০৮. লাল বাইকটা ছুটে যাচ্ছিল

লাল বাইকটা ছুটে যাচ্ছিল ড়ুয়ার্সের সুন্দর চওড়া পথ ধরে। গয়েরকাটা বীরপাড়ার মোড় হয়ে যখন অর্জুনরা জলদাপাড়ার জঙ্গলের গায়ে পৌঁছল তখন সূর্যদেব পাততাড়ি গোটাতে ব্যস্ত। ব্যাক সিটে মেজর এখন অনেকটা স্বচ্ছন্দ হয়ে বসে আছেন। সারাটা পথ আর মুখ খোলেননি। খুন হওয়ার গল্পটা শোনার পর থেকেই তিনি চুপচাপ। ভুল হল, ঠিক চুপচাপ নন তিনি, ঠোঁট বন্ধ করে সমানে একটা সুর বের করে যাচ্ছেন নাকের ফুটো দিয়ে। কানের কাছে সেটা খুব শ্রুতিকর নয় কিন্তু অর্জুন সেটা সহ্য করেছিল। পুরনো দিনের বাংলা গান থেকে আরম্ভ করে আধুনিক ইংরেজি গান, কিছুই বাদ যাচ্ছে না।

অর্জুনের অস্বস্তি শুরু হল মাদারিহাট টুরিস্ট বাংলো ছাড়ানোর পর থেকেই। দিনে-দিনে ফিরে না এলে অস্বস্তিটা যাবে না। অথচ সেটা যে আর সম্ভব নয় তা এখন বোঝা যাচ্ছে। এসব অঞ্চলে সন্ধের মুখেই হাতি বেরিয়ে আসে জঙ্গল যুঁড়ে। সেটা নিয়েও সে ভাবছে না। যাদের এড়াতে মিসেস মমতা দত্ত নিজের গাড়ি ছেড়ে অন্যভাবে জলপাইগুড়িতে তাদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, তাদের নিয়েই এখন চিন্তা। অবশ্য এখন সে একা নেই, মেজর সঙ্গে থাকায় কিছুটা সাহস পাওয়া যাচ্ছে। অর্জুন বাইকের গতি আরও বাড়াল।

পথে কোনও বাধা পাওয়া যায়নি। হাসিমারার মোড়ে একটা প্রাইভেট কার দাঁড়িয়েছিল। মোড় বলেই গতি কমাতে বাধ্য হয়েছিল অর্জুন। এবং তখনই সে ভানুদাকে দেখতে পেল! লম্বা পেটা শরীর। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় সুভাষিণী চা বাগানের ম্যানেজার। বছরখানেক আগে অমল সোমের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন ভদ্রলোক। না, কোনও প্রয়োজনে নয়। গল্প শুনে আলাপ করে গিয়েছিলেন। দারুণ মানুষ। এডমণ্ড হিলারির সঙ্গে এভারেস্টের ওপর তলায় উঠে ছবি তুলেছেন প্রচুর। সেই সময় বরফের কামড়ে পায়ের কয়েকটা আঙুল ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল। এক সময় একটি ইংরেজি দৈনিকের চাকুরে ছিলেন।

এডমন্ড সাহেবের বইয়ে ওঁর ভোলা প্রচুর ছবি আছে। সত্যিকারের স্পোর্টসম্যান মানুষটি এখন চাবাগানের ম্যানেজার। অর্জুন তাঁর গাড়ির পাশে নিজের বাইক দাঁড় করাল।

মুখ ফিরিয়ে দেখতে পেয়েই ভানুদা চিৎকার করলেন, আরে সাহেব যে! এদিকে কী ব্যাপার? একগাল হাসলেন ভদ্রলোক।

বাইক দাঁড় করাতেই মেজরও জিজ্ঞেস করলেন, আমরা কি পৌঁছে গিয়েছি?

অর্জুন মাথা নাড়ল, এখনও কিছুটা পথ বাকি। আসুন এর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। ভানুদা, ইনি মেজর, আমাদের খুব কাছের মানুষ, সারা পৃথিবী জুড়ে অনেক অ্যাডভেঞ্চার করেছেন। আর ইনি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, টি প্ল্যান্টার, এডমণ্ড হিলারির সঙ্গে এভারেস্ট গিয়েছিলেন।

বাইকে বসেই মেজর জিজ্ঞেস করলেন, কতটা?

মানে? ভানুদা জানতে চাইলেন।

কতটা উঠেছেন?

