০৮. সায়েন্স ফেয়ার শেষ হবার পর

সায়েন্স ফেয়ার শেষ হবার পর মহব্বতজান স্কুলে কয়েকটা পরিবর্তন হল। তার মাঝে একটা হল স্কুলের ল্যাবরেটরিরে একটা চাবি আমাদের পাকাপাকিভাবে দিয়ে দেয়া হল, আমরা যখন খুশী সেখানে যেতে পারি যতক্ষণ খুশী যেখানে থাকতে পারি। ল্যাবরেটরিতে গবেষণা করছি এরকম ভান করে আমরা এখানে বসে প্রত্যেকদিন আড্ডা মারি কেউ কিছু বলে না।

আমাদের বিজ্ঞান স্যার কালাপাহাড় মিঠুনকে যথেষ্ট সম্মান দেওয়া শুরু করলেন। সবচেয়ে বিপদ হল যখন ক্লাশে এসে কালাপাহাড় স্যার মিঠুনকে বলতে শুরু করলেন, “এই মিঠুন, তুই ক্লাশটা পড়া আমার জরুরী একটা কাজ আছে।”

মিঠুন খুব উৎসাহ নিয়ে আমাদের বিজ্ঞান পড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল কিন্তু কয়েকদিনের মাঝেই আমরা আবিষ্কার করলাম সে ভালো বিজ্ঞান জানতে পারে কিন্তু সে মোটেও পড়াতে পারে না। সোজা জিনিষটা এমন জটিল করে বলে যে আমরা মাথা মুণ্ডু কিছু বুঝি না। আমরা যখন কিছু একটা বুঝি না সে তখন আরো রেগে উঠতে থাকে আর যখন সে রেগে উঠে তখন মিঠুনের কথা বার্তাও ওলট পালট হতে থাকে। মিঠুনের ওপর ভর দিয়ে বিজ্ঞান স্যার আজকাল বেশীর ভাগ সময়েই ক্লাশে আসা বন্ধ করে দিলেন। তখন মিঠুনকে নিয়ে সমস্যা আরো বেড়ে গেল। কেউ মিঠুনের কোনো কথা শুনতে রাজী হতো না—সবাই মিলে হই চই চেঁচামেচি করে মিঠুনকে নিয়ে টিটকারী মারতে শুরু করল। আমরা আগেও কোনো স্যার থেকে কিছু শিখতাম না এখনো মিঠুনের কাছ থেকে কিছু শিখি না তাই আমাদের জীবনের কোনো উনিশ বিশ হল না।

ক্লাশে আমাদের বিজ্ঞানের কোনো কিছু বোঝাতে না পারলেও মিঠুন ব্ল্যাক হোলের বাচ্চা নিয়ে তার গবেষণা কাজ ভালোই চালিয়ে গেল। এনার্জি, মোমেনটাম, গ্রাভিটি, থ্রাস্ট, লিফট, সেন্টার অফ গ্রেভিটি এরকম অনেক কঠিন কঠিন শব্দ বলতে বলতে ব্ল্যাকহোলের বাচ্চা নিয়ে কাজ করতে থাকে। কী তৈরী করছে সেটা আমাদের পরিষ্কার করে বলে না, কিংবা কে জানে হয়তো বলেছে আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়নি। তবে আমরা সেটা নিয়ে মাথা ঘামাই না, মিঠুনের উপর আমাদের অনেক ভরসা। সে যেটা বানাচ্ছে তার জন্যে মাঝে মধ্যে কিছু কেনাকাটা করতে হচ্ছে— হেড স্যার যে দশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন আগে তার বিশেষ কিছু খরচ হয়নি। এখন সেখান থেকে টাকা ব্যবহার করে মিঠুন প্রায়ই এটা সেটা কেনে। ল্যাবরেটরির ভেতরের ভাঙ্গা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে—একদিন দেখলাম সিড়ির নিচে পড়ে থাকা ভাঙ্গা কিছু চেয়ার টেবিল টানাটানি করছে। সেগুলো দিয়ে কী করবে কে জানে! আমরা অবশ্যি বেশি মাথা ঘামালাম না, মিঠুন ভাঙ্গা চেয়ার টেবিলগুলো কোথায় নিতে চায় তার কাছ থেকে শুনে আমরা ধরাধরি করে সেখানে পৌঁছে দিলাম।

