তা বুঝলি কি করে শম্ভু একটি ঘুঘু? সুদৰ্শন প্রশ্ন করে।
ও আমরা দেখলেই চিনতে পারি।–দাশু বললে।
হুঁ। তা তুই আজ কখন জানতে পারিস যে তোর বাবু খুন হয়েছেন?
বাবুর ঘুম ভাঙার পরই এক কাপ চায়ের দরকার হয়, সেই চা নিয়ে তাঁর ঘরে ঢুকে দেখি—শোবার ঘরে বাবু নেই, তখন ভাবলাম বাবু বোধ হয়। বাথরুমে, কিন্তু কেউ নেই— ঐ সময় দুধওয়ালা দুধ নিয়ে আসে—কলিংবেল বাজাতেই দরজা খুলে দিতে গিয়েই দেখি—
সদর দরজা খোলা ছিল, না বন্ধ?
আজ্ঞে, বন্ধ।
ভিতর থেকে খিল দেওয়া ছিল?
না।
বিকাশ ঐ সময় বলে, দরজায় গডরেজের অটোমেটিক ডোরলক লাগানো স্যার।
তাই নাকি!
হ্যাঁ স্যার, আমার মনে হয়। হত্যাকারী হত্যা করার পর বাইরে থেকে দরজাটা টেনে হয়তো আবার লক করে দিয়ে গিয়েছিল। বিকাশ বললে।
তারপর তুই কি করলি দাণ্ড?
আজ্ঞে প্রথমটায় কি করব বুঝতে পারিনি, তারপর দোতলায় ছুটে গিয়ে যে সেপাইজী পাহারায় ছিল তাকে ডেকে আনি।
লালবাজারে কে খবর দিয়েছিল বিকাশ?
কারণ সিং—
সে-ই তো নীচের ফ্ল্যাটের সামনে পাহারায় ছিল?
হ্যাঁ স্যার—
সে কোন শব্দটব্দ উপরে শোনেনি?
না। স্যার।
আরো আধঘণ্টা পরে সুদৰ্শন ফিরে এল লালবাজারে, বিকাশের উপরেই বাকি কাজের ভার দিয়ে। নিজের ঘরে ঢুকেই একজন সার্জেণ্টকে বললে সমীরণকে তার অফিস-কামরায় নিয়ে আসবার জন্য। একটু পরে সমীরণ সার্জেণ্টর সঙ্গে এসে ঘরে ঢুকল।
এক রাত্রেই তার চেহারা যেন অর্ধেক হয়ে গিয়েছে।
চোখ-মুখ শুকনো-সমস্ত মুখে যেন একটা ক্লান্তি ও অবসন্নতা।
বসুন সমীরণবাবু।
সমীরণ বসল সুদর্শনের মুখোমুখি একটা চেয়ারে।
চা বোধ হয় খাননি—বলে সুদৰ্শন একজন সেপাইকে ডেকে সমীরণকে চা দেবার জন্য বললে।
কাল ঘুমোতে পারেন নি মনে হচ্ছে!
সুদৰ্শনের প্রশ্নের কোন জবাব দেয় না সমীরণ।
সমীরণবাবু!
সমীরণ মুখ তুলে তাকাল। বিজিতা দেবীকে আপনি তো অনেক দিন থেকেই চিনতেন?
চিনতাম।
আপনি তাকে ভালবাসতেন, তাই না?
সমীরণ মাথাটা নীচু করল, তারপর মৃদু গলায় বললে, সে সব কথার আজ আর কাজ কি মিঃ মল্লিক।
বুঝতে পারছি ভালবাসতেন। আর এও বুঝেছি সত্যিই কত গভীর ভালবাসা ছিল তার প্রতি আপনার। আশ্চর্য, তা ভালই যদি বাসতেন তো তাকে বিয়ে করলেন না কেন?
