০৮. শাহনাজ এবং ক্যাপ্টেন ডাবলুকে নিয়ে

শাহনাজ এবং ক্যাপ্টেন ডাবলুকে নিয়ে মহাজাগতিক প্রাণীটি যে ভাসমান যানটাতে উঠল সেরকম যান সায়েন্স ফিকশানের সিনেমাতেও দেখা যায় না। সেটি একটি মাইক্রোবাসের মতো বড় আর যন্ত্রপাতিতে বোঝাই। চকচকে ধাতব রঙের, দুই পাশে ছোট ছোট দুটি পাখা, মাথাটা সুচালো। পিছনে গেলে একটা ইঞ্জিক। ভিতরে পাশাপাশি তিনটা সিট। মাঝখানে মহাজাগতিক প্রাণী বসেছে, দুই পাশে শাহনাজ আর ক্যাপ্টেন ডাবলু। ভাসমান যানটা চলতে শুরু করার আগে শাহনাজ ভয়ে ভয়ে বলল, এটা বেশি ঝাঁকাবে না তো? আঁকুনি হলে আমার কিন্তু শরীর খারাপ হয়ে যায়।

মহাজাগতিক প্রাণী বলল, না ঝাঁকাবে না।

শাহনাজ জিজ্ঞেস করল, ইয়ে তামার নাম কী?

আমি আগেই বলেছি নাম–পরিচয় ইত্যাদি ব্যাপারগুলোতে আমরা বিশ্বাস করি না।

কিন্তু তোমাকে তো কিছু একটা বলে ডাকতে হবে। বল কী বলে ডাকব?

উচ্চ কম্পনের একটা শব্দ করে ডাকতে পার।

কুকুরকে যেভাবে শিস্ দিয়ে ডাকে সেরকম?

ক্যাপ্টেন ডাবলু বলল, সেটা ভালো হবে না। যে এত সুন্দর একটা ভাসমান যান চালাবে তার একটা ফ্যান্টাবুলাস নাম দরকার। যেমন মনে করা যাক– ক্যাপ্টেন ডাবলু মাথা চুলকে বলল, ডক্টর জিজি?

ডক্টর জিজি?

শাহনাজ আপত্তি করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু মহাজাগতিক প্রাণীটা মাথা নেড়ে বলল, ভালো নাম। আমি ডক্টর জিজি।

তোমার নামটা পছন্দ হয়েছে?

মহাজাগতিক প্রাণীটা মাথা নাড়ল, কাজেই কারোই আর কিছু বলার থাকল না। ডক্টর জিজি সামনে রাখা ত্রিমাত্রিক কিছু যন্ত্রপাতির মাঝে হাত দিয়ে কিছু একটা স্পর্শ করতেই ভাসমান যানটিতে একটা মৃদু কম্পন অনুভব করল এবং প্রায় সাথে সাথে সেটি উপরে উঠে গিয়ে প্রায় বিদ্যুদ্বেগে ছুটে যেতে রু করে। মাটির কাছাকাছি দিয়ে এটি গাছপালা ঘরবাড়ি মানুষজনের পাশ দিয়ে ছুটে যেতে থাকে। কিন্তু কী আশ্চর্য! কেউ ঘুরেও তাদের দিকে তাকাল না। ভাসমান যানের ভিতর দিয়ে তারা সবাইকে দেখতে পাচ্ছে কিন্তু তাদেরকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না। কী বিচিত্র ব্যাপার!

শাহনাজ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ডক্টর জিজি, আমাদেরকে কেউ দেখতে পাচ্ছে কেন?

কাউকে দেখতে হলে তাকে একই সময় এবং একই স্থানে থাকতে হয়। আমরা সময়ের ক্ষেত্রে একটু এগিয়ে আছি, কাজেই আমরা তাদের দেখতে পাচ্ছি কিন্তু তারা আমাদের দেখতে পাচ্ছে না।

সময়ে তারা যখন এগিয়ে আসবে?

তখন আমরাও এগিয়ে যাব, তাই কেউ দেখতে পারবে না।

ক্যাপ্টেন ডাবল ব্যাপারটি এত সহজে মেনে নিতে রাজি হল না। ঘাড়ের রগ ফুলিয়ে তর্ক করার প্রস্তুতি নিল, বলল, কিন্তু আমি পড়েছি কিছু দেখতে হলে লাইট কোণের মাঝে থাকতে হয়, কাজেই আমরা যদি তাদের দেখতে পাই তা হলে তারাও আমাদের দেখতে পাবে।

ডক্টর জিজি বলল, ব্যাপারটি বোঝার মতো যথেষ্ট নিউরন তোমাদের নেই। সহজ করে এভাবে বলি–আমাদের কাছে আলো আসছে বলে আমরা তাদের দেখছি, আমাদের এখান থেকে কোনো আলো তাদের কাছে যাচ্ছে না বলে তারা আমাদের দেখছে না।

ক্যাপ্টেন ডাবলু তর্ক করার জন্য আবার কী একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই তাদের ভাসমান যানটি হঠাৎ পুরোপুরি কাত হয়ে একটা বড় বিল্ডিঙের ভিতর ঢুকে গেল, বারান্দা দিয়ে ছুটে গিয়ে একটা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। ডক্টর জিজি বলল, সোমা এই ঘরে আছে।

শাহনাজ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কীভাবে জান?

