অষ্টম পরিচ্ছেদ – সত্যকাম
বজ্র যখন তীরধনুক লইয়া উত্তরের বনে শিকার করিতে যাইত তখন গুঞ্জাও কদাচ তাহার সঙ্গে থাকিত। দুইজনে হাত ধরাধরি করিয়া অরণ্যের রৌদ্র ছায়ায় ঘুরিয়া বেড়াইত, ছুটাছুটি করিয়া খেলা করিত। গুঞ্জা সঙ্গে থাকিলে শিকার বড় হইত না। গুঞ্জা শিকারে যাইতে ভালবাসে কিন্তু মৃত পশুপক্ষী দেখিলে তাহার কান্না আসে। তাহার কান্না দেখিয়া বজ্র প্রথম প্রথম হাসিত; কিন্তু তারপর তাহার সম্মুখে প্রাণী হত্যা করিতে আর তাহার মন সরিত না।
এইভাবে কৌমার অতিক্রম করিয়া তাহারা একসঙ্গে যৌবনে পদার্পণ করিল। বজ্রের যৌবন-পরিণত দেহ হইল তাহার পিতার দেহের প্রতিকৃতি। তেমনই দীর্ঘ প্রাণসার; বেত্রবৎ সাবলীল। হয়তো আরও একটু সুকুমার; পিতার পৌরুষের উপর মাতার লাবণ্য যেন স্নেহের প্রলেপ দিয়াছে। মাথার গুচ্ছ গুচ্ছ কেশ স্কন্ধ পর্যন্ত নামিয়াছে, মুখে গুম্ফের সূক্ষ্ম রোমরাজি কজ্জলরেখার ন্যায় মুখের শ্রীবর্ধন করিয়াছে। সে যখন ধনু স্কন্ধে লইয়া দাঁড়াইত, তখন তাহাকে দেখিয়া মনে হইত যে মহাভারতের অর্জুন; যে অর্জুন পাঞ্চাল রাজসভায় মৎস্য চক্ষু বিদ্ধ করিয়াছিল সেই ভস্মাচ্ছাদিত তরুণ বহ্নি।
বজ্রের পাশে গুঞ্জাকে দেখাইত— শুভ্র রাজহংসের পাশে হেমবরণী চক্রবাকীর ন্যায়। শুধু নবযৌবনের শ্রী নয়, মনের সুখ ও ভালবাসা গুঞ্জাকে লাবণ্যময়ী করিয়া তুলিয়াছিল। কৈশোরের নিত্য সাহচর্য যে স্নেহ-প্রগল্ভ অন্তরঙ্গতার সৃষ্টি করিয়াছিল, যৌবনের অভ্যুদয়ে তাহাই নিবিড় আসক্তিতে ঘনীভূত হইয়াছিল। কিন্তু এই আসক্তির বাহ্য প্রকাশ কিছু ছিল না। দুইজনে প্রায় সর্বদা একসঙ্গে থাকিত, দুইজনেই জানিত তাহাদের জীবন পরস্পর অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়াইয়া গিয়াছে; কিন্তু তবু কোনও দিন তাহাদের আচরণে কোনও বিহ্বলতা প্রকাশ পায় নাই। একটিবার কেহ মুখ ফুটিয়া বলে নাই, আমি তোমায় ভালবাসি।
কেবল একবার নিজেদের সম্পূর্ণ অনিচ্ছায় তাহারা বুঝিতে পারিয়াছিল যে আর তাহারা বালক-বালিকা নয়; অকস্মাৎ যৌবনের তীক্ষ্ণতপ্ত মাদকতার স্বাদ পাইয়াছিল।