বিজিত
বলুন।
কিন্তু সে সব কথা শুনে আপনার কি লাভ মিঃ মল্লিক।
বিজিতা দেবীর হত্যাকারীকে ধরতে হলে তাঁর সম্পর্কে সব কথাই জানা প্রয়োজন আমাদের সমীরণবাবু। আপনিও নিশ্চয়ই চান তাঁর হত্যাকারী ধরা পড়ুক—
কিন্তু আপনি বিশ্বাস করুন। মিঃ মল্লিক, সমীরণ সুদর্শনের মুখের দিকে চোখ তুলে তাকল, তার দুই চোখ জলে ভরে উঠেছে, বিজিতাকে আমি হত্যা করিনি।
ও কথা থাক। আপনি মধ্যে মধ্যে ওঁদের ওখানে যেতেন?
আগে আগে যেতাম—তবে ইদানীং কয়েক মাস যাইনি।
কেন?
মণি পছন্দ করত না জানতে পেরেই যাওয়া বন্ধ করেছিলাম।
মণিবাবু কিছু আপনাদের কোনদিন বলে ছিলেন?
না।
তবে আপনি বুঝতে পারলেন কি করে?
বুঝতে পেরেছিলাম—
কি করে?
ঐ সময় একজন বেয়ারা এক কাপ চা নিয়ে এসে টেবিলের ওপর রাখল।
চা-টা খেয়ে নিন।
চায়ের পিপাসা আমার নেই।
তবু খান না। সকালবেলাতে চা খাননি। নিন, কাপটা তুলে নিন।
সমীরণ কাপটা হাতে নিয়ে একটা ছোট চুমুক দিয়ে চায়ের কাপটা আবার টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে দিল।
খেলেন না।
ভাল লাগছে না।
তবে থাক। যা বলছিলাম-মণিবাবু আপনার যাওয়াটা পছন্দ করতেন না তা জানতে পারলেন কি করে?
বিজিতা আমাকে একটা চিঠিতে জানিয়েছিল।
বিজিতা দেবী মধ্যে মধ্যে আপনাকে বুঝি চিঠি লিখতেন?
না।
কি লিখেছিলেন চিঠিতে বিজিতা দেবী আপনাকে?
মণি পছন্দ করে না আমার যাওয়া-আসাটা তাই—অথচ কেন ও সন্দেহ করত বিজিতাকে আজও আমি ভেবে পাইনি মিঃ মল্লিক!
ওকথা বলছেন কেন?
কারণ বিজিতার সমস্ত মন জুড়ে ছিল মণিই। সেখানে কারো স্থান ছিল না। সী ওয়াজ সো সুইট—সো টেনডার—বলতে বলতে আবার সমীরণের গলাটা বুজে এল। দু চোখে জল ভরে উঠল।
শেষ আপনি কবে তাদের ওখানে গিয়েছিলেন?
গতকাল।
কাল গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ।
কখন? কখন গিয়েছিলেন?
বেলা তখন পৌনে একটা হবে।
ওঃ, তা দেখা হয়েছিল তার সঙ্গে?
না।
দেখা হয়নি?
না-গিয়ে দেখি সদর দরজা বন্ধ।
বন্ধ!
হ্যাঁ-বার বার কলিংবেল টিপলাম। বিজিতার নাম ধরে ডাকলাম, কিন্তু—
কি?
সে দরজা খুলল না।
তারপর?
ফিরে এলাম। অথচ–
কি?
শম্ভুর হাত দিয়ে চিঠি লিখে বিজিতা আমাকে বিশেষ জরুরী প্রয়োজনে ডেকে পাঠিয়েছিল?
চিঠি লিখে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তিনি আপনাকে?
হ্যাঁ।
কি লিখেছিলেন সে চিঠিতে?
বিশেষ কারণে সে আমার সঙ্গে একবার দেখা করতে চায়।
তারপর?
আমি অবিশ্যি একটু অবাকই হয়ে গিয়েছিলাম। চিঠি লিখে ডেকে পাঠাল অথচ দেখা করল না! ফিরে এলাম। আমি বাসায়।
কখন ফিরেছিলেন বাসায়?
বেলা তিনটে নাগাদ হবে।
তবে যে কাল বলেছিলেন—
মিথ্যা বলেছি-কাল আমার কোন রিহার্শেল ছিল না।
হুঁ। বলুন, তারপর?