সামান্যই। মাত্র বাইশ হাজার ফুট।

গুড। এবার যখন নর্থ পোলে আমার জাহাজড়ুবি হল তখন ভেবেছিলাম এভারেস্টের ওপরে নিশ্চয়ই এর চেয়ে বেশি ঠাণ্ডা হবে না। কেমন ঠাণ্ডা?

প্রচণ্ড। কিন্তু কোথায় জাহাজড়ুবি হয়েছিল বললেন?

নর্থ পোলে। বেড়াতে গিয়েছিলাম। ওখানকার পেঙ্গুইনদের ছবি তুলব এমন ইচ্ছে ছিল। জাহাজের ক্যাপ্টেন একটা আমেরিকান গোঁয়ার। চার্লি বলে ডাকতাম। হাজারবার বলেছিলাম, কুয়াশায় যখন চারপাশ ঢাকা তখন আর এগিয়ো না। শুনল না কথা। চোরা বরফে ধাক্কা খেলাম। আইসবার্গ। ব্যস। ড়ুবল। লাইফ জ্যাকেট পরে ওই ঠাণ্ডায় পাক্কা আট ঘণ্টা খাবি খেয়েছি জলে। হেলিকপ্টার এসে না তুললে আপনার সঙ্গে আলাপ হত না।

কথা শুনতে-শুনতে ভানুদা এতখানি মুগ্ধ যে, তাঁর গলায় সেটা ফুটে উঠল, আরে কী আশ্চর্য, আপনাকে তো ছাড়ছি না। চলুন আমার বাগানে।

মেজর মাথা নাড়লেন, না, নামতে পারব না।

মানে?

এতক্ষণ বাইকে বসে শরীর জমে গিয়েছে। এখন নেমে দাঁড়ালে আর উঠতে পারব না। এইভাবে এতক্ষণ বসা যে কী পরিশ্রমের! সেটা ভুলতে গান গাইছিলাম। শরীরের সব কজা এখন একেবারে আটকে গিয়েছে।

এই বাইকে আপনাকে উঠতে হবে না। আমার গাড়িতে পা ছড়িয়ে বসুন।

এবার অর্জুন আপত্তি করল, ভানুদা, আমি একটা জরুরি কাজে হৈমন্তীপুর চাবাগানে যাচ্ছি। এখন আপনার ওখানে যাওয়া যাবে না।

হৈমন্তীপুর? চমকে উঠলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, সেখানে কেন?

মিসেস মমতা দত্তকে একটা খবর দিতে।

হৈমন্তীপুরের এখনকার অবস্থা সম্পর্কে ধারণা আছে তো?

কিছুটা আছে।

গতকালও মিসেস দত্তের বাবুর্চি খুন হয়েছে।

হঠাৎ মেজর বলে উঠলেন, অ্যানাদার খুন? তা হলে তো আমাদের সেখানে যেতে হচ্ছেই। নো মিস্টার বন্দ্যোপাধ্যায়, এর পরের বার আপনার সঙ্গে দেখা করব।

ভানুদা হাত নাড়লেন, জাস্ট এ মিনিট। সন্ধে হয়ে এসেছে। আমার মনে হয় আজকের রাতটা আমার ওখানে কাটিয়ে কাল সকালে গেলেই ভাল হবে।

অর্জুন মাথা নাড়ল, তাহলে কথার খেলাপ হয়ে যাবে। মিসেস দত্তকে আমি কথা দিয়েছি আজই খবর দেব। আপনি কি কিছু আশঙ্কা করছেন?

হ্যাঁ। বাগানে ঢোকার আগেই বিরাট নীলগিরি ফরেস্ট। একটার পর একটা খুন হচ্ছে সেখানে। তা হলে চল, লোকাল থানায় তোমাদের নিয়ে যাই। ওদের এসকর্টকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে।

কিন্তু থানায় যাওয়াটা এই মুহূর্তে ঠিক কাজ হবে না। আপনি যাদের ভয় পাচ্ছেন তাদের নজর নিশ্চয়ই থানার ওপরেও আছে।

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় একটু চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, বাইকটাকে এখানে রেখে তোমরা আমার গা তে ওঠো। তিনজনেই যাই। মেজর চটপট বলে উঠলেন, দ্যাটস নট এ ব্যাড আইডিয়া।

এই সময় একটা পুলিশের জিপকে দেখা গেল। সম্ভবত ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাড়ি দেখেই দারোগাবাবু দাঁড়িয়ে গেলেন, কেমন আছেন সার?

ভানুদা হাত নাড়লেন, ভাল। কী খবর?

