হাটবার ছাড়া নদীর এই ঘাটে সন্ধের পরই নৌকো চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। যাত্রী থাকে না বলে ফেরিনৌকোও চলে না। দু-তিনটে যে খাবারের দোকান আছে, তারাও ঝাঁপ ফেলে দেয় তাড়াতাড়ি।
কৃষ্ণপক্ষের রাত, একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার।
একটিমাত্র নৌকোয় বসে তামাক খাচ্ছে একজন মাঝি। তার নৌকোয় টিমটিম করে জ্বলছে একটা কেরোসিনের লণ্ঠন।
ঠিক পৌনে নটার সময় একটা সাইকেল রিকশায় চেপে সন্তু পৌঁছোল সেই নদীর ঘাটে। তাকে নামিয়ে দিয়েই সাইকেল রিকশাটা ফিরে গেল পোঁ পোঁ করে।
সন্তুর হাতে একটা ঢাউস ক্যাম্বিসের ব্যাগ।
ঘাটের কাছটায় কাদা কাদা হয়ে আছে। সন্তু পা টিপে টিপে নেমে নৌকোটায় চড়ে বসল। কাদা লাগবেই জেনে সে খালি পায়ে এসেছে। সন্তু ফুলপ্যান্টই পরে কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকে, কিন্তু এখন পরে আছে হাফপ্যান্ট ও শুধু একটা গেঞ্জি।
এ-নৌকোর মাঝি কোনও কথা না বলে নৌকো ছেড়ে দিল। সে আগে থেকেই যেন জানে কোথায় যেতে হবে।
আকাশে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, যে-কোনও সময় বৃষ্টি আরম্ভ হবে। এ নৌকোটায় ছই নেই, বৃষ্টি এলে ভিজতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, টাকার থলেটা ভিজে গেলেই মুশকিল।
জলের কুলুকুলু ধ্বনি ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই।
নৌকোটা নদীর বাঁকের মুখে পৌঁছোবার পর মাঝিটি জিজ্ঞেস করল, এবারে কী করব?
সন্তু বলল, আর যেতে হবে না, এইখানেই চুপ করে বসে থাকতে হবে কিছুক্ষণ।
নদীতে তেমন স্রোত নেই, নৌকোটি একটু একটু দুলছে, সরে যাচ্ছে মাঝখান থেকে, মাঝি আবার নৌকোটাকে নিয়ে আসছে মাঝনদীতে। ভরা বর্ষার নদীতে এখন প্রচুর জল।
এখন শুধু প্রতীক্ষা।
সন্তুর একটু বুক দুরু দুরু করছে ঠিকই।
একেবারে শেষ মুহূর্তে ছোটমামা বেঁকে বসেছিলেন, সন্তুকে তিনি এই বিপদের মধ্যে একা যেতে দেবেন না। জোজোও বন্ধুর বিপদের কথা ভেবে কঁদো কাঁদো হয়ে গ্লিয়েছিল। এমনকী নিখিল মাহাতো পর্যন্ত বলেছিলেন, তার ছেলেকে বাঁচাবার জন্য অন্য একজনের ছেলেকে তিনি এমন ঝুঁকির মধ্যে পাঠাতে চান না। স(কেও যদি মেরে ফেলে, তা হলে সারাজীবন তাকে দ্বিগুণ শোক সইতে হবে।
কিন্তু সন্তু জেদ ধরে ছিল আগাগোড়া।
কাকাবাবু ফিরে আসেননি, কোনও খবরও পাঠাননি। তবু সন্তুর দৃঢ় ধারণা, কাকাবাবু যে-কোনও উপায়েই হোক, এই ছেলেচোরদের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করতেন। ওদের টাকা না দিয়ে।
এমনও হতে পারে, কাকাবাবু এই নদীর ধারে কোথাও অন্ধকারে লুকিয়ে রয়েছেন।
মাঝিটি ধৈর্য ধরতে না পেরে হঠাৎ বলে উঠল, খোকাবাবু, এখানকার চোর ডাকাতগুলি অতি সেয়ানা। আর যখন-তখন ছুরি-বন্দুক চালায়। তুমি একা একা এদের মুকাবেলা করতে পারবে?
সন্তু বলল, দেখা যাক!
মাঝিটি বলল, আহা রে, কার বাড়ির দুধের বাছা। কেন মরতে এলি?
এত উত্তেজনার মধ্যেও সন্তু হেসে ফেলল। হাফপ্যান্ট পরে এসেছে বলে তাকে খোকাবাবু তবু বলা যেতে পারে। কিন্তু একেবারে দুধের বাছা! বড্ড বাড়াবাড়ি!
