গল্পগ্রন্থ
উপন্যাস
অগ্রন্থিত
নাটক
ছড়া

০৮. লুটভিক যা বলে গেছে

লুটভিক যা বলে গেছে তা মিথ্যে নয়। শূন্যযানের যে অংশটায় ছোটখাটো একটা হল-এর মতো কামরায় আমরা আছি, খাবার-দাবার থেকে সাধারণ দরকারি কোনও জিনিসের সেখানে অভাব নেই। নীচে প্রথম ঢোকার সেই অপ্রত্যাশিত অভিজ্ঞতার পর লুটভিক নিজে আমাদের এ কামরায় নিয়ে এসেছে। উঠে এসে কামরায় জায়গা পাবার পর লুটভিক-এর শূন্যযানটা যে নেহাত ছোটখাটো নয় তা বুঝতে পেরেছি।

এত বিরাট একটা শূন্যযান কীসের শক্তিতে মহাকাশে পাড়ি দিচ্ছে তা অবশ্য বুঝতে পারিনি। সামান্য একটা রকেটকে পৃথিবী ছাড়িয়ে পাঠাবার আর ফেরত আনবারই কত ঝামেলা। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল পার হয়ে আসাযাওয়া করতেই তো তার শুধু হাওয়ার ঘর্ষণেই পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার বিপদ। কত কাণ্ড করে সে বিপদ সামলাতে হয়!

আর এ শূন্যযান পৃথিবী ছাড়িয়ে মহাকাশে যে চলে এল, মাধ্যাকর্ষণের অভাবে ক্রমশ পালকের মতো হালকা হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনও অসুবিধাই তো টের পেলাম না!

এ রহস্য নিয়ে এত সব ভাবনা তখন কিন্তু ভাববার সময় হয়নি।

আমরা যে তার পরীক্ষার গিনিপিগমাত্র তা জানিয়ে লুটভিক চলে যাবার পর এই উন্মাদের হাত থেকে কেমন করে রক্ষা পাওয়া যায় সেইটেই তখন একমাত্র ভাবনা হয়ে উঠেছে।

যেটুকু পরিচয় এই কিছুক্ষণের মধ্যে পেয়েছি, তাতে এই উন্মাদ পিশাচকে কোনও বিশ্বাস নেই। বিজ্ঞানের নামে সে আমাদের নিয়ে অকাতরে এমন কিছু করতে পারে যার পরিণাম হয়তো মৃত্যুর চেয়ে ভয়ংকর।

তাকে যেমন করে তোক তাই না ঠেকালে নয়। কিন্তু উপায়টা কী!

শুধু টুটিটা টিপে ধরলেই হয়। বটুকেশ্বর তার যেন মুখস্থ-পড়া-বলার গলায় বললে, ও শুটকো মুরগির জান আর কতটুকু।

না, আপত্তি করলে সুরঞ্জন, এ শূন্যযান কী বস্তু, আমরা কিছুই জানি না। এটা চালাবার জন্যই ওর টিকে থাকা দরকার। নইলে এই শূন্যে আমরা করব কী? ওকে ওর কন্ট্রোল রুমে বন্দি রাখাই ভাল।

উঁহুঁ, আমি মাথা নাড়ালাম, শুধু কন্ট্রোল রুমে বন্দি করে রাখলে সমস্যা মিটবে না। এ শূন্যযান চালাবার জন্য কোথাও কিছু দরকারি কলকবজা থাকতেও পারে। কন্ট্রোল রুমে বন্দি থাকলে লুটভিক সে সবের নাগাল পাবে না। ওকে তাই ছেড়ে রাখতেই হবে।

তাহলে ওর হাত থেকে বাঁচবার উপায়?

উপায় আমাদের নিজেদের বন্দি করা!

নিজেদের বন্দি করা? অবাক হয়ে বললে সুরঞ্জন, সে আবার কী রকম?

