০৮.
সিগারেটের শেষ অংশটা বাজে কাগজের ঝুড়িতে টোকা মেরে ফেলে দিয়ে হ্যাকেট হুইসাল এর মতো শিস্ দিয়ে উঠল। আপনি তাহলে নিশ্চিত যে, লোকটা হফম্যান নয়?
না, এ লোক সে নোক নয়, যন্ত্রণাও পাদুটো কোন ক্রমে সোজা রেখে বসলাম। সারা শরীর জুড়ে ব্যথা, যন্ত্রণার এই চিহ্ন দেখে মনে হচ্ছিল, একটা ট্রেন যেন আমার ওপর দিয়ে চলে গেছে।
লস-এঞ্জেলসগামী একটা গাড়ীর লোকেরা আমার আর্তচিৎকার তাদের কানে না পৌঁছত। তাহলে হয়তো কোনদিনই এখানে পৌঁছবার ক্ষমতা আমার হতো না। পাহাড়ের গায়ে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ার দৃশ্যটা হয়তো দুঃস্বপ্নের আকার নিয়ে আমাকে অনেকদিন তাড়া করে ফিরবে। ..হফম্যান যেমন লম্বা তেমন বিশাল চেহারা। তবে অনেকটা বেঁটে, সেই সঙ্গে স্বাস্থ্য বেশ ভালো। পেট্রলপাম্পের ছোকরাটাকে জেরা করে তার মুখ থেকে কিছু পেলেন?
আমরা যখন সেখানে পৌঁছাই, সে হাতের বাইরে চলে গিয়েছিল। আপনার বন্ধু তাকে মাথার পিছন দিক থেকে গুলি করেছে।
উঃ! রাগে আর বিরক্তিতে ফেটে পড়তে মন চাইছিল।মনের এই ইচ্ছাকে দমন করে বললাম, রাইস কী বলছে?
সে এখান থেকে পালিয়ে যেতে পারলে বাঁচে,মিকলিন বলে উঠল। স্ত্রী যে জীবিত নেই একথা সে টের পেয়ে গেছে।
কিডন্যাপারদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎহবার বহু আগেই সে এ বিষয়ে জানত। মীরা ল্যাসটিস আর রাইসের মধ্যে সংলাপগুলো তার কাছে খুলে বললাম।
তাহলে এই ঘটনার সঙ্গে সে-ও জড়িত,সব শোনার পর চিন্তিত কণ্ঠে প্রকাশ করল হ্যাকেট।
ভিন্নমুখী দুটো সূত্রধরে আমরা কাজে এগোতে পারি, আমি বললাম। একটা, জোইস শারম্যান স্যালনকে হত্যা করার পর হফম্যান তাকে ব্ল্যাকমেল করছিল, যার জন্য সে কিডন্যাপ হবার নাটক করে মুক্তিপণের টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যাবার চেষ্টায় আছে। আর তা যদি না হয়, জোইসের অবধারিত অধঃপতন দেখে, মীরা ল্যাসটিসকে বিয়ের জন্য রাইস নিজেই স্ত্রীকে কিডন্যাপ করেছে। এর মধ্যে যে কোন একটা সম্ভাবনা সত্যি হতে পারে। রাইসের যদি এ ব্যাপারে হাত থাকে, তাহলে যে লোকটা আমাকে প্রাণে মারার চেষ্টা করেছে, সে অবশ্যই তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করবেইকারণ, প্রথমতঃ মুক্তিপণের পুরো টাকাটাই তার হাতে, আর দ্বিতীয় হল, রাইসেরও তাতে অংশ আছে। আপনারা কয়েকজন লোককে ওর ওপর দিবারাত্রি পাহারায় রাখার ব্যবস্থা করছেন না কেন?
ঠিক বলেছ, হ্যাকেট বলল। আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
আর যদি কিছু বলার না থেকে থাকে আমার একটু ঘুমের প্রয়োজন। আমি বলে উঠলাম। আপনারা এবার কী করবেন?
আমাদের সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে, গম্ভীর কণ্ঠে মিকলিন জবাব দিল। আমাদের এখন কাজ হল কিডন্যাপারটার পিছু নিয়ে মিস শারম্যানকে খুঁজে বার করা।
দায়িত্ব ওরা ওদের ঘাড়ে নিচ্ছে শুনে খুশী হলাম। প্রচুর ধৈর্য আর সুসংবাদ নিষ্ঠাচারের সঙ্গে অনুসন্ধানের প্রয়োজন এখানে একজনের কাজ এটা নয়। হয়তো লোকটা ধৈর্য হারিয়ে এমন কিছু ভুল করে বসবে যেটার মাধ্যমে সে আমাদের কাছে ধরা পড়ে যাবে। একমাত্র পুলিসের পক্ষেই এইরকম পরিস্থিতির মোকাবিলা করা সম্ভব।
একটা ট্যাক্সি ধরে কালভার হোটেলে ফিরে এলাম। লাউঞ্জের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ নিজের নাম শুনে পেছনে তাকাতেই দেখি, স্বয়ং অ্যালান গুডইয়ার আমার দিকেই এগিয়ে আসছে।
এ কি রে! চোট পেয়েছিস নাকি রে?আমার নোংরা ছিন্ন-বিছিন্ন পোষাকটা সে অবাক চোখে দেখছিল।
আরে না, সব ঠিক আছে, আমি হালকা গলায় বলে উঠি। খাণিকক্ষণ শুয়ে পড়লেই সব ঝরঝরে। তুই এখানে কী মনে করে?
তোর কথাই ভাবছিলাম। ফ্যান’শর কাছে খোঁজ নিতে মন চাইল না। এখানেই তোর অপেক্ষায় ছিলাম। কি হয়েছিল তোর?
সংক্ষেপে একে একে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো তার কাছে বলে ফেললাম। শুনে গুডইয়ার বলে উঠল, তোর ধারণা জোইসুকে সে মেরে ফেলেছে?
তাই তো মনে হচ্ছে।
পুলিশ বলছে লোকটাকে খুঁজে বার করবে?
পুলিসকে তো তুই বহুকাল ধরেই চিনিস। ওরা আশাবাদী সব সময়। আশাবাদী না হলে ওদের চলেও না। তবে আমি জোর গলায় বলতে পারি, রাইসও এর মধ্যে জড়িত। পুলিস আজ রাত থেকে তার ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখবে, সেই সঙ্গে ফোনও ট্যাপ করা হবে।
রাইস? গুডইয়ার যেন নিজের অজান্তে চমকে উঠল। কী করে বুঝলি এসবের মধ্যে তার হাত আছে?
