৯১তম অধ্যায়
সন্ধির ব্যর্থতাশঙ্কায় তৎপ্ৰস্তাবে বিদুরের নিষেধ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, কৃষ্ণের ভোজন সমাধান হইলে পর মাহাত্মা বিদুর রজনযোগে তাঁহাকে কহিতে লাগিলেন, “হে মধুসূদন! আপনার কৌরবরাজ্যে আগমন করা অনুচিত হইয়াছে। দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন ধর্ম্মার্থবিবর্জিত, কামক্ৰোধপরায়ণ, মাননাশক, মানাভিলাষী, মূঢ়, বুদ্ধিহীন, অজিতেন্দ্রিয়, পাণ্ডিত্যাভিমানী, মিত্রদ্রোহী [বন্ধুগণের বিদ্রোহকারী], অকৃতজ্ঞ, ধর্ম্মহীন, মিথ্যাপ্রিয়, স্বেচ্ছাচারী ও কর্ত্তব্যবিষয়ে অকৃতনিশ্চয় [অব্যবস্থিতচিত্ত]। ঐ দুরাত্মা বৃদ্ধগণের ও ধর্ম্মশাস্ত্রের শাসন পালন করে না। অতএব স্পষ্টই বোধ হইতেছে যে আপনার বাক্য শ্রেয়স্কর হইলেও ঐ দুরাত্মা কখন উহাতে সম্মত হইবে না। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ, অশ্বত্থঅমা ও জয়দ্ৰথ-ইহারা দুৰ্য্যোধনের নিকট হইতে জীবিকা লাভ করিয়া থাকেন; সুতরাং শান্তিপক্ষে [সন্ধিতে] কদাপি সম্মত হইবে না। ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণ ও কর্ণ মনে মনে স্থির করিয়াছেন যে, পাণ্ডবগণ ভীষ্ম, দ্রোণ প্রভৃতিকে কদাপি আক্রমণ করিতে পরিবেন না। অল্পবুদ্ধি অবিচক্ষণ দুৰ্য্যোধন কতকগুলি মানবসৈন্য সংগ্ৰহ করিয়া আপনাকে কৃতাৰ্থ স্থির করিয়াছে। তাহার দৃঢ়বিশ্বাস আছে যে কৰ্ণ একাকী সমুদয় শত্রুগণকে পরাজয় করিতে পরিবেন; অতএব দুৰ্য্যোধন কদাপি শান্তিপথ অবলম্বন করিবে না।-সমুদায় ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণ পাণ্ডবদিগকে যথোচিত অংশ প্রদান করিবে না বলিয়া স্থির করিয়াছেন; সুতরাং আপনি কৌরব ও পাণ্ডবগণের সৌভ্রাত্ৰ [ভ্রাতৃসৌহার্দ] সংস্থাপনবাসনায় যেসকল কথা কহিবেন, তৎসমুদয় বৃথা হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।
“হে জনাৰ্দন! যেমন গায়ক ব্যক্তি বধিরের [শ্রবণশক্তিহীন-কালা] নিকট গান করেন না, তদ্রূপ যাহার নিকট সদ্বাক্য ও অসদ্বাক্য উভয়ই সমান, প্রাজ্ঞ ব্যক্তি কোনক্রমে তাহার নিকট কোন কথা কহেন না। যেমন চণ্ডালকে উপদেশ প্রদান করা ব্ৰাহ্মণের অকর্ত্তব্য, তদ্রূপ সেই মর্যাদাবিহীন অজ্ঞ মূঢ় ব্যক্তিগণকে সদুপদেশ প্রদান করা আপনার নিতান্ত অকর্ত্তব্য। দুৰ্য্যোধন স্বভাবতঃ মূঢ়; বিশেষতঃ এক্ষণে বহুতর সৈন্য সংগ্ৰহ করিয়াছে, অতএব কখনই আপনার বাক্য