০৮. সন্ধে থেকে মেঘ করেছিল কাল

সন্ধে থেকে মেঘ করেছিল কাল। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। গভীর রাতে তুমুল বৃষ্টি নামল। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠের হঠাৎ ধেয়ে আসা বারিধারা নয়, আষাঢ় শ্রাবণের ঝমঝমাঝম। সেই যে শুরু হয়েছে। রাত্রে, সকাল হওয়ার পরেও বিরাম নেই। তবে এখন তেজটা কমেছে, চলছে রিমঝিম্ রিমঝিমের পালা।

বৃষ্টির মধ্যে পাজামা গুটিয়ে ছাতা মাথায় বাজারে ছুটল পার্থ। নিয়ে এসেছে একটা আস্ত ইলিশ মাছ। আজ খুব সরল মেনু। খিচুড়ি, আর সঙ্গে যত ইচ্ছে মাছভাজা। পার্থ স্থির করে ফেলেছে আজ নো প্রেস। শুধু খাওয়া আর ঘুম। যতই কাজের পাহাড় মাথায় চেপে থাকুক, সে আজ নিজেই নিজেকে একটা রেনি ডের ছুটি দিতে চায়।

এমতো সকালে হঠাৎ উৎপলের ফোন। মিতিন আলুপরোটা ভাঁজছিল, দৌড়ে গিয়ে ফোনটা নিল টুপুরের হাত থেকে। কথা শেষ করে যখন রিসিভার নামাল তখন তার মুখ বেশ গম্ভীর।

টুপুর উৎকণ্ঠিত স্বরে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে গো?

আবার কাচ ভেঙেছে। ড্রয়িংরুমের শো কেসের। তবে এবার শুধু পাল্লা নয়, ভেতরের পুতুলগুলোও গেছে।

পার্থ সবে শব্দজব্দ খুলে বসেছিল, মিতিনের কথা কানে যেতেই তারও কপালে ভাঁজ, সে কী! বেশ তো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল!

সে আর কইটা দিন, মঙ্গল আর বুধ। মিতিনের গোমড়া মুখে একচিলতে হাসি উঁকি দিল, ভূতবাবাজি বোধ হয় দুদিন একটু সমঝে বুঝে নিচ্ছিলেন।

কী করবে এখন? যাবে?

 অগত্যা।

এই বৃষ্টি মাথায় করে?

উপায় কী, অ্যাডভান্স যখন গিলেছি। মিতিন টুপুরকে দেখল, কী রে, তুই আছিস তো সঙ্গে?

শুধু মুখের কথা খসার অপেক্ষা, টুপুর পাঁচ মিনিটে তৈরি। মিতিনও বেরিয়ে পড়ল ব্যাগ গুছিয়ে। ট্যাক্সি নিয়ে সাড়ে নটার। মধ্যে পৌঁছে গেছে জোনাথনের বাড়ি।

বছরের প্রথম বড় বৃষ্টি বলে পথেঘাটে তেমন জল জমেনি, এই একটা বাঁচোয়া।

উৎপল বাইরের বারান্দায় পায়চারি করছিল। বর্ষাতি পরা মিতিন টুপুরকে দেখতে পেয়ে প্রায় দৌড়ে এল, ও হরিবল্ ব্যাপার। কাল যা হয়েছে তাতে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড়।

মিতিন বলল, চলুন, দেখছি। বর্ষাতি দুটো হ্যাটস্ট্যান্ডে বুলিয়ে দিয়ে মাঝের প্যাসেজ দিয়ে ড্রয়িংরুমে এল টুপুররা। দেখল বড় সোফায় মুহ্যমান মুখে বসে আছেন জোনাথন, পাশের সোফায় ডিক। ডিকের পরনে ট্রাউজার আর ফুলশার্ট, পায়ে জুতোমোজা। নাইট ডিউটি থেকে ফিরে এখনও ডিক পোশাক বদলায়নি।