ওর কিছু কথা আমার কানে এসেছে। সে আর মীরা ল্যাসটিস পালিয়ে যাওয়ার তালে আছে।
চলি রে অ্যালান, আর দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি নেই।
হ্যাঁ, নিশ্চই নিশ্চই। ডেকে শুধু শুধু বিরক্ত করলাম।
রাতের কেরানীটা এই সময় এগিয়ে এল। মিঃ হারমাস, দু-ঘণ্টা ধরে এক ভদ্রলোক আপনার খোঁজ করছেন। তার নাকি ভীষণ দরকার।
কি নাম?
নাম বলেননি। শুধু বলেছেন, চোয়ালের ঘুষিটা মনে করিয়ে দিলেই আপনি তাকে চিনে নেবেন?
মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত ক্লান্তি উবে গেল।
হফম্যান! উত্তেজিত হয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম গুডইয়ারের দিকে। হফম্যান ছাড়া এ আর কেউ নয়! কেরানীটাকে বললাম, কিছু বলতে বলেছে সে?
হ্যাঁ, আপনাকে ওশ্যন পার্কের কাছে ব্ল্যাক হোটেলে তাড়াতাড়ি যেতে বলেছেন।
আচ্ছা, ঠিক আছে। দরজার দিকে এগোতে এগোতে গুডইয়ারকে বলি, এই লোকটার সঙ্গে কথা আমায় বলতেই হবে। ওখানে হয়তো মিলে যাবে আমাদের হারানো বাড়ি।
তুমি যা আশা করছ তা নাও হতে পারে?আমার সঙ্গে সঙ্গেই হাঁটতে হাঁটতে চলতে থাকে গুডইয়ার। সকালে দেখা করলেই পারতিস। তিনটে বেজে গেছে। তোর কিছুক্ষণ, বিশ্রামের প্রয়োজন।
তুই বিশ্রাম নে, আমি মৃদু হাসলাম। আমার ওখানে যাওয়া খুবই জরুরী।
ওকে ওখানে ছেড়ে এক দৌড়ে সিঁড়ি ভেঙে এপাশ-ওপাশ তাকালাম। ট্যাক্সির সন্ধানে, সামনে এসে একটা দাঁড়াল। তাতে পা দিতে যাবো গুডইয়ার সেখানে হাজির।
আমিও যাব নাকি তোর সঙ্গে?
দরকার নেই। হফম্যান একজন সাক্ষীর সামনে মুখ খুলতে রাজী হবে না। ভাবিস না, আমি ভালোই আছি। আচ্ছা, চলিরে ফিরে এসে তোকে উপাখ্যান শোনাব।
এক ঝটিকায় ট্যাক্সির দরজা খুলে লাফিয়ে উঠে চালককে নির্দেশ দিইঃ ব্ল্যাক হোটেল, ওশ্যান পার্কের কাছে।…..
কুড়ি মিনিটের মধ্যেই সেখানে পৌঁছে গেলাম। জলের ধারে এদো জায়গায় হোটেলটা। ভাড়া নেবার সময় ট্যাক্সি চালকটি বলে ওঠেন, সাবধানে যাবেন, স্যার। এ পাড়াটা ভালো নয়। আমি কী এখানে অপেক্ষা করব।
না, তার আর দরকার নেই। ধন্যবাদ।
ট্যাক্সির পেছনের লাল আলোটা মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত ফাঁকা পথের ওপরই দাঁড়িয়ে রইলাম। জায়গাটা নিস্তব্ধ, ফাঁকা চারিদিক। আকাশের কালোপর্দার সামনে সমুদ্রে ভাসমান পাহাড়ের আলোগুলো জ্বলজ্বল করছে। জলে তাদের জ্যোতি ছড়াচ্ছিল।ব্ল্যাকস হোটেলের দিকে তাকালাম। উঁচু সরু বাড়ী। দরজার ওপরে নিয়ন আলোয় লেখা নাম।
কাঁচের দরজা দিয়ে ভেতর থেকে আলো এসে সামনের তৈলাক্ত পাশ-পথের ওপর ছড়িয়ে পড়েছে।
ধীরে পদব্রজে এগিয়ে এসে চার ধাপ সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলাম। কাউন্টারের পেছনে পাকানো চেহারার এক ছোট্টখাটো চেহারার লোক। মুখের সামনে কাগজ ধরা। চশমাটা নাকের ডগায়, আমাকে কতে দেখে কাগজটা একপাশে সরিয়ে ভাবলেশহীন চোখে আমার দিকে তাকাল।
একদম একা, দেখছি, কাউন্টারের ওপর ঝুঁকে হাসতে হাসতে বলে উঠলাম।
সঙ্গে সঙ্গে কাগজটা টেনে নিল সে। ডান হাতটা সঙ্গে সঙ্গে চলে গেল কাগজের নীচে। আমি জানি, ও হাতটা বর্তমানে গুপ্ত দেরাজে রাখা রিভলবারটার অনুসন্ধানে ব্যস্ত। লোকটার কুতকুতে চোখের কঠিন দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল, ওটা ব্যবহার করতে সে দ্বিতীয়বার চিন্তা করবে না।
কি বললেন? আর একবার বলুন তো? ভাঙা ভাঙা গলায় হিসহিস করে উঠল, চোখের দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে আমার প্রতি, তার থেকে এক চুল এদিক-ওদিক নড়ছে না।
থাক থাক, গুলিগালা চালাবার কোন প্রয়োজন নেই; হাতদুটো কাউন্টার থেকে একচুলও না সরিয়ে জবাব দিই। আপনার সঙ্গে আলাপ করার ইচ্ছে ছিল। এখন দেখছি আমারই ভুল হয়েছে। আমার নাম হারমাস। আমার এক বন্ধু এখান থেকে কিছুক্ষণ আগে যে ফোন করেছিল। সে আমার জন্য প্রতীক্ষায় আছে।
কি নাম তার?
নিজের নাম সম্বন্ধে সে বরাবরই একটু লাজুক, আসলটা এখানে ব্যবহার করেছে বলে আমার মনে হয় না। সেটা না জানলেই কী নয়, খুব দরকার?