এর ঠিক দুইদিন পর ইংরেজি ক্লাশে মিঠুন আমার কাছে গলা নামিয়ে বলল, “ইবু। আজ সন্ধেবেলা তুই স্কুলে আসতে পারবি?”

আমি জিজ্ঞেস করলাম “কেন?”

“আজকে আমি একটা জিনিষ পরীক্ষা করব।”

“কী পরীক্ষা করবি?”

“ব্ল্যাক হোলের বাচ্চা দিয়ে যেটা বানিয়েছি”

“কী বানিয়েছিস?”

“তুই আসলেই দেখবি। এখন আর কাউকে কিছু বলছি না শুধু তুই আর আমি।”

মিঠুন যখন শুধু আমাকে ছাড়া আর কাউকে কিছু বলছে না তখন আমাকে তো আসতেই হয় তাই সন্ধেবেলা আমি চলে এলাম। আসার সময় দেখলাম বাবা অস্ট্রেলিয়ার সাথে ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলা দেখছে, আমি যখন বললাম, “বাবা একটা কাজে যাচ্ছি আসতে দেরী হতে পারে।”

বাবা সেটা শোনার চেষ্টাও করল না, হাত নেড়ে আমাকে বিদায় করে দিল। কোথায় যাচ্ছি কেন যাচ্ছি ফিরতে কেন দেরী হবে কিছুই জানতে চাইল না।

 

স্কুলে গিয়ে দেখি মিঠুন এর মাঝে চলে এসেছে। স্কুলের বারান্দায় বসে বসে মশার কামড় খাচ্ছে। আমাকে দেখে বলল, “এসেছিস?”

“আয়।”

“কোথায়?

মিঠুন কথা না বলে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে ল্যাবরেটরি ঘরে চাবি খুলে ঢুকল। বলল, “যে যন্ত্রটা বানিয়েছি সেটা আজকে জোড়া লাগা, আলাদা আলাদাভাবে তৈরী হয়েছে আজকে একত্র করা হবে।”

মিঠুন তখন পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে ভঁজ খুলে মেঝেতে রাখল–বলল, “এইটা হচ্ছে ডিজাইন।

আমি ডিজাইনের মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না। মিঠুন বলল, “আয় কাজ শুরু করি।”

আমি বললাম, “ঠিক আছে।”

মিঠুন তখন কাজ শুরু করল। দুইটা ভাঙ্গা চেয়ার পেরেক দিয়ে ঠুকে জুড়ে দিল। চেয়ারের পাগুলো করাত দিয়ে কেটে সেখানে নানারকম যন্ত্রপাতি লাগাতে লাগল। ড্রিল মেশিন দিয়ে ফুটো করে বড় বড় স্কু লাগাতে লাগল। অনেকগুলো টিউব বাঁকা করে লাগিয়ে দিল। মাঝখানে স্টীলের তৈরী ভারী একটা সিলিন্ডার লাগালো। সেখান থেকে অনেকগুলো তার বের হয়েছে সেই তারগুলো একটা প্যানেলের মাঝে লাগালো। প্যানেলটা চেয়ার দুটোর সামনে একটা কাঠের টুকরো দিয়ে লাগিয়ে নিল। চেয়ার দুটোর চারপাশে হার্ডবোর্ডের কয়েকটা পাখা লাগাল। দেখতে দেখতে পুরো জিনিষটা একটা জটিল যন্ত্রের মত দেখাতে থাকে, মনে হতে থাকে এটা বুঝি!

