সে পালাতে পারবে না, জানত। তবু দৌড়োচ্ছিল, প্রাণপণে দৌড়োচ্ছিল গলি থেকে গলিতে। আরও গলিতে। এসব অলিগলি তার মুখস্থ, হাতের তেলোর মতো চেনা। কোনদিক দিয়ে বেরোতে হবে, সে জানে। পিছনে এক জোড়া, মাত্র এক জোড়া পা-ই দৌড়ে আসছে। শবর দাশগুপ্ত। লালবাজারের টিকটিকি। ওর কাছে পিস্তল আছে। ইচ্ছে করলেই চার্জ করতে পারে। করছে না। পিস্তল তার কাছেও আছে। ইচ্ছে করলে সেও চার্জ করতে পারে। করছে না। করে লাভ নেই।
তবু সে দৌড়োচ্ছ কেন? পালাচ্ছে? না, সে পালাতে চাইলে পারবে। কিন্তু তা নয়। সে দৌড়োচ্ছে নিজের হাত থেকে, নিজেকে ছাড়াতে। না, ঠিক বোঝা যাবে না। কেউ বুঝবে না। এই অবোধ্য জীবন তার কত কী কেড়ে নিয়েছে। তার কত কী চলে গেছে ভেসে সময়ের জলে।
সামনে ডানহাতে একটা কানা গলি। সে ডানদিকেই ফিরল। দৌড়োতে লাগল। তারপর সোজা গিয়ে ঠেকল দেয়ালটায়। থামল। ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল। দেয়ালে পিঠ রেখে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। শুনশান গলি৷ দুরে গলির মুখ। সেখানে শবর দাশগুপ্ত এসে দাঁড়াল। না, পিস্তলে হাত দেয়নি। দূর থেকে তাকে দেখল। তারপর ধীর পায়ে হেঁটে আসতে লাগল তার দিকে। দুপুরের রোদ খাড়া হয়ে পড়েছে। শবরকে দেখাচ্ছে। ছোটখাটো, পায়ের নীচে বেঁটে ছায়া।
সেও পিস্তলে হাত দিল না। ফালতু। এখন আর এসব করে লাভ কী!
শবর সামনে এসে দাঁড়াল, পালালে কেন?
পালালে কি ধরতে পারতেন?
খামোখা এতটা দৌড়োনোর মানে হয় না।
হয়। এত সহজে ধরবেন, একটু গা ঘামাবেন না, তা কি হয়?
শবর একটু হাসল, সহজে ধরেছি কে বলল? অনেক চক্কর খেতে হয়েছে।
একটা কাজ করলেন, আপনার মতে ভাল কাজ, পরিশ্রম তো সার্থক।
তুমি তো বেশ কথা বলো!
পিস্তলটা চাইলেন না?
না। তুমি আমাকে গুলি করবে না, জানি।
কেন করব না?
তুমি বুদ্ধিমান বলে। আমাকে মারা যায়, কিন্তু সিস্টেমকে কি মারতে পারবে? অতীতকে মারতে পারবে? যা ঘটে গেছে তাকে মারতে পারবে?
না।
তাই চাইনি। আমি হিরো নই, লজিক্যাল।
আপনিও বেশ কথা বলেন!
শবর একটু হাসল। মৃদু স্বরে বলল, মেয়েটাকে মারলে কেন?
মেয়েটার মরাটা দেখলেন, আমার মরাটা লক্ষ করলেন না?
শবর ম্লান একটু হাসল, তাও দেখছি।
আমি কবে মরে গেছি জানেন? আরও দশ বছর আগে।
শবর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
আপনি কি বিশ্বাস করেন স্যার,আমি পালাচ্ছিলাম?