যৌবন প্রাপ্তির পরেও তাহারা একসঙ্গে শিকার করিতে যাইত। একদিন চৈত্র মাসে তাহারা কিরাতবেশী দেবমিথুনের ন্যায় বনে বনে বিচরণ করিতেছিল। দ্বিপ্রহরের মন্থর বাতাস তরুচ্ছায়াতলে শীতল আবার আতপতাপে উষ্ণ হইয়া বহিতেছে; পক্ক মধুকের গুরু সুগন্ধ বনভূমিকে আমোদিত করিয়াছে। পত্রান্তরাল হইতে বন-কপোতের ভীরু কূজন বৃন্তচ্যুত পুষ্পপল্লবের ন্যায় ঝরিয়া পড়িতেছে। মদালস মধ্যাহ্নে বনপ্রকৃতি যেন তন্দ্রাতুরা।
একটি উচ্চ বৃক্ষতলে আসিয়া বজ্র ও গুঞ্জা দাঁড়াইল। ঊর্ধ্ব হইতে ঘন গুঞ্জনধ্বনি আসিতেছে; উভয়ে মুখ তুলিয়া দেখিল, প্রায় বিশ হাত উচ্চে একটি শাখা হইতে মধুচক্র ঝুলিতেছে; মৌমাছিরা অদূরস্থ মহুয়াগাছ হইতে মধু সংগ্রহ করিয়া আনিতেছে, তাহারই গুঞ্জরন।
বজ্র সপ্রশ্ন নেত্রে গুঞ্জার পানে চাহিল, গুঞ্জা স্মিতমুখে ঘাড় নাড়িল। তখন বজ্র তীরধনুক লইয়া মৌচাক লক্ষ্য করিয়া তীর ছুঁড়িল। তীর মৌচাক বিদ্ধ করিয়া মধুলিপ্ত দেহে মাটিতে পড়িল। মৌমাছিরা বহু ঊর্ধ্ব হইতে আততায়ীকে লক্ষ্য করিল না, তাই বিশেষ বিচলিত হইল না। গুঞ্জা গাছের পাতা ছিঁড়িয়া পত্রপুট রচনা করিয়া মাটিতে রাখিল। চাক হইতে বিন্দু বিন্দু গাঢ় মধু ক্ষরিত হইয়া তাহাতে পড়িতে লাগিল।
পর্ণপুটে মধু সঞ্চিত হইলে দু’জনে তাহা ভাগ করিয়া পান করিল, তারপর তৃপ্ত মনে আবার একদিকে চলিল। শিকার সন্ধানের কোনও ব্যগ্রতা নাই, একসঙ্গে ঘুরিয়া বেড়ানোই যেন একমাত্র উদ্দেশ্য। কিছুক্ষণ লক্ষ্যহীনভাবে ভ্রমণ করিবার পর গুঞ্জা বলিল— ‘এস, কোথাও বসি।’
একটি ময়ূর ও দুই তিনটি ময়ূরী এক বৃক্ষের ঘনপল্লব ছায়াতলে বিশ্রাম করিতেছিল, তাহাদের আসিতে দেখিয়া সচকিতে উঠিয়া দাঁড়াইল, তারপর ত্রস্ত কেকাধ্বনি করিয়া বিপরীত দিকে পলায়ন করিল। বজ্র দ্রুত ধনুতে তীর সংযোগ করিয়াছিল, কিন্তু গুঞ্জা তাহার হাতের উপর হাত রাখিয়া বলিল— ‘না।’
গাছের তলায় দুইটি সুন্দর ময়ূরপুচ্ছ পড়িয়াছিল, গুঞ্জা তাহা তুলিয়া লইয়া হাসিমুখে বজ্রের হাতে দিল; বজ্র সেই দুটি হইতে চন্দ্রক অংশ ছিঁড়িয়া লইয়া গুঞ্জার দুই কানে দুল দুলাইয়া দিল। স্মিতমুখে বলিল— ‘কুঁচবরণ কন্যা মেঘবরণ চুল, তোমার কানেতে কন্যা পিঞ্ছের দুল।’