চশমাটা নাকের ওপর টেনেটুনে ঠিক করে নিল লোকটা। কার্ড আছে আপনার?
নিশ্চয়ই, কিন্তু দোহাই আপনার, ওটা বের করার সময় গুলিফুলি মেরে বসবেন না। আমার রিভলবারটা পেছনের পকেটেই আছে। আপনাকে আগে ভাগেই জানিয়ে রাখলাম।
ওসব ন্যাকামির অভিনয় এখন থাক। ডানহাতটা কাগজের ওপর নিয়ে এল সে। এপাড়াটা খুব একটা সুবিধের নয়, আর আপনি আমাকে উত্তেজিত করে তুলেছেন অহেতুক।
আর ছিছি। কিছু মনে করবেন না। সব দোষ আমার। এতক্ষণে আরাম করে বসবার সুযোগ হল। আসলে আমার বলার ঢঙটাই একটু বিশ্রী হয়ে গিয়েছিল। মানি ব্যাগ থেকে নিজের একটা কার্ড বের করে এগিয়ে দিই।
কার্ডটা উল্টে-পাল্টে দেখে, মাথা নেড়ে আমাকে আবার ফিরত দিয়ে দিল লোকটা। চার তলার ঘর,নম্বর তিন। ঢোকার আগে বার চারেক টোকা মারবেন, না হলে পেটে কয়েকটা সিসের খণ্ড ঢুকে গেলেও আশ্চর্য হবো না।বলে চশমাটা নাকের ওপর নামিয়ে আবার কাগজে পড়ায় ডুবে গেল।
ধুলোয় ভরা রেলিং থেকে হাত বাঁচিয়ে ধীরে সুস্থে আমি একটার পর একটা সিঁড়ি ভেঙে উঠতে শুরু করলাম। চারতলায় আসতেই নীল হলুদ কিমোন পরা একটি মেয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল। হাতে একটা জগ নিয়ে এদিকে আসছিল ও। পায়ে জুতোর বালাই নেই, চুলগুলো কাঁধের ওপর এসে পড়েছে।
আমার দিকে মোহিনী হাসি ছুঁড়ে দিয়ে কিমোনটা একটু ফাঁক করে দেখিয়ে দিল মেয়েটা। দেখলাম, ভেতরে বিশেষ কিছু পরেনি। তারপর থমকে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলে উঠল, কি গো, পথ ভুলে এসেছো নাকি?
না, তোমাদের জীবনযাত্রা ঠিক কী রকম সেটাই দেখতে এসেছিলাম। ওর পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে বলে উঠলাম।
অশ্রাব্য এক গালি দিয়ে চলে গেল মেয়েটা। তিন নম্বর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে মুখের ঘাম মুছে নিলাম, তারপর আস্তে আস্তে টোকা মারলাম চারবার। ভয় হচ্ছিল, আশেপাশের ঘর থেকে কারো আবার কাঁচা ঘুম ভেঙে না যায়। দরজায় কান পেতে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ, কিন্তু ভেতর থেকে এবারও কোন সাড়াশব্দ পেলাম না। উল্টো দিকের একটা ঘরের মধ্যে থেকে ঘড় ঘড় নাকডাকার আওয়াজ ভেসে আসছিল। মনে হচ্ছিল, কাঁচের ওপর করাত চালাচ্ছে কেউ। অন্য দরজাগুলো অবশ্য খোলাই ছিল।
আবার টোকা, সামান্য একটু জোরে হয়ে গেল। সেই সঙ্গে চোরের মতো দু-পাশে তাকাতে লাগলাম। প্রতি মুহূর্তে মনে শঙ্কা জাগছিল এই বুঝি কেউ কিছু ছুঁড়ে মারল।
এবারও কোন সাড়া না পেয়ে ধীরে ধীরে হাতলটা ঘোরালাম। দরজা কিন্তু আগের মতোই শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে, নড়ার বিন্দুমাত্রা লক্ষণ নেই। চাবির ফুটোয় চোখ রেখে দেখি, ভেতরে আলো জ্বলছে। এবার আরো জোরে টোকা মারলাম।শব্দের জোর এবার এতো বেশী যে করাতের শব্দটা হার মেনে থেমে গেল তৎক্ষণাৎ। তবু কোন উত্তর নেই।
নাঃ ব্যাপার সুবিধের নয়। দু-পাশ একবার ভালো ভাবে চোখ বুলিয়ে, এক দৌড়ে বারান্দা পেরিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নামতে লাগলাম।
নীচে বসা কেরানীটা চশমাটা নাকের পেছনে ঠেলে আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে।
সে নেই, বাইরে গেছে? হাঁফাতে হাঁফাতে বললাম আমি।
কেন? সে তো আপনার অপেক্ষাতেই ছিল!
কাগজটা এক পাশে সরিয়ে রাখল লোকটা।
কই, কোন উত্তর তো পেলাম না! অথচ ঘরে আলো জ্বলছে–তবে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ আপনি কিছু করতে পারবেন, না আমি পুলিশের দ্বারস্থ হবো?
লোকটা এতো জোরে লাফিয়ে উঠল যেন বেয়নেটের খোঁচা খেয়েছে।বোকার মতো কাজ করবেন না। পুলিস-টুলিস এখানে ঢোকানো চলবে না। দেখুন সে হয়তো গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। নাক ডাকালে তার শব্দ পাওয়া আমার উচিত ছিল। আপনার কাছে চাবি আছে, না হলে তালাটা গুলি মেরে ভেঙে ফেলব?
আপনার সন্দেহ যদি এভাবে বাড়তে থাকে, সন্দেহ অবসানের জন্য আমিই যাচ্ছি।
চলুন তাহলে।
লোকটাকে আমার সামনে পেয়ে তাকে অনুসরণ করতে করতে উপরে উঠতে লাগলাম। চারতলায় পৌঁছে কিমোন পরা মেয়েটার সঙ্গে আবার দেখা।
কি গো, কার্লি? এত হিট কিসের? কেরানীটাকে বলে উঠল মেয়েটা।
দুর হ, নচ্ছার মাগি! ভাগ এখান থেকে, গলা না চড়িয়ে কেরানীটা বলে উঠল।
আমিতো ভাবলাম এক্ষুনি বুঝি তুলকালাম কাণ্ড বেঁধে যাবে। অস্বস্তিকর হাসি নিয়ে নিজেকে সরিয়ে আনল মেয়েটা।
ওঃ, কী চমৎকার লোকজন নিয়ে আপনার এই কারবার!–তিন নম্বর ঘরের দিকে এগোতে এগোতে আমি বললাম।
সে নিয়ে মন্তব্য করার কোন অধিকার আপনার আছে কি? ওদের ঠিকঠাক মতো চালাতে পারলে অসুবিধে হবার কথাও নয়। আর গণ্ডগোলের কোন সম্ভাবনাও থাকে না!
