মুনি বলে, অবধান কর নরপতি।
প্রাগজ্যোতিষে ভগদত্ত-কন্যা ভানুমতী।।
নৃপতি করিল সেই কন্যা স্বয়ন্বর।
নিমন্ত্রিয়া আনাইল সব নৃপবর।।
দুর্য্যোধন শত ভাই ভীষ্ম কর্ণ দ্রোণ।
কলিঙ্গ কামদ মৎস্য পাঞ্চাল নন্দন।।
শাল্ব শিশুপাল দন্তবক্র পুরোজিত।
জয়দ্রথ শল্য মদ্র কোশল সহিত।।
রাজচক্রবর্ত্তী জরাসন্ধ মহাতেজা।
স্বয়ন্বরে গেল আশী সহস্রেক রাজা।।
হেনমতে রাজগণ করিল গমন।
ভগদত্ত নৃপতি করিল নিবেদন।।
এইমত মৎস্য-লক্ষ্য উর্চ্চাদ্ধযোজন।
এই ধনুর্ব্বাণে বিন্ধিবেক যেই জন।।
সেই মম কন্যা লভিবেক ভানুমতী।
এত বলি কন্যা আনাইল শীঘ্রগতি।।
ভানুর প্রকাশে যেন তিমির বিনাশ।
ভানুমতী-রূপে তেন করিল প্রকাশ।।
দেখিয়া মোহিত হৈল সব রাজগণ।
ষোড়শ কলাতে যেন চন্দ্রের শোভন।।
তবে যত রাজগণ উঠি একে একে।
কারো শক্তি গুণ দিতে নারিল ধনুকে।।
জরাসন্ধ মহারাজ ধনুক লইয়া।
বহুশক্তি দিল গুণ ধনু নোয়াইয়া।।
লক্ষ্যের উদ্দেশে বাণ এড়িল নৃপতি।
নারিল বিন্ধিতে লক্ষ্য তাহার শকতি।।
লক্ষ্য না বিন্ধিয়া বাণ পড়িল ভূতলে।
লাজ পাইয়া হাত হইতে ধনু ফেলে।।
যত সব রাজগণ হইল বিমুখ।
কারো শক্তি নোয়াইতে নারিল ধনুক।।
সবারে বিমুখ দেখি প্রাগজ্যোতিষ-পতি।
করযোড়ে কহে সব নৃপতির প্রতি।।
কারু হইতে নহিল আমার প্রয়োজন।
আজ্ঞা কর কোন কর্ম্ম করিব এখন।।
রাজগণ বলে, শক্তি নাহি মো’সবার।
উপায় করহ চিত্তে যা হয় বিচার।।
যে পারিবে সে লইবে তোমার কুমারী।
কার শক্তি তারে কিছু বলিতে না পারি।।
এত শুনি কহিতে লাগিল ভদগত্ত।
অস্ত্রধারী হইয়া আছয়ে হেথা যত।।
ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র চারিজাতি।
যে বিন্ধিবে লক্ষ্য, সে লভিবে ভানুমতী।।
এই ভাষা পুনঃ পুনঃ বলিল রাজন।
শুনিয়া উঠিল তবে বীর বৈকর্ত্তন।।
আকর্ণ পূরিয়া ধনু দিলেন টঙ্কার।
লক্ষ্যের উদ্দেশে বাণ করিল প্রহার।।
মহা-পরাক্রম কর্ণ হয়ে দৃষ্টভেদি।
এক বাণে মৎস্য-চক্র ফেলাইল ছেদি।।
দেখি হৃষ্ট মতি তবে হৈল ভানুমতী।
কর্ণগলে মালা দিতে যায় শীঘ্রগতি।।
পিছু হৈয়া মালা দিতে কর্ণ নিবারিল।
দেখিয়া সকল রাজা বিস্ময় হইল।।
রহ রহ বলি ডাকে জরাসন্ধ রাজা।
শুনিয়া কুপিল সূর্য্যপুত্র মহাতেজা।।
কর্ণ বলে লক্ষ্য যে বিন্ধিলাম সভাতে।
ভানুমতী আইল আমারে মালা দিতে।।
মৈত্র হেতু আমি তারে করিনু বারণ।
তুমি নিবারহ তারে কিসের কারণ।।
জরাসন্ধ বলে, অর্দ্ধভাগী হই আমি।
মোর গুণ দিয়া ধনু বিন্ধিয়াছ তুমি।।
গুণ দিলে ধনুক অর্দ্ধেক হয় তার।
হয় নয় বুঝ সবে করিয়া বিচার।।
এত শুনি কহিল যতেক নরপতি।
সত্য কহিলেন, জরাসন্ধ মহীপতি।।
গুণদাতা জনের অর্দ্ধেক অধিকার।
ভানুমতী উপরেতে স্বামীত্ব দোঁহার।।
এক্ষণে ইহার এই দেখি যে বিধান।
দোঁহাকার মধ্যে যে হইবে বলবান।।
ভানুমতী কন্যা লভিবেক সেই জন।