কোনো সায়েন্স ফিকশানের সিনেমা থেকে বের হয়ে এসেছে।

রাত দশটার দিকে আমি মিঠুনকে বললাম, “খিদে পেয়েছে।” মিঠুন বলল, “ঠিক বলেছিস। আয় খাই।”

“কী খাবি?”

“বাসা থেকে খাবার নিয়ে এসেছি।” বলে মিঠুন তার ব্যাগ থেকে নানা রকম খাবারের বাক্স বের করতে থাকে। পরটা, কাবাব, মিষ্টি, আপেল, দই এবং ফ্লাক্সে গরম চা। এতো খাবার যে আমরা দুজনে মিলে খেয়ে শেষ করতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, “তুই প্রত্যেকদিন এভাবে খাস? তাহলে তো হাতীর মত মোটা হয়ে যাবি।”

মিঠুন বলল, “না। প্রত্যেক দিন খাই না। আজকে বিশেষ দিন সেইজন্যে খাচ্ছি।”

“আজকে বিশেষ দিন কেন?”

“আজকে এই স্পেশাল ফ্লাইং মেশিনটা উড়াব সেই জন্যে স্পেশাল খাবার।”

আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, “ফ্লাইং মেশিন? এটা ফ্লাইং মেশিন? এটা উড়বে?”

“হ্যাঁ।”

“ঘরের ভেতর কেমন করে উড়বে?”

“ঘরের ভেতর উড়বে না গাধা। আমরা এখন এটা বাইরে নিয়ে যাব।”

তখন মিঠুন আর আমি ধরাধরি করে এই জটিল যন্ত্রটা ঘরের বাইরে নিয়ে গেলাম। দোতলাটা পুরো শেষ হয়নি। বিশাল অংশ খোলা ছাদ। বিল্ডিংয়ের চারপাশে বড় বড় গাছ সেই ছাদটাকে ঘিরে রেখেছে তাই বাইরে থেকে এই জায়গাটা দেখা যায় না।

মিঠুন তার ফ্লাইং মেশিনটাকে ছাদের মাঝখানে রাখল। আবছা অন্ধকারে এটাকে কেমন যেন রহস্যময় দেখাতে থাকে। মিঠুন তখন তার ব্যাগ থেকে একটা লাইট বের করে তার কপালে বেঁধে ফেলল। সেখানে একটা সুইচ টিপে দিতেই আলোটা জ্বলে উঠে এবং মিঠুনকে তখন একজন মহাকাশচারীর মত দেখাতে থাকে।

মিঠুন আরেকটা লাইট বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল, “নে এটা তোর মাথায় বেঁধে নে। অন্ধকারে প্যানেলটা দেখতে পাবি।”

অন্ধকারে প্যানেলটা আমার কেন দেখতে হবে আমি সেটা আর জিজ্ঞেস করলাম না, মিঠুনের কথা মত মাথায় বেঁধে নিলাম। মিঠুন বলল, “আয় উঠি।”

আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, “আগে একটু পরীক্ষা করে দেখলে হয় না এটা ঠিকমত কাজ করে কী না?”

“সেটাই তো করতে যাচ্ছি।”

“তাহলে উঠতে হবে কেন? না উঠে পরীক্ষা করা যায় না?”

“আর যখন এটা উড়ে চলে যাবে তখন কী করে নামাব?”

আমি মাথা চুলকে বললাম, “ইয়ে, মানে—”

মিঠুন বলল, “ও! তুই ভয় পাচ্ছিস? ভয় পেলে থাক, উঠতে হবে না।”

ভীতু বলে অপবাদ দেয়ার পর তো আর পেছানো যায় না। বললাম, “ভয় পাব কেন? ভয় পাবার কী আছে?”

তারপর মিঠুনের ফ্লাইং মেশিনে উঠে বসলাম। মিঠুনও অন্যদিক দিয়ে উঠে বসে। ব্যাগটা পায়ের কাছে রেখে সেখান থেকে দুটো বেল্ট বের করে আনে। একটা আমার হাতে দিয়ে বলল, “বেঁধে নে।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম “কী বেঁধে নেব?”

