৮ম অধ্যায় – সমর নিয়মনির্ধারণ–ব্যূহরচনা
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! রজনী প্রভাত হইলে রাজা দুর্য্যোধন আপনার সৈন্যগণকে বৰ্ম্ম ধারণ করিতে অনুমতি করিলেন। সৈন্যগণ রাজার আদেশ লাভ করিবামাত্র বর্ম্ম ধারণ করিতে লাগিল। কেহ কেহ অবিলম্বে রথে অশ্ব যোজনা করিল; কেহ কেহ দ্রুতবেগে ধাবমান হইল; কেহ কেহ মাতঙ্গসকলকে সুসজ্জিত করিয়া দিল এবং সহস্র সহস্র রথে আস্তরণ বিস্তীর্ণ করিতে লাগিল। ঐ সময় সৈন্য ও যোধগণের সমরোৎসাহ উদ্দীপনাৰ্থ নানাবিধ বাদ্যধ্বনি প্রাদুর্ভূত হইল।
“অনন্তর মহারথগণ সৈন্যগণকে সন্নদ্ধ [যুদ্ধসজ্জায় সজ্জিত] নিরীক্ষণ করিয়া তাহাদিগকে বিভক্ত ও পৃথক পৃথক অবস্থাপিত করিলেন। মহাবীর শল্য সেনাপতি হইলেন। তখন মহারথ কৃপ, কৃতবর্ম্মা, অশ্বত্থামা, শল্য, শকুনি ও অন্যান্য পার্থিবগণ রাজা দুর্য্যোধনের সহিত সমবেত হইয়া নিয়ম সংস্থাপন করিলেন যে, এক ব্যক্তি কদাচ পাণ্ডবগণের সহিত যুদ্ধ করিবে না। যে একাকী পাণ্ডবদিগের সহিত যুদ্ধ করিবে এবং যে ব্যক্তি কোন পাণ্ডবকে যুদ্ধ করিতে দেখিয়া পরিত্যাগ করিবে, তাহাকে পঞ্চপাতক [ব্রহ্মহত্যা, সুরাপান, ব্রাহ্মণের সোনা চুরি, গুরুপত্নীগমন এবং উক্ত পাপকারীর সংসর্গজনিত পাপ] ও উপপাতকে [পরদার, আত্মবিক্রয়, মাতা পিতৃ-পুত্র ত্যাগ, ঋণ পরিশোধ না করা, নাস্তিকতা, গো-বধ প্রভৃতি ৫৯ প্রকারের পাপে] লিপ্ত হইতে হইবে। আর আমরা সকলে মিলিত হইয়া পরস্পরের রক্ষাবিষয়ে সবিশেষ যত্ন করিয়া যুদ্ধ করিব। হে মহারাজ! কৌরবপক্ষীয় বীরগণ এইরূপ নিয়ম স্থাপনপূৰ্ব্বক মদ্ররাজকে পুরোবর্তী করিয়া সত্বর বিপক্ষগণের প্রতি ধাবমান হইলেন। তখন পাণ্ডবেরাও ব্যূহরচনা করিয়া সেই ফুভিত মহাসাগরের ন্যায় তুমুল কোলাহলসম্পন্ন রথকুঞ্জরবহুল সৈন্যগণের সহিত যুদ্ধ করিবার অভিলাষে চারিদিক হইতে কৌরবগণের অভিমুখে আগমন করিতে লাগিলেন।”
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! মহাবল দ্রোণ, ভীষ্ম, সূতপুত্র, ইঁহাদিগের বিনাশবৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়াছি, এক্ষণে মদ্ররাজ শল্য ও আমার আত্মজ দুৰ্য্যোধনের নিধনবৃত্তান্ত কীৰ্ত্তন কর। শল্য ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের হস্তে এবং আমার পুত্র দুর্য্যোধন ভীমের হস্তে কিরূপে নিহত হইল?”