কথা না বলে কাজে নেমে পড়ল মিতিন। উবু হয়ে বসে দেখছে ভাঙচুর। সত্যি ভারী বিশ্রীভাবে ভেঙেছে শোকেসের কাচ। ফ্রেমে যৎসামান্য কাচ লেগে আছে কোথাও কোথাও, কিন্তু একান্তই। এবড়োখেবড়ো ভাবে। পোর্সিলিনের পুতুলগুলোর গুঁড়ো গুঁড়ো দশা, মাটিতে ছড়িয়ে রয়েছে। দুটো মাত্র বড় পুতুল আধভাঙা, বাকিগুলোকে এখন আর পুতুল বলে শনাক্ত করা কঠিন।

উৎপল বলল, আপনার জন্যই এখনও সাফ করিনি ম্যাডাম। এবার মিসেস জোনসকে বলি ঘর ক্লিন করে দিতে?

 ও শিওর। আমার যা দেখার দেখা হয়ে গেছে।

 মিতিন আর টুপুর সোফায় এসে বসল। জোনাথন দুআঙুলে কপাল চেপে রয়েছেন। মিতিন নরম গলায় ডাকল, মিস্টার মাইকেল?

জোনাথন অন্যমনস্ক ভাবে সাড়া দিলেন, উ?

কাল ঠিক কখন হয়েছে ঘটনাটা?

 বেশ রাত্তিরে। আমার তখন ঘুম এসে গিয়েছিল।

 স্লিপিং পিল খেয়েছিলেন?

না। আমার ইউজুয়ালি ঘুমের ট্যাবলেট লাগে না। জোনাথন মুখ তুললেন, হঠাৎ এ ঘরে প্রচণ্ড জোরে ঝনঝন শব্দ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এসে দেখি এই কাণ্ড।

উৎপল বলল, সরি ম্যাডাম, একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। কাল সন্ধেবেলা এ ঘরের বালব টিউবও ফেটে গেছিল।

আগে দুদিন তো লাইট যায়নি?

জোনাথন বললেন, দুটো দিন তো সবই ঠিক ছিল। বা টিউব কাচ…। আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম চেয়ার টেবিলগুলো বার করার পর আবার সব নরমাল হয়ে গেল। কিন্তু তিনি যে এত ক্রুদ্ধ, এত ভয়ংকর হয়ে আছেন এ আমার ইমাজিনেশানেও ছিল না।

মিসেস জোনস থমথমে মুখে ঝাঁট দিচ্ছেন মেঝেটা। কাচের টুকরো এক জায়গায় জড়ো করতে করতে অস্ফুটে বলে উঠলেন, কী হচ্ছে…! কেন যে হচ্ছে…! পুতুলগুলোর কী দাম, এখন সেগুলোকে পর্যন্ত…!

মিতিন মৃদু গলায় বলল, হুঁ। এবার কাচের ভেতরকার জিনিসেও হোলি স্পিরিটের নজর পড়েছে।

গুম হয়ে বসে থাকা ডিক আচমকা ফুঁসে উঠল, সব যাবে। সব যাবে। একটা একটা করে জিনিস চলে যাবে। কিচ্ছু বাঁচবে না। কেউ বাঁচাতে পারবে না।

উৎপল তাড়াতাড়ি ডিকের কাঁধে হাত রেখেছে, শান্ত হও ডিক। শান্ত হও।

শান্ত থাকার উপায় রেখেছ তোমরা? সর্বনাশ যা করার সে তো করেই দিয়েছ। আমি বলিনি, হোলি স্পিরিট আর শান্ত হবে না? ফলল আমার কথা?

সব ঠিক হয়ে যাবে। একটু ধৈর্য ধরো।

কে ঠিক করবে? তুমি? না তোমার এই ডিটেকটিভ? কেউ কিছু করতে পারবে না। আমি কতবার বলছি, একটা যা হোক কিছু হেস্তনেস্ত করে ফ্যালো, আমার কথা কেউ গ্রাহ্য করছ না। এখন এই হন্টেড হাউস বেচতে গেলেও আর কেউ কিনবে? দাম পাবে?