“নিজেকে চেয়ারের সাথে বেঁধে নে, সিট বেল্টের মতন।”

আমি ভুরু কুঁচকে বললাম “কেন? বাঁধতে হবে কেন?”

“উপর থেকে যেন পড়ে না যাস।”

“পড়ে যাওয়ার কথা বলছিস কেন?”

“ফ্লাইং মেশিন উড়তে উড়তে যদি কাত হয়ে যায়? উল্টো হয়ে যায়?” আমি শুকনো গলায় বললাম, “কাত হবে কেন? উল্টো হবে কেন?”

“ব্লাকহোলের বাচ্চা দিয়ে যে ইঞ্জিনটা বানিয়েছি সেটা যদি কন্ট্রোল না করা যায় তখন যা খুশি তা হতে পারে।”

“যা খুশি হবে মানে? কী হবে তুই জানিস না?”

“থিওরিটিক্যালী জানি। প্র্যাকটিক্যালী যা খুশী হতে পারে।”

আমি আমার সিট বেল্ট খুলতে খুলতে বললাম, “ মিঠুন, তুই যাআমি যাব না।”

কিন্তু ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে। মিঠুন সামনের প্যানেলে কী একটা সুইচ অন করে দিল—আর সাথে সাথে মিঠুনের ফ্লাইং মেশিনটা থরথর করে কাপতে লাগল। মিঠুন অবাক হয়ে বলল, “আরে, কাপছে কেন?”

আমিও ভয় পেয়ে বললাম, “কী হয়েছে? কাঁপছে কেন?”

মিঠুন আমার কথায় উত্তর দিল না, প্যানেলের কী একটা হ্যান্ডেল ধরে টান দিল—তখন কাপুঁনীটা আরো বেড়ে গেল, আমি ভোঁতা একটা শব্দ শুনলাম আর নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ফ্লাইং মেশিনের নিচে দিয়ে আগুনের মত কী একটা বের হতে শুরু করেছে। আমি আমার পায়ে গরম বাতাসের একটা হলকা অনুভব করলাম। ভয় পেয়ে বললাম, “কী হয়েছে মিঠুন? কী হয়েছে?”

মিঠুন আমার কথার উত্তর দিল না, বিড়বিড় করে বলল, “ওয়েট ব্যালেন্স হয় নাই।”

আমি চিৎকার করে বললাম, “সেইটার মানে কী? “টেক অফের সময় সমস্যা হতে পারে। শক্ত করে ধরে রাখিস?”

“কী শক্ত করে ধরে রাখব?”

মিঠুন হ্যান্ডেলটা আরো জোরে টেনে ধরল আর ঠিক তখন ফ্লাইং মেশিনটা পিছন দিকে কাৎ হয়ে গেল, আমি চিৎকার করে ভয়ে চোখ বন্ধ করে সামনে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। ফ্লাইং মেশিনটা পিছন দিকে আরো কাত হয়ে আরো জোরে থর থর করে কাপছে-মনে হচ্ছে এক্ষুনি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। ভয়ে আতংকে আমি চিৎকার করে বললাম, “নামব, আমি নামব। এইখানে থাকব না। তোর ফ্লাইং মেশিনের খেতা পুড়ি।”

আমি সিট বেল্ট খুলে নেমে যাচ্ছিলাম, মিঠুন তখন চিৎকার করে বলল, “খরবদার!” তারপর হাত দিয়ে আমকে খপ করে ধরে ফেলল আর পুরো ফ্লাইং মেশিনটা তখন ডান দিকে কাত হয়ে গেল।

