রানী ভানুমতীর মহলে একটি প্রশস্ত কক্ষের মেঝেয় স্থানে স্থানে মৃগচর্মের আস্তরণ বিস্তৃত। মধ্যস্থলে একটি গজদন্ত পালঙ্কের উপর ভানুমতী অর্ধশয়ান রহিয়াছেন। বক্ষের নিচোল কিছু শিথিল, চুলের ফুল আতপ্ত দ্বিপ্রহরে মুরঝাইয়া গিয়াছে। রানীর কাছে দাসী কিঙ্করী কেহ নাই, কেবল মালিনী পালঙ্কের পাশে হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া ব্যগ্র-হ্রস্ব কণ্ঠে কথা বলিতেছে— ‘হ্যাঁ গো রানিমা, সত্যি বলছি তোমাকে, এমন গান তুমিও শোনোনি কখনো। শুনতে শুনতে মনে হয়—’ মালিনী দুই হাত নাড়িয়া নিজের মনের অবস্থা বুঝাইবার চেষ্টা করিল কিন্তু পারিল না— ‘কি বলে বোঝাব তোমাকে ভেবে পাই না। চোখে জল আসে, বুক ভরে ওঠে— নাঃ বলতে পারছি না। তুমি একবার নিজের কানে শোনো রানিমা। দেখো তখন, সব ভুলে যাবে, সংসার মনে থাকবে না।’
মালিনীর উদ্দীপনা দেখিয়া ভানুমতী একটু হাসিলেন— ‘বড় সরলা তুই মালিনী। সংসার ভুলিয়ে দিতে পারে এমন কবি আজকাল আর জন্মায় না। আমি সব আধুনিক কবির গান শুনেছি; তারা সব স্তাবক— চাটুকার, কেবল ইনিয়ে বিনিয়ে রাজার প্রশস্তি লিখতে জানে।’
মালিনী বলিল— ‘ওগো রানিমা, আমার কবি তেমন নয়, সে কারুর তোষামোদ করে না, সে কেবল ঠাকুর দেবতার গান লেখে। মহাদেব পার্বতী— মদন বসন্ত— এই সব।’
ভানুমতী আলস্যজড়িত স্বরে বলিলেন— ‘যাই হোক, আমার মালিনীটিকে যে-কবি এমন করে পাগল করেছে, তাকে একবার দেখতে ইচ্ছে করে—’
মালিনী উৎসাহে আহ্লাদে রানীর উপর ঝুঁকিয়া পড়িল— ‘দেখবে তাকে রানিমা? দেখবে?’
ভানুমতী বলিলেন— ‘দেখতে পারি। কিন্তু কি করে সম্ভব ভেবে পাচ্ছি না। — তোর কবি তো রাজসভায় যাবে না; আর অন্দরমহলে আনা, সেও অসম্ভব।’
মালিনী বলিল— ‘অসম্ভব কেন রানিমা, তোমার হুকুম পেলে আমি সব ঠিক করতে পারি।’
‘কী ঠিক করতে পারিস?’
‘এই— আমার কবি চুপিচুপি তোমার মহলে এসে গান শুনিয়ে যাবে, কেউ কিছু জানতে পারবে না। তুমি শুধু তোমার চেড়িদের একটু তফাতে রেখো— বাকি যা দরকার আমি করব।’
ভানুমতী ঊর্ধ্বে চক্ষু তুলিয়া একটু ভ্রূকুটি করিলেন, একটু হাসিলেন— ‘মন্দ হয় না, নতুন রকমের হয়। আর্যপুত্রকে—’
এক যবনী প্রতিহারী আসিয়া দ্বারের বাহিরে দাঁড়াইল। তাহার নীল চক্ষু, সোনালী চুল, বক্ষে লৌহজালিক; ভাঙা-ভাঙা উচ্চারণ। সে বলিল— ‘দেবপাদ মহারাজ আসছেন, সঙ্গে কঞ্চুকী মহাশয়।’
বার্তা ঘোষণা করিয়া প্রতিহারী অপসৃতা হইল। রানী তাড়াতাড়ি উঠিয়া বসিয়া উত্তরীয় দ্বারা অঙ্গ আবৃত করিলেন। তাঁহার চোখের ইঙ্গিতে মালিনী ঘরের এক কোণে গিয়া দাঁড়াইল।
বিক্রমাদিত্য প্রবেশ করিলেন, পশ্চাতে কঞ্চুকী। কঞ্চুকী নপুংসক; কৃশকায় মুণ্ডিতশীর্ষ কদাকার, চোখের দৃষ্টিতে সন্দেহ ও অসন্তোষ স্থায়িভাব ধারণ করিয়াছে। নিম্ব ভক্ষণের অব্যবহিত পরে মুখের আকৃতি যেরূপ হয়, কঞ্চুকীর মুখের সহজ অবস্থাই সেইরূপ।
ভানুমতী অঞ্জলিবদ্ধ হস্তে দাঁড়াইয়া আর্যপুত্রের সংবর্ধনা করিলেন, উভয়ের চোখে চোখে যে প্রসন্নতার বিনিময় হইল, তাহা হইতে অনুমান হয় যে এই রাজ-দম্পতির মধ্যে প্রণয়ের উৎসধারা এখনো মন্দবেগ হয় নাই। রানীর দিকে আসিতে আসিতে রাজা একবার পশ্চাদ্দিকে মুখ ফিরাইয়া বলিলেন— ‘তুমি এখন যেতে পারো কঞ্চুকী।’
কঞ্চুকী পশ্চাৎ হইতে রাজ-দম্পতিকে নমস্কার করিয়া ফিরিয়া চলিল। দ্বারের কাছে পৌঁছিয়া সে ঘরের চারিদিকে একবার সতর্ক সন্দিগ্ধ চক্ষু ফিরাইল; ঘরের কোণে দণ্ডায়মানা মালিনীর প্রতি তাহার দৃষ্টি পড়িল। ভীষণ ভ্রূকুটি করিয়া সে সেইদিকে তাকাইয়া রহিল, তারপর নিঃশব্দে মুণ্ড সঞ্চালন করিয়া তাহাকে কক্ষ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইবার ইঙ্গিত করিল। মালিনী শঙ্কিত মুখে পা টিপিয়া টিপিয়া কঞ্চুকীর আগে আগে দ্বারপথে নির্গত হইল।
কক্ষ শূন্য হইয়া গেলে ভানুমতী দুই বাহু দিয়া রাজার কণ্ঠ আলিঙ্গন করিয়া স্নিগ্ধ কৌতুকের স্বরে বলিলেন— ‘আজ বুঝি আমার সতীন পতিদেবতাকে ধরে রাখতে পারল না?’
