প্রভাতে উঠিয়া তবে ধর্ম্মের নন্দন।
নিত্য নিয়মিত কর্ম্ম কৈল সমাপন।।
দুর্ব্বাসা অতিথি হেতু সচিন্তিত মন।
নানা কার্য্যে নানা স্থানে ধায় সবর্ব জন।।
ফল পুষ্প হেতু কেহ প্রবেশিল বনে।
ভীমার্জ্জুন দোঁহে যান মৃগয়া কারণে।।
স্নান করি আসিলেন দ্রুপদ নন্দিনী।
আনন্দ বিধানে পূজে দেব দিনমণি।।
নানা দ্রব্য কৌতুকে আনিল সর্ব্ব জন।
দ্রুপদ নন্দিনী গেল করিতে রন্ধন।।
যথায় রন্ধন করে দ্রুপদ নন্দিনী।
সত্বর তথায় আসিলেন ধর্ম্মমণি।।
কহেন মধুর বাক্যে ধর্ম্মের নন্দন।
শীঘ্রগতি গুণবতী করহ রন্ধন।।
আজিকার দিন যদি যায় ভাল মতে।
তবে জানি কিছুকাল বাঁচিত জগতে।।
মহোগ্র দুর্ব্বাসা ঋষি, সর্ব্বলোকে বলে।
সংসার দহিতে পারে কোপের অনলে।।
স্নান করি অবিলম্বে আসিবে সে জন।
সংহতি করিয়া যত শিষ্য তপোধন।।
স্বচ্ছন্দ বিধানে যদি পায় অন্ন পান।
তবে সে হইবে সবাকার পরিত্রাণ।।
এই হেতু বড় চিন্তা হয় মোর মনে।
যা করিতে পার কৃষ্ণা আপনার গুণে।।
তোমা হতে সঙ্কটেতে সবে সদা তরি।
তুমি করিয়াছ বন হস্তিনা নগরী।।
তোমার যতেক গুণ না হয় বর্ণন।
কৃষ্ণ আর কৃষ্ণা যে পাণ্ডবের ভূষণ।।
আসিয়া রাখিলে কৃষ্ণ, ছিল যত দায়।
এখন করহ তুমি উচিত যে হয়।।
কৃষ্ণা বলে, মহারাজ করি নিবেদন।
অল্প কার্য্যে এত চিন্তা কর কি কারণ।।
ধর্ম্মপথ মত যদি আমি হই সতী।
একান্ত আমার যদি ধর্ম্মে থাকে মতি।।
সূর্য্যের বচন, আর তোমার প্রসাদে।
দশ লক্ষ হৈলে ভুঞ্জাইব অপ্রমাদে।।
চিন্তা না করহ কিছু ইহার কারণ।
এই দেখ মহারাজ করি যে রন্ধন।।
যাহ শীঘ্র শিষ্য সহ আন মুনিবর।
শুনি রাজা যুধিষ্ঠির হরিষ অন্তর।।
হেথায় দুর্ব্বাসা মুনি উঠিয়া সকালে।
করিল আহ্নিক স্নান প্রভাসের জলে।।
সেই মত কৈল, যত শিষ্যের সমাজ।
হেনকালে সবে ডাকি কহে মুনিরাজ।।
সবে জান কালি যে কহিনু ধর্ম্মরাজে।
অত্যন্ত লজ্জিত আমি আছি সেই কাজে।।
চল শীঘ্র সেই স্থানে যাব সবর্ব জন।
করিব ধর্ম্মের প্রতি শান্ত আচরণ।।
এত বলি শিষ্য সহ চলে মুনিরাজ।
শুনিয়া সানন্দমতি পাণ্ডব সমাজ।।
আগুসারি কত দূর সর্ব্ব জন আসি।
সাদরে আহবইনল সশিষ্য মহাঋষি।।
অনেক করিয়া ভক্তি ভাই পঞ্চজনে।
বসাইল মৃগচর্ম্ম কুশের আসনে।।
সুশীতল জল আনি ধর্ম্মের নন্দন।
কৌতুকে করেন ধৌত মুনির চরণ।।
আনন্দ বিধানে তবে পঞ্চ সহোদরে।
সেই পাদোদক সবে মিলি ভক্তিভরে।।
পান করি বন্দনা কিরেন সবে শিরে।
তবে ধর্ম্ম নৃপবর কহে ধীরে ধীরে।।
নিশ্চয় আমারে আজি সুপ্রসন্ন বিধি।
পাইলাম আজি বিনা যত্নে রত্ননিধি।।
সুপ্রভাত হৈল মোর আজিকার নিশি।
কৃপা করি আসিলেন নিজে মহাঋষি।।
পৃথিবীরে ভাগ্যহীন আমার সমান।
নহিল, না হবে, হেন করি অনুমান।।
তপস্যা করিল পূর্ব্ব পিতামহগণ।
যে কিছু আমার আর পূর্ব্ব উপার্জ্জন।।