কতদিনের পুরানো ছড়া, কাহার জন্য কে রচনা করিয়াছিল কে জানে। কিন্তু মধুমথনের মুখে ঐ ছড়াটি শুনিলে মনে হয় যেন গুঞ্জাকে লক্ষ্য করিয়া উহা রচিত হইয়াছিল। গুঞ্জা তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলিয়া তরুতলে বসিল, সম্মুখে পদদ্বয় প্রসারিত করিয়া বৃক্ষকাণ্ডে পৃষ্ঠভার এলাইয়া দিল। কুঁচবরণ কন্যা! আর মধুমথন? মধুমথন নামটির স্বাদ যেন চাকভাঙ্গা মধু’র মত মিষ্টি, মধু’র মাদকতার ন্যায় রক্তস্রোতে প্রবেশ করিয়া অনুরণিত হয়। — মধুমথন!—
বজ্র ধনুর্বাণ মাটিতে ফেলিয়া আলস্য ভাঙ্গিল, তারপর গুঞ্জার ঊরুর উপর মাথা রাখিয়া তৃণশয্যায় অঙ্গ প্রসারিত করিয়া দিল।
এইভাবে কিছুক্ষণ দুইজনে চোখে চোখে চাহিয়া রহিল। শান্ত নিরুদ্বেগ দৃষ্টি, নিস্তরঙ্গ মনের প্রতিবিম্ব। গুঞ্জার একটি হাত বজ্রের কেশগুচ্ছ লইয়া খেলা করিতেছে; একবার গণ্ডে হাত বুলাইয়া একটি ইন্দ্রতূলক মুছিয়া লইল। ক্রমে বজ্রের চক্ষু তন্দ্রায় মুদিয়া আসিল।
গুঞ্জা অর্ধনিমীলিত নেত্র তাহার মুখের পানে নত করিয়া রহিল। সাত বছর ধরিয়া ওই মুখখানি সে অহরহ দেখিয়াছে, কিন্তু নয়ন তৃপ্ত হয় নাই। আজ চৈত্রের কবোষ্ণ মধ্যাহ্নে নির্জন বনের ছায়ান্তরালে বসিয়া একটি কুশাগ্রতুল্য বাসনা তাহার মনে অঙ্কুরিত হইয়া উঠিল। মধুমথন বোধহয় ঘুমাইয়া পড়িয়াছে, ধীর নিশ্বাসের ছন্দে তাহার বক্ষ উঠিতেছে পড়িতেছে; রক্তিম অধরে যেন মধুসিক্ত সরসতা এখনও লাগিয়া আছে। গুঞ্জা নিশ্বাস বন্ধ করিয়া সন্তর্পণে সম্মুখ দিকে নত হইল; নিজ অধর দিয়া অতি লঘুভাবে বজ্রের অধর স্পর্শ করিল।
বজ্র হয়তো জাগিয়াছিল; হয়তো অস্পষ্ট তন্দ্রলোকে বিচরণ করিতেছিল; নিমেষ মধ্যে তাহার দুই বাহু গুঞ্জার কণ্ঠ জড়াইয়া লইল। দীর্ঘকাল তাহাদের অধর দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত হইয়া রহিল। তারপর বজ্র চক্ষু মেলিয়া গুঞ্জাকে ছাড়িয়া দিল।
গুঞ্জার বক্ষ দ্রুত স্পন্দিত হইতেছে, অধর পাণ্ডুবর্ণ। সে মুদ্রিত চক্ষে মাথাটি বৃক্ষকাণ্ডে রাখিয়া ঊর্ধ্বমুখীন হইয়া ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলিতে লাগিল।
‘কুঁচবরণ কন্যা!’
গুঞ্জা চক্ষু খুলিল না, কিন্তু তাহার মুখখানি ধীরে ধীরে আরক্তিম হইয়া উঠিতে লাগিল। এই সময় একটা কোকিল গাছে আসিয়া বসিল এবং বিস্ময়োৎফুল্ল কণ্ঠে ডাকিয়া উঠিল— কু কু কু!