মহারাজ স্মিতমুখে ভ্রূ তুলিলেন— ‘তোমার সতীন?’
ভানুমতী বলিলেন— ‘তাকে আপনি চেনেন না আর্যপুত্র? পুরুষ জাতি এমনি কপটই বটে। আমার সতীনের নাম রাজসভা, যাকে ছেড়ে আপনি এক দণ্ডও থাকতে পারেন না।’
রাজা ভানুমতীর কুন্তল হইতে একটি ফুল লইয়া আঘ্রাণ করিলেন, আবার তাহা যথাস্থানে রাখিয়া দিলেন। ভানুমতী বলিয়া চলিলেন— ‘শুনেছি কনিষ্ঠা ভার্যার প্রতি পুরুষের অনুরাগ বেশি হয়, কিন্তু মহারাজের সবই বিপরীত— জ্যেষ্ঠার প্রতি তাঁর আসক্তি বেশি। রাজ্যশ্রী চিরযৌবনা, তাই বুঝি তাকে এত ভালবাসেন মহারাজ।’
বিক্রমাদিত্যের মুখ হইতে কৌতুকের ছায়া অপসৃত হইল, তিনি ভানুমতীর মুখ দুই হাতে তুলিয়া ধরিয়া কিছুক্ষণ গভীর অনুরাগভরে চাহিয়া রহিলেন, তারপর ধীরে ধীরে বলিলেন— ‘তা জানি না। রাজ্যশ্রী যদি যায়, তবু তুমি আমার বুক জুড়ে থাকবে। কিন্তু তুমি যদি যাও আমার চোখে রাজ্যশ্রীর এ সম্মোহন রূপ কি থাকবে? রাজলক্ষ্মী যে তোমারই ছায়া ভানুমতী।’
বাষ্পাকুল চক্ষে ভানুমতী পতির বক্ষের উপর ললাট রাখিলেন, গদ্গদ কণ্ঠে বললেন— ‘ও কথা বলতে নেই প্রিয়তম। রাজলক্ষ্মীই প্রধানা, আমি কেউ নই। মহাকাল করুন রাজলক্ষ্মীর কোলে আপনাকে তুলে দিয়ে যেন যেতে পারি।’
কিছুক্ষণ উভয়ে তদবস্থায় রহিলেন। বাহিরে মানমন্দির হইতে দিবা তৃতীয় প্রহর ঘোষণা করিয়া বাঁশি বাজিয়া উঠিল। রানীর একটি সখী মঞ্জীর বাজাইয়া কক্ষের দ্বার পর্যন্ত আসিয়া রাজ-দম্পতিকে আশ্লেষবদ্ধ অবস্থায় দেখিয়া জিহ্বাকর্তনপূর্বক লঘুচরণে পলায়ন করিল।
রাজারানী পরস্পরকে ছাড়িয়া দিয়া পালঙ্কের উপর পাশাপাশি বসিলেন; ভানুমতী হাসিমুখে বলিলেন— ‘কিন্তু আজ মহারাজ তিন প্রহরের আগেই সভা থেকে পালিয়ে এলেন কেন তা তো বললেন না। সভাকবিরা কি চিত্তবিনোদন করতে পারল না?’
রাজা মুখে কারুণ্য ফুটাইয়া বলিলেন— ‘চিত্তবিনোদন! সভাকবিদের ভয়েই তো তোমার কাছে পালিয়ে এসেছি ভানুমতী।’
হাস্য গোপন করিয়া রানী কপট ভর্ৎসনার কণ্ঠে বলিলেন— ‘ছি মহারাজ, আপনি বীর কেশরী, আর কিনা কয়েকজন নির্জীব হংসপুচ্ছধারী কবির ভয়ে পালিয়ে এলেন?’