তিন নম্বর ঘরের দরজায় দুম দুম করে শব্দ করে উঠল লোকটা, অপেক্ষা করল কয়েক মুহূর্ত তারপর পিছিয়ে গিয়ে পায়ের চেটো দিয়ে সজোরে একটা লাথি কষাল দরজা লক্ষ্য করে।
ওসব ন্যাকা ন্যাকা অভিনয় ছেড়ে দিয়ে দরজাটা খুলুন দেখি, আমি মন্তব্য করে বসলাম।
আমার দিকে কটমট করে তাকাল সে, তারপর পকেট থেকে চাবি বের করে তালায় ঢুকিয়ে মোচড় দেবার পর একপাশে সরে দাঁড়াল। ও ঘাবড়ে যেতে পারে,বলেই হাতল ঘুরিয়ে দরজাটা ঠেলে খুলে দিল।
কিন্তু কিছু হল না। ভেতর থেকে কেউ গুলিও চালালো না। আমরা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে মুখ বাড়িয়ে ঘরের ভেতর দৃষ্টি দিলাম।
চেয়ারে বসে হফম্যান, শিথিল হয়ে দু-পাশে ঝুলে পড়েছে তার অবশ দুটো হাত। মাথাটা বুকে রয়েছে বুকের ওপর, কোটে আর মেঝেতে রক্তের দাগ।
খানকির বাচ্চা মরার জন্য কী শেষ পর্যন্ত এই জায়গাটা বেছে নিল, কেরানীটা ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে এই কথা বলে ফেলল।
ভেতরে ঢুকে হফম্যানের মাথাটা একবার তুলে আবার ধীরে সুস্থে নামিয়ে দিলাম। হাতটা এখনও গরম, তার মানে তার মৃত্যু বেশীক্ষণ আগে হয়নি।
আরে বাপ! হফম্যানের হাত স্পর্শ করে চেঁচিয়ে উঠল কেরানীটা। এযে দেখছি স্টোভের মতো গরম। আপনি দাঁড়িয়ে থাকুন এখানে। পুলিস আসার আগে কয়েকটা হারামজাদাকে এই সুযোগে রাস্তা দেখিয়ে আসি। দৌড়ে বেরিয়ে গেল সে।
ছোট্ট ঘরটায় আমি আমার পর্যবেক্ষণ শুরু করে দিলাম। ভোলা জানালা দিয়ে কনকনে শীতল সামুদ্রিক হাওয়া আর কুয়াশা ঢুকে আসছিল ঘরের মধ্যে। খুনি বোধ হয় এখানে আসার জন্য জানলার পাশে অগ্নিতারণ পথটা বেছে নিয়েছিল। হফম্যানের বুকের ক্ষতচিহ্নটা খুব সম্ভব মাংস কাটা ছুরি থেকেই তৈরী–কিন্তু অস্ত্রটা কোথাও চোখে পড়ল না। তার পকেটে উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না। বিছানার তলায় রাখা ছিল দুটো সুটকেস। কাছে আসার মতো তাতেও কিছু পেলাম না।
সহসা অসম্ভব ধরনের ক্লান্তি অবসাদ আমাকে আষ্টেপৃষ্টে দগ্ধ করছে, অথচ দুচোখে এক করার কোন সম্ভাবনাই নেই। হ্যাকেট না আসা পর্যন্ত আমার এখান থেকে নড়ারও কোন উপায় নেই। আর রাত শেষ হতে যতক্ষণ দেরী আছে, তার কাজ কর্ম দেখতে দেখতে কেটে যাবে। ওঃ, এই সময় একটু পানীয় পেলে কী ভালোই না হতো।
বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। ওখানে তখন কর্মকাণ্ডের হাট বসেছিল। পায়জামার ওপর কোন রকম জামা পরা, সুটকেস হাতে, তিনটে ষণ্ডা মার্কা চেহারার লোক আমাকে একরকম ধাক্কা মেরে নীচে নেমে গেল। তিন তলাতেও দুজন মেয়ে রাত্রিবাসের ওপর কোট, ওভারকোট চাপিয়ে সিঁড়ির দিকে হন্তদন্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছে।
টেলিফোন আগলে দাঁড়িয়ে আছে স্বয়ং কেরাণী নিজে। আমাকে দেখে বিষণ্ণ কণ্ঠে বলে উঠল, আর তিন মিনিট। হোটেলের খদ্দেরদেরও কিছুটা সুবিধা দিতেই হয়।
সবশেষে চোখে পড়ল বলিষ্ঠ চেহারার একটা লোক। তার ফ্যাকাশে সাদা মুখটা দেখে বার বার মনে হচ্ছিল, সবেমাত্র ভূতদর্শন হয়েছে। লোকটা তার থলথলে হাতটা কোনরকমে একবার কেরানীটার দিকে তুলে দরজা খুলে বেড়িয়ে গেল।
এই ছিল শেষ। দীর্ঘশ্বাস ফেলল কেরানীটা। ওদের সঙ্গে আমি কথা বলবো না, আপনি বলবেন?
আমিই বলছি। আমি টেলিফোনের দিকে হাত বাড়ালাম।
.