বজ্র তীরবিদ্ধবৎ উঠিয়া দাঁড়াইল। গুঞ্জাকে পরম বিস্ময়ে ক্ষণেক নিরীক্ষণ করিয়া তাহার হাত ধরিয়া টানিয়া তুলিল। গুঞ্জা একবার বজ্রের চোখের পানে চোখ তুলিয়াই আবার নতমুখে বসিয়া পড়িবার উপক্রম করিল; তাহার মনে হইল তাহার দেহের অস্থিগুলা সব দ্রবীভূত হইয়া গিয়াছে।
কিন্তু বজ্র তাহার হাত দৃঢ় মুষ্টিতে আকর্ষণ করিয়া তরুতল হইতে লইয়া চলিল, ঈষৎ শঙ্কিতকণ্ঠে বলিল— ‘চল, মা’র কাছে ফিরে যাই।’
এই ঘটনার পর দু’জনের মাঝখানে যেন সূক্ষ্ম অথচ রহস্যমধুর লজ্জার একটি আবরণ পড়িয়া গেল, কিন্তু এই আবরণ তাহাদের মাঝে ব্যবধানের সৃষ্টি করিল না, বরং আরও নিবিড়ভাবে উভয়ের হৃদয় আকর্ষণ করিয়া দুশ্ছেদ্য গ্রন্থিতে বাঁধিয়া দিল।
বজ্র ও গুঞ্জার অনুরাগ, প্রকাশ্য না হইলেও, গ্রামের কাহারও অবিদিত ছিল না। সকলেই জানিত তাহাদের বিবাহ হইবে। কিন্তু দুইজনেই প্রাপ্ত-যৌবন, অথচ বিবাহের কোনও উদ্যোগ নাই। রঙ্গনা জল আনিতে নদীর ঘাটে যাইলে অন্যান্য স্ত্রীলোকেরা তাহাকে প্রশ্ন করিত— ‘হ্যাঁ রাঙা, বেটার বিয়ে না দিয়েই তো ঘরে বৌ পেয়েছ। তা এবার বিয়ে দাও। আর কবে দেবে?’
রঙ্গনা হাসিয়া বলিত— ‘আমি জানি না, ঠাকুর জানেন। তিনি বললেই দিয়ে দেব।’
ঠাকুরকে বলিলে তিনি কিছুক্ষণ অন্য মনে আকাশের পানে চাহিয়া থাকিতেন, বলিতেন— ‘আর দু’দিন যাক্।’
এইভাবে বজ্রের জন্মের পর ঊনিশ বছর কাটিয়া গেল। বয়ঃপ্রাপ্তির পর বজ্র যে কেবল শিকার করিয়া বেড়াইত তাহা নয়, প্রয়োজন কালে গ্রামের যৌথ কাজকর্মেও যোগ দিত। নিজের সহজাত স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখিয়া সকলের সঙ্গে মেলামেশা করিত, মাঠে গিয়া একসঙ্গে কাজ করিত। ধানের সময় ধান রোপণ করিত, আখের সময় আখ মাড়াই কার্যে সহযোগিতা করিত। কিন্তু এই ঊনিশ বছরে গ্রামের অবস্থা অল্পে অল্পে পরিবর্তিত হইতেছিল। শুধু গ্রাম নয়, সমস্ত দেশের অবস্থাই বহতা নদীর ন্যায় ক্রমশ নিম্নগামী হইয়াছিল।
কোনও দেশের অবস্থাই চিরদিন সমান থাকে না; কালভেদে তাহার পতন-অভ্যুদয় আছে। শশাঙ্কদেবের দীর্ঘ রাজত্বকালে গৌড়দেশে যে সম্পদ-শ্রীর জোয়ার আসিয়াছিল, তাঁহার মৃত্যুর পর তাহাতে ভাঁটা পড়িয়াছিল। গৌড়রাজ্য লইয়া বিভিন্ন রাজশক্তির মধ্যে টানাটানি ছেঁড়াছেঁড়ি চলিতেছিল। তাহাতেও হয়তো সামগ্রিকভাবে দেশের জনগণের অধিক ক্ষতি হইত না, কিন্তু এই অন্তর্বিপ্লবের সঙ্গে বাহির হইতেও এক প্রচণ্ড আঘাত পড়িয়াছিল। সে সময়ে সামুদ্রিক বাণিজ্য ছিল গৌড়বঙ্গের প্রাণ; এই সাগর-সমুদ্ভবা বাণিজ্য-লক্ষ্মী সাগরে ডুবিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। চাতক ঠাকুর দেবাবিষ্ট হইয়া যাহা দেখিয়াছিলেন তাহা মিথ্যা নয়, আরব দেশের মরুভূমিতে সত্যই ঝড় উঠিয়াছিল এবং সেই বাত্যাবিক্ষিপ্ত বালুকণা সমুদ্রের উপর দিয়া উড়িয়া আসিয়া গৌড়দেশের আকাশ সমাচ্ছন্ন করিয়া দিয়াছিল।