বিক্রমাদিত্য বলিলেন— ‘উপায় কি? কবি দিঙ্নাগ সংবাদ পাঠালেন যে তিনি ‘কুম্ভকর্ণ-সংহার’ নামে মহাকাব্য শেষ করেছেন, আমাকে শোনাবার জন্যে উটের পিঠে কাব্য বোঝাই করে সভায় নিয়ে আসছেন। শুনে অমরসিংহ, বররুচি, বরাহমিহির— যাঁরা সভায় ছিলেন, সকলেই উঠে দ্রুত প্রস্থান করলেন। আমিও আর বিলম্ব করা অনুচিত বিবেচনা করে অন্তঃপুরের দিকে চলে এলাম। এখানে অন্তত দিঙ্নাগ ঢুকতে পারবে না।’
ভানুমতী কলকণ্ঠে হাসিয়া উঠিলেন। রাজা বলিলেন— ‘এবার এসো, একদান পাশা খেলা যাক।’
ভানুমতী হাস্য সংবরণ করিয়া ডাকিলেন— ‘মধুশ্রী! বনজ্যোৎস্না!’
দুইটি সখী দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। ভানুমতী তাঁহাদের বলিলেন— ‘মহারাজ পাশা খেলবেন, খেলার উপযোগ কর।’
সখিদ্বয় ত্বরিতে কাজে লাগিয়া গেল। মধুশ্রী কুট্টিমের মধ্যস্থল হইতে মৃগচর্ম অপসারিত করিতেই মর্মরের উপর খোদিত অক্ষবাট বাহির হইয়া পড়িল; বনজ্যোৎস্না দুইটি পক্ষ্মল আসন তাহার দুই পাশে বিছাইয়া দিল, তারপর ঘরের কোণ হইতে গজদন্তের একটি ক্ষুদ্র পেটিকা আনিয়া অক্ষবাটের পাশে রাখিল।
রাজা ও রানী গিয়া আসনে বসিলেন; রাজা পেটিকাটি অক্ষবাটের উপর উজাড় করিয়া দিয়া পার্ষ্টি তিনটি তুলিয়া লইলেন, রানী রঙিন গুটিকাগুলি যথাস্থানে সাজাইতে লাগিলেন।
রাজা পার্ষ্টিগুলি দুই হাতে ঘষিতে ঘষিতে বলিলেন— ‘আজ তোমাকে নিশ্চয় হারাবো।’ তাঁহার কথার ভাবে মনে হয় রানীকে দ্যূতক্রীড়ায় পরাস্ত করা তাঁহার ভাগ্যে বড় একটা ঘটিয়া ওঠে না।
রানী মুখ টিপিয়া হাসিলেন— ‘ভাল কথা। কিন্তু যদি হেরে যান কী পণ দেবেন?’
বিক্রমাদিত্য উদার কণ্ঠে বলিলেন— ‘যা চাও। অঙ্গদ কুণ্ডল দণ্ড মুকুট— কিছুতেই আপত্তি নেই। — জয় কৈতবনাথ!’
মহারাজ ঘর্ঘর শব্দে পাশা ফেলিলেন। খেলা আরম্ভ হইয়া গেল।
দেখিতে দেখিতে খেলা জমিয়া উঠিল। আরো কয়েকটি সখী কিঙ্করী আসিয়া জুটিল এবং চারিদিকে ঘিরিয়া বসিয়া সকুতূহলে খেলা দেখিতে লাগিল। রাজার পাশে সুরা-ভৃঙ্গার, রানীর পাশে তাম্বূলকরঙ্ক; দু’জনেই খেলায় মাতিয়া উঠিয়াছেন। খেলার মত্ততায় তাঁহারা কখনো কলহ করিতেছেন, কখনো উচ্চহাস্য করিতেছেন; মুখের অর্গলও খুলিয়া গিয়াছে, প্রগল্ভ শাণিত বাক্যবাণে উভয়ে পরস্পরকে বিদ্ধ করিতেছেন। সখীরা পরম কৌতুকে এই রঙ্গরস উপভোগ করিতেছে।
ক্রমে খেলা শেষ হইয়া আসিল। মহারাজের মুখ দেখিয়া স্পষ্টই প্রতীয়মান হইল তাঁহার অবস্থা ভাল নয়। তবু তিনি বীরের ন্যায় শেষ পর্যন্ত লড়িলেন। কিন্তু কোনো ফল হইল না। বাজি শেষ হইলে ভানুমতী উচ্ছলিত হাসিয়া বলিলেন— ‘আর্যপুত্র, আবার আপনি হেরে গেলেন!’