বেচার প্রশ্ন উঠছে কেন? তুমি তো জানো ড্যাডি মোটেই বিক্রি করতে চাইছেন না।

ড্যাডি চাইছেন না? নাকি তোমরা চাইছ না? তোমাদের কী ইন্টারেস্ট আছে, আমি বুঝি না ভেবেছ?

যাহ্ বাবা, আমাদের আবার কী স্বার্থ? ড্যাডির সেন্টিমেন্টটাকে আমরা তো জাস্ট অনার করতে চাইছি।

হুহ, ড্যাতির চিন্তায় ঘুম হচ্ছে না! সারা বছরে একবার ড্যাডিকে দেখতে আসার সময় পেতে না, আর এখন ড্যাডির সেন্টিমেন্ট নিয়ে বিগলিত! এই সব গুলগপ্পো আমায় ঝেড়ো না। তোমাদের আসল ইন্টারেস্ট তো বাড়িটাকে জিইয়ে রাখা। তোমরা লোভে পড়ে গেছ। ভাবছ গুপ্তধন খুঁজে বার করে ফেলবে। কিচ্ছু পাবে না, তোমরা মরবে। তোমাদের কবরে গিয়ে আমি ফুল মালা ছড়িয়ে আসব।

আহ্, ডিক। জোনাথন ধমকে উঠলেন, বিহেভ ইওরসেলফ। মির্না-উৎপল সম্পর্কে তুমি এভাবে কথা বলবে না।

প্লিজ ড্যাডি, মির্না উৎপলকে তুমি অনেক মাথায় তুলেছ, আর নয়। ওদের এবার নিজের চরকায় তেল দিতে বলো। এ বাড়িতে ভূত লাফাচ্ছে, না মানুষ, এ নিয়ে ওদের গবেষণা করার দরকার নেই।

বলেই ডিক উঠে গটগট করে ভেতরে চলে গেল। গোটা ঘর নিস্তব্ধ, যেন পিন পড়লেও শব্দ শোনা যাবে। মিসেস জোনসের ঝাড়ু থেমে গেছে, জোনাথনের ঘাড় ঝুলে পড়েছে, উৎপল দাঁড়িয়ে নিথর।

নীরবতা ভঙ্গ করল উৎপলই। পাংশু মুখে বলল, সরি মিসেস মুখার্জি। আমি আপনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

না, না, ঠিক আছে। আমি কিছু মনে করিনি, মিতিন আলগা হাসল, আমি কি গিয়ে ডিককে একটু ঠাণ্ডা করে আসব?

আপনি? যাবেন? এর পরেও?

কোনও অসুবিধে নেই। ডিকের মাথা বড় তেতে আছে, ওকে একটু বোঝানো দরকার।

জোনাথন বড় করে একটা শ্বাস ফেললেন। উৎপলও আর আপত্তি জুড়ল না। টুপুরকে ল্যাংবোট করে ডিকের দরজায় এল মিতিন, ভেতরে আসতে পারি?

কোনও উত্তর নেই।

সামান্য অপেক্ষা করে মিতিনরা ঢুকেই পড়ল। ডিক চিতপটাং হয়ে শুয়ে ছিল বিছানায়, ধড়মড়িয়ে উঠে বসেছে। রুক্ষ গলায় বলল, আমি কি আপনাদের আসতে বলেছি?

মিতিন একটুও থমকাল না। কড়া গলায় বলল, আপনি না চাইলেও আমাদের আসতে হবে। প্রয়োজন আছে।

আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে বাধ্য নই! আপনিও যে দেখি সুরজমলের ভাষায় কথা বলেন। ডিক কটমট করে তাকাল।

মিতিনের গলা আরও কঠোর হল, চোখ পাকিয়ে লাভ নেই। আপনিও এমন কিছু ভালমানুষ নন। আপনার ড্যাডিকে হ্যারাস করার মূলে তো আপনিই।

কী বলতে চাইছেন?