দরজায় ক্রমাগত টোকা পড়তে আমার গাঢ় ঘুমটা নিমেষের মধ্যে ভেঙে গেল। টেবিলে রাখা ঘড়িটার দিকে তাকালাম। দশটা বেজে দশ। সূর্যরশ্মি ঘরের বন্ধ খড়খড়ি দিয়ে ঢোকার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
অর্থাৎ রাত এখন দশটা দশ কখনোই নয়। কোনরকমে অঙ্গাবরণটা গায়ে চড়িয়ে দরজা খুলে দিলাম। হোটেলের ভৃত্য আমার হাতে একটা টেলিগ্রাম ধরিয়ে দিল। খুলে দেখি, হেলেনের নাম।
গতকাল দুপুরে কনিরা লটবহর সমেত দ্বীপ ছেড়ে চলে গেছে। দুপুরে আমার সঙ্গে এয়ারপোর্টে দেখা করো।
হেলেনের সঙ্গে দেখা হবার কথা মনে হতেই দেহে আপনা থেকে একটা জোর পেলাম। চটপট ফ্লাক্স থেকে তিন কাপ কফি খেয়ে, পুলিস সদর দপ্তরের দিকে হাঁটা লাগালাম।
সেখানে কিন্তু কিছুই পাওয়া গেল না। হফম্যানের খুনের ব্যাপারে সর্বপ্রথম সন্দেহ গিয়ে পড়ে রাইসের ওপর।
রাইসই যদি তার স্ত্রীকে আটক করে রাখে, তাহলে হফম্যানের মুখ বন্ধ রাখা তার একান্ত প্রয়োজন ছিল। কিন্তু যে দুজন গোয়েন্দা তার ওপর নজর রাখছিল, তারা জানিয়েছে, রাইস রাত্রে– আগে বাড়ী ছাড়া হয়নি।
ওদিকে জোইস শ্যারম্যান বা তার অপহরণকারীর খোঁজ এখনও না পাওয়ায় হ্যাকেটের মেজাজ ভীষণ ভাবে বিগড়ে গেল। আমি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে উঠলাম, আর আপনি এত ভাবছেন কেন? দেখবেন কেউ না কেউ খুব শীঘ্রই একটা ভুল পদক্ষেপ নিয়ে বসবে। তখন আমরা তাকে ঠিকই ধরে ফেলব।
সশব্দে নাক সিঁটকালো হ্যাকেট। আমার কথাটা তাকে প্রভাবিত করতে পেরেছে আমার কিন্তু মনে হয় না।
ওখান থেকে বেরিয়ে বিমান বন্দরে গিয়ে শুনি হেলেনের প্লেন কুড়িমিনিট দেরী করে আসছে। অগত্যা খাবার কাউন্টারে গিয়ে কফি নিয়ে বসে গেলাম।
নিশ্চিন্ত মনে কাপে চুমুক দিচ্ছি, এমন সময় কে যেন পাশ থেকে বলে উঠল, মিঃ হারমাস না?
মুখ তুলতেই চোখে পড়ে নিখুঁত পোষাক পরনে এক তরুণী আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।
প্রথমটায় ঠিক চিনতে পারিনি, তারপর বুঝতে পেরেই লাফিয়ে উঠলাম। মিসেস কনি! আপনি! শহুরে পোষাকে আপনাকে দেখতে অভ্যস্ত নই, তাই চিনতে একটু অসুবিধে হয়েছিল। তারপর, কেমন আছেন?
ওর সঙ্গে এভাবে দেখা হবে সত্যি আমার ধারণার অতীত। বুঝতে পারছি না এই সাক্ষাৎ দৈবাৎ না পরিকল্পিত।
হাসি হাসি মুখ নিয়ে আমার পাশের একটা টুল দখল করল ও। ভালোই। আমাকে দেখে অবাক হয়েছেন তো? আমারও একটু সন্দেহ জাগছিল আপনি না অন্য কেউ। এরকম অযাচিত ভাবে ডাকার জন্য রাগ করেননি তো?
আরে না না, আমি ভীষণ খুশি আপনাকে দেখে। কিন্তু ব্যাপার কি, লস এঞ্জেলসে কী মনে করে?
বুয়েনস এয়ারস যাচ্ছি আমি।
ও আচ্ছা। আপনার স্বামীও নিশ্চয়ই আপনার সঙ্গেই আছেন?
কথাটা শোনা মাত্র মুখটা কঁচুমাচু করে মাথা ঝাঁকিয়ে উঠল ও। না, আমি ওকে ছেড়ে এসেছি।
সে কী? কবে?
গতকাল রাত্রে।
কফি আনতে গিয়ে কোরিন তার বক্তব্য শুরু করল, এ দ্বীপটায় আমি আর মন বসাতে পারছি না। আর মজার কথা কী জানেন? এরজন্য যদি কাউকে দায়ী করা যায় সে আপনি আর আপনার স্ত্রী। বিশ্বাস করুন মিঃ হারমাস, আপনারাই ছিলেন সর্ব প্রথম যারা আমাদের গৃহে অতিথি হয়ে আসেন। আপনারা চলে আসার পর আমি মনকে শক্ত করে ফেলি, জ্যাক যদি ওখানে থেকে যায় থাক, আমি এখানে আর এক মুহূর্তও থাকবনা। একথা শুনে সে শুধু হেসেছিল। তবে আমার এই প্রস্তাবে আপত্তি করার পরিবর্তে এ কথায় রাজি হয়েছিল। দুনিয়ায় সাপ ছাড়া ও আর কিছুই চেনে না।
উনি তাহলে একাই ওখানে থেকে গেলেন?
না না, সেও আমার সঙ্গে এখানে এসেছিল। কিন্তু প্লেনে তুলে দেওয়া পর্যন্ত তার হাতে সময় ছিল না। আসলে ও সুসানকে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছে। আমার বোনের দরকার অবসর আর ওর প্রয়োজন একজন রাঁধুনি। তাই সুসান কয়েক সপ্তাহ ওর সঙ্গে দ্বীপে গিয়ে থাকবে। আপনার অনুপস্থিতিটা ওর কাছে খুব একটা কষ্টের হবে না। কারণ আপনার অভাব অনুভব করলেই আপনার বোন মাথায় কালো পরচুলা চাপিয়ে নিলেনই মনে করবেন, আপনি বুঝি সঙ্গেই আছেন, কোরিনকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে করতে আমি বলে উঠলাম।
মুহূর্তের জন্য চোখ দুটো কুঁচকে গেল ওর, কিন্তু পরক্ষণেই খিল খিলিয়ে হেসে উঠল। ঠিকই বলেছেন। আমার কিন্তু এ ব্যাপারে কোন আপত্তি নেই। বরং অনুতাপের পরিবর্তে ওকে আমি স্বাগতই জানাচ্ছি। নির্জন দ্বীপে দিনের পর দিন কাটাতে আমরা দুজনেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। হয়তো এই কারণেই আমরা উভয়ে উভয়ের চোখে বিষ হয়ে উঠেছিলাম, একে অপরকে সহ্য করতে পারছিলাম না।
আপনার বোন এখন আছেন কেমন?
