৯০তম অধ্যায়
উত্তরদিক্স্থিত যমুনাদি তীর্থ
ধৌম্য কহিলেন, “হে বীর! উত্তরদিকে যে সমস্ত তীর্থ আছে, তাহা কীর্ত্তন করিতেছি, অবহিত হইয়া শ্রবণ করুন। যাহা শ্রবণ করিলে সাত্ত্বিকী শ্ৰদ্ধা সমুৎপন্ন হয়, যে প্রদেশে মহাপুণ্যা সরস্বতী ও বেগবতী স্রোতস্বতী যমুনা প্রবাহিত হইতেছে, যে প্রদেশে পুণ্যতম প্রক্ষাবতরণ-তীর্থ সন্নিবেশিত আছে, দ্বিজগণ বিল্বদণ্ডদ্বারা যজ্ঞ সম্পন্ন করিয়া অবভৃথ [যজ্ঞাম্তস্নানে- যজ্ঞসমাধানন্তর স্নান]-স্নানানন্তর তথায় গমন করেন।
“অগ্নিশিরনামে বিখ্যাত পবিত্র কল্যাণকর এক তীৰ্থ আছে, তথায় রাজা সহদেব শম্যাক্ষেপ-যজ্ঞ করিয়াছিলেন। তিন্নিমিত্ত ব্ৰাহ্মণগণ এই ইন্দ্ৰগীতগাথা অদ্যাপি গান করিয়া থাকেন, সহদেব যমুনাসমীপে কোটিসুবৰ্ণ দক্ষিণা দানপূর্ব্বক অগ্নির অৰ্চনা করিয়াছিলেন।” মহাযশাঃ সার্ব্বভৌম ভরত সেই স্থানেই পঞ্চত্রিংশদ্বার অশ্বমেধ-যজ্ঞ করিয়াছিলেন। দ্বিজাতিগণের অভীষ্টফলপ্ৰদ শরভঙ্গ-ঋষির বিখ্যাত পুণ্যাশ্রম ঐ স্থানে প্রতিষ্ঠিত আছে।
“সরস্বতী নদী সাধুগণের অতি পূজনীয়। পূর্ব্বকালে বালখিল্য ঋষিগণ তথায় যজ্ঞ করিয়াছিলেন। সে প্রদেশে দৃষদ্বতী নদীও তদ্রূপ মহাপুণ্যা বলিয়া বিখ্যাত। যে প্রদেশে ন্যাগ্রোধাখ্য, পুণ্যাখ্য, পাঞ্চাল্য, দালভ্যঘোষ ও দাল্ভ্য এই কয়েকটি স্থান অনন্তযশাঃ অমিততেজাঃ মহাত্মা সুব্রতের আশ্রম বলিয়া ত্ৰিভুবনে প্রসিদ্ধ আছে। পূর্ব্বে অর্ণ ও অবর্ণনামে বিখ্যাত বেদজ্ঞ ঋষিদ্বয় তথায় প্রধান প্রধান যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন। তত্ৰত্য বিশাখযূপে ইন্দ্রাদি দেবগণ একত্র মিলিত হইয়া তপস্যা করিয়াছিলেন, এই নিমিত্ত ঐ স্থান পুণ্যতম বলিয়া বিশ্রুত হইয়াছে।
“মহাভাগ মহাযশাঃ জমদগ্নি ঋষি অতি রমণীয় পলাশ-তীর্থে বাস করিয়াছিলেন; সমুদয় তরঙ্গিণী স্ব স্ব সলিল গ্রহণপূর্ব্বক তথায় উপস্থিত হইয়া সেই ঋষিশ্রেষ্ঠকে উপাসনা করিয়াছিল। বিশ্বাবসু গন্ধর্ব্ব সেই মহাত্মার দীক্ষা নিরীক্ষণ করিয়া স্বয়ং এই গাথা গান করিয়াছিলেন, ‘মহাত্মা জমদগ্নি দেবগণের নিমিত্ত যজ্ঞ করিতেন এবং নদীসকল তথায় আগমন করিয়া মধুদ্বারা বিপ্রগণকে পরিতৃপ্ত করিত।’
“যে প্রদেশে ভাগীরথী, গন্ধর্ব্ব, যক্ষ, রক্ষা ও অন্সরাসেবিত কিরাত ও কিন্নরগণের আলয় হিমালয়পর্ব্বতকে বেগপ্রভাবে বিদীর্ণ করিয়াছেন, সেই স্থান অতিপবিত্ৰ গঙ্গাদ্বার বলিয়া বিখ্যাত ও ব্ৰহ্মর্ষিগণ। তথায় সতত বাস করিয়া থাকেন।
“সনৎকুমার, কনখল ও পুরূরবার জন্মস্থান পুরুনামক পর্ব্বত অতিপবিত্র তীর্থ, যে স্থানে মহর্ষি ভৃগু তপস্যা করিয়াছিলেন, সেই আশ্রমীভূত মহাগিরি ভৃগুতুঙ্গ বলিয়া বিখ্যাত হইয়াছে।
“যিনি ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্ত্তমানের কর্ত্তা, সনাতন পুরুষোত্তম, বিশাল বদরীতে সেই ভূতভাবন ভগবান বিষ্ণুর ত্ৰিলোক-বিখ্যাত আশ্রম; পূর্ব্বে যে স্থানে শীতল-জলবাহিনী গঙ্গা উষ্ণজলপ্রবাহিণী ও সুবর্ণসিকতা হইয়া প্রবহমানা হইতেন, মহাভাগ ঋষি ও দেবগণ প্ৰতিনিয়ত তথায় আগমন করিয়া নারায়ণদেবকে নমস্কার করেন। যে স্থানে সনাতন পরমাত্মা নারায়ণ আছেন, সেই স্থানেই সমস্ত জগৎ, সমস্ত তীর্থ ও সমস্ত পুণ্যায়তন। সেই পরম-পুরুষই পরমপবিত্র, তিনিই ব্রহ্ম, তিনিই তীর্থ, তিনিই তপোধন, তিনিই পরম দেবতা; তিনিই ভূতগণের পরমেশ্বর, পরম বিধাতা; তিনিই সনাতন ও পরম পরমপদ।। জ্ঞানিগণ তাঁহাকে জানিয়াই আর শোক করেন না। যে স্থানে আদিদেব মহাযোগী মধুসূদন, সেই স্থানেই সমুদয় দেবর্ষি, সিদ্ধ ও তপোধনগণ। তিনিই পুণ্যের পুণ্য, তাহার সন্দেহ নাই।
“হে রাজন! পৃথিবীতে যে সকল তীর্থ ও পুণ্যায়তন আছে, তাহা কীর্ত্তন করিলাম। বসু, সাধ্য, আদিত্য, মরুৎ, অশ্বি ও দেবকল্প ঋষিগণ এই সকল তীর্থের সেবা করিয়া থাকেন। আপনি ব্রাহ্মণ ও ভ্রাতৃগণের সহিত এই সকল তীর্থে বিচরণ করুন, তাহা হইলে আপনার উৎকণ্ঠার শান্তি হইবে, সন্দেহ নাই।”