জিপে বসেই দারোগা উত্তর দিলেন, এই চলছে। এমন একটা চাকরি মশাই যে, একটু শান্তিতে থাকার জো নেই।

ভানুদা জিজ্ঞেস করলেন, হৈমন্তীপুরে শুনলাম গত রাত্রেও মাডার হয়েছে?

আর বলবেন না। আজ ভোরে নাকি একটা অ্যাম্বাসাডার এসেছিল এ তল্লাটে, শিলিগুড়ি থেকে। খবরটা পেয়ে ছুটোছুটি করলাম কিন্তু কোনও লাভ হল না। হৈমন্তীপুরে ঢোকার মুখে যে সাঁকোটা ছিল সেটা কেউ উড়িয়ে দিয়েছে। গাড়ি যাচ্ছে না আর। মনে হচ্ছে ভদ্রমহিলাকে বাগানটা বিক্রি করে দিয়ে যেতে হবে। দারোগাবাবু বললেন।

ওঁকে আপনারা প্রোটেকশন দিচ্ছেন না?

কাকে দেব? আমাদের না জানিয়ে হুটহাট জলপাইগুড়ি চলে যাচ্ছেন। এঁরা কারা? দারোগার চোখের দৃষ্টি ঘুরল।

আমার বন্ধু। ভানুদা জানাতেই দারোগা হাত নেড়ে চলে গেলেন।

অর্জুন এবার জিজ্ঞেস করল, কী করবেন? আপনার গাড়ি তা হলে হৈমন্তীপুরে ঢুকবে না। সাঁকো থেকে বাংলো কতদূর?

মাইলখানেক তো বটেই। মনমরা হয়ে গেলেন ভানুদা।

তা হলে আমরা চলি। এখন সাঁকোর নীচে জল থাকার কথা নয়। বাইকটাকে পার করাতে পারব। ফেরার সময় আপনার সঙ্গে দেখা করে যাব।

অগত্যা যেন রাজি হতে বাধ্য হলেন ভানুদা, বেশ। রাত নটা পর্যন্ত তোমাদের জন্য আমি অপেক্ষা করব। খুব চিন্তায় ফেলে দিলে ভাই।

অর্জুন আর অপেক্ষা করল না। মেজর বললেন, এই নামে একজন অ্যাক্টর ছিলেন না? খুব হাসাতেন?

হ্যাঁ। সেটা প্রথম দর্শনে ওঁকে বলেছিলেন অমলদা। শুনে ভানুদা জবাব দিয়েছিলেন, কার সঙ্গে কার তুলনা করছেন? উনি জিনিয়াস, আমি ওয়ান অব দ্য ম্যান। অর্জুনের কথা শুনে মেজর এমন হেসে উঠেছিলেন যে, বাইকটা জোর নড়ে উঠল। মেজর বললেন, সরি।

একটু বাদেই হেডলাইট জ্বালাতে হল। রাস্তা নির্জন। দুপাশে বাড়িঘরও নেই। হাসিমারা ছাড়াবার পরেই কেমন জঙ্গুলে আবহাওয়ায় এসে গিয়েছিল ওরা, এবার সেটা গভীর হল। হঠাৎ মেজর অর্জুনের পিঠে টোকা মারলেন। অর্জুন ঘাড় না ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল, কিছু বলছেন?

মেজর গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কানের কাছে মুখ এনে, তোমার সঙ্গে রিভলভার আছে তো? গুলি ভরা আছে কিনা দেখে নাও।

অর্জুন স্বাভাবিক গলায় জবাব দিল, আমার কাছে কোনও অস্ত্র নেই।

যাচ্চলে। মেজর ককিয়ে উঠলেন। আপনি কি ভয় পাচ্ছেন?

নো, নেভার। সেবার হার্লেমে মারপিট করেছিলাম খালি হাতে। ভয় আমি পাই না হে। তবে সাবধানের তো মার নেই। আর কত দূর? আমার দুটো পা এমন অবশ হয়ে গিয়েছে যে, ও দুটো আছে কিনা তাই বুঝতে পারছি না।

মেজরের গলার স্বর শুনে অর্জুনের মায়া হল। ভারী শরীর নিয়ে একভাবে বসে থাকা সহজ কথা নয়। কিন্তু এই মানুষটাই কী করে তা হলে আফ্রিকা, নর্থ পোলে অথবা তিব্বতে অভিযান করে বেড়ান? মাঝে-মাঝে মনে হয় মেজর সমানে গুল মেরে যাচ্ছেন, কিন্তু বিষ্ঠুসাহেব বলেছেন ওঁর সবচেয়ে বড় গুণ কখনওই মিথ্যে কথা বলেন না।