কৃপা কর আমারে সে ফলে সর্ব্বজনে।
নহিলে অধম আমি তরি কোন্ গুণে।।
যুধিষ্ঠির মুখে শুনি এতেক বচন।
তুষ্ট হয়ে বলে তবে মহা তপোধন।।
শুন ধর্ম্মসুত যুধিষ্ঠির নৃপমণি।
আপনারে না জানিয়া বহ হেন বাণী।।
তুমি ধর্ম্মবন্ত সত্যবাদী মতিমান।
পৃথিবীতে নাহি কেহ তোমার সমান।।
ধর্ম্মেতে ধার্ম্মিক তুমি, ক্ষত্রিয় সুধীর।
সমুদ্র সমান অতি গুণেতে গভীর।।
অসার সংসার, এই সার মাত্র ধর্ম্ম।
তোমার হইল রাজা সহজ এ কর্ম্ম।।
লোভ মোহ কাম ক্রোধ মাৎসর্য্য মত্ততা।
তোমার নিকটবর্ত্তী নহিল সর্ব্বথা।।
সুখ দুঃখ শরীরের সহযোগ ধর্ম্ম।
সময়ে প্রবল হয় আপনার কর্ম্ম।।
তাহতে সন্তাপ নাহি করে জ্ঞানবান।
সাধুর জীবন মৃত্যু একই সমান।।
সাধুর গণনে রাজা তুমি অগ্রগণ্য।
পৃথিবীর লোক যত করে ধন্য ধন্য।।
তোমার বংশেতে যত মহারাজ ছিল।
ধার্ম্মিক তোমার তুল্য নহিবে নহিল।।
কহিলাম সত্য, এই লয়ে মম মন।
বসুমতী পতি যোগ্য তুমি হে রাজন।।
এ তিন ভুবনে তব পরিপূর্ণ যশ।
তোমার গুণেতে রাজা হইলাম বশ।।
কিন্তু এক কথা কহি, শুন মহারাজ।
সম্প্রতি তোমার ঠাই পাইলাম লাজ।।
কহিয়া তোমারে হেথা করিতে রন্ধন।
সন্ধ্যা হেতু প্রভাসেতে গেনু সর্ব্ব জন।।
সায়ংসন্ধ্যা জপ আদি যে কিছু আছিল।
ক্রমে ক্রমে সর্ব্বজন সমাপ্ত করিল।।
পথশ্রমে উঠিবার শক্তি কার নাই।
আলস্যেতে না পারে কেহ, এই সে কারণ।
তব স্থানে লজ্জা বড় হইল রাজন।।
ক্ষুধার্ত্ত আছয়ে সবে, করিবে ভোজন।
স্নান করি গিয়া, যদি হইল রন্ধন।।
ধর্ম্ম বলে, কালি মম দুরদৃষ্ট ছিল।
সে কারণে সবাকার আলস্য হইল।।
হইল আমার যদি সুকর্ম্মের লেশ।
তবে মহামুনি আসি করিলে প্রবেশ।।
দেবের দুর্ল্লভ হয় তর আগমন।
অল্প ভাগ্যে এ সব না হয় কদাচন।।
মম শক্তি অনুরূপ অন্ন জল স্থল।
তোমার প্রসাদে মুনি প্রস্তুত সকল।।
এত বলি মহানন্দে উঠি ধর্ম্মপতি।
নিকটে ডাকেন ভীমার্জ্জুন মহামতি।।
আজ্ঞা দেন ধর্ম্মসুত করিবারে স্থান।
শ্রুতমাত্র দুই ভাই হৈল সাবধান।।
নানা দিকে স্থান করি দিল অন্ন জল।
নিযুক্ত করিল তাহে রক্ষক সকল।।
আনন্দ বিধানে তবে ভাই দুই জনে।
শীঘ্রগতি জানাইল ধর্ম্মের নন্দনে।।
ধর্ম্ম বলে, অবধান কর মুনিরাজ।
অতঃপর বিলম্বেতে নাহি কিছু কাজ।।
হইবে রৌদ্রের তেজ হলে অতি বেলা।
বিধাতা নিযুক্ত করিলেন বৃক্ষতলা।।
মুনি বলে, যুধিষ্ঠির তুমি সাধুজন।
অট্টালিকা হৈতে ভাল তোমার আশ্রম।।
কদর্য্য স্থানেতে যদি সাধুজন রয়।
স্বর্গের সমান তাহা, বেদে হেন কয়।।
এত বলি মহানন্দে উঠি মুনিবর।
আনন্দ বিধানে বসে সহ শিষ্যবর।।
বসিলেন মুনিগণ যথাযোগ্য স্থান।
যুধিষ্ঠির পঞ্চ ভাই হরিষ বিধান।।
অন্ন পরিবেশনাদি করে সবে আনি।
বাটিয়া ব্যঞ্জন অন্ন দেন যাজ্ঞসেনী।।
সবে অতি শীঘ্রহস্ত ভাই পঞ্চ জন।
যেই তাহা চাহে, তাহা দেন সেইক্ষণ।।