সেটাই হল সবচেয়ে নিরাপদ ব্যবস্থা, ওদের বুঝিয়ে দিলাম, এই কামরাটার সাজ-সরঞ্জাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এটা আমাদের ওর শয়তানি পরীক্ষার গিনিপিগ রাখবার মতো করেই তৈরি। তাই আর যেখানে থাক, এ কামরায় শূন্যযানের কোনও দরকারি কলকবজা ও রাখেনি বলেই আমার বিশ্বাস। আমরা নিজেরা এ কামরা ভেতর থেকে বন্ধ করে নিজেদের বন্দি করে রাখলে ওর শূন্যযান চালাবার কোনও অসুবিধা হবে না, অথচ আমরাও ওর নাগালের বাইরে থাকব। অবশ্য দরজা ভেতর থেকে বন্ধ থাকা সত্ত্বেও এ কামরায় ঢোকার কোনও গোপন উপায় যদি থাকে তাহলে আমরা নাচার।

হতাশার আশা হিসেবে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ রাখবার ব্যবস্থাই তারপর করা হল।

ব্যবস্থা আর কী? কামরার ভেতরকার চেয়ার টেবিল গোছের কিছু আসবাবপত্র এনে দরজায় ঠেকা দেওয়া। আমাদের ভাগ্যে লুটভিক মানুষটা নেহাত শুটকো দুবলা-পাতলা হাডিউসার। শূন্যযানে ভার বলে কিছু না থাকলেও তার মতো তালপাতার সেপাইয়ের পক্ষে দরজার ওসব ঠেকো ঠেলার জোরে ভেঙে ঢোকা সম্ভব নয়।

দরজাটা বন্ধ করবার সময়ও শূন্যযানের ভেতরকার মামুলি ব্যবস্থায় বেশ অবাক হতে হয়েছে। এমন আশ্চর্য একটা যন্ত্রযান এমন সব সাধারণ আসবাবপত্র নিয়ে মহাশূন্যে পাড়ি দিচ্ছে কী করে?

উত্তরটা তখনও পাইনি, তবে নিজেদের বন্দি করার বুদ্ধিটা সফলই হয়েছে।

দরজার বাইরে লুটভিক-এর আস্ফালন থেকে বোেঝা গেছে যে ভেতরে ঢোকবার অন্য কোনও গোপন উপায় নেই।

লুটভিক অবশ্য আমাদের ভয় দেখাতে কিছু বাকি রাখেনি। নিজে থেকে দরজা না খুললে আমাদের হাওয়া বন্ধ করে দেবে বলেও শাসিয়েছে। তাতে ভয় কিন্তু পাইনি।

এ কামরায় ওঠবার পথে হাওয়ার কলটা লুটভিকই দেখিয়ে এনেছে। যতদূর বুঝেছি ভাগ ভাগ করে কামরা হিসেবে হাওয়া বন্ধ করার ব্যবস্থা তাতে নেই। হাওয়া বন্ধ করলে লুটভিককেও আমাদের মতোই জব্দ হতে হবে।

যতই ভয় দেখাক, হাওয়া বন্ধ হয়নি। লুটভিকও আমাদের কামরায় ঢুকতে পারেনি। তার শয়তানি পরীক্ষার গিনিপিগ হবার বিভীষিকা এ পর্যন্ত অন্তত ঠেকিয়ে রাখা গিয়েছে।

এমনই করে পৃথিবীর হিসেবে ক-দিন যে কেটেছে তা ঠিক জানি না। ঘড়ি দিয়ে চব্বিশ ঘণ্টা করে ভাগ করে একটা হিসেব রাখা যেত। কিন্তু আমাদের দলে সুরঞ্জনের হাতে একটি মাত্র যে ঘড়ি ছিল, বালির ঝড়ের সঙ্গে যোঝার সময় কখন তা একেবারে বিকল হয়ে গেছে!

নেহাত খিদে পাওয়া ঘুম পাওয়া ধরেই সময়ের যা কিছু আন্দাজ তাই মনের মধ্যে আছে।

সেই আন্দাজ অনুযায়ী অন্তত মাসখানেক ইতিমধ্যে কেটে গেছে। একটা কামরার মধ্যে বন্দি থাকা ছাড়া আর বিশেষ অসুবিধে তাতে হয়নি। খাবার-দাবারের অভাব নেই। গিনিপিগের মতো আমাদের সুখে-স্বচ্ছন্দে সুস্থ রাখবার জন্য লুটভিক বেশ দীর্ঘকালের মতো রসদ এ কামরায় মজুদ রেখেছে।

খাওয়া-দাওয়া আর নিজেদের মধ্যে ভবিষ্যতের হতাশ আলোচনা ছাড়া আমাদের একমাত্র আনন্দ হল জানলা দিয়ে আকাশ দেখা।

তাই দেখতে গিয়েই আজ এক অভাবিত বিস্ময়ের চমক।

কিন্তু সে চমকের মানে বোঝবার আগেই পরমায়ু যে শেষ হয়ে যাবার উপক্রম।

আমার সঙ্গে সুরঞ্জনও বুকে হাত দিয়ে হাঁফাচ্ছে।

বটুক আমাদের খাবার নিয়ে আসতে গেছে। তার অবস্থাও সেখানে নিশ্চয় আমাদের মতো।

আর লুটভিক!