তোমার মস্তিষ্কে যে তথ্য আছে সেটা ব্যবহার করে বের করেছি।

শাহনাজ কী একটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল তার আগেই ভাসমান যানটি কাত হয়ে ঘরের মাঝে ঢুকে গেল। শাহনাজ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল একটা ছোট জায়গার ভিতরে কেমন করে একটা বড় জিনিস ঢুকে পড়ে, কিন্তু তার আগেই তার নজরে পড়ল বিছানায় শুয়ে সোমা ছটফট করছে। তার মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম, ঠোঁট কালচে এবং মুখ রক্তশূন্য। সোমার কাছে তার আম্মা দাঁড়িয়ে আছেন, তার মুখ ভয়ার্ত। সোমার হাত ধরে কাতর গলায় বলছেন, কী হয়েছে সোমা? মা, কী হয়েছে?

ব্যথা করছে মা। বুকের মাঝে ব্যথা করছে।

সোমার আম্মা লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, তারপর চিৎকার লাগলেন, নার্স নার্স। নার্স কোথায়?

আম্মার কথা শুনে কেউ এল না, তখন আম্মা চিৎকার করতে করতে বের হয়ে গেলেন। শাহনাজ বলল, চল আমরা নামি।

ডক্টর জিজি বলল, না। এই গাড়ি থেকে বের হলে তোমাকে দেখতে পাবে। এখন বের হওয়া যাবে না।

শাহনাজ প্রায় কান্না–কান্না হয়ে বলল, কিন্তু সোমা আপার বুকের মাঝে কষ্ট!

ডক্টর জিজি বলল, আমরা সেটা এক্ষুনি দেখব।

ডক্টর জিজির কথা শেষ হবার আগেই সোমার আম্মা আবার ঘরে এসে ঢুকলেন, তার পিছু পিছু একজন পুরুষমানুষ এসে ঢুকল। মানুষটা খুব বিরক্তমুখে সোমার আম্মাকে ধমক দিয়ে বলল, কী হয়েছে? এত চিৎকার করছেন কেন?

আমার মেয়েটার বুকে খুব ব্যথা করছে!

ব্যথা তো করবেই। অসুখ হলে ব্যথা করবে না?

কিন্তু ওষুধ দিয়ে তো ব্যথা কমার কথা, কমছে না কেন?

মানুষটা ধমক দিয়ে বলল, আমি কি ওষুধ তৈরি করি? আমি কেমন করে বলব?

ডক্টর জিজি বলল, বিচিত্র, অত্যন্ত বিচিত্র।

শাহনাজ জিজ্ঞেস করল, কী বিচিত্র?

এই মানুষটি মুখে একটি কথা বলছে কিন্তু মস্তিষ্কে সম্পূর্ণ অন্য কথা।

মস্তিষ্কে কী কথা বলছে?

মস্তিষ্কে বলছে যে—ভাগ্যিস বেটি জানে না আমি ভুল ওষুধ দিয়ে ফেলেছি!

সর্বনাশ! তাই বলছে ওই বদমাইশ লোকটা? ওই পাজি লোকটা? শয়তান লোকটা?

হ্যাঁ।

এখন কী হবে ডক্টর জিজি? শাহনাজ প্রায় কেঁদে ফেলল, এখন সোমা আপুর কী হবে?

বিশেষ কিছু হবে না। ডক্টর জিজি বলল, সোমার শরীর সামলে নিয়েছে। ভুল ওষুধে বেশি ক্ষতি হয় নি। কিন্তু খুব বিচিত্র।

কী বিচিত্র?

ওই মানুষটার মস্তিষ্ক আবার একটা জিনিস বলছে, কিন্তু মুখে অন্য জিনিস বলছে।

কী বলছে মস্তিষ্কে? কী চিন্তা করছে? তুমি সব শুনতে পাচ্ছ?

ডক্টর জিজি শাহনাজের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি একটা কাজ করি তা হলে তোমরাও শুনতে পারবে।

কী করবে?

মানুষটার ভোকাল কর্ডের সাথে মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণটা জুড়ে দিই। তা হলে সে যা চিন্তা করবে সেটা জোরে জোরে বলবে।

তুমি করতে পারবে?

পারব।

তোমাকে কি লোকটার ভিতরে যেতে হবে? নাকি এখানে বসেই করবে?

আমি বলে এখানে কিছু নেই। আমি একটা রূপ, আমাদের প্রকৃত অস্তিত্ব এক ও অভিন্ন।

বুঝেছি বুঝেছি বুঝেছি। শাহনাজ মাথা চেপে ধরে বলল, এখন বক্তৃতা না দিয়ে তোমার কাজ শুরু কর।

ডক্টর জিজি তার যন্ত্রপাতির মাঝে হাত ঢুকিয়ে কিছু একটা স্পর্শ করল এবং হঠাৎ করে সোমার আম্মার সাথে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার মাথাটা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে নড়তে থাকে। সোমার আম্মা এক পা পেছনে সরে ভয় পেয়ে বললেন, কী হয়েছে? আপনার কী হয়েছে?

মানুষটার মাথাটা হঠাৎ যেভাবে নড়তে শুরু করেছিল ঠিক সেরকম হঠাৎ করে আবার থেমে গেল। বলল, না কিছু হয় নাই। খালি মনে হল মগজ থেকে কিছু একটা টেনে বের করে নিয়ে গেল!

সোমার আম্মা অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকালেন, জিজ্ঞেস করলেন, কী বললেন আপনি?

আমি কিছু বলি নাই। এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, যেটা বলতে চাই নাই সেটাও বলে ফেলেছি! শালার মহাযন্ত্রণা দেখি।

সোমার আম্মা কোনো কথা না বলে অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মানুষটা থতমত খেয়ে বলল, আমি আপনার মেয়েকে ব্যথা কমানোর জন্য একটা ইনজেকশন দিয়ে দিই। এবারে চেষ্টা করব ঠিক ইনজেকশন দিতে আগেরবারের মতো ভুল যেন না হয়!