বাসায় ফিরে শোবার ঘরে ঢুকে দেখি বিছানার উপর সেই সুটকেসটা পড়ে আছে—
কয়েকটা চাবি দিয়ে সুটকেসটা খোলবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোন চাবির সাহায্যেই সুটকেসটা খুলতে পারলাম না।
আপনি সুটকেসটা খুলতে চেষ্টা করেছিলেন তাহলে?
হ্যাঁ।
তারপর?
কেমন যেন একটা ভয় ভূতের মত আমাকে পেয়ে বসেছিল ঐ সময়।
ভয়!
হ্যাঁ-আর সেই ভয়টা আরো চেপে বসল যে মুহুর্তে আমি টেলিফেনটা পোলাম। এবং টেলিফোনটা পাওয়ার পর–
হঠাৎ যেন সমীরণ আবার থেমে গেল।
তারপর? বলুন, থামলেন কেন?
ভয়টা ক্রমশঃই যেন কেমন আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে লাগল। শেষ পর্যন্ত
সুটকেসটা দূরে কোথাও ফেলে আসবার জন্য আমি সেটা নিয়ে বের হয়ে পড়ি। আপনি হয়তো আমার কথা বিশ্বাস করছেন না মিঃ মল্লিক?
সুদৰ্শন কি যেন ভাবছিল। সমীরণের কথার কোন জবাব দিল না।
আচ্ছা সমীরণবাবু!
সুদৰ্শনের ডাকে সমীরণ মুখ তুলে তাকাল।
যাকে আপনি অত ভালবাসতেন সে সুখী হতে পারেনি জেনে নিশ্চয়ই মনটা আপনার খারাপ হয়ে গিয়েছিল?
হয়েছিল। কিন্তু আমি আর কি করতে পারি!
আপনি মণিশঙ্করবাবুকে আলাদা করে ডেকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন না কেন?
না। করিনি।
কেন?
মণি হয়তো আমার কথা বিশ্বাস করত না। তাছাড়া কে জানে ব্যাপারটা আরো বিশ্ৰী হয়ে দাঁড়াত না!—তাই ওদের কাছ থেকে দূরেই সরে গিয়েছিলাম।
ঠিক আছে সমীরণবাবু, আপাততঃ আপনি যেমন আছেন তেমনি এখানেই থাকুন। সুদৰ্শন বলতে বলতে বেল বাজাল বোতাম টিপে।
একজন সেপাই এসে সেলাম দিল।
সার্জেণ্ট চক্রবর্তীকে ডাক।
একটু পরেই সার্জেণ্ট চক্রবতী এল, স্যার আমাকে ডেকেছেন?
হ্যাঁ, এঁকে নিয়ে যান। যে ঘরে উনি ছিলেন সেখানেই রাখুন।
সমীরণ উঠে দাঁড়াল।
সুদৰ্শন একটা সিগারেট ধরিয়ে ধূমপান করতে করতে চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগল।
সমীরণ দত্ত একটু আগে যা বলে গেল তা কি সত্যি? না বানিয়ে বানিয়ে সব কিছু বলে গেল?
ঐদিনকার সংবাদপত্রটা টেবিলের উপর পড়ে ছিল—তাই কালকের সি. আই. টি.র ফ্ল্যাট-বাড়িতে হত্যার ব্যাপারটা প্রথম পৃষ্ঠাতেই প্রকাশিত হয়েছে। নজরে পড়ল সুদর্শনের।
সি. আই. টির ফ্ল্যাটে নৃশংস জোড়া খুন দিনের বেলা।
মা ও মেয়ে খুন হয়েছে।
আততায়ীকে পুলিস এখনো সন্ধান করতে পারে নি।
পরের দিন সকালে।
কে?
দাদা আমি সুদৰ্শন।
ফোনের অপর প্রান্ত থেকে কিরীটির গলা শোনা গেল–কি খবর?
দাদা, সেই ফ্ল্যাটে আর একটা খুন হয়েছে, শুনেছেন তো?
গোপেন বসু নিহত?
হ্যাঁ।
জেনেছি। ভাবছিলাম তুমি আমায় সংবাদটা দেবে। মনে হচ্ছে একই ভাবে খুন হয়েছে, তাই না?