ভালোই বলা চলে। নিউইয়র্কে ব্র্যাডঃ শোয়ের কী বন্দোবস্ত করেছে সেই আশায় ও দিন গুণছে। মিস্ ডেনি তাহলে বর্তমানে নিউইয়র্কে?
কোরিন মাথা নাড়ল। ওখানে সুবিধে কতটা হবে জানি না, তবে চেষ্টা তো চালিয়ে যাচ্ছি। কফি শেষ করে আমার বাড়ানো সিগারেটটা হাতে তুলে নিল ও। বুয়েনস এয়ারস এ আমি যেতাম না, সুসির সঙ্গেই থাকতাম, কিন্তু আমার পুরনো বস জানিয়েছেন, আমার কাজটা এখনও খালি পড়ে আছে। বিয়ের আগে আমি ওখানেই কাজ করতাম। ভাবছি চাকরিটা আবার নিয়ে নেব।
ঝুকে বসে আমার হাতে ধরা জ্বলন্ত লাইটারে সিগারেটটা ধরিয়ে নিল ও।
জোইস শ্যারম্যানের কিডন্যাপিং কেসে তদন্তে আপনিও আছেন? আপনার নামটা কাগজে দেখছিলাম।
হ্যাঁ সহসা নিজেকে সতর্ক করে নিলাম।
কী সাংঘাতিক কাণ্ড ভাবুন দেখি! আমার থেকে সুসির কৌতূহলই বেশী, কিন্তু খবরটা শুনে আমিও চমকে উঠেছিলাম। আচ্ছা, আপনার ধারণা ওকে মেরে ফেলা হয়েছে?
গলার স্বর যতটা সম্ভব শান্ত রেখে জবাব দিই, হতেও পারে। এই বিষয়ে আপনার বোনের এত কৌতূহল কেন?
ওদের মধ্যে একসময় খুব বন্ধুত্ব ছিল।
ও আচ্ছা! এটা আমার জানা ছিল না।
অবশ্য জোইস তখন সিনেমায় নামেনি। বছর চারেক আগেও ও আর আমার বোন একই ঘরে বসবাস করত। জোইস ছিল হোটেলের রিসেপসনিস্ট আর সুসি আমার সঙ্গেই নাচতে।
ওটা বোধহয় স্যান বারনাডিনোতে, তাই না?
চোখ দুটো আবার যেন চঞ্চল হয়ে উঠল, কিন্তু মাথা নেড়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলল ও। তাই হবে। আমার ঠিক মনে পড়ছে না। বেচারি জোইস! ও তাহলে আর বেঁচে নেই বলছেন?
খুব সম্ভব, আপনার বোনের সঙ্গে তার কি যোগাযোগ ছিল?
না, না। জোইস যখন সিনেমায় সুযোগ পেল, সুসি আশা করেছিল ও তাকেই সুযোগ করে দেবে। কিন্তু তার আশা সফল হল না। জোইসের অহঙ্কার বেড়ে গেল-সুসিকে ও তেমন পাত্তা। দিচ্ছিল না। তারপর একদিন সামান্য একটা ঝগড়ার সূত্র ধরে জোইস ওকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিল। একটু নাম হতেই মাথা বিগড়ে গিয়েছিল আর কি।
এটা বেশীর ভাগ লোকেরই হয়ে থাকে, মিসেস কনি। এসব কথা আমাকে শোনানোর পেছনে কোন উদ্দেশ্য আছে কিনা সেটা বুঝতে পারছিলাম না। এগুলো শুধু মাত্র আলাপনের খাতিরে বলছে বলে আমার মনে হচ্ছে না। নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে।
আপনি কী স্প্রিংভিলেতেই রেখে এলেন স্ত্রীকে? সহজ গলায় ও প্রশ্ন করল। ওর বলার কায়দাটা এতো স্বাভাবিক যে আর একটু হলেই সত্যটা মুখ ফসকে বেরিয়ে যাচ্ছিল আর কি।
আমার স্ত্রী? কই না তো! একথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?
তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ওর দুচোখের দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে আমার মুখের ওপর, যদিও উজ্জ্বল হাসিটা একবারও ঠোঁট থেকে মিলিয়ে যায়নি।
আমার যেন মনে হল, ওঁকে চেনা চেনা ঠেকছে, দেখেছি আগে। একটা মেয়ে আমাদের দ্বীপের আশেপাশে ঘোরাফেরা করছিল–তাকে অবিকল আপনার স্ত্রীর মতো দেখতে। কিছু কাজ না থাকলে আমি চোখে দূরবীন লাগিয়ে এটা-সেটা দেখে সময় কাটাই। পাখি দেখতে দেখতে হঠাৎ মেয়েটার দিকে চোখ পড়ে যেতেই মনে হল, উনি বোধহয় আপনার স্ত্রী।
না না ভুল দেখেছেন। টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। ওতো সারাক্ষণই আমার সঙ্গে রয়েছে। এই দিন দুয়েকের জন্য স্যান ফ্রান্সিসকো বেড়াতে গিয়েছিল। আজই ফিরছে, ওকে নিতেই এখানে আসা। ঐ প্লেন নামছে। চলি, দৌড় লাগাতে হবে হয়তো, বুয়েনস এয়ারস এ পৌঁছে আমাকে একটা পোস্টকার্ড পাঠাতে ভুলবেন না। ওখানে ঘুরে আসার আমারও ইচ্ছে আছে।
করমর্দন করতে করতে ও বলে উঠল, সুসি নিউইয়র্ক গেলে আপনারা দুজনেই ওর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করবেন, কেমন?
পরিচিত লোক কাছে পেলে ও মনে জোর পাবে।
নিশ্চয়ই দেখা করবো। এখন চলি।…
বিমান থেকে হেলেনই প্রথম নামল। কাছে আসতেই স্থান কাল ভুলে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম ওকে। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর বাধন শিথিল করে বলে উঠলাম, তোমাকে এখানেই কামড়ে খেয়ে ফেলার স্বাদ জাগছে। আমার জন্য মন কেমন করেনি তোমার?