এইমত কহিল যতেক রাজগণ।।
শুনি কর্ণ ডাকি বলে জরাসন্ধ প্রতি।
মিথ্যা দ্বন্দ্ব অকারণে কর নরপতি।।
বহুশক্তি দিলা গুণ করি প্রাণপণ।
নোয়াইতে ধনু তাহে নহিলে ভাজন।।
কন্যা লোভে দ্বন্দ্ব এবে কর অকারণে।
ইহার উচিত ফল পাবে মোর স্থানে।।
গুণ দিতে ধনু আমি পারি শতবার।
হেন লক্ষ্য বিন্ধিবারে কি শক্তি তোমার।।
আবার তথায় লক্ষ্য রাখ লৈয়া পুনঃ।
পুনঃ আমি বিন্ধিব ধনুকে দিয়া গুণ।।
নতুবা আইস দোঁহে করিব সমর।
এত বলি ডাকে বীর কর্ণ ধনুর্দ্ধর।।
শুনিয়া ধাইল জরাসন্ধ নরপতি।
দোঁহাকারে দোঁহে অস্ত্র বিন্ধে শীঘ্রগতি।।
নানা অস্ত্র কর্ণ বীর করে বরিষণ।
নিবারষে তাহা বৃহদ্রথের নন্দন।।
প্রাণপণে ঘোর যুদ্ধ হইল দোঁহার।
ধনু এড়ি গদা লৈল মগধ-কুমার।।
গদাযুদ্ধে অধিক কুশল মহারথ।
গদাঘাতে চূর্ণ সে করিল কর্ণরথ।।
সারথি তুরঙ্গ রথ আদি চূর্ণ হৈল।
লাফ দিয়া কর্ণ বীর ভূমিতে পড়িল।।
আর রথে চড়ি অস্ত্র করে বরিষণ।
সেই রথ চূর্ণ তবে করিল তখন।।
মার মার বলিয়া ভীষণ ঘোর ডাকে।
বায়ুবেগে গদা বীর ফিরায় মস্তকে।।
মেঘের বর্ষণাধিক কর্ন অস্ত্র এড়ে।
গদায় ঠেকিয়া অস্ত্র ধূলি হৈয়া পড়ে।।
হেনমতে কতক্ষণ হইল সমর।
ক্রোধে দিব্য অস্ত্র এড়ে কর্ণ ধনুর্দ্ধর।।
খণ্ড খণ্ড করি গদা কাটিয়া ফেলিল।
অন্য গদা লৈয়া বীর কর্ণে প্রহারিল।।
সেই গদা কাটি কর্ণ কৈল খান খান।
অন্য গদা লৈল পুনঃ মগধ-প্রধান।।
পুনঃ পুনঃ জরাসন্ধ যত গদা লয়।
তিল তিল করি কাটে সূর্য্যের তনয়।।
বহু গদা গেল, গদা নাহি আর।
কর্ণ প্রতি বলে তবে মগধ-কুমার।।
আমি অস্ত্রহীন, তুমি হও অস্ত্রধারী।
অস্ত্য ত্যজি এস দোঁহে বাহুযুদ্ধ করি।।
শুনি কর্ণ সেইক্ষণে এড়ি ধনুঃশর।
বাহুযুদ্ধ করে দোঁহে ভূমির উপর।।
মুণ্ডে মুণ্ডে, ভুজে ভুজে, বুকে বুকে তাড়ি।
চরণে চরণে ছান্দি যায় গড়াগড়ি।।
গদাঘাত করাঘাত মুষ্টির প্রহার।
চ্ট্ চট্ শব্দ বাজে অঙ্গে দোঁহাকার।।
কোথায় পড়িল রত্ন-কন্ঠহার ছিঁড়ি।
মাথার মুকুট গেল চূর্ণ হয়ে উড়ি।।
দোঁহাকার সংগ্রাম না হয় যে বিরাম।
পূর্ব্বে সীতা হেতু যেন রাবণ শ্রীরাম।।
বসন্ত সময় যেন হস্তিনী কারণ।
দুই মত্ত দন্তীবল করে মহারণ।।
সূর্য্যের নন্দন কর্ণ সূর্য্য-পরাক্রম।
ক্রোধমূর্ত্তি দেখি যেন কালান্তক যম।।
ভুজবলে জরাসন্ধে পাড়ি ভূমি পরে।
বুকে হাঁটু দিয়া তার গলা চেপে ধরে।।
জরাসন্ধ-সঙ্কট দেখিয়া রাজগণ।
হাহাকার করিয়া করিল নিবারণ।।
হারি অপমান হৈয়া মগধের পতি।
আপনার দেশে গেল হৈয়া দুঃখমতি।।
তবে ভানুমতী লৈয়া ভানুর নন্দন।
দুর্য্যোধন আগে লৈয়া দিল ততক্ষণ।।
হৃষ্ট হৈয়া দুই মিতে করে কোলাকুলি।
ভানুমতি লৈয়া গেল নিজ দেশে চলি।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীদাস কহে, সদা শুনে পুণ্যবান।।