সমগ্র দেশের সহিত ক্ষুদ্র বেতসগ্রামও এই ঘনায়মান দুরদৃষ্টের অংশভাগী হইয়াছিল। গ্রামবাসীরা আর গ্রামের বাহিরে যায় না। কি জন্য যাইবে? গ্রামের গুড় বাহিরে বিক্রয় হয় না। স্বর্ণ রৌপ্যের প্রচলন দেশ হইতে ধীরে ধীরে লুপ্ত হইতেছে; দ্রহ্ম কার্ষাপণ দিয়া কেহ আর সহজে পণ্য কেনে না; কড়ি এখন প্রধান মুদ্রার স্থান আধিকার করিয়াছে। যে লক্ষ্মী নারিকেলফলাম্বুবৎ আসিয়াছিলেন তিনি আবার গজভুক্তকপিত্থবৎ অলক্ষিতে অন্তর্হিত হইতেছেন।
যেদিন বজ্রের বয়স ঊনিশ পূর্ণ হইল সেদিন সায়ংকালে অকস্মাৎ নিদাঘের আকাশ আচ্ছন্ন করিয়া নীল ঘনঘটার আবির্ভাব হইল। অশনি ও প্রভঞ্জনের রুদ্রতাণ্ডব শুরু হইয়া গেল; যেমন বজ্রের জন্মদিনে হইয়াছিল।
গুঞ্জা সায়ংদোহ করিতে বাথানে গিয়াছিল, সে সেইখানেই আটক পড়িল। বজ্র গিয়াছিল দেবস্থানে— চাতক ঠাকুরের একচালায়। বজ্র ঠাকুরের জন্য কৃষ্ণসারের চর্ম হইতে অজিন প্রস্তুত করিয়াছিল, তাহাই ভক্তিভরে ঠাকুরকে দিতে গিয়াছিল। তারপর উভয়ে বসিয়া লঘু জল্পনা করিতেছিল; দিনে দিনে দেশের অবস্থা কিরূপ দুর্গতির পথে চলিয়াছে তাহারই আলোচনা হইতেছিল এমন সময় আকাশে দৈত্যদানবের মালসাট্ আরম্ভ হইল।
বৎসরের এই সময় ঝড়-ঝাপটা অপ্রত্যাশিত নয়, কিন্তু এই বছর এই প্রথম। চাতক ঠাকুর চকিতে বজ্রের পানে চাহিলেন, মনে মনে কি গণনা করিলেন, তারপর বলিলেন— ‘দিন যায় না ক্ষণ যায়। বজ্র, আজ তোমার ঊনিশ বছর বয়স পূর্ণ হল।’
বজ্র ভুলে নাই। সে ঋজু হইয়া বসিয়া ঠাকুরের পানে চাহিয়া রহিল। শেষে বলিল— ‘তাহলে কুড়ি বছর বয়স হয়েছে?’
‘হাঁ, হয়েছে।’
‘তাহলে মা’কে জিজ্ঞাসা করতে পারি?’
‘পারো। কিন্তু জেনে কোনও লাভ নেই বজ্র। বরং—’
বজ্র তর্ক করিল না; উঠিয়া দাঁড়াইয়া শুধু বলিল— ‘আমি জানতে চাই।’
বৃষ্টিবাত্যা ভেদ করিয়া সে গৃহে ফিরিয়া চলিল।
বর্ষণ থামিয়াছে, বায়ু শান্ত হইয়াছে। সিক্ত প্রকৃতির সর্বাঙ্গে চন্দন-শীতল সরসতা। গুঞ্জা বাথান হইতে ফিরিয়া আসিয়া দেখিল, ঘরে প্রদীপ জ্বলিতেছে। মা ও ছেলে মুখোমুখি দাঁড়াইয়া আছে; মায়ের চোখে জল। মা ছেলের বাহুতে একটি সোনার অঙ্গদ পরাইয়া দিতেছে। অপূর্ব সুন্দর অঙ্গদ, বজ্রের বাহুতে এমন সুষ্ঠুভাবে লগ্ন হইল যেন তাহার বাহুর পরিমাপেই নির্মিত। রঙ্গনা দরদর-ধারে কাঁদিতে কাঁদিতে পুত্রের মস্তক বুকে টানিয়া লইল।
বজ্র অবরুদ্ধ স্বরে বলিল— ‘মা, আমি কালই পিতার সন্ধানে বেরুব। যেখান থেকে পারি সংবাদ নিয়ে আসব।’
এই দৃশ্য দেখিয়া গুঞ্জার হৃৎস্পন্দন যেন বন্ধ হইয়া গিয়াছিল। সে দুগ্ধকলস নামাইয়া তাহাদের কাছে গিয়া দাঁড়াইল। স্খলিত স্বরে বলিল— ‘মা, কি হয়েছে?’