একসময় দূরে ভটভট শব্দ হল। এখন বেশিরভাগ নৌকোই ডিজেল এঞ্জিনে চলে, তাই এগুলির নামই হয়ে গেছে ভটভটিয়া।
আওয়াজটা আসছে উলটো দিক থেকে, এদিকেই। একটু পরে দেখা গেল একটা জোরালো টর্চের আলো জ্বলছে আর নিভছে।
সন্তুর কাছে টর্চ নেই, সে দাঁড়িয়ে রইল চুপ করে। অন্য নৌকোর টর্চের আলো এসে পড়ছে তার মুখে।
ভটভটিয়াটা একেবারে পাশে এসে দাঁড়াল। একজন কেউ কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করল, টাকা এনেছিস?
সন্তু বলল, হ্যাঁ, এনেছি।
লোকটি বলল, পুরো টাকা এনেছিস তো? আমরা ধারে কারবার করি না।
সন্তু একটুও নার্ভাস না হয়ে বলল, হ্যাঁ, পুরো পাঁচ লাখ।
লোকটি বলল, তোর সঙ্গে আর কে আছে?
সন্তু বলল, আর কেউ না।
লোকটি টর্চ ফেলে নৌকোটা ভাল করে দেখল। খোলা নৌকোয় কারও লুকোবার কোনও জায়গা নেই।
মাঝির মুখের ওপর আলো ফেলে ভাল করে দেখে ওদিকের লোকটি বলল, এ তো বদরু শেখ।
তারপর সেই লোকটি অন্য একটি লোককে বলল, ভয়ের চোটে ওরা একটা পুঁচকে ছেলেকে পাঠিয়েছে।
অন্য লোকটি সন্তুকে বলল, এই ছোড়া, টাকার থলেটা আগে এই নৌকোয় ছুড়ে দে।
সন্তু বলল, না, আগে আমি সুকোমলকে দেখতে চাই। হাতে হাতে দেব আর নেব।
অন্য লোকটি বলল, আমরা কথার খেলাপ করি না। তুই মাথার ওপর দুহাত তুলে দাড়া।
সন্তু বাধ্য ছেলের মতন দুহাত তুলল মাথার ওপর।
ওদিক থেকে বন্দুক হাতে একজন লোক লাফিয়ে এ-নৌকোয় এসে সন্তুর সারা গা থাবড়ে থাবড়ে দেখল।
তারপর বলল, তুই অস্তরটস্তর কিছু আনিসনি তা হলে? একটা পেনসিল কাটা ছুরিও না? এবার তুই টাকার থলেটা নিয়ে ওই নৌকোয় চলে যা।
সন্তু অন্য নৌকোটায় গিয়ে দাড়াতেই লোকটি সন্তুর নৌকোর মাঝিকে বলল, বদরু তুই ফিরে যা! এদের আমরা নামিয়ে দেব।
সন্তু ব্যাগটা বুকে চেপে ধরে রইল।
মাঝি ছাড়া এ-নৌকোয় রয়েছে দুজন লোক, আর সুকোমল বসে আছে হাঁটুতে থুতনি ঠেকিয়ে। সন্তুর দিকে সে তাকালও না। বোধ হয় সে ঘুমিয়ে আছে।
একজন লোকের হাতেই শুধু বন্দুক।
সে হাত বাড়িয়ে টাকার থলিটা নিয়ে চেন টেনে খুলে ভেতরটা দেখল। বলল, ঠিক আছে। তোদের নামাব তেঁতুলতলার ঘাটে।
অন্য লোকটি বলল, কটা বান্ডিল আছে গুনে দেখবি না?
বন্দুকধারী বলল, ডেরায় গিয়ে গুনে নেব। এখন নৌকোয় স্টার্ট দে!