সোমার আম্মা চমকে উঠে বললেন, কী বললেন আপনি? কী বললেন? আপনি আগেরবার ভুল ইনজেকশন দিয়েছেন?

মানুষটি মাথা নেড়ে বলল, না, না, না, আমি ভুল ইনজেকশন দিই নাই।

শাহনাজ অবাক হয়ে দেখল মানুষটা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আবার কথা বলতে শুরু করেছে, কী মুশকিল! আমি সব কথা দেখি বলে ফেলছি। তুল ইনজেকশন দিয়েছি দেখেই তো এই যন্ত্রণা। ওষুধগুলো চুরি করার জন্য আলাদা করে রেখেছিলাম, তখনই তো গোলমালটা হল।

সোমার আম্মা তীক্ষ্ণচোখে মানুষটার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি ওষুধ চুরি করেন?

মানুষটার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল, সে কথা না–বলার জন্য নিজের মুখ চেপে ধরার চেষ্টা করে, কিন্তু তবু মুখ থেকে কথা বের হতে থাকে, আমি তো অনেকদিন থেকেই ওষুধ চুরি করছি। শুধু ওষুধ চুরি করলে কী হয়? রোগীদের বিপদের মাঝে ফেলে দিয়ে তাদের থেকে টাকাও আদায় করি। আর গ্রামের সাদাসিধে মানুষ হলে তো কথাই নাই, তাদের এমনভাবে ঠকাই যে বারটা বেজে যায়।

সোমার আম্মা অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইলেন, মানুষটা কাঁদো–কাঁদো হয়ে বলল, আমার কী হয়েছে আমি বুঝতে পারছিজ, উল্টাপাল্টা কথা বলে ফেলছি।

উল্টাপাল্টা বলছেন নাকি সত্যিই বলছেন?

মানুষটা আবার প্রাণপণে মুখ বন্ধ করে রাখার চেষ্টা করে কিন্তু তবু তার মুখ থেকে কথা বের হতে থাকে, এ কী বিপদের মাঝে পড়েছি! সব কথা দেখি বলে দিয়ে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারতে শুরু করেছি। এখন তো মনে হচ্ছে অন্য কথাগুলোও বলে দেব! কয়দিন আগে একজন রোগী এসেছিল, যখন ব্যথায় ছটফট করছে তখন মানিব্যাগটা সরিয়ে দিলাম কেউ টের পেল না! সেদিন ফুড পয়জনিঙে যখন একটা নতুন বউ এল, তার গলার হারটা খুলে নিলাম। ইচ্ছে করে ওভারডোজ ঘুমের ওষুধ দিয়ে রেখেছিলাম। তারপর সেই বাচ্চার কেসটা ধরা যাক–

মানুষটা আর পারল না, দুই হাতে নিজের চুল টেনে ধরে চিৎকার করতে করতে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। সোমা ক্ষীণ গলায় বলল, কী হয়েছে আম্মু?

তোকে নাকি একটা ভুল ওষুধ দিয়েছিল তাই ব্যথা কমছে না।

মানুষটা কী ভালো দেখেছ আম্মু? ভুল হয়ে গেছে সেটা নিজেই স্বীকার করল!

ভালো না হাতি! কী কী করেছে শুনিস নি? আস্ত ডাকাত, পুলিশের হাতে দিতে হবে। দাঁড়া আগে ঠিক ওষুধ দেওয়ার ব্যবস্থা করি।

শাহনাজ অবাক বিস্ময়ে পুরো ব্যাপারটি দেখছিল। এবারে অকারণেই গলা নামিয়ে ডক্টর জিজিকে বলল, তুমি সোমা আপুকে ভালো করে দিতে পারবে?

ডক্টর জিজি কিছুক্ষণ তার যন্ত্রপাতির দিকে তাকিয়ে বলল, মনে হয় পারব।

শাহনাজ হাততালি দিয়ে বলল, সত্যি পারবে?

হ্যাঁ।

কী করতে হবে?

ডক্টর জিজি তার যন্ত্রপাতি স্পর্শ করে বলল, সোমার হৃৎপিণ্ডে একটা সমস্যা আছে। তোমরা যেটাকে হৃৎপিণ্ড বল সেখানে একটা ইনফেকশন হয়ে একটা অংশ অকেজো হয়ে যাচ্ছে। রক্ত সঞ্চালনে সমস্যা হচ্ছে, এভাবে থাকলে বড় বিপদ হয়ে যাবে।

শাহনাজ ভয় পাওয়া গলায় বলল, সর্বনাশ! কীভাবে এটা ঠিক করবে?

এখান থেকে ঠিক করা যায়। আবার শরীরের ভিতরে ঢুকে হৃৎপিণ্ডে ঢুকেও ঠিক করা যায়।

শরীরের ভিতরে ঢুকে? শাহনাজ চোখ কপালে তুলে বলল, শরীরের ভিতরে ঢুকবে কেমন করে?

ক্যাপ্টেন ডাবলু উত্তেজিত গলায় বলল, শাহপু–মনে নাই তোমাকে বলেছিলাম ডক্টর জিজি স্পেসকে ছোট করে ফেলতে পারে? আমরা সবাই মিলে এখন ছোট হয়ে কী–মজা হবে আপুর শরীরে ঢুকে যাব, তাই না ডক্টর জিজি?