আমি চোখ খুলে তাকালাম আর হঠাৎ আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল, ভয়ে আতংকে আমি জমে গেলাম। ফ্লাইং মেশিনটা আসলে ছাদের উপর নেই, কাঁপতে কাঁপতে সেটা উপরে উঠে যাচ্ছে, এর মাঝে আমরা কয়েকশ ফুট উপরে উঠে গেছি, নিচে স্কুল বিল্ডিংটাকে এখন একটা পোড়ো বাড়ীর মত মনে হচ্ছে।

মিঠুন বলল, “সীট বেল্ট বেঁধে ফেল।”

আমি ভাঙ্গা গলায় বললাম, “খোদার কসম লাগে। নিচে নামা।

মিঠুন বলল, “সীট বেল্ট বাঁধ।”

আমি প্রায় কেঁদেই ফেললাম “নামা মিঠুন! তাড়াতাড়ি নামা।”

মিঠুন ধমক দিয়ে বলল, “সিট বেল্ট বাঁধ তা না হলে লাথি দিয়ে নিচে ফেলে দেব।”

মিঠুন সত্যি সত্যি লাথি দিয়ে ফেলে দেবে সেটা বিশ্বাসযোগ্য কোনো কথা না কিন্তু আমি তখন বাধ্য হয়ে কাঁপা হাতে সিট বেল্ট বাঁধলাম। মিঠুন হ্যান্ডেলটা নাড়াচাড়া করতে থাকে আর ফ্লাইং মেশিনটার কাপুনী কখননা বাড়তে থাকে কখনো কমতে থাকে। আমি ভয়ে নিচে তাকিয়ে দেখলাম, ফ্লাইং মেশিনের নিচে দিয়ে আগুনের শিখার মতো কিছু একটা বের হচ্ছে আর আমরা আস্তে আস্তে উপরে উঠছি। নিচে দোকানপাট, রাস্তা, গাড়ী, ট্রাক, টেম্পাে সবকিছু ছোট হয়ে আসছে। আমার সমস্ত শরীর শক্ত হয়ে আছে, প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে এই বুঝি ফ্লাইং মেশিন নিয়ে আমরা হুড়মুড় করে নিচে আছাড় খেয়ে পড়ে একেবারে ছাতু হয়ে যাব।

কিন্তু আমরা হুড়মুড় করে পড়ে গেলাম না, আকাশে ঝুলে থাকলাম। আমি কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম, “এই মিঠুন! আর কতো উপরে যাবি? এখন থামা।”

“ঠিক আছে এখন উপরে উঠা বন্ধ করে দিই।”

“হ্যাঁ। শুধু বন্ধ করিস না, নিচে নেমে যা।”

মিঠুন বলল, “আগেই নিচে নামব কেন? সামনে পিছনে যাব না?”

“সামনে পিছে যাবি?”

“হ্যাঁ।” বলে মিঠুন আরেকটা হ্যান্ডেল ধরে টান দেয়। সাথে সাথে পুরো ফ্লাইং মেশিনটা একটা আঁকুনী দিয়ে সামনে যেতে থাকে। আমি মুখে ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা টের পেলাম, ভয়ে ভয়ে বললাম, “কতো জোরে যাচ্ছি?”

“ঘণ্টায় ষাট সত্তুর কিলোমিটার হবে।”

“এতো জোরে যাওয়ার দরকার আছে?”

মিঠুন আমার কথার উত্তর না দিয়ে হ্যান্ডেলটা সামনে ঠেলে দিল, সাথে সাথে ফ্লাইং মেশিনটা ঝাকুনী দিয়ে কাত হয়ে যায়, আমি ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম। মিঠুন বলল, “ভয় পাস নে এখন এটাকে ঘোরাচ্ছি।”

“আর ঘুরাতে হবে না। এখন নিচে নামা।”

মিঠুন বলল, “নামাব। আগে ভালো করে টেস্ট করে নেই।”

“আকাশে ঝুলে থেকে টেস্ট করানোর দরকার আছে? নিচে নেমে টেস্ট করা যায় না?”

মিঠুন বলল, “আকাশে সামনে পিছে ডানে বায়ে উপরের নিচে সবদিকে ফাঁকা-নিচে এই রকম ফাঁকা জায়গা পাবি?”