আপনিই তো এই বাড়ি বিক্রির জন্য যেচে সুরজমলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন।

থতমত মুখে ডিক বলল, কে বলেছে?

ঢিল ঠিক জায়গাতেই পড়েছে। ডিকের চোখে চোখ রেখে সামান্য গলা নামাল মিতিন, সুরজমলই বলেছে। তবে আপনার বাড়ির লোক এখনও জানেন না। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, শুনলে আপনার বাবা, আই মিন ড্যাডি খুব প্রীত হবেন না!

একটু চুপ থেকে ফের গরগর করে উঠেছে ডিক, অন্যায়টা কী করেছি? এ বাড়ি রেখে হবেটা কী? বরং বেচলে ড্যাডির হাতে কিছু ক্যাশ আসে। শেষ জীবনটা ড্যাডি আরও ল্যাভিলি কাটাতে পারে।

ড্যাডির ভাল চাইতে তো আপনি যাননি। গেছেন নিজের ধান্দায়।

সে টাকা কার না দরকার? উৎপল মির্না টাকার জন্য ছোঁক ছোঁক করে না? ড্যাডির ব্রেনওয়াশ করে ভাগলপুরের বাড়িদুটো বেচাল কে? উৎপলই তো।

তার ভাগ তো আপনিও পেয়েছেন। মিতিন আর একটা ঢিল ছুড়ল।

ভাগই বটে। চোদ্দো লাখ টাকা থেকে মাত্র পঞ্চাশ হাজার। বুড়ো কিপটের জাশু। হাত দিয়ে টাকা গলে না। তাও নেহাত মির্নাকে দিয়েছিল বলে আমাকেও দিতে বাধ্য হল।

তা হলে এ বাড়ি হাতবদল হলেই যে আপনি মোটা টাকা পাবেন এমন আশা করলেন কেন?

কিছু তো আদায় করতামই। লাখ, দেড় লাখ যা হোক। পারমানেন্টলি ঘাড় থেকে নেমে যাব, এই আনন্দেই ড্যাডি দিয়ে দিতেন টাকাটা।

ঘাড় থেকে নামা মানে? আপনি আলাদা হতে চান?

আমি এ দেশ থেকেই চলে যেতে চাই। এ শহর আমার আর এক মুহূর্ত ভাল লাগে না। আমার বন্ধুবান্ধবরা অনেকেই সেটল করেছে অস্ট্রেলিয়ায়, কিছু টাকা হাতে এলে আমিও ওখানেই পাড়ি দেব।

বুঝলাম। মিতিন ঢক ঢক ঘাড় নাড়ল। এবং তার সঙ্গে তৃতীয় ঢিলটাও ছুড়ল, কিন্তু ডিক, তার জন্য এত ছলাকলার আশ্ৰয় কেন?

কীসের ছলাকলা?

আপনার ড্যাডির গলা নকল করে সুরজমলকে টেলিফোন করার কোনও প্রয়োজন ছিল কি?

ভীষণ চমকেছে ডিক। হতবুদ্ধি মুখে বলল, আমি…? ড্যাডির গলা নকল করেছি। কবে?

ভান করবেন না। সুরজমল আমায় সব বলেছে।

মিথ্যে বলেছে। মিথ্যে বলেছে। ডিক আবার পুরনো মেজাজে। প্রায় গর্জে উঠল, আমি তো তাকে নিজের গলাতেই ফোন করেছিলাম। রবিবার রাত্তিরে। সুরজমল আমায় স্ট্রেট কাট জানিয়ে দেয় এই বাড়ি কেনার ব্যাপারে তার আর কোনও আগ্রহ নেই।

কিন্তু কারুর একটা ফোন পেয়ে শনিবার সুরজমল আপনার ড্যাডির কাছে এসেছিল, এ খবর নিশ্চয়ই আপনার অজানা ছিল না?