করেনি আবার! ঝকঝকে মুক্তোর মতো দন্ত বিকশিত করে হাসতে লাগল ও। আমাকে এভাবে গুঁড়িয়ে দেবার এখনই কোন প্রয়োজন দেখছি না স্টিভ। এখনও বহু বছর আমি একান্ত তোমার-ই হয়ে থাকব, তাই নিজের প্রগাঢ় ভালোবাসাকে এই মুহূর্তে ভাবপ্রবণতায় জোয়ারে ভাসিয়ে দিয়ে নিঃশেষ করে দিও না।
এক বার হোটেলে চলো,কত ধানে কত চাল তখনই দেখবে।ওর স্যুটকেসটা তুলে নিলাম। এটা গেল মহড়া।
সেটা আমার চেয়ে আর কেইবা ভালো জানবে।জানাল ও, তারপর, এদিককার খবরাখবর কি?
অনেক কিছু। গাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করে দিলাম। চলল হোটেলে ফিরে সব বলব।…
হোটেলে পা রাখতেই যুক্তিসঙ্গত তর্ক করে প্রথমেই প্রমাণ করে দিলাম, ও কাছে না থাকায় আমি কী রকম শোচনীয় অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলাম। আমার বলার ভঙ্গিমায় এমন কিছু ছিল, মনে হল তাওর মনে ধরেছে। তারপর একটু দম নিয়ে বলে উঠলাম, আপাততঃ আজ এই পর্যন্তই। থাক। এবার আমার কোলে এসে বোস দেখি। এতদিন তুমি কী করলে?
আমি চেয়ারে বসবো, কপট গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলে উঠল ও, তোমার কোলে একবার বসলে কী হাল হবে আমার জানা আছে।
বেশ বাবা তাই বসো। আমি নিজেই একটা আরামকেদারা টেনে দিলাম। এবার শোনাও দেখি, ডেড লেকে কী করছিলে শুনি?
ইগান আর আমি পালা করে ওদের ওখানে নজর রাখছিলাম,আমার সামনে বসে হেলেন তার বক্তব্য শুরু করল। এক মুহূর্তের জন্যেও আমরা জায়গাটার থেকে চোখ সরায়নি। অবশ্য উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই আমার দৃষ্টিতে পড়েনি। জ্যাক কনি প্রত্যেক দিনই মাছ ধরতে বেরিয়ে যেত। কোরিনকে সেই তুলনায় খুব কমই চোখে পড়ত। ওদের সঙ্গে একজনও দেখা করতে আসেনি। গতকাল বিকেলের দিকে ওরা মোটরবোটে মালপত্র চাপিয়ে এপারে আসে, আর আগে থাকতেই দাঁড় করানো একটা ভাড়া করা গাড়িতে উঠে চলে যায়। আমি তখন ভাবলুম, এই সুযোগে ওদের কেবিনটা একবার দেখে এলে মন্দ হয় না। চলেও গিয়েছিলাম ঘাট বরাবর, কিন্তু পরক্ষণেই চোখের সামনে সাপগুলোর কথা মনে হতেই আর সাহসে কুলোল না। ফিরে এলুম।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল ও। এই, হেসো না। আমি জানি কাজটা ভীতুর মতো হয়েছে। সাপ আছে জেনেও ওখানে পা রাখি কী করে বলো?
আমার মুখেও হাসি নেই,তবে ওর হাতে মৃদু চাপড় মারলাম। আমি থাকলেও সাহস করে এগিয়ে যাবার ক্ষমতা বোধহয় হতো না।
তবে একটা জিনিস আমি আবিষ্কার করেছি। দ্বীপের ওপর সতর্ক দৃষ্টি রেখে আমি আর গান ঘন্টার পর ঘণ্টা কনিদের সম্পর্কে আলোচনা করতাম। আমার আশা ছিলো গল্পের ফাঁকে ওর কাছে নিশ্চয়ই কাজে লাগার মতো কোন তথ্য পেয়ে যাব। যা ভেবেছিলাম শেষ পর্যন্ত অক্ষরে অক্ষরে তা মিলে গেল। ইগান বলল, স্প্রিংভিল থেকে ডেডলেক যাবার পথে সুসান আর জ্যাক কনি একবার তার হোটেলে ড্রিঙ্ক করতে এসেছিল। সুসানকে একা ছেড়ে জ্যাক কনি বাইরে গাড়ি ঠিক করতে চলে যায়। সেই সময় একটা লোক নাকি সুসানের সঙ্গে সিনেমা অভিনেত্রীদের নিয়ে আলোচনায় বসে যায়। বারের পেছন থেকে ওদের কথাবার্তা ইগানের কানেও এসেছিল। লোকটা নাকি বলেছে, জোইস শ্যারম্যান হচ্ছে পৃথিবীর সেরা অভিনেত্রী। ইগানের কথামতো সুসান নাকি এ বিষয়ে তার সঙ্গে তর্ক জুড়ে দেয়। ওর মতে জাইস একটা নোংরা বিশ্রী মেয়ে ছাড়া আর কিছুই নয়। সিনেমায় নামার আগে ওরা নাকি এক সঙ্গেই বসবাস করত। সুসান বলে, ডাইরেক্টর ভালো না হলে নাকি জোইস শ্যারম্যানের পক্ষে ভালো করে পা ফেলাও সম্ভব হবে না। এরপর জ্যাক কনি হঠাৎ ঢুকে পড়তে সুসান চুপ করে যায়।ইগান বলছিল, সে দেখেছেকনি নাকি বাইরে বেরিয়ে সুসানকে কী সব বলছিল, সুসানের মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে যায়।
মনে মনে না হেসে পারি না। এখন বুঝতে পারছি কোরিন কনি কেন উপযাচক হয়ে আমাকে সুসান আর জোইসের পরিচয় বলতে উৎসাহী ছিল। বললাম, তুমি এয়ারপোর্টে আসার আগে আমার সঙ্গে কোরিন কনির হঠাৎ করে সাক্ষাৎ হয়ে যায়। ওর কাছে শুনলাম, সুসান নাকি জোইসের সঙ্গে থাকত, পরে জোইস তাকে তাড়িয়ে দেয়। ও দ্বীপের আশেপাশে তোমার টিকি দেখতে পেয়েছে বলেও দাবি করেছে।
একেবারেই অসম্ভব! নিজেকে আড়াল করে খুব সাবধানেই ছিলাম।
ও তোমাকে দূরবীনের সাহায্যে দেখেছিল। যাইহোক তোমাকে কিন্তু আমার একটা কাজ করে দিতে হবে। একবার স্যান বারনাডিনোতে ঘুরে আসবে? আমিও যেতে পারতাম তবে এই হতচ্ছাড়া কিডন্যাপ কেসটার জন্যে আমায় এখানেই থেকে যেতে হবে।
না না, আমি চলে যাচ্ছি। কী করতে হবে তাই বলল।
মেয়েটার সঙ্গে যতক্ষণ কথা হচ্ছিল, আমার কেবলই মনে হয়েছে তার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবার। ব্যাপারটা হঠাৎ করে নয়, মনে হয় ব্যাপারটা সম্পূর্ণ পূর্ব পরিকল্পিত। তাছাড়া সুসান আর জোইসের কথাটা ও যে ভাবে আকস্মিক ভাবে টেনে আনল, তাতেও খটকা লাগছে। খুব সম্ভব ও বুঝে গেছে ইগান তোমায় কিছু জানিয়েছে, তাই আগে থাকতেই নিজের সাফাই গেয়ে রাখল। তোমাকে এখন স্যান বারনাডিনোতে গিয়ে কিছু খোঁজ-খবরও নিতে হবে। যে হোটেলে জোইসের সঙ্গে দেখা হয়েছিল সেটার সন্ধান করে ওখানে জিজ্ঞাসাবাদ করে একবার দেখো। ও মেয়েটা সম্বন্ধে যত বেশী জানতে পারবে ততই উপকার হবে আমার। আর চার বছর আগে সুসানের গতিবিধির খোঁজ নাও। ছোট ছোট থিয়েটার পার্টি, এজেন্সি আর স্থানীয় সংবাদপত্রের পুরনো সংখ্যাগুলো ঘাঁটলে নিশ্চয়ই কিছু দরকারি তথ্য হাতে এসে যাবে।
তুমি ঠিক কী জানতে চাইছ, স্টিভ?