বিক্রমাদিত্য অত্যন্ত বিমর্ষভাবে একপাত্র সুরা পান করিয়া ফেলিলেন,— তারপর কপট ক্রোধের ভ্রূভঙ্গি করিয়া বলিলেন— ‘অয়ি দর্পিতা বিজয়িনি, তোমার বড় অহঙ্কার হয়েছে। আচ্ছা, আর একদিন তোমার গর্ব খর্ব করব। এখন তোমার পণ দাবি কর।’
ভানুমতী মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিলেন, তাঁহার চক্ষু অর্ধ-নিমীলিত হইয়া আসিল। তিনি কুহক মধুর স্বরে বলিলেন— ‘এখন নয় আর্যপুত্র। আজ রাত্রে— নিভৃতে— আমার বর ভিক্ষা চেয়ে নেব।’
রাজার চক্ষু দু’টিও প্রীতিহাস্যে ভরিয়া উঠিল।
রাজপুরীর পুরসীমার অন্তর্ভুক্ত বিহার ভূমি। অদূরে অবরোধের তোরণদ্বার দেখা যাইতেছে।
বৃক্ষ গুল্মাদি শোভিত বিহার ভূমির উপর দিয়া মালিনী ও কালিদাস অবরোধের পানে চলিয়াছেন। কালিদাসের বাহুতলে অসমাপ্ত কুমারসম্ভবের পুঁথি। মালিনী সাবধান সতর্ক চক্ষে চারিদিকে চাহিতে চাহিতে চলিয়াছে।
কবি মৃদু মৃদু হাসিতেছেন, তাঁহার ভাব-ভঙ্গিতে বিশেষ সতর্কতা নাই; তিনি যেন মালিনীর এই ছেলেমানুষী কাণ্ডে লিপ্ত হইয়া একটু আমোদ অনুভব করিতেছেন মাত্র। ক্রমে দু’জনে অবরোধদ্বারের অনতিদূরে এক বৃক্ষতলে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। মালিনী সংহত কণ্ঠে বলিল— ‘আস্তে। সামনেই দেউড়ি।’
কালিদাস উঁকি মারিয়া দেখিলেন। আমাদের পূর্বপরিচিত নবযুবক দৌবারিক শূলহস্তে পাহারায় নিযুক্ত— আর কেহ নাই।
মালিনী দ্রুত-অনুচ্চ কণ্ঠে কালিদাসকে কিছু উপদেশ দিয়া একাকিনী অবরোধদ্বারের দিকে অগ্রসর হইল; কালিদাস বৃক্ষকাণ্ডের আড়ালে দাঁড়াইয়া রহিলেন।
রক্ষী দ্বারের সম্মুখে পরিক্রমণ করিতেছিল, মালিনীকে আসিতে দেখিয়া একগাল হাসিল। মালিনী পা টিপিয়া টিপিয়া তাহার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল, মুখের দিকে চাহিয়া ঈষৎ হাসিল, তারপর সন্ত্রস্তভাবে এদিকে ওদিকে চাহিয়া নিজ ঠোঁটের উপর তর্জনী রাখিল।
রক্ষী ঘোর বিস্ময়ে প্রশ্ন করিল— ‘কি হয়েছে? অমন করছ, কেন?’
মালিনী চাপা গলায় বলিল— ‘চুপ— চেঁচিও না। তোমার জন্য একটা জিনিস এনেছি!’
রক্ষী সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিল— ‘কি জিনিস?’
মালিনী রহস্যপূর্ণভাবে বলিল— ‘লাড়ু।’ কোঁচড়ের উপর হাত রাখিয়া্ মালিনী ইঙ্গিতে জানাইল যে লাড়ু ঐখানে আছে। রক্ষীর মুখ আনন্দে বিহ্বল হইয়া উঠিল। সে বলিল— ‘অ্যাঁ— লাড়ু! আমার জন্যে এনেছ? দেখি দেখি।’
মালিনী মাথা নীড়িল— ‘এখানে নয়। খাবে তো ওদিকে চল— ঐ মল্লিকা-ঝাড়ের আড়ালে।’
লাড়ু খাইবার জন্য মল্লিকা-ঝাড়ের আড়ালে যাইবার কী প্রয়োজন? কিংবা মালিনীর মনে আরো কিছু আছে? উৎসাহে রক্ষী ঘর্মাক্ত হইয়া উঠিল। কিন্তু অবরোধের দ্বার ছাড়িয়াই বা যায় কি করিয়া! সে ইতস্তত করিয়া বলিল— ‘তা— তা— দেউড়ি খালি থাকবে?’
মালিনী বলিল— ‘তাতে কি হয়েছে? এ সময় কেউ আসবে না।’
রক্ষী দ্বিধাগ্রস্তভাবে বলিল— ‘তা আসে না বটে— কিন্তু কঞ্চুকী মশাই—। কাজ নেই মালিনী, তুমি লাড়ু দাও, আমি এখানে দাঁড়িয়েই খাই।’
মালিনী ক্রমেই অসহিষ্ণু হইয়া উঠিতেছিল, বলিল— ‘দেউড়িতে দাঁড়িয়ে লাড়ু খাবে! যদি কেউ দেখে ফ্যালে কী ভাববে বলে দেখি।’
রক্ষী বলিল— ‘তাও বটে। কিন্তু উপায় কি বলো? দেউড়ি ছাড়া যে বারণ।’
মালিনী রাগ করিয়া মুখ ফিরাইয়া দাঁড়াইল, বলিল— ‘বেশ, কাজ নেই তোমার লাড়ু খেয়ে, আমি আর কাউকে খাওয়াব। এত যত্ন করে নিজের হাতে তৈরি করেছিলুম—’
রক্ষী আর পারিল না, বলিল,— ‘না না মালিনী, তোমার লাড়ু খাচ্ছি। চল কোথায় যাবে।’
দেয়ালের গায়ে বল্লম হেলাইয়া রাখিয়া রক্ষী মালিনীর পিছে পিছে চলিল। ওদিকে কালিদাস গাছের আড়াল হইতে উঁকি মারিয়া দেখিতেছিলেন। তোরণ হইতে বিংশতি হস্ত দক্ষিণে একটি মল্লিকার ঝোপ ছিল, মালিনী ও রক্ষী তাহার আড়ালে গিয়া দাঁড়াইল। মালিনী সাবধানে একবার চারিদিকে চাহিয়া লইয়া রক্ষীকে দ্বারের দিকে পিছন করিয়া দাঁড় করাইল। রক্ষী ব্যাপার না বুঝিয়া বিস্ময়ভরে মালিনীকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিল।
মালিনী বলিল— ‘হয়েছে। এবার চোখ বোজো।’
রক্ষী বলিল— ‘চোখ বুজবো? কেন?’