অর্জুন নজর রাখছিল। প্রত্যেক চা-বাগানের সামনে নাম লেখা বোর্ড থাকে। সেটা থেকেই হৈমন্তীপুরের হদিস পেতে হবে। হঠাৎ দারোগার কথাটা মনে এল। সকালে তিনি একটা অ্যাম্বাসাডারের খোঁজ করেছিলেন? কোন অ্যাম্বাসাডার? ভদ্রলোক বিশদে বলেননি। আজ সকালে শিলিগুড়ি যাওয়ার পথে মিষ্টির দোকানে যেটা দাঁড়িয়ে ছিল, অমলদার অনুরোধে যে-গাড়িটা তাদের লিফট দিয়েছিল সেইটে কি? শিলিগুড়িতে পৌঁছবার পর এ নিয়ে অমলদার সঙ্গে কথা বলার আর সুযোগ হয়নি। তবু ব্যাপারটা মনে বিধতে লাগল। পরক্ষণেই সে চিন্তাটাকে ঝেড়ে ফেলতে চাইল। হৈমন্তীপুরের কেসটা যখন সে নিচ্ছে না তখন এ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কী লাভ?

বাইকের হেডলাইটের আলো সাইনবোর্ডের ওপর পড়তেই অর্জুন গতি কমিয়ে বলল, আমরা এসে গিয়েছি। মেজর পেছন থেকে বললেন, কোথায় এলাম? চারপাশে তো অন্ধকার!

ততক্ষণে রাস্তাটা দেখতে পাওয়া গিয়েছে। পিচের রাজপথ থেকে একটু নুড়িতে ভরা পথ নেমে গিয়েছে বাঁ দিকে। চা-বাগানের রাস্তা যেমন হয়। অর্জুন বাঁ দিকে বাইক ঘোরাল। মেজর বলে উঠলেন, ভাঙা ব্রিজটাকে খেয়াল কর। উঃ কী অন্ধকার রে বাবা। সেবার নিউ ইয়র্কে এক ঘণ্টার জন্য পাওয়ার চলে গিয়েছিল। ঠিক এমন অন্ধকার হয়েছিল সেখানে। অমন ঘটে না বলে কেউ তো বাড়িতে মোমবাতি পর্যন্ত রাখে না।

গতি কম ছিল। মিনিট দেড়েক যাওয়ার পর সাঁকোটাকে দেখা গেল। কাঠের সাঁকো। বড়জোর হাত পনেরো হবে। ঠিক মাঝখানের কাঠগুলো উধাও। গাড়ি যাওয়া-আসা অসম্ভব, কিন্তু অর্জুনের মনে হল সার্কাসের বাইক ড্রাইভাররা ওই ফাঁকটুকু বাইক নিয়ে লাফিয়ে যেতে পারে। হেডলাইটের আলোয় সাঁকোর নীচেটা দেখল অর্জুন, তারপর বলল, এবার আপনাকে নামতে হবে। বাইকটাকে নীচে নামাতে হবে।

একদম ইচ্ছে ছিল না মেজরের। গাঁইগুঁই করে তিনি কোনও রকমে নীচে নেমে চিৎকার করে বসে পড়লেন। বোঝা যাচ্ছিল পায়ে বিন্দুমাত্র জোর নেই। একনাগাড়ে বসে বসে ও দুটোতে ঝিঝি ধরে গেছে। অর্জুন হেসে বলল, মোটর বাইকের পেছনে বসে আপনার এই অবস্থা! আর ভাবুন তো, কালাপাহাড়ের কথা? ভদ্রলোক দিনের পর দিন রাতের পর রাত ঘোড়ার পিঠে বসে থাকতেন।

খিঁচিয়ে উঠলেন, ইঃ, আমাকে কালাপাহাড় দেখিও না। আমি কি ওরকম লোক? অদ্ভুত তুলনা।

মেজরের পা ঠিক হতে যে সময় লাগল তার মধ্যে অর্জুন দেখে নিল সাঁকোর নীচে দিয়ে কোনওমতে বাইকটাকে পার করা সম্ভব হবে। যা ভেবেছিল ঠিক তাই, জল নেই। কয়েকটা বড় বোল্ডার পড়ে আছে শুকনো হয়ে। মাঝে মাঝে বাইকটাকে দুহাতে তুলতে হবে এই যা। পায়ে-পায়ে শুকনো ঝোরাটা পার হয়ে আবার রাস্তায় উঠতেই ওরা পায়ের শব্দ শুনতে পেল। আওয়াজ লক্ষ করে তাকাতেই অন্ধকারের মধ্যেই একটা ছায়ামূর্তিকে ছুটে যেতে দেখা গেল। মেজর চিৎকার করলেন, অ্যাই কে? হু আর ইউ?