তার কথাটা মনে হওয়াতেই চোখে যেন আরও অন্ধকার দেখলাম। লুটভিক-এর কিছু হলে তো এই শূন্যযানই অচল। এত বড় বিপদের মধ্যেও এইটুকু বিশ্বাস মনে ছিল যে, যতই উন্মাদ হোক, লুটভিক এ শূন্যযান সাধ করে ধ্বংস করবে না। আবার পৃথিবীতে একদিন ফিরবেই। তখন কোনও একটা উপায়ে তাকে এড়িয়ে এ বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব হবে না, এই ছিল আশা।

কিন্তু এখন যা দেখছি তাতে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের নিষ্প্রাণ দেহগুলো নিয়ে এশূন্যযান মহাকাশের একটা নিরুদ্দেশে ভাসা উল্কাপিণ্ড হয়েই থাকবে।

কিন্তু এই বুকের কষ্টটাই বা কীসের?

একসঙ্গে সকলেরই বা এমন করে হবার কারণ কী?

এটা কি সংক্রামক কোনও রোগ? তা তো মনে হয় না।

তাহলে যা খেয়েছি সেই খাবারের ভেতরকার বিষ-টিষ কিছু?

কিন্তু বিষ যদি হয় তাহলে সাতদিন কোনও কিছু হয়নি কেন? আর লুটভিক অন্য যা-ই করুক, তার পরীক্ষার জন্যে পুষে রাখা গিনিপিগদের বিষ দিয়ে মারবার চেষ্টা করবে না।

কিন্তু বুকের যে কষ্টটা হচ্ছে তার সঙ্গে আমাদের খাদ্যের কিছু একটু সম্পর্ক কি নেই? তা না হলে একসঙ্গে আমাদের সকলেরই এক অবস্থা হবার আর কোনও কারণ তো ভেবে পাচ্ছি না।

ওই পর্যন্ত ভাবতেই কারণটা হঠাৎ মাথার মধ্যে বিদ্যুচ্চমকে স্পষ্ট হয়ে উঠল।

কারণটা, ওই আমাদের খাবারের মধ্যেই তো রয়েছে, তবে বিষের মতো কোনও মেশানো জিনিসে নয়, শরীরে বিশেষ করে আমাদের হার্ট-এর অত্যন্ত দরকারি উপাদানের ঘাটতিতে।

কোথায় পাই সে উপাদান।

ওই কষ্টের ভেতরই জোর করে উঠে দাঁড়ালাম।

সুরঞ্জনও একটা ধাক্কা সামলে তখন কাত হয়ে উঠে বসেছে। হঠাৎ ওই অবস্থাতেই সে হাঁ হাঁ করে উঠল।

ওকী! করছেন কী আপনি? অগ্নিকাণ্ড করবেন নাকি একটা!

আমি তখন সত্যিই একটা টেবিলের পায়া দাড়ি কামাবার ব্লেড দিয়ে চেঁছে সেই ছাঁটগুলোয় দেশলাই দিয়ে আগুন ধরাচ্ছি।

কী ভাগ্যি শূন্যযানের কামরার আসবাবপত্রগুলো মামুলি ও সাধারণ।

টেবিলটা কাঠের না হয়ে প্লাস্টিক কি স্টিলের হলে এ কাহিনী আর তোমাদের শোনার ভাগ্য হত না!

 

ঘনাদা থামলেন।

আমাদের চারজনের কাউকে আর কিছু বলতে হল না। আমাদের ভাড়াটে ডাক্তারদের তখন ঘোর লেগে গেছে।

তাহলে, অমনই করে কাঠের ছাই জোগাড় করলেন? মুগ্ধ বিস্ময় ফুটে উঠল কার্ডিওগ্রাম সান্যালের মুখে।

আর ওই কাঠের ছাইয়ের জোরেই সবাই সেরে উঠলেন? প্রেশার সোম ভক্তিতে গদগদ।

শুধু সেরেই উঠলাম না, ঘনাদা ঈষৎ হেসে বললেন, আমাদের যা সবচেয়ে বড় সমস্যা তা-ও মিটিয়ে ফেললাম।