অন্য লোকটি বলল, এখনই গুনে নে। একটা দুটো কম পড়লে ওস্তাদ আমাদের নামে দোষ দেবে।
বন্দুকধারীটি আবার ব্যাগ খুলল।
বন্দুকটা পাশে নামিয়ে রেখে বার করতে লাগল বান্ডিলগুলো। একটা, দুটো, তিনটে-প্রত্যেকটারই ওপরে আসল একশো টাকার নোট।
চতুর্থ বান্ডিলটা বার করতেই সন্তু এক লাফে সুকোমলের কাছে গিয়ে তার একটা হাত ধরে লাফিয়ে পড়ল নদীতে।
তার পায়ের ঝাঁকুনিতে দারুণভাবে দুলে উঠল নৌকোটা, প্রায় ড়ুবে যাওয়ার মতন অবস্থা।
ঘটনার আকস্মিকতায় এই নৌকোর দুজন লোক হকচকিয়ে গিয়ে তাল সামলাতে সামলাতেই কেটে গেল কয়েক মুহূর্ত, তার মধ্যে সন্তু ড়ুব দিয়ে চলে গেছে অনেক নীচে।
সুকোমল ভয় পেয়ে জাপটে ধরেছে সন্তুকে।
সন্তু সাঁতারের চ্যাম্পিয়ান, পরপর দুবছর সে অল বেঙ্গল সুইমিং কম্পিটিশানে ফার্স্ট হয়েছে। তা ছাড়া লাইফ সেভিং-এর ট্রেনিং নেওয়া আছে, সাঁতারের সুবিধে হবে বলেই তো সে আজ ফুলপ্যান্ট পরেনি, খালি পায়ে এসেছে।
শ্বাস নেওয়ার জন্য একবার ভুস করে মাথা তুলে সন্তু বলল, সুকোমল, ভয় পাসনি! শরীরটা আলগা করে রাখ। আমরা ঠিক পৌঁছে যাব!
এ-নৌকোর লোকদুটো ধারণাই করতে পারেনি যে, এই ভরা বর্ষার নদীতে সন্তুর মতন একটা অল্পবয়েসি ছেলে ইচ্ছে করে ঝাপ দিতে পারে। এমনিতেই এনদীতে ভয়ে কেউ নামে না, এখানে কামঠ নামে একরকম ছোট ছোট হাঙর আছে, তারা মানুষের পা কেটে নেয়। কুমিরও আছে।
সন্তু আর একবার মাথা তুলতেই ওরা গুলি চালাল।
সঙ্গে সঙ্গে নদীর ধার থেকেও ছুটে এল গুলি। নৌকোর দিকে।
সন্তুর ধারণা হল, কাকাবাবু এসে গেছেন, তা হলে আর কোনও চিন্তা নেই!
গুলি চলতে লাগল দুদিক থেকে।
একটা গুলি নৌকোর মাঝির গায়ে লাগতেই সে আর্তনাদ করে উঠল। তখন একজন চালিয়ে দিল ভটভটি। গুলি চালাতে চালাতে তারা পালাল।
সন্তু সুকোমলকে নিয়ে চলে এল পাড়ের কাছে।
সেখানে ঘাট নেই, খুব কাদা। তার মধ্য থেকে সে সুকোমলকে টানতে টানতে উঠে এল ওপরে।
তারপর ডাকল, কাকাবাবু!
কাকাবাবু নয়, রিভলভার হাতে নিয়ে ছুটে এলেন নিখিল মাহাতো।
তিনি সুকোমলের দিকে ভাল করে না তাকিয়েই জলকাদা-মাখা স্যুকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন ঝরঝর করে। আবেগের সঙ্গে বলতে লাগলেন, সন্তু, সন্তু, তুমি আমার ছেলেকে উদ্ধার করে আনলে… তোমার ঋণ যে কী করে শোধ করব—
কেউ সামনা সামনি প্রশংসা করলে সন্তুর খুব অস্বস্তি হয়। সে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, সুকোমলকে দেখুন। ও কথা বলছে না কেন?
পেটে জল ঢুকে যায়নি তো!
নিখিল মাহাতো এবার ছেলের পাশে বসে পড়ে বললেন, সুকু, তুই ঠিক আছিস তো? তোকে ওরা কষ্ট দিয়েছে?
তারপরই তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, এ কী? এ কে?
সন্তুও দারুণ চমকে উঠল। যাকে সে উদ্ধার করে এনেছে, সে সুকোমল তো নয়। অন্য একটি ছেলে।
সে-ও ছেলেটির পাশে বসে পড়ে বলল, এই, তুমি কে?
ছেলেটি কাঁচুমাচু ভাবে বলল, আমি লুতফর!
নিখিল মাহাতো বললেন, লুতফর? তুই ওদের নৌকোয় কী করছিলি? তুইও ওদের দলের?
লুতফর বলল, আমি কিছু জানি না সার। আমি নদীতে মাছ ধরছিলাম, দুজন জোয়ান লোক জোর করে আমারে ধরে টেনে নিয়ে গেল। তারপর সন্দেশ খেতে দিল নৌকোয় তুলে। ধমকাতে ধমকাতে বলল, খা, খা! সেই সন্দেশ খেয়ে, কী যেন হল, ঘুম এসে গেল, আর আমি কিছু জানি না!
নিখিল মাহাতো দারুণ হতাশভাবে বললেন, যাঃ! ওরাও আমাদের ঠকিয়েছে!