আমি দুর্বলভাবে বললাম, “প্রথম দিনেই সব টেস্ট করে ফেলতে হবে? কাল পরশুর জন্যে কিছু রাখবি না?”

“কাল পরশুরটা কাল পরশু দেখা যাবে। আজকেরটা আজকে। মিঠুন আমার দিকে তাকিয়ে হাসল, চাঁদের আলোতে তার হাসিটা অবশ্যি খুব ভালো দেখা গেল না। মিঠুন এবারে তার ব্যাগটা খুলে ভিতর থেকে ফ্লাক্সটা বের করে বলল, “আয় চা খাই।”

আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, “চা? তুই এখন চা খাবি?”

“হ্যাঁ। উপরে একটু শীতশীত করছে। চা খেলে শরীর গরম হবে। ফ্লাইং মেশিনটা পার্ক করে রেখেছি, এখন একজায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।”

আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না—যখন দেখলাম সত্যি সত্যি মিঠুন ফ্লাক্স থেকে একটা প্লাস্টিকের কাপে চা ঢেলে আমার দিকে এগিয়ে দিল। আমি কাঁপা হাতে কাপটা নিলাম মিঠুন তখন তার নিজের জন্যে এক কাপ ঢেলে নিয়ে খুব তৃপ্তি করে চায়ের কাপে চুমুক দিল। কেউ যদি একদিন আগেও আমাকে বলত যে পরের দিন আমি আকাশে ঝুলে থেকে চা খাব আমি কী সেটা বিশ্বাস করতাম?

চা খেতে খেতে মিঠুন বলল, “আমাদের এই ফ্লাইং মেশিনের সুবিধে কী জানিস?”

“কী সুবিধা?”

“এইখানে যে ফুয়েল আছে সেটা কোনোদিন শেষ হবে না”। “শেষ হবে না?”

“না। এনার্জীটা খরচ হয় ই ইকুয়েলস টু এম সি স্কয়ার দিয়ে। তার মানে শক্তি প্রায় অফুরন্ত। তাছাড়া—”

“তাছাড়া কী?”

“যখন এনার্জী ব্যবহার করি না তখন আমার ধারণা ব্লাকহোলের বাচ্চা চারপাশের ভর শুষে বড় হতে থাকে। এটা যেহেতু অন্যরকম ভর তাই আমরা টের পাই না। তবে—”

“তবে কী?”

মিঠুন উত্তর না দিয়ে হঠাৎ করে মুখ সুঁচালো করে কিছু একটা ভাবতে লাগল। আমার কাছে পুরো ব্যাপারটা একটা অবাস্তব স্বপ্নের মত মনে হতে থাকে। গভীর রাতে আমি আর মিঠুন আকাশে ঝুলে ঝুলে চা খাচ্ছি। শুধু তাই না মিঠুন চা খেতে খেতে বৈজ্ঞানিক চিন্তার মাঝে ডুবে আছে। সত্যি কথা বলতে কী প্রথম প্রথম আমার যেরকম অসম্ভব ভয় লাগছিল, মনে হচ্ছিল এক্ষুণি বুঝি ধপাস করে আকাশ থেকে পড়ে যাব এখন আর সেরকম মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে আকাশে ঝুলে থাকা এমন কিছু অসম্ভব ব্যাপার না।

আমি চা শেষ করে বললাম, “মিঠুন এখন নিচে চল।”

“হ্যাঁ” মিঠুন বলল, “একটু একটু ঠাণ্ডা লাগছে।”

মিঠুন তার কপালে লাগানো লাইটটা জ্বালিয়ে প্যানেলটা দেখে একটা সুইচ টিপে আরেকটা হ্যান্ডেল ধরে নিজের দিকে টেনে আনে। ফ্লাইং মেশিনটা একটা ঝাঁকুনী দিয়ে নিচে নামতে থাকে। আমি নিচের দিকে তাকালাম, সেখানে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মিঠুনকে জিজ্ঞেস করলাম, “স্কুলটা কোন দিকে?”

