দ্রৌপদীর রূপ দেখি মোহে নৃপগণ।
শীঘ্রগতি সবাই উঠিল ততক্ষণ।।
হুড়াহুড়ি করি সবে ধায় বায়ুবেগে।
সবে বলে, রহ লক্ষ্য আমি বিন্ধি আগে।।
সুহৃদে সুহৃদে সবে উপজিল দ্বন্দ্ব।
ধনুক বেড়িয়া দাঁড়াইল নৃপবৃন্দ।।
তবে মগধের পতি জরাসন্ধ রাজা।
রাজচক্রবর্তী ক্ষত্রকুলে মহাতেজা।।
ধনুক তুলিয়া সে ঝাঁকারে পুনঃ পুনঃ।
নোয়াইয়া ধনু ধরে হুলে দিতে গুণ।।
অতিশয় ধনুর্দ্ধর ধনুকের ভরে।
মূর্চ্ছা হৈয়া নৃপতি পড়িল কত দূরে।।
তবে দুর্য্যোধন দম্ভ করিয়া বহুল।
ধনু ধরে জানু পাতি নোয়াইয়া হুল।।
মুখে রক্ত উঠিল, কম্পিত কলেবর।
কত দূরে মূর্চ্ছা হৈয়া ধূলায় ধূসর।।
তবে মৎস্য-অধিপতি বিরাট-রাজনে।
ঠেলাঠেলি করি ধনু নিল প্রাণপণে।।
তুলিতে সে নারিল ছাড়িতে না পারিল।
হাসিয়া সুশর্ম্মা রাজা ধনু কাড়ি নিল।।
কন্যারে দেখিয়া বুড়া খাইলি কি লাজ।
লক্ষ্য বিন্ধিবার ছলে হাসালি সমাজ।।
তুলিবার নাহ শক্তি বিন্ধিবারে চাও।
এই মুখে মৎস্যদেশে রাজভোগ খাও।।
এত বলি শীঘ্রগতি তুলিলেক ধনু।
দেখিয়া কীচক বীর ক্রোধে কাঁপে তনু।।
কতদূরে ত্রিগর্ত্তেরে ফেলিল ঠেলিয়া।
চাপড় মারিয়া ধনু লইল কাড়িয়া।।
পায়ে চাপি ধরি ধনু গুণ দিতে চায়।
কতদূরে পড়িল হইয়া মৃতপ্রায়।।
মত্ত-দশসহস্র-মাতঙ্গ-পরাক্রম।
ধনুকে দিবার গুণ না হইল ক্ষম।।
শিশুপাল মহারাজ চেদির ঈশ্বর।
বড় লজ্জা পাইল সে সভার ভিতর।।
লজ্জাভয়ে প্রাণপণে নোয়াইল ধনু।
না পারিল ধৈর্য্য, হৈতে হীনবীর্য্য তনু।।
ধনুহুলে চিবুক লাগিয়া উলটিল।
কত দূরে রাজগণ-উপরে পড়িল।।
মুকুট ভাঙ্গিল তনু হৈল মহাক্ষীণ।
মৃতপ্রায় হইয়া রহিল দণ্ড তিন।।
তবে একে একে যত নৃপতি সকল।
রুক্মী ভগদ্ত্ত শল্য শাল্ব মহাবল।।
বাহ্লীক কলিঙ্গ কাশী ভোজ নরপতি।
চন্দ্রসেন মদ্রসেন পৌরব প্রভৃতি।।
সত্যসেন সুষেণ রোহিত বৃহদ্বল।
দীর্ঘপিঙ্গকেশী দন্তবক্র মহাবল।।
বলবন্ত কুলবন্ত ক্ষত্রিয়-প্রধান।
লক্ষ লক্ষ নরপতি সবে বলবান।।
একে একে সবাই বুঝিল পরাক্রম।
ধনু নেয়াইতে কেহ না হইল ক্ষম।।
প্রাণপণে তুলিল দুর্জ্জয় মহাধনু।
পরিশ্রমে সবে হতবীর্য্য হৈল তনু।।
কোথায় ধনুক পড়ে কোথায় আপনি।
কোথা পড়ে কুণ্ডল মুকুট রত্নমণি।।
কাহার ভাঙ্গিল হাত ঘাড় স্কন্ধ নাক।
মুখে রক্ত উঠে কারো ঝলকে ঝলক।।
হাহাকার করে কেহ ভূমিতলে পড়ি।
ধুলায় ধূসর তনু যায় গড়াগড়ি।।
বড় বড় নৃপতির দেখি অপমান।
ভয়ে আর কেহ না হইল আগুয়ান।।
প্রথমে বিন্ধিব বলি কৈল মহাগোল।
লজ্জায় কাহার মুখে নাহি আর বোল।।
দম্ভ করি উঠিয়া বসিল অধোমুখে।
লজ্জিত হইয়া পৃষ্ঠ করিয়া ধনুকে।।
অজেয় জানিয়া সবে বিপুল ধনুক।
যত ক্ষত্রকুল সবে হইল বিমুখ।।
রাজগণ যখন হইল ভঙ্গিয়ান।
করযোড় করি বলে পাঞ্চাল-প্রধান।।
অবধান কর যত রাজার সমাজ।
স্বয়ম্বর করিয়া যে পাইলাম লাজ।।
নিমন্ত্রিয়া আনিলাম যত রাজগণ।
না হইল কার্য্যসিন্ধি করি প্রাণপণ।।
সবে বলে, রাজা তব না বুঝি চরিত।
কভু নাহি দেখি হেন ধনু বিপরীত।।
বহুস্থানে এমত হয়েছে লক্ষ্য পণ।
লক্ষ্য বিন্ধি সবে লইয়াছে কন্যাগণ।।
ঈদৃশ ধনুক কভু নাহি দেখি শুনি।
ধনুর্ভরে মূর্চ্ছা হৈল সব নৃপমণি।।
বিন্ধিবার কাজ থাকে, গুণ দিতে নারি।
আমা সবা বিড়ম্বিতে করেছ চাতুরী।।
বহু ধনু দেখিয়াছি আমা সবা জ্ঞানে।
হেন ধনু দেখি নাই শুনি নাই কাণে।।
মদ্ররাজ পূর্ব্বে কন্যা স্বয়ম্বর কৈল।
যোজনেক উচ্চে রাধাচক্র করেছিল।।
তাহাতেও গুণ দিল কোন কোন জনা।
লক্ষ্য বিন্ধি বাসুদেব লভিল লক্ষণা।।
ভদগত্ত-নৃপতির কন্যা ভানুমতী।
সেই এইমত পণ করিল নৃপতি।।
দুর্জ্জয় ধনুক কৈল জানে সর্ব্বজনা।
সেই ধনু নহিবে এ ধনুর তুলনা।।
তাহাতে ত গুণ দিয়াছেন রাজগণে।
কর্ণ লক্ষ্য বিন্ধি কন্যা দিল দুর্য্যোধনে।।
জন্মেজয় জিজ্ঞাসিল মুনি সম্বোধনে।
কহ মুনি, কর্ণ লক্ষ্য বিন্ধিল কেমনে।।
কহ শুনি ভানুমতী-স্বয়ম্বর-কথা।
কোন্ কোন্ রাজগণ গিয়াছিল তথা।।
মহাভারতের কথা অমৃত-লহরী।
কাশী কহে শুনিলে তরয়ে ভববারি।।