ক্যাপ্টেন ডাবলু অতিরিক্ত উত্তেজনার কারণে শাহনাজের নামটি আরো সংক্ষিপ্ত করে সেটাকে শাহপু করে ফেলেছে, কিন্তু সেটা এখন কেউই খেয়াল করল না। ছোট হয়ে সোমার শরীরের ভিতর ঢুকে যাওয়ার কথাটি সত্যি কি না জানার জন্য শাহনাজ ডক্টর জিজির দিকে তাকাল। ডক্টর জিজি মাথা নাড়ল, বলল, আসলে ব্যাপারটা আমরা যেভাবেই করি না কেন, এর মাঝে টপোলজিক্যাল কিছু স্থানান্তর হবে। কিন্তু তোমাদের মনে হবে তোমরা অনেক ছোট হয়ে সোমার শরীরে ঢুকে যাচ্ছ।

শাহনাজ বুকের ভিতর আটকে থাকা একটা নিশ্বাস বের করে দিল। তারা নিশ্চয়ই এর মাঝে খানিকটা ছোট হয়ে গেছে তা না হলে মাইক্রোবাসের মতো বড় একটা স্পেসশিপ এই ছোট ঘরটায় ঢুকে গেল কেমন করে?

ডক্টর জিজি তার যন্ত্রপাতিতে হাত দিতে দিতে বলল, তোমরা শক্ত করে সিট ধরে রাখ, অনেক বড় ত্বরণ হবে।

শাহনাজ শুকনো গলায় বলল, বেশি ঝাঁকুনি হবে না তো? বেশি ঝাঁকুনি হলে আমার আবার শরীর খারাপ হয়ে যায়, বমিটমি করে দিই।

ডক্টর জিজি বলল, কিছু ঝাঁকুনি হতে পারে।

সর্বনাশ! আর সোমা আপু? তার শরীরের ভিতরে ঢুকে যাব–সে ব্যথা পাবে না তো?

চামড়া ফুটো করে শরীরের ভিতরে ঢুকে যাবার সময় একটু ব্যথা পাবে, মশার কামড় বা ইনজেকশনের মতো। তারপর আর টের পাবে না।

ভাসমান যানটি ভোঁতা শব্দ করে ঘরের ভিতরে ঘুরতে শুরু করে। শাহনাজের কেমন জানি ভয়–ভয় করতে থাকে, সে শক্ত করে তার সিটটা ধরে রাখল। ক্যাপ্টেন ডাবলুর দিকে তাকিয়ে দেখল তার মুখ আনন্দে জ্বলজ্বল করছে, উত্তেজনায় সবগুলো দাঁত বের হয়ে আছে। শাহনাজের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, কী খেপচুরিয়াস ফ্যান্টাগ্নিমাস কুকাডুমাস ব্যাপার! কী বুকাংটুকাস, কী নিন্টিফিটাস!

ক্যাপ্টেন ডাবলুর অর্থহীন চিৎকার শুনতে শুনতে শাহনাজ দেখতে পেল সোমার সারা ঘরটা আস্তে আস্তে বড় হতে শুরু করেছে। শুধু ঘরটা নয়, সোমাও বড় হতে শুরু করেছে, মনে হচ্ছে সোমা বিশাল একটা ভাস্কর্যের মতো বড় হয়ে ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মাঝেই মনে হল তারা বুঝি এক বিশাল আদি অন্তহীন প্রান্তরে, বহুদূরে বিশাল পাহাড়ের মতো সোমা শুয়ে আছে, তাকে আর এখন মানুষ বলে চেনা যায় না। ক্যাপ্টেন ডাবলু চিৎকার করে বলল, শাহপু, দেখেছ– মনে হচ্ছে আমরা ঠিক আছি আর সবকিছু বড় হয়ে গেছে? আসলে আমরা ছোট হয়ে গেছি। কী বুকাংটুকাস ব্যাপার!

ক্যাপ্টেন ডাবলুর কাছে এটা খুব মজার বুকাংটুকাস ব্যাপার মনে হলেও শাহনাজের ভয়–ভয় করতে থাকে। কোনো কারণে তারা যদি আর বড় না হতে পারে তা হলে কী হবে? কেউ তো কখনো তাদের খুঁজেও পাবে না।

ডক্টর জিজি বলল, আমরা এখন সোমার শরীরে অনুপ্রবেশ করতে যাচ্ছি। সবাই প্রস্তুত থাক।

ভাসমান যানটা হঠাৎ মাথা নিচু করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে, শাহনাজ নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে। ভাসমান যানটা দিক পরিবর্তন করে সামনের পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, ধীরে ধীরে পাহাড়ের ঘুঁটিনাটি তাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, এটা নিঃসন্দেহে সোমার শরীরের কোনো অংশ, সেটি এখন এত বিশাল যে কোন অংশ আর বোঝা যাচ্ছে না। হয়তো হাত, কিংবা হাতের আঙুল, কিংবা নাক বা কপাল! ডক্টর জিজি ভাসমান যানটিকে নিয়ন্ত্রণ করে সামনের দিকে ছুটিয়ে নিতে থাকে। সোমার মনে হতে থাকে তারা। বুঝি এক্ষুনি কোনো এক বিশাল পাহাড়ে আঘাত খেয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার করে সে চোখ বন্ধ করল। সাথে সাথে প্রচণ্ড একটা ধাক্কা অনুভব করল, সাথে সাথে। চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। ক্যাপ্টেন ডাবলু আনন্দে চিৎকার করে বলল, নিন্টিফিটাস! শরীরের ভিতরে ঢুকে গেছি!

শাহনাজ ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে বলল, এত অন্ধকার কেন?