এ বিষয়ে আমিও ঠিক জানি না। তবে সুসান আর জোইসের একসঙ্গে বসবাস সম্বন্ধেও আমি আগে নিশ্চিত হতে চাই। এই ধরনের কেসে অনেক সময় কেঁচো খুঁজতে গিয়ে সাপও বেরিয়ে পড়ে।…
পরের দিন সকালেই হেলেন স্যান বারনাডিনোর পথে রওনা হয়ে গেল। আমিও যাবার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু ফ্যান’শ লস-এঞ্জেলস-এ থাকার জন্য পীড়াপীড়ি করাতে আমার আর যাওয়া হয়ে উঠল না।
ওদিকে পুলিস শত চেষ্টা করেও কোন সূত্র খুঁজে পেল না। গুপ্ত আঙ্গুলোতে হানা দিয়ে তারা অনেক সময় প্রয়োজনীয় সংবাদ পেয়ে যায়, কিন্তু এক্ষেত্রে সফলতার মুখ তারা দেখেনি। আমাদের সব সন্দেহ পুঞ্জীভূত হয়েছিল পেরি রাইসের ওপর, কিন্তু তাকে অভিযুক্ত করার মতো কোন প্রমাণ তাদের হাতে এসে তখনও পর্যন্ত পৌঁছয়নি।
অপহরণকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করার কোন চেষ্টা তার দিক থেকে হয়নি। দিবারাত্র, পাহারাধীন থাকা সত্ত্বেও কোন সন্দেহজনক গতিবিধি ধরা পড়েনি তার ক্ষেত্রে। তবে হ্যাঁ, একটা জিনিস যা আমাদের মনে কিছুটা উৎসাহের সৃষ্টি করেছিল। তা হল, রাইস প্যারিসে যাবার চিন্তা। বর্তমানে ত্যাগ করেছে। এটা থেকে এই বোঝা যাচ্ছে যে, মুক্তিপণের টাকায় নিজের ভাগ সে এখনও পায়নি। অবশ্য পুরোটাই আমার অনুমান, যার কোন প্রমাণ নেই।
মীরা ল্যাসটিস এখনও রাইসের সঙ্গেই আছে।বাইরেও নিজেকে রাইসের সেক্রেটারীহিসেবে পরিচয় করালেও তাদের আসল সম্পর্কটা আমাদের কাছে আর গোপন ছিলনা। যদিও এ ক্ষেত্রেও আমরা অপারগ ছিলাম।
সকালে আমার হাতে কাজও ছিল। পুলিস সদর দপ্তরে যাওয়া আর ওখান থেকে ফ্যান’শর নিকট টু মারা। এভাবেই দেখতে দেখতে দুটো দিন কেটে গেল। রাত্রে হেলেন টেলিফোনে আমায় সব খবরা-খবর দিত। এখনও পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কিছুই তার হাতে এসে পৌঁছয়নি। যে হোটলে জোইস শারম্যানকে রাইস আবিষ্কার করেছিল সেটার খোঁজ এখনও অব্যাহত রেখেছে। তাড়াহুড়োর কাজ এটা নয়, কিন্তু নামজাদা অমন একজন অভিনেত্রী যে একসময় স্যান বারনাডিনোতে হোটেল আপ্যায়িকার কাজ করত, এ খবরটা আগে কেন কারো কানে যায়নি, আমাদের দুজনেরই এটা মাথাতে ঢুকছিল না।
এই একঘেয়েমির ব্যতিক্রম ঘটে যায় ঠিক তৃতীয় দিনে। যথারীতি বেলা আটটায় ঘুম থেকে উঠে ধীরে-সুস্থে প্রাতঃরাশ সমাপ্ত করার পর, প্রায় ফাঁকা লাউঞ্জে বসেই সেদিনের খবরের কাগজটা তুলে নিলাম।
কাগজটায় চোখ বোলাতে বোলাতে পাতার নীচে একটা ছোট্ট খবরের দিকে আমার দৃষ্টি পড়ল। প্রথমটায় অনেকটা অন্যমনস্ক হয়েই শিরোনামটা একবার চোখ বুলিয়ে ছেড়ে দিয়েছিলাম, কিন্তু কী মনে হতে আবার ফিরে এলাম পূর্বে পড়ার সেই শিরোনামে। খবরটা দ্বিতীয়বার পড়তেই মনে হল কেউ যেন আমার মুখে আচমকা ঘুষি বসিয়ে দিয়েছে।
সর্পনর্তকীর মর্মান্তিক পরিণতিঃ
নির্জন দ্বীপে রক্তক্ষরণে মৃত্যু।
দুসেকেন্ড পরেই উন্মাদের মতো আমি গাড়ির দিকে ছুটে ছিলাম।