সকলে এসে লাইব্রেরী ঘরে প্রবেশ করল।
মধুসূদন ও বৃন্দাবন সরকার দুই ভাই দুটো চেয়ারে পাশাপাশি বসেছিলেন, ওদের পদশব্দে মুখ তুলে তাকালেন দুজনেই একসঙ্গে।
দেখলেন বিমলবাবু? প্রশ্নটা করলেন মধুসূদনই।
হ্যাঁ।
বৃন্দাবনবাবু মধুসূদনবাবু, মিঃ রায়কে তাহলে আপনারা এই ব্যাপারের মীমাংসা করতে–
সুশান্তর কথাটা শেষ হল না, মধুসূদন সরকার বলে উঠলেন, নিশ্চয়ই। উনি যদি এ ব্যাপারের মীমাংসার ভারটা দয়া করে হাতে নেন, তাহলে আমরা সত্যিই ওঁর কাছে কৃতজ্ঞ থাকব, কি বল বৃন্দাবন?
নিশ্চয়ই। আমার তো হাত-পা পেটে সেধিয়ে যাবার যোগাড় হয়েছে-পনের দিনের মধ্যে দু-দুটো মৃত্যু! আত্মহত্যাই হোক বা হত্যাই হোক, এর একটা বিহিত করা একান্ত প্রয়োজন বইকি। সমর্থন জানালেন ছোট ভাই বৃন্দাবন সরকার।
এবারে কথা বললে কিরীটী ওঁদের দুই ভাইকেই লক্ষ্য করে, দেখুন আপনাদের ঐ ভৃত্য দশরথের মৃত্যুর ব্যাপারটা যে সুইসাইড নয় সে বিষয়ে আমি হলফ করে বলতে পারি, আর ঐভাবে দশরথের হত্যার ব্যাপারটা থেকে আমার মনে হচ্ছে, আপনাদের কাকামশাইয়ের মৃত্যুর ব্যাপারটাও সুইসাইড নয়—হোমিসাইডই-হত্যা!
মিঃ রায়,-বৃন্দাবন সরকার যেন কি বলবার চেষ্টা করেন কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে আবার কিরীটী বলে, হ্যাঁ মিঃ সরকার, আপনার কাকামশাইকেও-া, সামবডি ডেলিবারেটলি কিড় হিম, নো ডাউট অফ ইট–
বৃন্দাবনবাবু এবারেও কিছু বুঝি বলবার জন্য উদ্যত হয়েছিলেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় কিরীটীকে সমর্থন জানালেন এবারে মধুসূদন সরকার এবং বললেন, কেমন বৃন্দাবন, আমি সেদিন সব ব্যাপারটা শোনার পরই তোমাকে বলিনি! কোন্ দুঃখে আর কেনই বা আফটার অল কাকা অমনি করে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করতে যাবে! নিশ্চয়ই কেউ না কেউ তাকে হত্যা করেছে।
কিন্তু দাদা, এ যে কেবল অসম্ভবই নয়-অবিশ্বাস্যও! বৃন্দাবন সরকার বললেন।
সে তুমি যাই বল বৃন্দাবন, ইট ইজ দি ফ্যাক্ট!
বুঝলাম কিন্তু তাই যদি হয় তো কে তাকে হত্যা করবে আর কেনই বা তাকে আফটার অল হত্যা করতে যাবে বলতে পার দাদা? বৃন্দাবন সরকার আবার তাঁর জ্যেষ্ঠকে প্রশ্ন করেন।
তা কি করে বলব? তবে সহজ বিচার-বুদ্ধিতে এক্ষেত্রে যা মনে হচ্ছে তাই বলছি।
বেশ, তাহলে বলতে হয় বাইরে থেকেই কেউ না কেউ এসে সেরাত্রে তার ঘরে ঢুকে তাকে অমন করে হত্যা করে গিয়েছে!
আমার মনে হয় তা নয় বৃন্দাবনবাবু। প্রতিবাদ জানায় এবারে কিরীটী।
তা নয়?