জানব না কেন? কিন্তু ড্যাডি তাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল।

 তারপরেও ফোন করলেন?

ড্যাডির সঙ্গে সুরজমলের ঠিক কী কথা হয়েছে একটু বুঝে নিতে চাইছিলাম।

কী বুঝলেন?

বললাম তো। সুরজমল কোনও হন্টেড হাউস কিনতে আর ইচ্ছুক নয়।

সুরজমল কোত্থেকে জানল বাড়িতে ভূতুড়ে কাণ্ডকারখানা হচ্ছে? আপনি বলেছেন?

আমার আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই? ড্রাম পিটিয়ে সবাইকে বলে বেড়াই, আর হু হু করে বাড়ির দাম পড়ে যাক… আমি কি এতই বোকা?

তার মানে আপনি মিস্টার মাইকেলের নাম করে ফোন করেননি?

রিচার্ড মাইকেল অকারণে মিথ্যে কথা বলে না।

অর্থাৎ কারণ থাকলে বলে, তাই তো?

সে আপনি যা ইচ্ছে ভেবে নিতে পারেন।

বেশ। আর একটা প্রশ্ন করি? মিতিন শেষ ঢিলটা ছুড়ল, বাড়িটাকে ভূতুড়ে বানানোর এ খেলায় আপনি নামলেন কেন?

খেলা? বলছেন কী আপনি? ডিকের মুখচোখ আমূল বদলে গেল। হাত মুঠো করে বলল, আমি নিজের চোখে হোলি স্পিরিটকে দেখেছি। গত সপ্তাহে বুধবার আমার ডিউটি ছিল না। সন্ধেবেলা এক বন্ধুর বাড়িতে ডিনারে গিয়েছিলাম, ফিরতে রাত হয়েছিল। খাওয়াদাওয়া খুব রিচ হয়েছিল সেদিন। আমার বেশি তেলমশলা সয় না, ঘুম আসছিল না রাতে, জলতেষ্টা পাচ্ছিল বারবার। রাত দেড়টা-দুটো নাগাদ ডাইনিং প্লেসে গিয়ে ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা জলের বোতল বার করছি, তখনই স্পষ্ট দেখতে পেলাম উঠোনের ওপারে একটা ছায়ামূর্তি। ডাইনিং প্লেস আর উঠোনের মধ্যিখানে কাচের দরজাটা রাতে বন্ধ থাকে। পা টিপে টিপে গিয়ে দরজার ছিটকিনি নামাতে-না-নামাতে ভুস করে মাটিতে মিশে গেলেন তিনি।

মিতিন চোখ কুঁচকে শুনছিল কাহিনীটা। জিজ্ঞেস করল, গত সপ্তাহের বুধবার? মানে তখনও আপনাদের বাড়িতে কাচভাঙা এপিসোড শুরু হয়নি?

না। হোলি স্পিরিটের বিরক্তি তো শনিবার থেকে প্রকাশ পাচ্ছে।

আপনি আর কখনও হোলি স্পিরিটকে দেখেননি?

 নাহ্। এক দিনই সে সৌভাগ্য হয়েছিল। আর দেখার বাসনাও নেই। এবার আমি মানে মানে কেটে পড়তে পারলে বাঁচি।

ড্যাডিকে একা ফেলে চলে যাবেন?

কীসের একা? এখন তো ড্যাডির পেয়ারের লোকজনরা এসে গেছে। তারাই তো দিব্যি ঘিরে আছে ড্যাডিকে। আমার মতো কম রোজগেরে অপদাৰ্থ সন্তান নয় দূরেই রইল।

মিতিন নিশ্চুপ। একদৃষ্টে দেখছে ডিককে।

ডিক ফের বলল, শুনুন ম্যাডাম, আপনি যদি সত্যিই ড্যাডির ভাল চান তা হলে ড্যাডিকে বোঝান। দাম থাকতে থাকতে বাড়ি না বেচলে পরে পস্তাতে হবে। …অবশ্য আপনাকে বলে কী লাভ। আপনি তো উৎপলেরই লোক।