না। পালাতে চাইলে তুমি এই কানাগলিতে ঢুকতে না। কিন্তু তুমি পালালে আমি খুশি হতাম।
সে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে শবরের দিকে চেয়ে হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠল। দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলল। কিছুক্ষণ সময় লাগল সামাল দিতে। তারপর মুখের ঢাকা খুলে তার তীব্র চোখদুখানা শবরের চোখে স্থাপন করে বলল, লোকে জানে, আমি মেয়েটাকে নিয়ে পালিয়েছিলাম, লোকে জানে আমি ওকে নষ্ট করেছি। পুলিশ আমাকে এমন মারল, যে, একটা কিডনি নষ্ট হয়ে গেল। অপটিক নার্ভ জখম হয়ে আমার বাঁ চোখ হয়ে গেল কমজোরি, ভবিষ্যতে অন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ও থেকে গেল। আমার সেক্সয়াল আর্জ চলে গেল। তার চেয়েও অনেক বেশি ক্ষতি হল, আমার পড়াশুনার। আমার ক্যারিয়ারের। মায়ের কাছে আমার মার্কশিট আছে স্যার। দেখে নেবেন।
দেখতে হবে না। বোর্ডে গিয়ে তোমার মার্কশিটের রেকর্ড আমি চেক করেছি।
স্তিমিত চোখে চেয়ে বলল, কী হল স্যার? বস্তিতে থাকি, গরিবের ছেলে, ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করেছিলাম, আমার সামনে ব্রাইট ফিউচার খুলে গিয়েছিল। কিন্তু কী হল স্যার? কী হল বলুন। এই মার্কশিট ধুয়ে কি জল খাব?
তুমি তখন মস্তানি করতে?
মস্তানি কি খারাপ স্যার, যদি তার পিছনে মর্যালিটি থাকে? ব্যায়াম করতাম, খেলাধুলোয় ভাল ছিলাম, গায়ে জোর ছিল, বুকে সাহস ছিল, তাই পাড়া শাসন করে বেড়াতাম। লোকাল থানায় খোঁজ নেবেন স্যার, আমার তখনকার লাইফে কোনও খারাপ রেকর্ড নেই। কোনও চুরি, ছিনতাই, দু’নম্বরি করিনি। কিন্তু বস্তির ছেলে তো, বুক ফুলিয়ে বেড়াতাম বলে ভদ্রলোকরা ভয় পেত। বলত, মস্তান।
মেয়েটার কথা বলো।
মিতালির কথা তো আপনিও জানেন স্যার। বড়লোকের মেয়ে, মাথাটা খাওয়াই ছিল। আমাকে লাইন দেওয়া শুরু করেছিল কবে থেকে, তখন ফ্রক পরত। চিঠি চালাচালি করত, ইশারা ইঙ্গিত করত। তারপর সিনেমায়টিনেমায় নিয়ে গেছি। গরম মেয়ে স্যার। বলতে লাগল, আমাকে নিয়ে পালাও। তখন আমি সায়েন্স নিয়ে কলেজে পড়ছি। ভাল রেজাল্ট করতে হবে বলে খাটছি, অন্যদিকে আমার মাথা খাচ্ছে মিতালি। ওই বয়স তখন আমার, ফাস্ট লাভ। সুন্দরী মেয়ে। বাপ বড়লোক। সব জেনেবুঝেও বয়সের দোষে ঝুলে পড়লাম। পড়া গেল, ক্যারিয়ার গেল। লোকে বলে, আমি ওকে নষ্ট করেছি। লোকে দেখল না, ও আমাকে কতটা নষ্ট করেছিল। বড়লোকের তো দোষ হয় না। মিতালি ফিরে গেল, বাপের কাছে, ক্ষমা হয়ে গেল, পড়াশুনো করতে লাগল, বিয়ে হল, আমেরিকা গেল। এমনকী অত ভাল পাত্র মিঠু মিত্তিরকে ডিভোর্স করার মতো আস্পর্ধাও দেখাল। মিতালির কি কিছু লস হল স্যার? কিছু না। জীবনটা টালও খেল না, ক্যারিয়ার বিল্ড আপটা দেখুন স্যার। আর অন্য দিকে আমাকেও দেখুন। জীবনটা শুরু করেছিলাম কী দুর্দান্ত। গরিব ঘরের ছেলে, প্রাইভেট মাস্টার দূরের কথা বইপত্তরই জোগাড় হয় না। পুষ্টিকর খাবার নেই। পড়াশুনোর জায়গা জুটত না। তবু ওরকম রেজাল্ট। কত কী করতে পারতাম স্যার। বাপ-মা কত স্বপ্ন দেখত আমাকে নিয়ে। পুরো ধস নেমে গেল। মিতালির দোষ কেউ দেখল না, দেখলেও চোখ ফিরিয়ে নিল। আর আমাকে? প্রথম অপমান আর তাচ্ছিল্য করে গেল মিতালি। তারপর পুলিশ তুলে নিল। তারপর আপনি সব জানেন…
জানি।
আজ আমি পালাব কেন স্যার? পালিয়ে কোথায় যাব? আমার হারানোর কিছু নেই। জিজ্ঞেস করছিলেন মেয়েটাকে মারলাম কেন? আপনি বুদ্ধিমান, কেন মারলাম তা কি বোঝেননি? হাসপাতালে পুরো দু’মাস থাকতে হয়েছিল। হাজতে চার মাস। পুলিশ কেস দিলে আরও কতদিন মেয়াদ হত কে জানে। বরুণ ঘোষ বেশি চাপাচাপি করেনি পাবলিসিটির ভয়ে। তাই ছেড়ে দিয়েছিল। ছাড়া পেয়ে কী হল স্যার? পাড়ায় সবাই দুয়ো দিত। পড়াশুনোর আর্জ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল আগেই। তার ওপর শরীর। বাইরে থেকে ভিতরের ভাঙচুর দেখতে পাবেন না স্যার। বলছিলাম না, মিতালি মরল সেদিন, আমি মারা গেছি অনেক আগে। কিন্তু একটা হিসেব তো মেটাতে হবে। ডিভভার্সের পর একদিন মিঠু মিত্তির আমাকে পিটিয়েছিল, আগেই বলেছি স্যার। বলিনি?