রঙ্গনা উত্তর দিতে পারিল না, গুঞ্জাকেও বাহু বন্ধনের মধ্যে আকর্ষণ করিয়া অঝোরে অশ্রুবিসর্জন করিতে লাগিল।
সে রাত্রে তিনজনের কেহই ঘুমাইল না; অতীত ও ভবিষ্যতের দুরূহ দুর্গম ভাবনায় বিনিদ্র রজনী কাটিয়া গেল।
রাত্রি প্রভাত হইল; প্রাতঃসূর্যের উদয়ে সদ্যস্নাতা ধরণীর শুচিস্মিত রূপ প্রকাশ পাইল। স্নিগ্ধ বাতাস, প্রসন্ন আকাশ; শুভযাত্রার অনুকূল মুহূর্ত। বজ্র মাতাকে লইয়া দেবস্থানে উপস্থিত হইল; যুগল দেবতার সম্মুখে দণ্ডবৎ হইল; চাতক ঠাকুরের পদধূলি মাথায় লইল। রঙ্গনা পুত্রের কপালে চুম্বন দিল, কনিষ্ঠ অঙ্গুলি দংশন করিল, তারপর তাহাকে জড়াইয়া লইয়া কাঁদিতে লাগিল।
বজ্র মায়ের কানে কানে বলিল— ‘মা, কেঁদ না। যদি পিতার সন্ধান না পাই আমি একা তোমার কাছে ফিরে আসব।’
এমনই আশ্বাস দিয়া আর একজন চলিয়া গিয়াছিল। বিপুল সংসার তাহাকে ফিরাইয়া দেয় নাই। এবার দিবে কি?
রঙ্গনা ও চাতক ঠাকুর মৌরীর ঘাট পর্যন্ত বজ্রের সঙ্গে আসিলেন। তারপর বজ্র নদীর তীর ধরিয়া দক্ষিণমুখে চলিতে আরম্ভ করিল। তাহার মাথায় বাঁধা উত্তরীয়, স্কন্ধে একটি বংশদণ্ড, দণ্ডের প্রান্তে একটি পুঁটুলি বাঁধা। প্রগণ্ডে পিতার অভিজ্ঞান— সোনার অঙ্গদ।
যতক্ষণ দেখা গেল গলদশ্রুনেত্রা রঙ্গনা সেদিক হইতে চক্ষু ফিরাইল না। তারপর চাতক ঠাকুর হাত ধরিয়া তাহাকে গৃহে লইয়া গেলেন।
কিন্তু গুঞ্জা কোথায়? অতি প্রত্যূষে সে কলস লইয়া ঘাটে গিয়াছিল, আর ফিরিয়া আসে নাই। কোথায় গেল সে? ঘাটেও তো নাই।
বজ্র হেঁটমুখে চিন্তা করিতে করিতে চলিয়াছে। কত বিচিত্র চিন্তা, কোনও চিন্তাই মনের মধ্যে স্থায়ী হইতেছে না, চঞ্চল জলের উপর সূর্যকিরণের ন্যায় ক্ষণেক নৃত্য করিয়া অদৃশ্য হইতেছে। কাল রাত্রে বজ্র মা’কে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, আমার পিতার আকৃতি কেমন ছিল? উত্তরে মা একটি পিত্তলের থালিকা তাহার সম্মুখে ধরিয়াছিল; সেই থালিকার মার্জিত আদর্শে সে নিজের মুখ দেখিয়াছিল। কুড়ি বছর পূর্বে তাহার পিতার মুখও এমনি ছিল…গৌড়রাজ মানবদেব— তিনি কি জীবিত আছেন?…কর্ণসুবর্ণ কেমন নগর? বজ্র পূর্বে কখনও গ্রামের বাহিরে যায় নাই—
বেতসবন পিছনে পড়িয়া রহিল, বজ্র গ্রামের সীমান্তে আসিয়া উপনীত হইল। বৃদ্ধ জটিল ন্যগ্রোধ বৃক্ষ গ্রামের সীমা চিহ্নিত করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। বৃক্ষটি অধিক উচ্চ নয়, কিন্তু বহু স্তম্ভযুক্ত চন্দ্রাতপের ন্যায় জটস্তম্ভ রচনা করিয়া চারিদিকে বিস্তৃত হইয়া পড়িয়াছে। ঘন শাখাপত্রের নিম্নে নিবিড় ছায়া।
ন্যগ্রোধের ছায়াচ্ছত্র প্রান্তে আসিয়া বজ্র দাঁড়াইল, একবার পিছু ফিরিয়া চাহিল। দূরে বেতসলতার ফাঁকে ফাঁকে গ্রামটি দেখা যাইতেছে। ঐ গ্রামে তাহার মা আছেন, চাতক ঠাকুর আছেন, গুঞ্জা আছে—
বিদায়কালে গুঞ্জার সহিত দেখা হইল না। কোথায় গেল কুঁচবরণ কন্যা! সে কি অভিমান করিয়াছে— তাই বিদায়কালে সরিয়া রহিল?