মালিনী ধমক দিয়া বলিল— ‘যা বলছি কর। যতক্ষণ হুকুম না দিই চোখ খুলবে না।’
রক্ষী অগত্যা চক্ষু মুদিত করিল। লাড়ুর লোভ যতটা না হোক, মালিনীকে প্রসন্ন রাখা প্রয়োজন! সে একটুতে বড় রাগিয়া যায়।
মালিনীর কিন্তু রক্ষীকে বিশ্বাস নাই; কে জানে হয়তো চোখের পাতার ফাঁকে দেখিতেছে। মালিনী তাহার মুখের কাছে মুখ লইয়া গিয়া ভাল করিয়া পরীক্ষা করিল; না, চোখ বুজিয়াই আছে, দেখিতেছে না। মালিনী তখন হাত তুলিয়া কালিদাসকে ইশারা করিল। কালিদাস বৃক্ষতল হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গুটিগুটি অরক্ষিত দ্বারের পানে চলিলেন।
রক্ষী চক্ষু বুজিয়া থাকিয়া অসহিষ্ণু হইয়া উঠিতেছিল, বলিল— ‘কি হল! লাড়ু কৈ?’
মালিনী চকিতে তাহার দিকে ফিরিয়া বলিল— ‘এই যে। হাঁ করো।’
রক্ষী হাঁ করিল, সঙ্গে সঙ্গে চক্ষু দু’টিও খুলিয়া গেল। কালিদাস তখনো অর্ধপথে; মালিনী ভয় পাইয়া বলিয়া উঠিল— ‘ও কি করছ! চোখ বন্ধ কর— চোখ বন্ধ কর।’
কালিদাস রক্ষীর পিছন দিক দিয়া যাইতেছিলেন। তাই সে তাঁহাকে দেখিতে পাইল না। সে আবার চোখ বন্ধ করিল, সঙ্গে সঙ্গে মুখও বন্ধ হইল। মালিনী গলা বাড়াইয়া দেখিল কালিদাস নির্বিঘ্নে তোরণে প্রবেশ করিলেন। তখন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া সে রক্ষীর মুখের পানে চাহিল, হাসিয়া বলিল— ‘নাও এবার মুখ খোলো।’
রক্ষী যুগপৎ চক্ষু ও মুখ খুলিল।
মালিনী বলিল— ‘দূর, হল না। চোখ বন্ধ, মুখ খোলা— এই রকম— বুঝলে।’
মালিনী প্রক্রিয়া দেখাইয়া দিল। কিন্তু কয়েকবার চেষ্টা করিয়াও রক্ষী কৃতকার্য হইল না; হাঁ করিলেই চক্ষু খুলিয়া যায়। মালিনী হাসিতে লাগিল। রক্ষী কাতর স্বরে বলিল— ‘কি করি— হচ্ছে না যে।’
মালিনী বলিল— ‘তাহলে লাড়ু পেলে না।’
হাসিতে হাসিতে সে দ্বারের দিকে চলিল। অর্ধপথে থামিয়া ঘাড় ফিরাইয়া বলিল— ‘তুমি ততক্ষণ অভ্যেস কর। ফিরে এসে যদি দেখি ঠিক হয়েছে, তখন লাড়ু পাবে।’
মালিনী অবরোধের ভিতর অন্তর্হিত হইয়া গেল। রক্ষী বিমর্ষ মুখে ফিরিয়া আসিয়া বল্লমটি তুলিয়া লইল, তারপর স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া গভীর মনঃসংযোগে চক্ষু মুদিত রাখিয়া মুখব্যাদান করিবার দুরূহ সাধনায় আত্মনিয়োগ করিল।
অবরোধের প্রাচীরবেষ্টনীর মধ্যে একটি উদ্যানে মহাদেবী ভানুমতীর সখী-কিঙ্করীরা জমা হইয়াছে। তাহাদের সংখ্যা কম নয়, প্রায় গুটি পঞ্চাশ। কেহ বৃক্ষশাখায় লম্বিত ঝুলায় দুলিতে দুলিতে গান করিতেছে; এক ঝাঁক যুবতী ছুটাছুটি করিয়া খেলা করিতেছে; কোথাও দুইটি সখী পাশাপাশি বসিয়া মালা গাঁথিতেছে এবং মৃদুকণ্ঠে জল্পনা করিতেছে। আজ তাহারা রানীর পরিচর্যা হইতে ছুটি পাইয়াছে।
দূর হইতে কালিদাস তাঁহাদের দেখিতে পাইয়া সেইদিকেই চলিয়াছিলেন, পিছন হইতে মালিনী ছুটিতে ছুটিতে আসিয়া তাঁহাকে ধরিয়া ফেলিল। আর একটু হইলেই সর্বনাশ হইয়াছিল; সখীরা দেখিতে পাইত অবরোধে পুরুষ প্রবেশ করিয়াছে। কঞ্চুকী মহাশয়ের কানে কথা উঠিত—