না। সেরাত্রে যারা এ বাড়িতে ছিল তাদেরই মধ্যে নিশ্চয়ই, আমার বিশ্বাস, কেউ না কেউ তাকে হত্যা করেছিল। শুধু তাই নয়, হত্যাকারী বুদ্ধিমান বিচক্ষণ ও বেশ কিছু জ্ঞানগম্যিও তার ছিল। কিরীটী আবার বলে।
এ আপনি কি অসম্ভব কথা বলছেন মিঃ রায়। আবার প্রতিবাদ জানান বৃন্দাবন সরকার, সেরাত্রে এ বাড়িতে তো থাকার মধ্যে ছিলাম আমি, শকুন্তলা দেবী আর ছিল দশরথ, গোকুল, ঝি পেয়ারী, ঠাকুর হরিদাস, দারোয়ান রামভজন। এদের কি স্বার্থ থাকতে পারে কাকাকে হত্যা করার বলতে পারেন?
স্বার্থের কথা যদি বলেন বৃন্দাবনবাবু, কিরীটী বলে, তো অত জোরগলায় একেবারে ডেফিনিটলি কিছুই হলফ করে বলা যায় না। কারণ কিসে যে কার স্বার্থ থাকতে পারে আর কিসে যে কার স্বার্থ থাকতে পারে না, তা কি সর্বদা সকলের পক্ষে জানা সম্ভব। তাছাড়া বৃন্দাবনবাবু, একটু আগে যে লিস্ট বললেন, তার মধ্যে একজন কিন্তু বাদ গিয়েছে।
বাদ গিয়েছে? বৃন্দাবন শুধান।
হ্যাঁ, কেতু না রাহু কে একজন আপনার কাকার নতুন বেয়ারা নিযুক্ত হয়েছিল তার মৃত্যুর মাত্র দিন পনের আগে এবং যাকে ঘটনার দিন সকাল থেকেই আর ট্রেস করা আজ পর্যন্ত যায়নি—তাই না বিমলবাবু?
হ্যাঁ। বিমল সমর্থন জানায়।
কেতু-রাহু, কি ব্যাপার বৃন্দাবন? প্রশ্নটা এবারে করলেন মধুসূদনই তার ভাইকে।
হ্যাঁ শুনেছি বটে, কেতু নামে একটা নতুন লোককে কিছুদিন আগে রাখা হয়েছিল, কিন্তু লোকটাকে বিশেষ তেমন আমিও দেখিনি দাদা।
আই সি! তা লোকটা বুঝি উধাও?
হ্যাঁ। তবে তার যথাসম্ভব ডেসক্রিপশন দিয়ে প্রায় সর্বত্রই পুলিস স্টেশনে স্টেশনে ইনফরমেশন পাঠিয়ে দিয়েছি ঐদিনই। বাছাধন যাবেন কোথায়! বললে বিমল কতকটা যেন আত্মপ্রত্যয়ের কণ্ঠে ঐসময়।
তা এতগুলো লোক তো বাড়িতে রয়েছে, আবার একজন নতুন লোকই বা আমদানি করবার কি প্রয়োজন হয়েছিল, বিশেষ করে অজ্ঞাতকুলশীল? কথাটা বললেন মধুসূদন সরকার।
দশরথ বুড়ো হয়ে গিয়েছে, কাকার দেখাশুনা তেমন আর করে উঠতে পারছিল না, তাই নাকি লোকটাকে কাজে বহাল করা হয়েছিল। শকুন্তলা দেবী কথাটা আমাকে বলেছিলেন। মধুসূদন সরকারের প্রশ্নের জবাব দিলেন বৃন্দাবনবাবু।
কাকা এত বড় কাঁচা কাজটা কি করে যে করলেন বুঝলাম না! অজ্ঞাতকুলশীল একটা লোককে হুট করে কি করে যে তিনি এ বাড়ির কাজে বহাল করলেন, বিশেষ করে তার মত একজন সতর্ক ও বিচক্ষণ প্রকৃতির লোক, এখনও বুঝে উঠতে পারছি না। মধুসূদন আবার মৃদুকণ্ঠে কথাটা বললেন।
কিন্তু সে যাই হোক মধুসূদনবাবু, লোকটা দুর্ঘটনার সময় এ বাড়িতে উপস্থিত ছিল যখন, তখন সন্দেহের তালিকায় সেই কেতুকেও আমাদের ধরতে হবে। বললে কিরীটী।
ধরাধরি আর কি মিঃ রায়, এ তো অত্যন্ত সহজ ব্যাপার! আপনার কথা যদি সত্যি বলে ধরে নেওয়া যায়, তাহলে সবচাইতে বেশী সন্দেহ তো ঐ লোকটার উপরেই পড়ে! বললেন মধুসূদন।
তারপরই একটু থেমে আবার মৃদুকণ্ঠে বললেন, কিন্তু বর্তমানে তো সে হাতের কাছে আমাদের নেই–
মধুসূদনের কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে কিরীটী বললে, না থাকলেও আমাদের তদন্তের ব্যাপারে অগ্রসর হতে বিশেষ কোন অসুবিধা হবে না মিঃ সরকার। কারণ আপাতত যাঁরা আমাদের চোখের সামনেই আছেন বা আছে, তাদের সম্পর্কেই তো আমরা এখনো সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল হতে পারিনি। কিন্তু তারও পূর্বে আমি একটা বিষয়, মধুসূদনবাবু ও বৃন্দাবনবাবু, আপনাদের কাছে জানতে চাই–
বলুন! দুজনেই তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে।
সারদাবাবু-আপনাদের কাকা কোনরকম উইল কিছু করে গিয়েছেন কিনা জানেন?