‘মধুমথন!’
বিদ্যুদ্বৎ ফিরিয়া বজ্র দেখিল— ন্যগ্রোধ-বিতানের ভিতর হইতে গুঞ্জা বাহির হইয়া আসিতেছে। সে আসিয়া বজ্রের হাত ধরিল। গুঞ্জার চোখ দুটি যেন আরও বড় হইয়াছে, ঈষৎ রক্তিমাভ। মুখের ব্যঞ্জনা দৃঢ় সম্বৃত। বজ্রের হাত ধরিয়া গুঞ্জা তাহাকে বৃক্ষের ছায়ান্তরালে লইয়া গেল।
আজ গুঞ্জার সঙ্কোচ নাই, লজ্জা নাই। বজ্রকে সম্মুখে দাঁড় করাইয়া সে বাহু দিয়া তাহার কণ্ঠ জড়াইয়া লইল, দুরন্ত আবেগে তাহার চক্ষে গ্রীবায় অধরে চুম্বন করিতে লাগিল। বজ্র প্রথমে গুঞ্জার এই আবেগ-প্রগল্ভতায় বিমূঢ় হইয়াছিল, তারপর সেও চুম্বনে চুম্বনে তাহার প্রতিদান দিল।
কিছুক্ষণ পরে একটু শান্ত হইয়া গুঞ্জা বলিল— ‘তুমি কবে ফিরে আসবে?’
বজ্র বলিল— ‘তা জানি না। কিন্তু ফিরে আসব।’
‘আসবে? আসবে? আমাকে মনে থাকবে?’
বজ্র একটু হাসিল— ‘থাকবে।’
‘নগরের মেয়েরা শুনেছি মোহিনী হয়। তাদের দেখে আমাকে ভুলে যাবে না?’
‘না, কুঁচবরণ কন্যা, তোমাকে ভুলে যাব না।’
গুঞ্জা একাগ্র জিজ্ঞাসু নেত্রে বজ্রর মুখের পানে চাহিল, যেন তাহার অন্তরের মর্মস্থল পর্যন্ত দেখিবার চেষ্টা করিল। তারপর নিজের বুক হইতে বস্ত্র সরাইয়া বজ্রের একটা হাত নগ্ন বক্ষের উপর চাপিয়া ধরিল।
‘আমাকে বুকে হাত দিয়ে বলো— আর কোনও মেয়ের গায়ে হাত দেবে না।’
বজ্রের মেরুমজ্জার ভিতর দিয়া একটা তীব্র বিদ্যুৎশিহরণ বহিয়া গেল, শ্বাস রুদ্ধ হইয়া আসিল।
‘গুঞ্জা! কুঁচবরণ কন্যা!’
‘না, বলো। শপথ কর।’
‘শপথ করছি।’
‘তুমি আমার? শুধু আমার?’
‘হ্যাঁ, তোমার। শুধু তোমার।’
তারপর— ন্যগ্রোধ বৃক্ষের ছায়ান্ধকার যেন আরও নিবিড় হইয়া আসিল। গুঞ্জা চোখ বুজিয়া বলিল— ‘মনে থাকে যেন। সব দিয়ে তোমাকে নিজের করে নিলাম।’