শরীরের ভিতরে তো অন্ধকার হবেই। ক্যাপ্টেন ডাবলু ডক্টর জিজিকে বলল, একটু আলো জ্বেলে দাও না।

সাথে সাথে বাইরে উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠল, শাহনাজ অবাক হয়ে দেখল বিশাল একটা পাইপের মাঝে দিয়ে তারা ছুটে যাচ্ছে পাইপে হলুদ রঙের তরল, তার মাঝে নানা ধরনের জিনিস ভাসছে। ভাসমান যানটিকে হঠাৎ কে যেন প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা দেয়, আর সেই ধাক্কায় তারা সামনে ছিটকে পড়ল। শাহনাজ কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, কী হয়েছে?

আমরা একটা আর্টারিতে ঢুকেছি। হৃৎপিণ্ডের স্পন্দনের সাথে সাথে রক্তের চাপের জন্য এ রকম একটা ধাক্কা খেয়েছি।

রক্ত? শাহনাজ অবাক হয়ে বলল, বাইরে এটা রক্ত?

হ্যাঁ।

কিন্তু রক্ত তো লাল হবার কথা, হলুদ কেন?

ক্যাপ্টেন ডাবলু বলল, বুঝতে পারছ না শাহপু, আমরা এত ছোট হয়ে গেছি যে সবকিছু আলাদা আলাদা দেখতে পাচ্ছি। হলুদ তরলটা হচ্ছে প্লাজমা। মাঝে মাঝে যে লাল রঙের জিনিস দেখতে পাচ্ছ বড় বড় থালার মতো গোল গোল, সেগুলো হচ্ছে লোহিত কণিকা। আর ঐ সাদা সাদাগুলো, ভিতরে নিউক্লিয়াস, সেগুলো নিশ্চয়ই শ্বেতকণিকা। তাই না ডক্টর জিজি?

ডক্টর জিজি ভাসমান যানটিকে রক্তের স্রোতের মাঝে দিয়ে চালিয়ে নিতে নিতে মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ।

শাহনাজ ভয়ে ভয়ে বলল, কিন্তু শ্বেতকণিকা তো সবসময় শরীরের মাঝে রোগজীবাণুকে আক্রমণ করে! আমাদেরকে আক্রমণ করে ফেলবে না তো?

শাহনাজের কথা শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ করে অনেকগুলো শ্বেতকণিকা তাদের। ভাসমান যানটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, প্রচণ্ড আক্রমণে তাদের ভাসমান যানটি ওলটপালট খেতে থাকে। শাহনাজ ভয়ে–আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল। ডক্টর জিজি বলল, সবাই সাবধান, বাড়তি ত্বরণ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি।

হঠাৎ করে তারা একটা প্রচণ্ড গতিবেগ অনুভব করল, মনে হল কোনো কঠিন জিনিস ভেদ করে তারা এগিয়ে যাচ্ছে। খানিকক্ষণ ওলটপালট খেয়ে একসময় তারা স্থির হল। শাহনাজের সমস্ত শরীর গুলিয়ে আসছে, মনে হচ্ছে এখনি বুঝি হড় হড় করে বমি করে দেবে। ফ্যাকাসে মুখে সে ডক্টর জিজির মুখের দিকে তাকাল, কী হচ্ছে এখানে?

পুরো ভাসমান যানের শরীরে বৈদ্যুতিক চার্জ দিয়ে দিয়েছি। শ্বেতকণিকা এখন আর আক্রমণ করবে না।

শাহনাজ তাকিয়ে দেখল সত্যিই তাই, ভয়ঙ্কর শ্বেতকণিকাগুলো এখন দূরে দূরে রয়েছে, কাছে আসতে সাহস পাচ্ছে না। শাহনাজ কী একটা বলতে চাইছিল তার আগেই আবার পুরো ভাসমান যানটি দুলে উঠে প্রচণ্ড ধাক্কায় সামনে এগিয়ে যায়। প্রস্তুত ছিল না বলে ক্যাপ্টেন ডাবলু তার সিট থেকে উল্টে পড়ল, মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে উঠে বসে বলল, কী–মজা–হবে আপুর হার্ট কী শক্ত দেখেছ? একেকবার যখন বিট করে, আমরা একেবারে ভেসে যাই।

শাহনাজ অনেক কষ্ট করে বমি আটকে রেখে বলল মানুষের হার্টবিট তো সেকেন্ডে একটা করে হয়। সোমা আপুর এত দেরি করে হচ্ছে কেন?

ডক্টর জিজি বলল, আমাদের নিজেদেরকে সংকুচিত করার জন্য সময় প্রসারিত হয়ে। গেছে। বাইরের সবকিছু এখন খুব ধীরগতি মনে হচ্ছে।

ব্যাপারটি ঠিক কীভাবে হচ্ছে শাহনাজের এখন সেটা বোঝার মতো অবস্থা নেই, সে দুর্বল গলায় বলল, আমরা যদি আর্টারিতে থাকি তা হলে তো হার্ট থেকে দূরে সরে যাব। আর ব্লাডপ্রেশারের এই ধাক্কাগুলো খেতে থাকব। আমাদের এখন কি একটা ধমনীর মাঝে যাওয়ার চেষ্টা করা উচিত না?

ক্যাপ্টেন ডাবলু বলল, এখানে বসে থাকলে নিজ থেকেই ক্যাপিলারি হয়ে চলে যাব। তাই না ডক্টর জিজি?

ডক্টর জিজি মাথা নাড়ল। শাহনাজ ভয়ে ভয়ে বলল, কিন্তু তা হলে তো অনেক সময় লাগবে। তা ছাড়া আর্টারিতে থাকলে তো একটু পরে পরে হার্টের সেই প্রচণ্ড ধাক্কা খেতে থাকব।

ডক্টর জিজি বলল, আমরা রক্তের স্রোতের ওপর ভরসা না করে নিজেরাই এগিয়ে যাব। তা হলে সময় লাগবে না।

ক্যাপ্টেন ডাবলু আগ্রহ নিয়ে বলল, আমরা শরীরের কোন্ জায়গার ক্যাপিলারিতে যাব?