শ্রবণ করিবে না। একত্র সমুপবিষ্ট পাপাত্মা দুবুর্দ্ধি দুৰ্য্যোধনপ্রভৃতি অশিষ্টগণের মধ্যে আপনার গমন করা ও তাহাদের ইচ্ছার বিপরীত বাক্য প্রয়োগ করা আমার মতে শ্রেয়স্কর নহে। দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন একে কখন বৃদ্ধগণের উপদেশ গ্রহণ করে নাই, তাহাতে আবার নিতান্ত ক্ৰোধপরায়ণ, ধনমদে মত্ত ও নিতান্ত গর্ব্বিত, সে কখনই আপনার শ্রেয়স্কর বাক্য গ্রহণ করিবে না। সে প্রবল সৈন্য সংগ্ৰহ করিয়াছে, আপনার উপর তাহার মহতী শঙ্কা আছে; এ নিমিত্ত সে কখনই আপনার বাক্য রক্ষা করিবে না। ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণ স্থির করিয়াছে যে, সুররাজ ইন্দ্র সমুদয় অমরগণসমভিব্যাহারেও তাহাদের সৈন্যকে পরাজয় করিতে পরিবেন না। অতএব আপনার বাক্য সন্ধিস্থাপনে সমর্থ হইলেও সেই ক্ৰোধনস্বভাব কামপরবশ কৌরবগণের নিকট কাৰ্য্যসাধনে অসমর্থ হইবে।
“হে জনাৰ্দন! দুরাত্মা দুৰ্য্যোধনপ্রভৃতি হস্তি-অশ্বিরথ, সম্পন্ন সৈন্য সংগ্ৰহ করিয়া নিৰ্ভয়চিত্তে সমুদয় পৃথিবী আপনার বশীভূত ও রাজ্য শত্রুসৈন্য হইয়াছে বলিয়া বোধ করিতেছে, অতএব সে কখনই শান্তিসংস্থাপনে সম্মত হইবে না। এই পৃথিবী বিপৰ্য্যস্ত হইয়াছে [উপকৃত হইতে বসিয়াছে]; কালগ্রাসে পতনোন্মুখ ভূপতিগণ ও অন্যান্য যোদ্ধারা দুৰ্য্যোধনের নিমিত্ত পাণ্ডবগণের সহিত সংগ্রাম করিতে চতুর্দ্দিক হইতে আগমন করিয়াছে। হে কৃষ্ণ! যেসকল ভূপতি পূর্ব্বে আপনার সহিত কৃতবৈরী [শত্রুভাবাপন্ন] ও আপনার প্রভাবে হৃতসার [হৃতসর্ব্বস্বসর্ব্বস্বহারা] হইয়াছিল, এক্ষণে তাহারা আপনার ভয়ে উদ্বিগ্ন হইয়া ধৃতরাষ্ট্ৰতনয়দিগের আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছেন। যোদ্ধৃগণ দুৰ্য্যোধনসমভিব্যাহারে প্রাণপণে পাণ্ডবগণের সহিত যুদ্ধ করিতে কৃতসঙ্কল্প হইয়াছে; তাহাদের মধ্যে প্রবেশ করিয়া সন্ধিস্থাপনের কথা উত্থাপন করা আমার মত নয়। হে মধুসূদন! আমি আপনার প্রভাব, পৌরুষ [পুরুষত্ব-বল, বীৰ্য্য] ও বুদ্ধি বিলক্ষণ অবগত আছি এবং দেবগণও আপনার প্রভাব সহ্য করিতে সমর্থ হয়েন না, যথাৰ্থ বটে। তথাপি আপনি সেই দুষ্টচিত্ত শক্রগণের সভায় প্রবেশ করিবেন, ইহা আমার অভিপ্রেত নয়। পাণ্ডবগণের প্রতি আমার যেরূপ প্রীতি, আপনার উপর তদপেক্ষা অধিক। হে পুরুষোত্তম! আপনার দর্শনে আমি যেরূপ প্রীত হইয়াছি, তাহা আপনাকে আর কি বলিব; আমি সর্ব্বভূতের অন্তরাত্মা।”