মালিনী দৃঢ়ভাবে কবির হাত ধরিয়া তাঁহাকে অন্য পথে টানিয়া লইয়া চলিল। —
মহাদেবী ভানুমতীর বিরামকক্ষটি লূতাজালের মত সূক্ষ্ম তিরস্করিণীর দ্বারা দুই ভাগে বিভক্ত করা হইয়াছে। এক ভাগে রানীর বসিবার আসন, অন্য ভাগে কবির জন্য একটি মৃগচর্ম ও পুঁথি রাখিবার নিম্ন কাষ্ঠাসন। ভানুমতী নিজ আসনে বসিয়া প্রতীক্ষা করিতেছেন, কক্ষে অন্য কেহ নাই।
ত্বরিত অথচ সতর্ক পদক্ষেপে মালিনী দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল, একবার ঘরের চারিদিকে ক্ষিপ্র দৃষ্টিপাত করিয়া মস্তক সঞ্চালনে রানীকে জানাইল যে কালিদাস আসিয়াছেন। রানী বেশবাস সংবরণপূর্বক ঘাড় নাড়িয়া অনুমতি দিলেন। তখন মালিনী পাশের দিকে হাতছানি দিয়া ডাকিল।
কালিদাস অলিন্দে অপেক্ষা করিতেছিলেন, দ্বারের সম্মুখে আসিলেন; উভয়ে কক্ষে প্রবেশ করিলেন। মালিনী ভিতর হইতে কক্ষের দ্বার বন্ধ করিয়া দিল।
রানীকে দেখিতে পাইয়া কালিদাস হাত তুলিয়া সংযত স্বরে বলিলেন— ‘স্বস্তি।’
কালিদাসের প্রশান্ত অপ্রগল্ভ মুখচ্ছবি, তাঁহার অনাড়ম্বর হ্রস্বোক্তি ভানুমতীর ভাল লাগিল, মনের ঔৎসুক্যও বৃদ্ধি পাইল। তিনি স্মিতমুখে হস্ত প্রসারণ করিয়া কবিকে বসিবার অনুজ্ঞা জানাইলেন।
কবি আসনে উপবেশন করিয়া পুঁথির বাঁধন খুলিতে লাগিলেন; মালিনী অদূরে মেঝের উপর বসিল।
অবরোধের উদ্যানে ভানুমতীর সখীরা পূর্ববৎ গান গাহিতেছে, ঝুলায় বুলিতেছে, ছুটাছুটি করিয়া খেলা করিতেছে। একটি সখী কোমরে আঁচল জড়াইয়া লীলাভরে নৃত্য করিতেছে, অন্য কয়েকটি তরুণী করকঙ্কণ বাজাইয়া গান ধরিয়াছে—
ওপথে দিস্নে পা
দিস্নে পা লো সই
মনে তোর রইবে না সুখ
রইবে না লো সই।
যদি না মন বাঁচে
কালো তোর হবে সোনার গা লো সই—
ভানুমতীর কক্ষে কুমারসম্ভব পাঠ আরম্ভ হইয়াছে। ভানুমতী করলগ্নকপোলে শুনিতেছেন, প্রতি শ্লোকের অনুপম সৌন্দর্যে মুগ্ধ হইয়া মাঝে মাঝে বিস্ময়োৎফুল্ল চক্ষু কবির মুখের পানে তুলিতেছেন। কোথা হইতে আসিল এই অখ্যাতনামা ঐন্দ্রজালিক, এই তরুণকান্তি কথাশিল্পী!
কালিদাস পড়িতেছেন— উমার রূপ বর্ণনা :
দিনে দিনে সা পরিবর্ধমান লব্ধোদয়া চান্দ্রমসীব লেখা—
ভানুমতীর বিরামকক্ষের পাশে একটি গুপ্ত অলিন্দ আছে; দেখিতে কতকটা সুড়ঙ্গের মত। প্রাচীরগাত্রে মাঝে মাঝে প্রচ্ছন্ন রন্ধ্র আছে, সেই রন্ধ্রপথে কক্ষের অভ্যন্তর দেখা যায়। অবরোধের প্রত্যেক কক্ষে, যাহাতে কঞ্চুকী মহাশয় স্বয়ং অলক্ষ্যে থাকিয়া লক্ষ্য রাখিতে পারেন সেই জন্য এইরূপ ব্যবস্থা।
রানীর একটি সহচরী— নাম ভ্রমরী— পা টিপিয়া টিপিয়া অলিন্দ পথে চলিয়াছে। তাহার মুখে সন্দেহপূর্ণ উত্তেজনার ব্যঞ্জনা। একটি ছিদ্রের নিকটে আসিয়া সে কান পাতিয়া শুনিল— কক্ষ হইতে একটানা গুঞ্জনধ্বনি আসিতেছে। তখন ভ্রমরী ডিঙি মারিয়া সন্তর্পণে ছিদ্রপথে উঁকি মারিল।
রন্ধ্রটি নীচের দিকে ঢালু; ভ্রমরী কক্ষের কিয়দংশ দেখিতে পাইল। কালিদাস কাব্য পাঠ করিতেছেন, স্বচ্ছ তিরস্করিণীর অন্তরালে ভানুমতী উপবিষ্টা। মালিনী রন্ধ্রের দৃষ্টিচক্রের বাহিরে ছিল বলিয়া ভ্রমরী তাহাকে দেখিতে পাইল না।