আঙুলের।

ক্যাপ্টেন ডাবলু ঠোঁট উন্টে বলল, আঙুল তো মোটেই ইন্টারেস্টিং না। ব্রেনের ভিতরে যেতে পারি না? সব নিউরনগুলোকে দেখতে পেতাম।

শাহনাজ কঠিন গলায় বলল, ডাবলু, তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে বুঝি পর্যটনের বাসে করে রাঙ্গামাটি বেড়াতে এসেছিস! যে কাজের জন্য এসেছি সেটা শেষ করে ভালোয় ভালোয় ফিরে যা।

কিন্তু শাহপু! এ রকম সুযোগ জীবনে আর কয়বার আসে তুমি বল? আমরা একজনের শরীরের ভিতরে ঢুকে সবকিছু নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছি।

আমার এত সুযোগের দরকার নেই। শাহনাজ ডক্টর জিজির দিকে তাকিয়ে বলল, ডক্টর জিজি। তুমি ক্যাপ্টেন ডাবলুর কথা শুনো না। যেখানে যাওয়ার কথা সেখানে চল।

ডক্টর জিজি তার যন্ত্রপাতিতে হাত দিয়ে স্পর্শ করতেই ভাসমান যানটা একবার কেঁপে উঠে তারপর হঠাৎ দ্রুতগতিতে ছুটতে শুরু করে। বাইরের স্নাজমা, লোহিত কণিকা, শ্বেতকণিকা, আর্টারির দেয়াল সবকিছু অস্পষ্ট হয়ে আসে। এভাবে তারা কতক্ষণ গিয়েছিল কে জানে, হঠাৎ করে ভাসমান যানটা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। ডক্টর জিজি বলল, এসে গেছি।

কোথায় এসে গেছি?

হৃৎপিণ্ডে।

শাহনাজের পেটের ভিতরে কেমন জানি পাক খেয়ে ওঠে, কী আশ্চর্য, তারা সোমার হৃৎপিণ্ডের মাঝে হাজির হয়েছে! গোল জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে তারা দেখতে পায়, চকচকে ভিজে এবং গোলাপি রঙের বিশাল একটা জিনিস থরথর করে কাঁপছে, পুরো জিনিসটা হঠাৎ সংকুচিত হতে শুরু করে, এক সময় প্রচণ্ড শব্দ করে আবার ফুলে ওঠে, তার ধাক্কায় পুরো ভাসমান যানটি শূন্যে কয়েকবার ওলটপালট খেয়ে আসে। শাহনাজ তার সিট থেকে ছিটকে পড়ে গেল, কোনোমতে সোজা হয়ে বসে বলল, কী হয়েছে?

ক্যাপ্টেন ডাবলু সিটের তলা থেকে বের হয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, হার্ট বিট করছে।

শাহনাজ নিশ্বাস ফেলে বলল, সোমা আপুর হার্ট ঠিক করতে গিয়ে আমাদেরই তো মনে হচ্ছে হার্টফেল হয়ে যাবে!

ডক্টর জিজি বলল, পুরো হার্টটা একবার দেখে আসি, তারপর কাজ শুরু করব।

শাহনাজ ভয়ে ভয়ে বলল, বেসি কাছে যেয়ো না ডক্টর জিজি। হার্টটা যখন বিট করে একেবারে বারটা বেজে যায় আমার্দের।

ডক্টর জিজি তার ভাসমান যান নিয়ে হার্টটা পর্যবেক্ষণ করে আসে। শাহনাজ কিংবা ক্যাপ্টেন ডাবলু ঠিক বুঝতে পারল না, কিন্তু ডক্টর জিজি নিজে নিজে কিছু হিসাব করে কাজ শুরু করে দিল। ইনফেকশনের অংশটুকুতে কিছু খুব ছোট ছোট ভাইরাস ছিল, সেগুলোর। পিছনে ডক্টর জিজি কী সব লেলিয়ে দিল। ভয়ঙ্কর দর্শন কিছু ব্যাকটেরিয়া ছিল, শ্বেতকণিকা তাদের সাথে যুদ্ধ করে খুব সুবিধে করতে পারছিল না, ডক্টর জিজি তার কিছু রোবটকে শ্বেতকণিকার পাশাপাশি যুদ্ধ করতে পাঠিয়ে দিল। হার্টের কোষগুলোর ক্ষতি হয়েছিল, সেগুলো সারিয়ে তোলার জন্য ডক্টর জিজি তার কাজ আরম্ভ করে দিল। হার্টের ভিতরে একটা অংশ পরীক্ষা করে দেখা গেল কিছু গুরুত্বপূর্ণ আর্টারি ইনফেকশনের কারণে বন্ধ হয়ে আছে, রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়াতে হার্টের বেশকিছু কোষ নষ্ট হয়ে গেছে, অনেক কোষ নষ্ট হবার পথে। ডক্টর জিজি আর্টারির পথ খুলে রক্তপ্রবাহ নিশ্চিত করল। হঠাৎ করে যখন। রক্তপ্রবাহ শুরু হল, রক্তের ধাক্কায় ভাসমান যানটি ওলটপালট খেয়ে একটা ভয়ঙ্কর অবস্থার সৃষ্টি হয়ে গেল। শক্ত করে আঁকড়ে ধরে থেকেও সিটে বসে থাকা যায় না। নষ্ট হয়ে যাওয়া কোষগুলো সরিয়ে সেখানে অন্য জায়গা থেকে কোষ এনে লাগানো হল, বিদ্যুৎস্ফুলিঙ্গ দিয়ে সেগুলো জুড়ে দেওয়া হল, মৃতপ্রায় কিছু কোষকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য তার ভিতরে বিশেষ পুষ্টিকর জিনিস ঢোকানো হল।

