৯১তম অধ্যায়
দ্রোণার্জ্জুনের যুদ্ধ
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! সব্যসাচী মহারথ অর্জ্জুন এইরূপে দুঃশাসনের সৈন্য বিনাশ করিয়া সিন্ধুরাজকে আক্রমণ করিবার মানসে দ্রোণাচার্য্যের সৈন্যাভিমুখে ধাবমান হইলেন এবং ব্যূহসম্মুখে দ্রোণাচাৰ্য্যকে অবস্থিত দেখিয়া কৃষ্ণের অনুমতিক্রমে কৃতাঞ্জলি পুটে কহিলেন, হে ব্রহ্মন্! আপনি আমার মঙ্গল চিন্তা ও কল্যাণ করুন। আমি আপনার প্রসাদে এই দুর্ভেদ্য চমূমধ্যে প্রবেশ করিতে ইচ্ছা করিতেছি। সত্য বলিতেছি, আমি আপনাকে পিতার সমান, কৃষ্ণের সমান ও জ্যেষ্ঠভ্রাতা ধর্ম্মরাজের সমান জ্ঞান করিয়া থাকি। হে তাত! আপনি অশ্বত্থামাকে যেরূপ রক্ষা করিয়া থাকেন, আমাকেও সর্ব্বদা সেইরূপে রক্ষা করা আপনার কর্ত্তব্য। আমি আপনার অনুগ্রহে রণস্থলে নরোত্তম সিন্ধুরাজকে বিনাশ করিতে ইচ্ছা করিয়াছি; অতএব আপনি আমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করুন।
মহাবীর দ্রোণাচাৰ্য্য অৰ্জ্জুনের বাক্য শ্রবণে হাস্য করত কহিলেন, ‘হে অর্জ্জুন! তুমি অগ্রে আমাকে জয় না করিয়া কদাচ জয়দ্রথকে পরাজয় করিতে সমর্থ হইবে না।’ দ্রোণাচার্য্য এই বলিয়া হাসিতে হাসিতে তীক্ষ্ণ শরজাল দ্বারা অর্জ্জুন ও তাঁহার রথ, অশ্ব, ধ্বজ ও সারথিকে সমাচ্ছন্ন করিয়া ফেলিলেন। তখন মহাবীর ধনঞ্জয় ক্ষত্ৰ ধর্ম্মানুসারে স্বীয় সায়ক দ্বারা দ্রোণের শরজাল নিবারণ পূর্ব্বক ভীষণাকার বাণ সকল নিক্ষেপ করিয়া তাঁহার অভিমুখে ধাবমান হইয়া তাঁহাকে নয় বাণে বিদ্ধ করিলেন। দ্রোণাচাৰ্য্য স্বীয় সায়ক দ্বারা অর্জ্জুনের বাণ ছেদন পূর্ব্বক বিষাগ্নি সদৃশ শর দ্বারা কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। ঐ সময় মহাত্মা ধনঞ্জয়, কিরূপে আচার্য্যের শরাসন ছেদন করিবেন এই চিন্তা করিতেছেন, ইত্যবসরে বীৰ্য্যবান দ্রোণ সত্বরে তাঁহার চাপজ্যা ছেদনপূর্ব্বক শরদ্বারা রথধ্বজ, ঘোটক ও সারথিকে বিদ্ধ করিয়া সহাস্য বদনে অর্জ্জুনকে সায়ক সমাচ্ছন্ন করিয়া ফেলিলেন। তখন অস্ত্রবিদগ্রগণ্য মহাবীর পার্থ সত্বর কার্ম্মুকে অপর জ্যা আরোপণ করিয়া আচাৰ্য্যকে হস্তলাঘব প্রদর্শন করিবার নিমিত্ত এক বারে ছয়শত শর নিক্ষেপ করিলেন। পরে কখন সপ্তশত, কখন সহস্র ও কখন অযুত সংখ্যক বাণ নিক্ষেপ করিয়া দ্রোণাচার্য্যের সেনাগণকে বিনাশ করিতে লাগিলেন। অসংখ্য মনুষ্য, মাতঙ্গ ও তুরঙ্গ অর্জ্জুনের শরে বিদ্ধ হইয়া ধরাতলে নিপতিত হইল। রথিগণ ধনঞ্জয়ের শর প্রভাবে অস্ত্র, ধ্বজ, সারথি ও অশ্ববিহীন এবং নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া প্রাণ পরিত্যাগ পূর্ব্বক রথ হইতে ধরাতলে নিপতিত হইতে লাগিল।
মাতঙ্গ সকল বজ্রচূর্ণ পর্ব্বতশৃঙ্গের ন্যায়, বাতাহত মেঘের ন্যায়, হুতাশন দগ্ধ গৃহের ন্যায় সমরাঙ্গনে নিপতিত হইল। সহস্র সহস্র অশ্ব হিমালয় প্রস্থে বারিবেগাহত হংসকুলের ন্যায় ভূতলশায়ী হইতে লাগিল। যুগান্তকালীন সূৰ্য্য যেমন কিরণজাল দ্বারা অগাধ জল রাশি ক্ষয় করেন, তদ্রপ মহাবীর পার্থ শরজাল বিস্তার পূর্ব্বক অসংখ্য রথ, অশ্ব, হস্তী ও পদাতি বিনষ্ট করিলেন।