কিছুক্ষণ একাগ্রভাবে নিরীক্ষণ করিয়া ভ্রমরী রন্ধ্রমুখ হইতে সরিয়া আসিল, উত্তেজনা-বিবৃত চক্ষে চাহিয়া নিজ তর্জনী দংশন করিল; তারপর দ্রুত লঘুপদে ফিরিয়া চলিল।
অতঃপর ভ্রমরী উদ্যানে ফিরিয়া গিয়া তাহার প্রিয় বয়স্যা মধুশ্রীকে কী বলিল, মধুশ্রী তাহার প্রিয়সখী মঞ্জুলার কানে কানে কী বার্তা শুনাইল এবং সর্বশেষে অবরোধের রক্ষক কঞ্চুকী মহাশয়ের কাছে সংবাদটি কীভাবে বহুবর্ণে রঞ্জিত হইয়া উপস্থিত হইল তাহার বিশদ বর্ণনা প্রয়োজন নাই। গুপ্তকথার বিচিত্র ভুজঙ্গপ্রয়াত গতিভঙ্গির সহিত আমরা সকলেই অল্পবিস্তর পরিচিত।
ইতিমধ্যে, রানী ভানুমতীর কক্ষে কালিদাস রতিবিলাপ নামক চতুর্থ সর্গ পাঠ শেষ করিয়াছেন। এই পর্যন্তই লেখা হইয়াছে। মদনপ্রিয়া রতির নব-বৈধব্যের মর্মান্তিক বর্ণনা শুনিয়া দেবী ভানুমতী কাঁদিয়াছেন, তাঁহার চক্ষু দু’টি অরুণাভ। মালিনীর কপোলও অশ্রুধারায় অভিষিক্ত।
পাঠ শেষে কালিদাস ধীরে ধীরে পুঁথি বন্ধ করিলেন; ভানুমতী আর্দ্র তদ্গত কণ্ঠে বলিলেন— ‘ধন্য কবি! ধন্য মহাভাগ!’—
কঞ্চুকী এতক্ষণে আসিয়া গুপ্ত রন্ধ্রপথে উঁকি মারিতেছিল। কক্ষ হইতে কোমল কণ্ঠস্বর ভাসিয়া আসিল, রানী বলিতেছেন— ‘আবার কতদিনে দর্শন পাব?’
কালিদাস বলিলেন— ‘দেবি, আপনার অনুগ্রহ লাভ করে আমি কৃতার্থ; যখন আদেশ করবেন তখনি আসব। কিন্তু কাব্য শেষ হতে এখনো বিলম্ব আছে—’
ভানুমতী বাধা দিয়া বলিলেন— ‘না না, শেষ হওয়া পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করতে পারব না।’
কালিদাস স্মিতমুখে কহিলেন— ‘ভাল, পরের সর্গ শেষ করে আমি আবার আসব।’
হাত তুলিয়া সসম্ভ্রমে অভিবাদনপূর্বক কালিদাস মালিনীর দিকে ফিরিলেন।
কঞ্চুকী রন্ধ্রমুখে কান খাড়া করিয়া শুনিতেছিল, কিন্তু আর কিছু শুনিতে পাইল না। তখন সে রন্ধ্রমুখ হইতে সরিয়া আসিয়া ভ্রূবদ্ধ ললাটে ক্ষণেক চিন্তা করিল, তারপর শিখার গ্রন্থি খুলিয়া আবার তাহা বাঁধিতে বাঁধিতে অলিন্দ হইতে অপসৃত হইল।
বিক্রমাদিত্যের অস্ত্রাগার। একটি বৃহৎ কক্ষ; নানাবিধ অস্ত্রশস্ত্রে প্রাচীরগুলি সুসজ্জিত। এই অস্ত্রগুলির উপর মহারাজের যত্ন ও মমতার অন্ত নাই। তিনি স্বহস্তে এগুলিকে প্রতিনিয়ত মার্জন করিয়া থাকেন।
বর্তমানে, কক্ষের মধ্যস্থলে একটি বেদিকার প্রান্তে বসিয়া তিনি তাঁহার সর্বাপেক্ষা প্রিয় তরবারিটি পরিষ্কার করিতেছেন। তাঁহার পাশে ঈষৎ পশ্চাতে দাঁড়াইয়া কঞ্চুকী নিম্নস্বরে কথা বলিতেছে। রাজার মুখ কালবৈশাখীর মেঘের মত অন্ধকার; চক্ষে মাঝে মাঝে বিদ্যুদ্বহ্নির চমক খেলিতেছে। তিনি কিন্তু কঞ্চুকীর মুখের পানে তাকাইতেছেন না।
কঞ্চুকী বার্তা শেষ করিয়া বলিল— ‘যেখানে স্বয়ং মহাদেবী— এঁ— লিপ্ত রয়েছেন সেখানে আমার স্বাধীনভাবে কিছু করার অধিকার নেই। এখন দেবপাদ মহারাজের যেমন অভিরুচি।’