এর সবকিছুর মাঝে সোমার হৃৎপিণ্ড যখন প্রতিবার স্পন্দন করে, তার প্রচণ্ড ধাক্কায় ভাসমান যানের ভিতরে সবাই ওলটপালট খেতে থাকে! শেষ পর্যন্ত যখন ডক্টর জিজি বলল, আমার ধারণা সোমার শারীরিক সমস্যাটি আমরা সারিয়ে তুলেছি তখন শাহনাজ আনন্দে চিৎকার করে উঠল। ক্যাপ্টেন ডাবলু হাতে কিল দিয়ে বলল, ক্যান্টাবুলাস! ফিকটুবুলাস!! চল এখন কী–মজা–হবে আপুর শরীরে একটা ট্যুর দিয়ে আসি?

শরীরে ট্যুর দিয়ে আসি!

হ্যা কিডনির ভিতরে দেখে আসি সেটা কেমন করে কাজ করে।

কিডনির ভিতরে? ডাবলু, তোর মাথা খারাপ হয়েছে?

তা হলে চল পাকস্থলিতে ঢুকে যাই, সেখানে দেখবে হাইড্রোক্লোরিক এসিড টগবগ করছে, একটু ভুল হলেই সবকিছু গলে যাবে! কী বুকাংটুকাস, নিন্টিফুটাস!

ডক্টর জিজিকে নিয়ে তুই একা যখন আসবি তখন তোর যা ইচ্ছে তাই করিস। এখন এই মুহূর্তে এখান থেকে বের হতে হবে! কখন কোথা থেকে কোন্ শ্বেতকণিকা আক্রমণ করবে, কোন্ এন্টিবডি এসে ধরে ফেলবে, কোন্ কেমিক্যাল জ্বালিয়ে দেবে, কোন্ নার্ভ থেকে ইলেকট্রিসিটি এসে শক দিয়ে দেবে, ব্লাডপ্রেশার আছাড় মারবে, তার কি কোনো ঠিক আছে? মানুষের শরীরের ভিতরের মতো ডেঞ্জারাস কোন্ জায়গা আছে?

তা ঠিক। কিন্তু এ রকম একটা সুযোগ আর কখনো আসবে?

না আসলে নাই। ডক্টর জিজি চল যাই।

ডক্টর জিজি মাথা নেড়ে বলল, চল।

কাজেই ক্যাপ্টেন ডাবলুকে তার আশা অসম্পূর্ণ রেখেই বের হয়ে আসতে হল। হৃৎপিণ্ডের কাছাকাছি একটা বড় আর্টারি ধরে রওনা দিয়ে গলার কাছাকাছি ছোট একটা কেপিলারি ধরে তারা বের হয়ে এল। ভাসমান যানটি আবার উপরে কয়েকবার পাক খেয়ে তার আগের আকৃতি নিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়াল।

সোমা তার বিছানায় বসে একটু অবাক হয়ে তার গলায় হাত বুলাচ্ছে। পাশেই সোমার আম্মা দাঁড়িয়ে আছেন, অবাক হয়ে সোমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী হয়েছে, সোমা?

গলার কাছে কী যেন কুট করে উঠল। মশার কামড়ের মতো।

আমি মশার ওষুধ দিতে বলছি, তুই উঠে বসেছিস কেন? শুয়ে থাক।

সোমা হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে তার আম্মার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, আম্মা আমার আর শুয়ে থাকতে হবে না। আমি ভালো হয়ে গেছি। একেবারে ভালো হয়ে গেছি।

আম্মা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন, কী বলছিস তুই পাগলের মতো! ডাক্তার বলেছে হার্টে ইনফেকশন

ডাক্তারকে বলতে দাও মা। আমি জানি আমি ভালো হয়ে গেছি। আমার বুকে কোনো ব্যথা নেই, আমার মাথা ঘুরছে না, আমার দুর্বল লাগছে না, আমার এত খিদে পেয়েছে যে আমার মনে হচ্ছে আমি আস্ত একটা ঘোড়া খেয়ে ফেলতে পারব!

কী বলছিস মা তুই!

হ্যা মা। তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছ না, তাই না?

কেমন করে করি? ডাক্তার আজ সকালে এত মনখারাপ করিয়ে দিয়েছে।

ডাক্তার বলেছে আমার হার্ট রক্ত পাম্প করতে পারছে না, তাই আমি খুব দুর্বল। তাই?

হ্যাঁ।

আমি তোমার কাছে প্রমাণ করব। আমি দুর্বল না। আমি কী করব জান?

কী করবি?

আমি তোমাকে কোলে নিয়ে নাচব। বলে সত্যি সত্যি সোমা তার আম্মাকে জড়িয়ে ধরে টেনে উপরে তুলে একপাক ঘুরে এল! তারপর আনন্দে চিৎকার করে বলল, আমি ভালো হয়ে গেছি। আমি ভালো হয়ে গেছি!

সোমার আম্মা খুশিতে কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না, সোমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, খোদা নিশ্চয়ই তোকে ভালো করে দিয়েছে। কিন্তু মা, যতক্ষণ পর্যন্ত ডাক্তার তোকে পরীক্ষা না করছে আমি শান্তি পাব না। তুই চুপ করে শুয়ে থাক। বিকেলবেলা ডাক্তার আসবে।

সোমা মাথা নেড়ে বলল, না আম্মা। আমি শুয়ে থাকতে পারব না। তুমি শুয়ে থাক, আমি হাসপাতালটা ঘুরে দেখি।

কী বলছিস তুই!