উইল!
হ্যাঁ, মধুসুদনবাবু। কারণ শুনেছি আপনাদের সরকার জুয়েলারী বিরাট একটা লাভজনক প্রতিষ্ঠান। এত বড় সম্পত্তির একটা কিছু বিলি-ব্যবস্থা ভবিষ্যতের জন্যে ভেবে নিশ্চয় তিনি করে রেখেছিলেন, স্বাভাবিক বলেই মনে হয় না কি! কিরীটী বললে ওঁদের দিকে তাকিয়ে।
তা তো নিশ্চয়ই। তবে আমি তো এখানে দীর্ঘদিন ছিলাম না, কাকার সঙ্গে কোন চিঠিপত্রের যোগাযোগও ছিল না-বৃন্দাবনই কাকার কাছে ছিল। সেরকম কিছু থাকলে ও-ই হয়ত ভাল বলতে পারবে। বললেন মধুসূদন সরকার ভাইয়ের দিকে চেয়ে।
আমিও সঠিক কিছু বলতে পারব না বর্তমানে মিঃ রায়, এসব ব্যাপার জানেন সব কিছুই হয়তো আমাদের সলিসিটার বোস ও চৌধুরী ফার্মের মিঃ শচীবিলাস বোস। তিনিই আমাদের লিগ্যাল অ্যাডভাইসার ছিলেন। কিন্তু কাকার মৃত্যুর পর থেকে আর তো ইতিমধ্যে আমি কলকাতাতেই যাইনি—তাঁর সঙ্গে এর মধ্যে দেখাসাক্ষাৎও হয়নি।
আপনার কাকার মুখেও কখনও কি ঐ সম্পর্কে কিছু শোনেননি বৃন্দাবনবাবু?
না, প্রয়োজন হয়নি। তাছাড়া বিষয়-সম্পত্তির ব্যাপারে কাকা কখনও কিছু আলোচনা পছন্দ করতেন না।
কিন্তু মানুষের একটা কৌতূহলও তো হয় বৃন্দাবনবাবু!
তা হয়তো হয়, কিন্তু আমার বেলায় তো তার কোন প্রয়োজন ছিল না। কারণ কাকার তো কোন সন্তানাদি ছিল না—যা কিছু সব তো আমরাই পাব জানতাম।
কিন্তু মানুষের মনের কথা তো কিছু বলা যায় না বৃন্দাবনবাবু! কিরীটী আবার বলে।
তা হয়তো যায় না, তবে কাকার দিক থেকে সেরকম কিছু ঘটবার সম্ভাবনা হলে অন্তত
আমি জানতে পারতাম বৈকি!
ইতিমধ্যে একসময় বিমল সেন ঘর থেকে বের হয়ে গিয়েছিল দশরথের মৃতদেহটা ময়না। তদন্তের জন্য পাঠাবার ব্যবস্থা করতে।
সত্যি কথা বলতে কি, থানা অফিসার বিমল সেন দশরথের মৃত্যুর ব্যাপারে বেশ একটু বিচলিতই হয়ে পড়েছিল।
ঘটনার পরিস্থিতিতে এখন মনে হচ্ছে তারও যে সারদা সরকার ও দশরথের মৃত্যুর ব্যাপার দুটো সাধারণ আত্মহত্যা নয়—দুটোই হত্যা!
দুজনকেই হত্যা করা হয়েছে।
আর ব্যাপারটা রীতিমত জটিলই বলে তার এখন মনে হচ্ছে।
বিমল সেন যখন পুনরায় ঘরের মধ্যে ফিরে এল, কিরীটী তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, সমস্ত বাড়িটা একবার ঘুরে দেখলে কেমন হত বিমলবাবু?
বেশ তো, দেখুন না!