অর্জুন মোটর বাইকের হেডলাইট ঘুরিয়ে লোকটির পেছনটা দেখতে পেল এক ঝলক। চট করে পাশের চা বাগানের মধ্যে মিলিয়ে গেল সে।

মেজর বললেন, লোকটা কে হে? পালাল কেন ওভাবে?

হয়তো গার্ড দিচ্ছিল। আমরা এসেছি এই খবর দিতে গেল।

কাকে?

সেটাই তো জানি না। অর্জুন আবার বাইক চালু করল। মেজর জিজ্ঞেস করলেন, উঠতে হবে?

না হলে যাবেন কী করে? হাঁটবেন?

হাঁটা আমাকে দেখিও না তৃতীয় পাণ্ডব? এক রাত্রে সাহারায় আমি কুড়ি মাইল হেঁটেছিলাম। ঠিক আছে, উঠছি। বাইকে উঠে তিনি বললেন, ভানুবাবুর প্রস্তাবটা খারাপ ছিল না। আজ রাত্রে ওঁর বাড়িতে রেস্ট নিয়ে কাল সকালে এলে হত।

পরিশ্রমই হয়নি যখন, তখন রেস্ট নেওয়ার কী দরকার?

মেজর নাক দিয়ে যে শব্দটা করলেন তাতে কথাটা যে খুব অপছন্দের, তা বোঝা গেল।

অন্ধকার চিরে হেডলাইটের আলো এগিয়ে যাচ্ছিল। রাত্রে বাগানের চেহারা ভাল বোঝা যাচ্ছে না বটে কিন্তু রাস্তার ওপর যেভাবে শুকনো ডালপালা ছড়ানো আছে, তাতেই স্পষ্ট, ইদানীং যত্ন নেওয়া হচ্ছে না। একটু বাদে বাগানের ফ্যাক্টরি এবং অফিসগুলো নজরে এল। কোথাও আলো নেই। একটি মানুষকেও কাছেপিঠে দেখা যাচ্ছে না।

অর্জুন দুবার হর্ন দিল। তারপর এগিয়ে গেল সামনে। ডান দিকে বাঁক নিতেই আচমকা একটি আলোকিত বাংলা চোখে পড়ল। অনুমান করা গেল এটিতেই মমতা দত্ত থাকেন। বাংলোয় বিদ্যুৎ আছে। টেলিফোন মৃত কিন্তু বিদ্যুতের লাইন যদি ঠিক থাকে তা হলে আর সব জায়গা অন্ধকার কেন?

গেট বন্ধ। ভেতর থেকে তালা দেওয়া। অর্জুন হর্ন দিল। মমতা দত্তের নিজস্ব কর্মচারীরা নিশ্চয়ই পাহারায় থাকবেন কিন্তু তাদের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। অর্জুন আরও কয়েকবার হর্ন দিল। মেজর নেমে দাঁড়ালেন। গেটের সামনে গিয়ে চিৎকার করলেন, বাড়িতে কেউ আছেন? আমরা জলপাইগুড়ি থেকে এসেছি।

বাড়িটা ছবির মতো নিশ্চল রইল।

অর্জুন বলল, আপনি বাইকটার কাছে থাকুন, আমি ভেতরে ঢুকছি।

ভেতরে ঢুকবে কী করে? গেট তো বন্ধ।

গেটটা টপকাতে হবে। আলো জ্বলছে যখন, তখন মানুষ নিশ্চয়ই ভেতরে আছে।

বাইকটাকে দাঁড় করিয়ে অর্জুন এগিয়ে গেল। গেটের উচ্চতা ফুট ছয়েকের। খাঁজে পা দিয়ে সে শরীরটাকে ওপরে তুলে লাফিয়ে নামল নীচে। দুপাশে বাগান, মাঝখানে গাড়ি চলার পথ। সেই পথ ধরে বাংলোর দিকে এগোতেই সে দাঁড়িয়ে পড়ল। বাংলোর গাড়িবারান্দার নীচে সিঁড়ির ওপর উপুড় হয়ে আছে একটা শরীর। রক্তের ধারা বেরিয়ে এসে জমাট বেঁধে গেছে পাশে।