদান করিলেন। ঐ সময় সারথি দারুক তাঁহার সমীপে আগমনপূর্ব্বক তাঁহাকে বন্দনা করিয়া কিঙ্কিণীজালজড়িত [মাল্যাকারে গ্রথিত ক্ষুদ্র ঘণ্টাসমূহ] উৎকৃষ্ট অশ্বগণযোজিত বৃহৎ রথ আনয়ন করিল। মনস্বী বাসুদেব সেই নীরদনির্ঘোষ [মেঘগম্ভীর শব্দযুক্ত] সর্ব্বরত্নবিভূষিত স্যান্দন [রথ] সমুপস্থিত হইয়াছে জানিয়া অগ্নি ও ব্রাহ্মণগণকে প্ৰদক্ষিণ এবং কৌস্তুভমণিধারণপূর্ব্বক কৌরব ও বৃষ্ণিগণসমভিব্যাহারে গমন করিয়া তাহাতে আরোহণ করিলেন। সর্ব্বধর্ম্মবেত্তা বিদুর তাঁহার পশ্চাৎ সেই রথে উঠিলেন। পরে দুৰ্য্যোধন ও শকুনি অপর এক রথে আরোহণ করিয়া কৃষ্ণের অনুগামী হইলেন। সাত্যকি, কৃতবর্ম্মা ও অন্যান্য বৃষ্ণিবংশীয়গণ কেহ রথে, কেহ গজে, কেহ বা অশ্বে আরোহণপূর্ব্বক তাঁহার অনুগমন করিতে লাগিলেন। তখন ঐ সমুদয় ক্ষত্ৰিয়গণের হেমোকরণ [সোণার সাজ] সম্পন্ন মেঘগম্ভীরনিম্বন স্যান্দনসমুদয় অপূর্ব্ব শোভা ধারণ করিল।
মহাত্মা মধুসূদন ক্রমে ক্ৰমে সংসিক্তরজ [জলদ্বারা অপসারিত ধূলি] রাজপথে সমুপস্থিত হইলেন। তখন শঙ্খ, দুন্দুভিপ্রভৃতি বহুবিধ বাদ্য বাদিত হইতে লাগিল। সিংহসদৃশ বিক্রমশালী অরতিনিপাতন বীরপুরুষগণ তাঁহার রথের চতুর্দ্দিকে গমন করিতে লাগিলেন। অদ্ভুত বিচিত্রবসনবিভূষিত, অসি, প্রাস [ক্ষেপণীয় অস্ত্র-বর্শা] প্রভৃতি অস্ত্রশস্ত্ৰধারী, সহস্ৰ সহস্ৰ ব্যক্তি তাঁহার অনুগামী হইল। সহস্ৰ সহস্ৰ গজ ও রথ তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিল। কৌরবপুরবাসী আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই রাজপথস্থিত কৃষ্ণকে দর্শন করিবার নিমিত্ত নিতান্ত ব্যগ্র হইল। কামিনীগণ গৃহবেদিকার [রোয়াক] উপরিভাগে দণ্ডায়মান হইয়া কৃষ্ণকে দর্শন করাতে বোধ হইল যে, ভুবনসমুদয় উহাদিগের ভরে প্রচলিত হইতেছে।
তখন মহাত্মা দেবকীনন্দন কৌরবগণকর্ত্তৃক পূজিত হইয়া তাঁহাদের মধুরবাক্যশ্রবণ, তাঁহাদিগকে যথোচিত প্ৰতিসৎকার [সৎকার স্বীকারপূর্ব্বক সৎকারকারীর প্রতি সৎকারপ্রয়াগ] ও চতুর্দ্দিক অবলোকন করিয়া মন্দ মন্দ গমন করিতে লাগিলেন। ঐ সময়ে তাঁহার অনুযায়িগণ সভায় গমন করিয়া শঙ্খ ও বেণুর ধ্বনিতে দশদিক প্রতিধ্বনিত করিল। সমুদয় সভা কৃষ্ণাগমনজনিত হর্ষে কম্পিত [চাঞ্চল্যযুক্ত] হইতে লাগিল। মহাত্মা মধুসূদন ক্ৰমে ক্ৰমে সভামণ্ডপের সমীপবর্ত্তী হইলে তত্রস্থ ভূপালগণ তাঁহার মেঘনির্ঘোষসদৃশ [মেঘধ্বনিতুল্য] রথশব্দ শ্রবণ করিয়া সাতিশয় আনন্দিত হইলেন।
কৃষ্ণের কুরুসভায় প্রবেশ
অনন্তর সাত্বতকুলতিলক কৃষ্ণ সভাদ্বারে সমুপস্থিত হইয়া সেই কৈলাসশিখরসদৃশ স্যন্দন হইতে অবতরণপূর্ব্বক বিদুর ও সাত্যকির হস্ত ধারণ করিয়া রূপপ্রভাবে কৌরবগণকে প্রচ্ছাদিত [হীনপ্রভ] করিয়া নবজলধরবর্ণ [নবমেঘসম বর্ণ] তেজঃপ্রজ্বলিত মহেন্দ্রসভাসদৃশ [ইন্দ্ৰসভাতুল্য] কৌরবসভায় প্রবেশ করিলেন। কর্ণ ও দুৰ্য্যোধন তাঁহার অগ্রে এবং কৃতবর্ম্মা ও বৃষ্ণিগণ তাঁহার পশ্চাদ্ভাগে গমন করিতে লাগিলেন।