বলেছ। কিন্তু মিঠু মিত্তির টের পেয়েছিল সে একটা মরা মানুষকে পেটাচ্ছে। তাই মিঠু মিত্তির আমার সঙ্গে ভাব করে নেয়। শুধু তাই নয়, আমার সব কথা শুনে দয়া করে নিজের রিস্কে ট্যাক্সির লোন বের করে দেয়। নিজের পকেট থেকে টাকাও দিত সময়ে সময়ে। আমরা দোস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। মিঠু মিত্তিরকে কী করেছিল স্যার আপনাদের সুন্দরী বড়লোক মিলি? মিঠু মিত্তিরের দোষটা কী ছিল বলবেন? তার জীবনটাও বরবাদ করে যায়নি কি ওই…যাক স্যার, আজ খারাপ কথা বলব না।
স্থির, অপলক, করুণ দু’খানা চোখে চেয়ে রইল শবর। কিছু বলল না।
হিসেবটা মেটানোর ছিল স্যার। আমার যে জীবনটা মিতালি কেড়ে নিয়েছে তা ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্য ছিল মিতালির? ছিল না স্যার। আমি বহু বছর ধরে তার দেশে ফেরার জন্য ওত পেতে অপেক্ষা করেছি।
তুমি হয়তো জানো না, মিতালিও খুব হ্যাপি ছিল না।
মিলি হ্যাপি ছিল কি না তা জেনে আমার কী হবে স্যার? আমার একটা কিডনি নেই। আপনি জানেন না আমার সেক্স আর্জ চলে গেছে। পুরুষের পক্ষে কত যন্ত্রণার ব্যাপার বলুন, বিছানায় মেয়েমানুষ, সে কিছু করতে পারছে না। পাগলের মতো হয়ে যাচ্ছে পুরুষত্বহীনতায়। এই নষ্ট জীবন নিয়ে বেঁচে আছি কি মিতালিকে হ্যাপি দেখতে স্যার? আমি তো মহাপুরুষ নই। আপনাকে রীতা দাসের কথা বলেছি। যদি কখনও তাকে পান জিজ্ঞেস করবেন। সে আপনাকে বলবে কীভাবে সেক্সয়াল আর্জের অভাবে আমি মাথা কুটেছি আর কেঁদেছি।
সে বলেছে।
বলেছে? যাক বাঁচা গেল। আপনি তা হলে আমার জ্বালাটা একটু বুঝবেন। পার্টির দিন যখন ওরা ফুর্তি মারছিল তখন আমি মরুভূমি বুকে নিয়ে দুর থেকে ওদের ঘরে আলোর রোশনাই দেখেছি। মাতালের হল্লা শুনেছি। আপনাকে মিথ্যে কথা বলেছিলাম স্যার। সেই রাতে আমি মাতাল হইনি।
জানি। বলো।
রাত সাড়ে বারোটায় আমি দোতলায় উঠি। পিছন দিক দিয়ে। ঘরে ঢুকি। মিতালি তখন মাতাল। জামাকাপড় খোলার চেষ্টা করছে। দু’বার মেরেছিলাম। একটা আমার জন্য। আর
একটা মিঠু মিত্তিরের জন্য।
শবর হঠাৎ ডান হাতটা বাড়িয়ে বলল, এবার পিস্তলটা আমাকে দাও পান্টু।
পান্টু একটু হাসল, সুইসাইড করব বলে ভয় পাচ্ছেন স্যার? আরে না। এখন সুইসাইড করে লাভ কী বলুন? আপনারও বদনাম হবে। লোকে বলবে শবর দাশগুপ্ত নিজেই পান্টুকে মেরে সুইসাইড কেস সাজিয়েছে। মরে আর কী হবে? মরা লোক কি দোবারা মরে স্যার? তবে জজসাহেবকে বলবেন, ওসব যাবজ্জীবনটিবন আমার ভাল লাগে না। ফালতু চৌদ্দ বছর শুয়ে বসে থাকা। তার চেয়ে ঝটপট ট্রায়ালটা মিটিয়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেন যেন। বলবেন স্যার?