আমি ঠিকই বলছি। তোমার ওপর দিয়ে অনেক ধকল গিয়েছে। তুমি শুয়ে থাক। সোমা সত্যি সত্যি তার আম্মাকে ধরে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এল।

সোমা তার কেবিন থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে ডক্টর জিজি ভাসমান যানটি তার পিছু পিছু বের করে নিয়ে এল। এতবড় একটি ভাসমান যান কীভাবে ছোট দরজা দিয়ে বের হয়ে আসে সেটা নিয়ে শাহনাজ আর অবাক হয় না, কিছুক্ষণ আগে তারা সোমার শরীরের ভিতর থেকে ঘুরে এসেছে। সোমা হেঁটে হেঁটে সাধারণ ওয়ার্ডে এসে উঁকি দিল, সেখানে নানারকম রোগী বিছানায় শুয়ে আছে। সোমা তাদের মাঝে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটা বেডের সামনে দাঁড়িয়ে যায়। চার–পাঁচ বছরের একটা ছোট বাচ্চা বিছানায় শুয়ে আছে, তার কাছে একজন মহিলা, মহিলাটির মাথার চুল এলোমেলো, উদ্ভ্রান্তের মতো চেহারা। সোমা কাছে গিয়ে নরম গলায় বলল, আপনার কী হয়েছে মা?

মহিলাটি মাথায় হাত দিয়ে ম্লানমুখে হেসে বললেন, কিছু হয় নি মা। আমার বাচ্চাটির সেলুলাইটিস হয়েছিল।

এখন কেমন আছে?

ডাক্তার বলেছে বিপদ কেটে গেছে। আল্লাহ মেহেরবান।

মা, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি কয়েকদিন কিছু খান নি, ঘুমান নি, বিশ্রাম নেন নি।

ঠিকই বলেছ মা। মা ম্লানমুখে হাসলেন, ছেলেটাকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম।

সোমা বলল, এখন তো আর দুশ্চিন্তা নেই। এখন আপনি বিশ্রাম নেন। ছেলেটা আমাকে ছাড়ছে না। হাসপাতালের পরিবেশে অভ্যস্ত নয় তো।

আমি আপনার ছেলের সাথে বসি, আপনি ঘুরে আসেন। বাইরে একটা সোফা আছে, বসে দুই মিনিট ঘুমিয়ে নেন।

আমার ছেলে মানবে না, মা।

মানবে। সোমা বিছানার দিকে এগিয়ে বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি জান আমি ম্যাজিক দেখাতে পারি?

বাচ্চাটি চোখ বড় বড় করে কৌতূহলী চোখে তাকাল। সোমা বিছানার পাশে বসে তার ডান হাত খুলে সেখানে একটা লজেন্স রেখে বলল, আমার এই হাতে একটা লজেন্স। এই দেখ আমি হাত বন্ধ করলাম। সোমা হাত বন্ধ করে তার হাতের উপর দিয়ে অন্য হাত নেড়ে বলল, ছুঃ মন্তর ছু! আকালী মাকালী যাদুমন্তর ছোঃ! তারপর ছেলেটার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, এখন বল দেখি লজেন্সটা কোথায়?

ছেলেটা বড় বড় চোখে সোমার দিকে তাকিয়ে রইল, সোমা আরো বড় বড় চোখ করে বলল, লজেন্সটা চলে গেছে তোমার পকেটে!

ছেলেটা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে সোমার দিকে তাকিয়ে নিজের পকেটে হাত দিতে গেল, সোমা তার আগেই ছেলেটার হাত ধরে বলল, উহঁ, আগেই পকেটে হাত দেবে না। আমি তো আসল ম্যাজিকটা এখনো দেখাই নি!

ছেলেটা কৌতূহলী চোখে সোমার দিকে তাকাল, সোমা চোখ বড় বড় করে তার ডান হাতটা মুষ্টিবদ্ধ রেখে বাম হাত নাড়তে শুরু করে, ছুঃ মন্তর ছুঃ কালী মন্তর ছু! পকেটের লজেন্সটা আবার আমার হাতে চলে আয়!

সোমা এবারে ছেলেটার চোখের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে তার ডান হাত খুলে বলল, এই দেখ লজেন্সটা তোমার পকেট থেকে আবার আমার হাতে চলে এসেছে।

ছেলেটাকে এক মুহূর্তের জন্য বিভ্রান্ত দেখায় তারপর হঠাৎ করে কৌশলটা বুঝতে পারে, সাথে সাথে বিছানায় উঠে বসে বলল, ঈশ! কী দুষ্ট! আসলে–আসলে লজেন্সটা হাতেই আছে,–আমার পকেটে যায়ই নাই। আমি যেন বুঝতে পারি না–_

সোমা চোখেমুখে ধরা পড়ে যাবার একটা ভঙ্গি করে বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে রইল, তার পর হঠাৎ খিলখিল করে হাসতে থাকল। সোমার হাসি দেখে বাচ্চাটাও হাসতে থাকে, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মাও হাসতে শুরু করেন। হঠাৎ করে পুরো পরিবেশটা আনন্দময় হয়ে ওঠে।

শাহনাজ ডক্টর জিজিকে ধাক্কা দিয়ে বলল, ঐ দেখ, সোমা আপু হাসছে! তাড়াতাড়ি রেকর্ড কর।

ডক্টর জিজি বলল, আমি তথ্য সংরক্ষণ করতে শুরু করেছি। অত্যন্ত বিচিত্র।

শাহনাজ উবু হয়ে বসে সোমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, দেখতে দেখতে তার মুখেও হাসি ফুটে ওঠে।