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! আমি মনুষ্য, অশ্ব ও করনিকক্ষয়কর, ঘোরতর সংগ্রামবৃত্তান্ত কীৰ্ত্তন করিতেছি, আপনি অবহিত হইয়া শ্রবণ করুন। হে মহারাজ! ভীষ্ম, দ্রোণ ও সূতপুত্র নিপাতিত হইলেও ঐ সময় আপনার পুত্রগণের অন্তঃকরণে এই বলবতী আশার সঞ্চার হইয়াছিল যে, মদ্ররাজ শল্য অনায়াসে পাণ্ডবদিগকে সমরে পরাজিত করিবেন। মহারাজ দুর্য্যোধন ঐ আশায় আশ্বাসিত হইয়া মদ্ররাজ শল্যকে আশ্রয় করিয়া আপনাকে সনাথ বলিয়া বিবেচনা করিলেন।
“হে মহারাজ! সূতপুত্র নিহত হওয়াতে পাণ্ডবগণ সিংহনাদ পরিত্যাগ করিলে উহা শ্রবণে আপনার পুত্রগণের অন্তঃকরণে ভয়সঞ্চার হইয়াছিল; এক্ষণে মদ্ররাজ তাঁহাদিগকে আশ্বাস প্রদান করিয়া অতি সমৃদ্ধ সৰ্ব্বতোভদ্র ব্যূহ নিৰ্মাণ করিলেন এবং স্বয়ং এক সুসজ্জিত রথে আরোহণপূৰ্ব্বক ভারসহ বেগশালী শরাসনে অনবরত টঙ্কার প্রদান করিয়া পাণ্ডবগণের প্রতি গমন করিতে লাগিলেন। তাঁহার সারথি রথারূঢ় হইয়া রথের অপূৰ্ব্ব শোভা বিস্তার করিল। প্রবলপ্রতাপশালী বৰ্মধারী মদ্ররাজ আপনার আত্মজগণের ভয় অপনোদনপূৰ্ব্বক মদ্রদেশীয় বীরবর্গ ও নিতান্ত দুর্জয় কর্ণাত্মজগণের সহিত ব্যূহের মুখে অবস্থান করিলেন। কৌরবগণপরিরক্ষিত মহারাজ দুর্য্যোধন ব্যূহের মধ্যভাগে, ত্রিগর্তগণপরিবৃত কৃতবর্ম্মা উহার বামপার্শ্বে, শক ও যবন পরিবেষ্টিত কৃপাচার্য্য দক্ষিণপার্শ্বে এবং কাম্বোজগণসমবেত মহাবীর অশ্বত্থামা উহার পৃষ্ঠদেশে অবস্থিত হইলেন। মহাবীর শকুনি ও কৈতব্য অশ্বসৈন্যপরিবৃত হইয়া বহুল বলসমভিব্যাহারে পাণ্ডবগণের অভিমুখে গমন করিলেন।
অষ্টাদশদিবসীয় যুদ্ধ–সমবেত সমর
“হে মহারাজ! তখন পাণ্ডবগণও ব্যূহরচনা করিয়া তিনভাগে বিভক্ত হইয়া আপনার সৈন্যগণের প্রতি ধাবমান হইলেন। মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী ও সাত্যকি মহারথ শল্যের সৈন্যগণের প্রতি দ্রুতবেগে গমন করিতে লাগিলেন। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির জিঘাংসাপরবশ হইয়া স্বীয় সৈন্যগণের সহিত মহাবীর শল্যের প্রতি, প্রবলপ্রতাপশালী অর্জ্জুন মহাবেগে কৃতবৰ্ম্মা ও সংশপ্তকগণের প্রতি, মহাবীর বৃকোদর ও সোমকগণ শত্রুগণের বিনাশসাধনবাসনায় কৃপাচার্যের প্রতি এবং মাদ্রীতনয় নকুল ও সহদেব সসৈন্য মহারথ শকুনি ও উলূকের প্রতি ধাবমান হইলেন। এইরূপে পাণ্ডবগণ কৌরবগণকে আক্রমণ করিতে সমুদ্যত হইলে কৌরবপক্ষীয় অসংখ্য মহারথ বিবিধ আয়ুধ ধারণপূৰ্ব্বক ক্রোধভরে দ্রুতবেগে তাঁহাদিগের প্রতি গমন করিতে লাগিলেন।”
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! মহাধনুৰ্ধর ভীষ্ম, দ্রোণ ও কর্ণের নিধনানন্তর অল্পাবশিষ্ট কৌরব ও ক্রোধাবিষ্টচিত্ত মহাবলপরাক্রান্ত পাণ্ডবগণের কি পরিমাণে সৈন্য অবশিষ্ট ছিল?”
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! যেরূপে আমাদিগের সহিত পাণ্ডবগণের যুদ্ধ হইল এবং যে পরিমাণ সৈন্য অবশিষ্ট ছিল, তাহা সমস্তই নিবেদন করিতেছি, শ্রবণ করুন। কৌরবসৈন্যমধ্যে একাদশসহস্র রথ, দশসহস্র সাতশত হস্তী, দুইলক্ষ অশ্ব ও তিনকোটি পদাতি এবং পাণ্ডবসৈন্যমধ্যে ছয়সহস্র রথ, ছয়সহস্র হস্তী, দশসহস্র অশ্ব ও এককোটি পদাতিমাত্র অবশিষ্ট ছিল। আপনার সেই সমুদয় সৈন্য মদ্ৰাধিপতির আদেশানুসারে রীতিমত বিভক্ত হইয়া জয়লাভার্থ ক্রোধভরে পাণ্ডবগণের প্রতি গমন করিল। তখন জয়োল্লাসিত যশস্বী মহাবল পরাক্রান্ত পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণও কৌরবসৈন্যের প্রতি ধাবমান হইলেন। হে মহারাজ! এইরূপে সেই প্রভাত সময়ে কৌরব ও পাণ্ডবগণ পরস্পর বধার্থী হইয়া ধাবমান হইলে উভয়পক্ষে ঘোরতর যুদ্ধ সমুপস্থিত হইল।”