প্রতিবাদ না করে মিতিন হাসল একটু। বলল, ওকে ডিক। অনিচ্ছাসত্ত্বেও কথা বলার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

ডিকের ঘরের বাইরে পা রেখেই মিতিন ফিসফিস করে টুপুরকে বলল, তুই ও ঘরে গিয়ে বোস। আমি একটু আসছি।

ড্রয়িংরুমে ফিরে টুপুর দেখল জোনাথন এখনও বিমর্ষ মুখে সোফায় আসীন। উৎপল পায়চারি করছে বারান্দায়।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই উৎপলের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, এ কী ম্যাডাম আপনি এদিক দিয়ে যে?

আর একবার বাড়িটা ঘুরে দেখলাম। মিতিন উত্তর দিল, বার করে দেওয়া টেবিল-চেয়ারগুলোর সত্যিই খুব বুরা হাল। মিছিমিছি বৃষ্টিতে ভিজছে।

আমি আর কিচ্ছুটি বলব না। খুব শিক্ষা হয়েছে। মিতিনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ড্রয়িংরুমে এল উৎপল। চোরা চোখে জোনাথনকে দেখতে দেখতে বলল, যাদের জিনিস তারাই বুঝুক। ভাল করতে গিয়ে আমি কেন দোষী হই!

জোনাথন অসহায় মুখে বললেন, ডিকের কথা কেন এত গায়ে মাখছ উৎপল?

মিতিন জোনাথনের সামনে গিয়ে বসল, মিস্টার মাইকেল, আপনাকে একটা কথা বলব?

বলো।

দেখলেন তো, চেয়ারটেবিল বার করে দিয়েও হোলি স্পিরিট শান্ত হলেন না।

হুম। এখন যে কী হবে!

কিচ্ছু হবে না। শুনুন মিস্টার মাইকেল, এ বাড়িতে অশান্তিগুলো হোলি স্পিরিট ঘটাচ্ছেন না। এর পেছনে একটা গভীর চক্রান্ত আছে। আপনি আমায় দুচারটে দিন সময় দিন, আপনার কাছে সমস্ত ছবিটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।

বলছ?

 বলছি না, গ্যারান্টি দিচ্ছি। এ বাড়িতে হোল স্পিরিট নিয়েও আর কোনও অশান্তি থাকবে না।

জোনাথন চোখ পিটপিট করলেন, যদি সত্যিই তা পারো, তুমি যা চাইবে তাই দেব।

উৎপল বলল, আমি তো প্রথম থেকেই ড্যাডিকে বলছি একটা চক্ৰান্ত চলছে। ড্যাডি মানতেই চান না।

এবার সব ঠিক হয়ে যাবে। মিতিন ঘড়ি দেখল, আপনি কি এখন এ বাড়িতেই থাকবেন উৎপলবাবু?

না না, বাড়ি ফিরতে হবে। মির্না সকালে ফোন পাওয়ার পর থেকে ছটফট করছে। আমি গেলে তবে ও আসতে পারবে।

আটকে আছেন কেন? আপনারা তো দুজনে একসঙ্গে বেরোন।

আর বলবেন না, কাল দুপুরে একটা কেলেঙ্কারি হয়েছে। টিপসি ফিনাইল খেয়ে ফেলেছে। তারপর থেকে কী বমি…একদম নেতিয়ে পড়েছে বেচারা। অসুস্থ প্রাণীটার কাছে আমাদের একজনকে তো থাকতেই হয়। মির্না কাল ক্লাস পর্যন্ত নেয়নি।

মিতিন দুএক সেকেন্ড কী যেন ভাবল। তারপর বলল, চলুন, আমরাও আপনার সঙ্গে যাই। টিপসিকে দেখে আসি।

উৎপল বলল, সত্যি যাবেন? চলুন।