তখন মেঘ যেমন বিকিরণ আচ্ছন্ন করে, তদ্রূপ মহাবীর দ্রোণাচার্য্য স্বীয় শরনিকর দ্বারা ধনঞ্জয়ের শরজাল সমাচ্ছন্ন করিয়া তাঁহার বক্ষস্থলে এক অরাতি ঘাতক নারাচ নিক্ষেপ করিলেন। মহাবীর ধনঞ্জয় আচার্য্যের নারাচ প্রহারে ভূমিকম্পকালীন অচলের ন্যায় ব্যাকুলিত হইলেন এবং অবিলম্বে ধৈৰ্য্যাবলম্বন পূর্ব্বক দ্রোণকে শরবিদ্ধ করিতে লাগিলেন। তখন মহাবল পরাক্রান্ত দ্রোণাচার্য্য পাঁচ বাণে বাসুদেবকে ও ত্ৰিসপ্ততি বাণে অর্জ্জুনকে বিদ্ধ করিয়া তিন শরপ্রহারে তাঁহার রথধ্বজ বিপাটিত করিলেন এবং হস্ত লাঘব প্রদর্শন পূর্ব্বক নিমেষ মধ্যে শর বৃষ্টি দ্বারা তাঁহাকে অদৃশ্য করিয়া ফেলিলেন। ঐ সময় আমরা দেখিলাম, দ্রোণাচার্য্যের সায়ক সকল অনবরত নিপতিত হইতেছে এবং তাঁহার ভীষণ শরাসন মণ্ডলাকারই রহিয়াছে। হে মহারাজ! দ্রোণ বিসৃষ্ট কঙ্কপত্রভূষিত শর সকল কেবল বাসুদেব ও ধনঞ্জয়ের প্রতিই ধাবমান হইল।
তখন মহামতি বাসুদেব দ্রোণ ও অর্জ্জুনের সেই ভয়ানক যুদ্ধ সন্দর্শন করিয়া প্রকৃত কাৰ্য্য সাধন চিন্তা করত অর্জ্জুনকে কহিলেন, ‘হে মহাবাহো ধনঞ্জয়! আমাদের আর কালক্ষেপ করা কৰ্তব্য নয়। দ্রোণের সহিত অনেকক্ষণ সংগ্রাম করা হইয়াছে; অতএব উহাকে পরিত্যাগ পূর্ব্বক অনত্র গমন করি ।’ মহাবীর অর্জ্জুন কেশবের বাক্য শ্রবণান্তর তাঁহাকে ‘তোমার যাহা অভিরুচি’ এই কথা বলিয়া দ্রোণকে প্রদক্ষিণ পূর্ব্বক বাণ পরিত্যাগ করিয়া বিবৃত্তমুখে গমন করিতে লাগিলেন। মহাবীর দ্রোণাচার্য্য অর্জ্জুনকে অন্যত্র গমন করিতে দেখিয়া কহিলেন, হে পাণ্ডব! এক্ষণে কোথায় গমন করিতেছ? তুমি না সমরে শক্র পরাজয় না করিয়া প্রতিনিবৃত হওনা? তখন অর্জ্জুন বলিলেন, ‘হে আচার্য্য! আপনি আমার গুরু, শত্রু নহেন। আমি আপনার পুত্র সমান শিষ্য। বিশেষত আপনাকে যুদ্ধে পরাভব করিতে পারে এমন কেহই নাই।’
জয়দ্রথবধোৎসুক বিভৎসু দ্রোণকে এই কথা বলিয়া সত্বরে কৌরব সৈন্যের প্রতি ধাবমান হইলেন। পাঞ্চাল দেশীয় মহাত্মা যুধামন্যু ও উত্তমৌজা চক্ররক্ষক হইয়া তাঁহার অনুগমন করিতে লাগিলেন। এই রূপে পুত্রশোকে সন্তপ্ত মহাবল পরাক্রান্ত ধনঞ্জয় জীবিতাশা পরিত্যাগ পূর্ব্বক সাক্ষাৎ কৃতান্তের ন্যায়, মত্তমাতঙ্গের ন্যায় সৈন্য মধ্যে প্রবেশ করিতে আরম্ভ করিলে কৌরব পক্ষীয় জয়, কৃতবর্ম্মা, সাত্বত, কাম্বোজ ও শ্রুতায়ু তাঁহাকে নিবারণ করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন ঐ বীরগণের অনুগামী দশ সহস্র রথী এবং অভীষাহ, শূরসেন, শিবি, বসাতি, মাবেল্লক, ললিখ, কৈকয়, মদ্রক, নারায়ণ, গোপাল ও পূর্ব্বে কর্ণকর্ত্তৃক পরাজিত কাম্বোজ দেশীয় বীরগণ দ্রোণাচাৰ্য্যকে পুনরাবর্ত্তী করিয়া প্রাণ পণে বিচিত্র যোদ্ধা নরশ্রেষ্ঠ অর্জ্জুনকে নিবারণ করিতে প্রবৃত্ত হইল। এইরূপে পরস্পর স্পর্ধাশীল যোদ্ধারা সকলে মিলিত হইয়া অর্জ্জুনের সহিত লোমহর্ষণ তুমুল যুদ্ধ করিয়া ঔষধাদি যেমন ব্যাধি নিবারণ করে, তদ্রূপ জয়দ্রথ বধোৎসুক ধনঞ্জয়কে নিবারণ করিতে আরম্ভ করিল।