হ্যাঁ, ঠিক একই ভাবে খুন হয়েছে—সুদৰ্শন সমস্ত ঘটনোটা ফোনেই বিবৃত করে গেল।
সব শুনে কিরীটী বললে, আমি জানতাম। এমনিই একটা কিছু ঘটবে—
আপনি জানতেন?
হ্যাঁ, মনই আমার বলেছিল-তাই তোমাকে গতকাল সকালেই ওর সঙ্গে গিয়ে দেখা করতে বলেছিলাম। কিন্তু ভাবতে পারিনি এত তাড়াতাড়ি কিছু ঘটে যাবে—
আমিও ভাবতে পারি নি। দাদা চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই ওখানে আরো একটা খুন হবে। সব যেন কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে–
শোন, এক কাজ কর সুদৰ্শন।
বলুন?
কালিকা বোর্ডিংয়ে পুলিস-পাহারা আছে তো?
হ্যাঁ, আছে।
মণিশঙ্করবাবুকে লোক পাঠিয়ে লালবাজারে নিয়ে এস।
এখুনি আনাচ্ছি।
আরো একটা কাজ তোমাকে করতে হবে।
কি।
স্বামীনাথনকে লালবাজারে নিয়ে এস।
স্বামীনাথনকে! আপনি কি তাকেও সন্দেহ করছেন?
ঐ ধরনের হত্যার ব্যাপারে আশেপাশে যারাই থাকে। কেউ সন্দেহের তালিকার বাইরে যেতে পারে না। সুদৰ্শন। তাছাড়া কয়েকটা কথাও তার কাছ থেকে আমাদের জানা দরকার।
বেশ-যা বললেন। তাই করছি-কিন্তু তারপর?
একটু খোঁজখবর নেওয়ার জন্য যদি কালকের দিনটা আমি নষ্ট না করতাম, তবে হয়তো মিঃ বোসকে আমন করে প্রাণ দিতে হত না। যাক-যা বললাম। তাই কর, ওদের দুজনকেই আমাদের প্রয়োজন।–তাছাড়া ওরা–
ওরা কি?
ওরা দুজনের একজনও সব সত্য কথা বলেনি।
মণিশঙ্কর যে বলেনি তা বুঝতে পেরেছি, কিন্তু স্বামীনাথন—
একটা কথা ভুলে যাচ্ছ কেন ভায়া-বিজিতা মণিশঙ্করের স্ত্রী ছিল, দক্ষিণ দেশের মেয়ে—আর স্বামীনাথন সেই দেশেরই লোক। এবং ঐ ফ্ল্যাটেই এসে স্বামীনাথন উঠেছিল। দুজনের পরস্পরের মধ্যে কোথাও একটা যোগসূত্র থাকা এমন কিছুই বিচিত্র নয়।
আপনি কি তাহলে—
এর মধ্যে আর সন্দেহের কি ভায়া-হয়তো খোঁজ করতে গেলে এমনও দেখতে পাব ওদের পরস্পরের মধ্যে পরিচয় তো বটেই আত্মীয়তাও ছিল হয়তো।
হঠাৎ ওই সময় সুদৰ্শন বলে, আপনি একবার আসবেন দাদা?
কেন বল তো!
জিজ্ঞাসাবাদ যা করতে হয় আপনিই করবেন। ওদের।
কেন? সবই তো তোমাকে বলে দিলাম। এবারে তুমিই জিজ্ঞাসাবাদ কর না!
তা পারি, কিন্তু আপনার মনের মধ্যে ওদের ঘিরে কোন প্রশ্নের উদয় হয়েছে সেটা তো আমার পক্ষে জানা সম্ভব নয়—শুধু আমার পক্ষেই বা বলি কেন, স্বয়ং ঈশ্বরও হয়তো জানেন না।
টেলিফোনের অপর প্রান্তে হো-হো করে গলা খুলে হেসে ওঠে কিরীটী।
না না-হাসি নয় দাদা—আসুন–
আসতেই হবে?
হ্যাঁ
বেশ, আসছি।–
দেরি করবেন না যেন
না, না-দেরি হবে না।