অপরূপ দেখ তার দৈবের করণ।
একবার একদ্রব্য করয়ে রন্ধন।।
আপনার ইচ্ছাবশে যত করে ব্যয়।
সূর্য্য অনুগ্রহে পুনঃ পরিপূর্ণ হয়।।
স্থানে স্থানে বসিলেক ব্রাহ্মণ মণ্ডলী।
ভোজন করেন সবে বড় কুতূহলী।।
না জানি খায় বা কত, দেয় কত আনি।
খাও খাও বলে সবে, এই মাত্র শুনি।।
অবিলম্বে তাহা পায় যাহা অভিলাষী।
ভোজন করিল দশ সহস্র তপস্বী।।
অনন্তরে উঠি সবে করে আচমন।
সাধু সাধু ধন্যবাদ দেয় সর্ব্ব জন।।
দুর্ব্বাসা বলেন, রাজা তুমি ভাগ্যবান।
নহিল নহিব আর তোমার সমান।।
এমন প্রকার যদি পাই বনবাস।
তবে আর কিবা কার্য্য স্বর্গে অভিলাষ।।
তোমার ভ্রাতারা সবে মহা শুণবান।
দ্রুপদ নন্দিনী হয় লক্ষ্মীর সমান।।
ভোজনে যেমন তৃপ্ত হইলাম আমি।
এইমত নিরন্তর হবে তুষ্ট তুমি।।
কদাচিৎ চিন্তা কিছু না করিহ মনে।
খণ্ডিবে তোমার দুঃখ অতি অল্প দিনে।।
তোমারে দিলেক দুঃখ যাহার মন্ত্রণা।
মজিবে তাহার বংশ পাইয়া যন্ত্রণা।।
কহিলাম ধর্ম্মপুত্র, মিথ্যা নহে বাণী।
দ্রৌপদী দেখহ এই লক্ষ্মী-স্বরূপিণী।।
বিদায় করহ শীঘ্র, যাই তপোবন।
শুনিয়া কহেন তবে ধর্ম্মের নন্দন।।
সফল এ জন্ম কর্ম্ম মানিনু আপনি।
যাহে এত কৃপা করে কৃপাসিন্ধু মুনি।।
মম এই নিবেদন তোমার অগ্রেতে।
কদাচিৎ বিচলিত নহি সত্যপথে।।
দুর্ব্বাসা বলেন, রাজা তুমি পুণ্যবান।
পৃথিবীতে নাহি আর তোমার সমান।।
সত্য করি কহি কথা, শুন দিয়া মন।
যবে গিয়াছিনু আমি হস্তিনা ভুবন।।
সেবাতে করিল বশ রাজা দুর্য্যোধন।
হেথায় আসিতে মোরে কহে পুনঃ পুনঃ।।
বিনয় করিয়া মোরে পাঠাইল হেথা।
দশ দণ্ড রাত্রি পর তুমি যাবে তথা।।
মনেতে করিল সেই নিশাকালে গেলে।
অতিথি সেবিতে নারি পড়িবে জঞ্জালে।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন, শুন মহামুনি।
সম্পদ বিপদ মোর দেব চক্রপাণি।।
আর এক নিবেদন শুন, মহাশয়।
তুমি যে আসিলে হেথা মোর ভাগ্যোদয়।।
তোমার চরণে যদি থাকে মোর মন।
আমারে করিতে নষ্ট নারে অন্যজন।।
এত বলি ধর্ম্মপুত্র নমস্কার কৈল।
সন্তুষ্ট হইয়া মুনি আশীর্ব্বাদ দিল।।
আর চারি ভাই তবে বন্দে মুনিরাজে।
সেই মত সম্ভাষণ করে শিষ্যমাঝে।।
সবে আশীর্ব্বাদ করি বেদ বিধিমতে।
তুষ্ট হয়ে সর্ব্বজন চলে পর্ব্ব পথে।।
আনন্দিত ভ্রাতৃসহ ধর্ম্মের কুমার।
দুর্য্যোধন পায় ক্রমে সব সমাচার।।
পরাণে কাতর দুষ্টবুদ্ধি দুরাশয়ে।
অসহ্য বজ্রের প্রায় বাজিল হৃদয়ে।।
আহারে অরুচি, চিত্ত সতত চঞ্চল।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সদা, শরীর দুর্ব্বল।।
এইরূপে দুর্য্যোধন চিন্তাকুল হয়ে।
একান্তে বসিল যত পাত্রমিত্র লয়ে।।
ত্রিগর্ত্ত শকুনি কর্ণ দুঃশাসন আদি।
হেনকালে কহে রাজা কর্ণেরে সম্বোধি।।
ভারতের কথা ব্যাসদেবের রচন।
কাশীরাম রচে ছন্দে দুর্ব্বাসা পারণ।।