“কী জানি?”

“কী জানি মানে?”

আমি রেগে উঠে বললাম, “না জানলে যাবি কেমন করে?”

“সেটাই তো বুঝতে পারছি না!” মিঠুন বলল, “যখন সামনে পিছে ডানে বায়ে গেছি তখন অনেক দূরে সরে গেছি। তাছাড়া

“তাছাড়া কী?”

“বাতাসেও মনে হয় সরে এসেছি।”

“এখন?”

মিঠুন মাথা চুলকালো, “স্কুলটা খুঁজে বের করতে হবে।“

“কেমন করে খুঁজে বের করবি?”

মিঠুন মাথা নাড়ল, বলল, “জানি না আমি এর আগে কখনো আকাশে হারিয়ে যাইনি।”

সেটা সত্যি কথা। নিচে হারিয়ে গেলেও রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলে কোথাও না কোথাও পৌঁছানো যায়। আকাশে কোনো রাস্তা নেই—আকাশে হারিয়ে গেলে কোনদিকে যেতে হবে বোঝার কোনো উপায় নেই।

 

অনেক কষ্ট করে যখন শেষ পর্যন্ত স্কুলটা খুঁজে পেলাম তখন ভোররাত হয়ে গেছে। ফ্লাইং মেশিনটা নিচে নামিয়ে মিঠুন বলল, “এতো রাতে বাসায় গিয়ে কী হবে? আর স্কুলে ঘুমিয়ে যাই।”

আমি বললাম, “তোর বাসায় চিন্তা করবে না?”

“নাহ!” মিঠুন বলল, বাসায় বলেছি আজ রাতে তোর বাসায় থেকে রাত জেগে সমাজ পাঠ পড়ব।”

“সমাজ পাঠ?”

“হ্যাঁ।” মিঠুন তার ফ্লাইং মেশিনের যন্ত্রপাতিগুলো টানাটানি করে কী যেন দেখল তারপর মুখ দিয়ে সন্তুষ্টির মত শব্দ করল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোর বাসায় চিন্তা করবে না?”

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “না। আমার বাসায় আব্দু ছাড়া আর কেউ নাই। আব্ব আমাকে নিয়ে কখনো মাথা ঘামায় না। কয়েক রাত বাতে না গেলেও আব্ব বুঝতেই পারবে না।”

মিঠুন বলল, “তোর কী মজা!”

আমি ছোট একটা নিশ্বাস ফেললাম। সত্যিই কী আমার অনেক মজা।

মিঠুন ল্যাবরেটরি ঘরের মাঝখানে একটা টেবিলে উঠে বলল, “উড়তে পারলাম কী না?”

“পেরেছিস। তুই একটা জিনিয়াস।”

“সত্যি? তোর তাই মনে হয়?”

“হ্যাঁ। সুপার জিনিয়াস।”

মিঠুন বাচ্চা ছেলের মত খুশী হয়ে উঠল, “শুধু তুই ভালো ভাবে দেখেছিস। সবাই শুধু বকাবকি করে।”

“এই ফ্লাইং মেশিন দেখলে বাককি করবে না। যেই দেখবে সেই ট্যারা হয়ে যাবে কেনো সন্দেহ নাই।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ। প্রথমবার উঠার সময় একটু ভয় পেতে পারে কিন্তু একটু অভ্যাস হয়ে গেলে ট্যারা হয়ে যাবে। কোনো সন্দেহ নাই।”

মিঠুন টেবিলটাতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। আমি আরেকটা টেবিলে শুয়ে পড়লাম। সারারাত ঘটনাগুলো মাথার মাঝে খেলা করছিল। মনে হচ্ছিল বুঝি ঘুমই আসবে না, কিন্তু এক সময় সত্যিই ঘুমিয়ে গেলাম।