শবর একটু হাসল।
অ্যারেস্ট করবেন না স্যার?
শবর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, পালাতে পারতে। কেন যে পালালে না!
বললাম তো স্যার, কোথায় পালাব? কার কাছ থেকে পালাব? আমার ফিলজফিটা আপনি বুঝতে পারছেন না স্যার?
পারছি। পান্টু অধিকারী, ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট।
.
এটাই কি সেই দীর্ঘ চুমু?
না। এটা অন্য। আর একরকম। অনেক বিষণ্ণ, অনেক গভীর।
জানি। আজ তো তুমি আর সেই তুমি নও। আজ তুমি অনেক বিষণ্ণ, কত গম্ভীর।
আজ আমি অনেক গভীরও। তাই না?
আমরা কি সুখী হব, বলো না!
কে জানে! কেউ তা বলতে পারে না।
আমরা কোনওদিন তেমন সুখী হতে পারব না বোধহয়! হ্যাগো, একটা কথা বললে তুমি কি রাগ করবে?
রাগ! ফুলশয্যার রাতে? তাও কি হয়?
শোনো, আমরা কেন সব ওদের দিয়ে দিই না?
মিঠু নিবিড়ভাবে জয়িতার মুখের দিকে চেয়ে রইল। মুখে মিটিমিটি হাসি। মৃদু স্বরে বলল, কাকে দেবে? কী দেবে?
দোয়েল তো আসলে জ্যাঠামশাইয়ের বউই, বলো? প্রীতীশ তো ছেলে। হ্যাগো, কেন ওদেরই সব দিয়ে দিই না আমরা?
জানতাম।
কী জানতে?
তুমি যে এই কথা বলবে।
তুমি বুঝি অন্তর্যামী?
হ্যাঁ। ভালবাসলে মনের কথা টের পাওয়া যায়, জানো না?
আমিও তোমার মনের কথা টের পাই।
কীরকম?
তুমিও চাও। তাই না? তুমিও চাও ওরা সব নিয়ে নিক।
চাই। কিন্তু আস্তে আস্তে। একবারে অত সম্পত্তি হাতে পেলে ওরা দিশাহারা হয়ে যাবে। লোকে ওদের এক্সপ্লয়েট করবে। ছেলেটা আদরে নষ্ট হবে। ধীরে, বন্ধু ধীরে।
আমি বোকা নই তো!
না। তুমি খুব ভাল।
তুমিও। আমরা কি সুখী হব? বলল না!
সুখ চাও? সুখ মানুষকে অলস করে দেয়, ভোঁতা করে দেয়, সুখ থেকে মেদবৃদ্ধি হয়। আমরা সুখ চাইব কেন?
তা হলে?
একটু সুখের সঙ্গে মাঝে মাঝে একটু দুঃখ মিশিয়ে দেওয়া যাবে। ককটেল। ব্যালান্স।
আমি জানি পান্টুর জন্য তোমার মন ভাল নেই। মিতালিদির জন্য তোমার মন ভাল নেই। দোয়েলের জন্য তোমার মন ভাল নেই। আমি কী করে তোমাকে ভোলাব বলো তো! পারব?
না জয়িতা, ভোলানোর দরকার নেই। এ সবই আমাদের চেতনায় নাড়া দেবে। আমাদের তাকাতে শেখাবে নিজেদের দিকে। দুঃখকে কি তুমি ভয় পাও?
তুমি কাছে থাকলে কিছুকেই ভয় পাই না।
ঠোঁটটা বাড়িয়ে দিল জয়িতা।
মিঠু হেসে বলল, দীর্ঘ চুমু? না। পৃথিবীর দীর্ঘ দীর্ঘতম চুমু–