বৃষ্ণিবংশাবতংস বাসুদেব সভামণ্ডপে প্রবেশ করিবামাত্র মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র ভষ্মিদ্রোণাদিসমভিব্যাহারে আসন হইতে গাত্ৰোত্থান করিলেন। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র গাত্ৰোত্থান করাতে তত্ৰস্থ সহস্ৰ সহস্র ভূপতিগণ আসন হইতে সমুত্থিত হইলেন। ধৃতরাষ্ট্রের শাসনানুসারে ঐ সভামধ্যে কৃষ্ণের নিমিত্ত সুবৰ্ণময় অতি পরিষ্কৃত মহাৰ্ঘ্য এক আসন সন্নিবেশিত ছিল। বাসুদেব হাস্যমুখে ধৃতরাষ্ট্র, ভীষ্ম, দ্রোণ ও অন্যান্য ভূপতিগণকে বয়ঃক্রমানুসারে অভ্যর্থনা করিলেন। সমস্ত ভূপতিগণ ও কৌরবসমুদয় সভাগত জনাৰ্দনকে অর্চ্চনা করিলেন।
মহাত্মা মধুসূদন সেই ভূপতিগণমধ্যে দণ্ডায়মান হইয়া অন্তরীক্ষস্থ নারদপ্রভৃতি ঋষিগণকে অবলোকন করিয়া ভীষ্মকে কহিলেন, “হে শান্তনুতনয়! দেখুন, ঐ নারদপ্রভৃতি মহর্ষিগণ সভা অবলোকন করিবার নিমিত্ত মর্ত্যলোকে আগমন করিয়াছেন। উহাদিগকে যথাযোগ্য আসন প্ৰদানপূর্ব্বক সৎকার করুন। উহারা আসন পরিগ্রহ না করিলে কেহই উপবেশন করিতে পরিবেন না; অতএব শীঘ্র উহাদিগের পূজা করুন।”
তখন কৌরববংশাবতংস শান্তনুনন্দন ভীষ্ম ঋষিগণকে সভাদ্ধারে সমুপস্থিত দেখিয়া সত্বরে ভৃত্যগণকে আসন আনয়নে আদেশ করিলেন। ভৃত্যগণ তৎক্ষণাৎ মণিকাঞ্চনখচিত [স্বর্ণরত্নসন্নিবেশিত] বিপুল আসনসকল সমানীত করিল। মহর্ষিগণ সেই সমুদয় আসনে উপবিষ্ট হইলে পর মহাত্মা কৃষ্ণ ও অন্যান্য ভূপতিরা স্ব স্ব আসন গ্রহণ করিলেন। দুঃশাসন সাত্যকিকে ও বিবিংশতি কৃতবর্ম্মকে উৎকৃষ্ট কাঞ্চনময় আসন প্রদান করিলেন। অমর্ষপরায়ণ কর্ণ ও দুৰ্য্যোধন কৃষ্ণের অনতিদূরে একাসনে উপবিষ্ট হইলেন। গান্ধাররাজ শকুনি গান্ধীরগণকর্ত্তৃক অভিরক্ষিত [চারিদিকে রক্ষিগণদ্বারা রক্ষিত] হইয়া পুত্রসমভিব্যাহারে একাসনে উপবেশন করিলেন। মহামতি বিদুর আসন স্পর্শ করিয়া শুক্লাজিনসংস্তীর্ণ [শ্বেতবর্ণের মৃগাচর্মে মণ্ডিত] মণিময় আসনে উপবিষ্ট হইলেন। যেমন বারংবার অমৃত পান করিলে তৃপ্তিলাভ [তৃপ্তির শেষ] হয় না, তদ্রুপ ভূপতিগণ বহুক্ষণ কৃষ্ণকে অবলোকন করিয়াও পরিতৃপ্ত হইলেন না। অতসী [অতসীকুসুম দুই রকমের হয়-পীত ও কৃষ্ণ] কুসুমের ন্যায় শ্যামবর্ণ পীতবসন জনাৰ্দন সুবৰ্ণমণ্ডিত নীলকান্তমণির ন্যায় সভামধ্যে শোভা পাইতে লাগিলেন। তৎকালে ঐ সভার – সমুদয় সভ্যগণ একমনে অনিমিষনয়েনে নারায়ণকে নিরীক্ষণ করিয়া নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন। কাহারও মুখে বাক্যস্ফুর্ত্তি হইল না।