মহারাজ তাঁহার চক্ষু তরবারি হইতে তুলিয়া ঈষৎ ঘাড় বাঁকাইয়া কঞ্চুকীর পানে চাহিলেন; কয়েক মুহূর্ত তাঁহার খরধার দৃষ্টি কঞ্চুকীর মুখের উপর স্থির হইয়া রহিল। তারপর আবার তরবারিতে মনঃসংযোগ করিয়া তিনি ধীর সংযত কণ্ঠে বলিলেন— ‘এখন কিছু করবার দরকার নেই। শুধু লক্ষ্য রাখবে। সে— সে— ব্যক্তি যদি আবার আসে তৎক্ষণাৎ আমাকে সংবাদ দেবে।’
কঞ্চুকী মাথা ঝুঁকাইয়া সম্মতি জানাইল। তাহার বিকৃত মনোবৃত্তি যে এই ব্যাপারে উল্লসিত হইয়াছে, তাহা তাহার স্বভাব-তিক্ত মুখ দেখিয়াও বুঝিতে বিলম্ব হয় না।
রাজপ্রাসাদের স্ফটিকনির্মিত ডমরুসদৃশ বালু-ঘটিকা হইতে ক্ষীণ ধারায় বালু ঝরিয়া পড়িতেছে। কয়েক সপ্তাহ অতীত হইয়াছে।
একদিন অপরাহ্ণে ভানুমতীর কক্ষে কবির জন্য মৃগচর্ম ও পুঁথি রাখিবার জন্য কাষ্ঠাসন যথাস্থানে ন্যস্ত হইয়াছে। ভানুমতী নতজানু হইয়া পরম শ্রদ্ধাভরে কাষ্ঠাসনটি ফুল দিয়া সাজাইয়া দিতেছেন। কক্ষে অন্য কেহ নাই।
মালিনী দ্বারের নিকট প্রবেশ করিয়া মস্তক-সঞ্চালনে ইঙ্গিত করিল; প্রত্যুত্তরে ভানুমতী ঘাড় নাড়িলেন, তারপর তিরস্করিণীর অন্তরালে নিজ আসনে গিয়া বসিলেন।
মালিনী বাহিরের দিকে হাতছানি দিয়া কবিকে ডাকিল, কবি পুঁথি-হস্তে দ্বারের নিকট আসিয়া দাঁড়াইলেন।
এই সময় বিক্রমাদিত্য নিজ অস্ত্রাগারে বসিয়া একাকী একটি চর্মনির্মিত গোলাকৃতি বর্ম পরিষ্কার করিতেছিলেন। কঞ্চুকী বাহির হইতে আসিয়া দ্বারের কাছে দাঁড়াইল; মহারাজ তাহার দিকে চক্ষু তুলিলেন। কঞ্চুকী কিছুক্ষণ স্থির নেত্রে চাহিয়া থাকিয়া যেন রাজার অকথিত প্রশ্নের উত্তরে ধীরে ধীরে ঘাড় নাড়িল।
রাজা বর্ম রাখিয়া দ্বারের কাছে গেলেন। দ্বারের পাশে প্রাচীরে একটি কোষবদ্ধ তরবারি ঝুলিতেছিল, কঞ্চুকী তাহা তুলিয়া লইয়া অত্যন্ত অর্থপূর্ণভাবে রাজার সম্মুখে ধরিল। রাজা একবার তীব্র দৃষ্টিতে কঞ্চুকীকে নিরীক্ষণ করিলেন, তারপর এক ঝটকায় তরবারি কোষমুক্ত করিয়া স্বহস্তে তরবারি লইয়া কক্ষ হইতে বাহির হইলেন। কঞ্চুকী পিছে পিছে চলিল।
ভানুমতীর কক্ষে কালিদাস পার্বতীর তপস্যা অংশ পাঠ করিয়া শুনাইতেছেন। কপোল-ন্যস্ত-হস্তা রানী অবহিত হইয়া শুনিতেছেন; তাঁহার দুই চক্ষে নিবিড় রস-তন্ময়তার আভাস।
গুপ্ত অলিন্দে তরবারি হস্তে মহারাজ আগে আগে আসিতেছেন, পশ্চাতে কঞ্চুকী। রন্ধ্রের সম্মুখে আসিয়া মহারাজ দাঁড়াইলেন; রন্ধ্রপথে একবার দৃষ্টি প্রেরণ করিলেন, তারপর সেই দিকে কর্ণ ফিরাইয়া রন্ধ্রাগত স্বর-গুঞ্জন শুনিতে লাগিলেন। তাঁহার মুখ পূর্ববৎ কঠিন ও ভয়াবহ হইয়া রহিল।
রন্ধ্রপথে ছন্দোবদ্ধ শব্দের অস্পষ্ট গুঞ্জরন আসিতেছে। শুনিতে শুনিতে রাজা প্রাচীরে স্কন্ধ অর্পণ করিয়া দাঁড়াইলেন। হাতের তরবারিটা অস্বস্তিদায়ক; সেটা কয়েকবার এহাতে ওহাতে করিয়া শেষে কঞ্চুকীর হাতে ধরাইয়া দিয়া নিশ্চিন্ত হইলেন। কঞ্চুকী মহারাজের দিকে বক্র কটাক্ষপাত করিল; কিন্তু তাঁহার বজ্রকঠিন মুখ দেখিয়া মানসিক অবস্থা অনুমান করিতে পারিল না। সে ঈষৎ উদ্বিগ্নভাবে মনে মনে জল্পনা করিতে লাগিল— কি আশ্চর্য! মহারাজ এখনও ক্ষেপিয়া যাইতেছেন না কেন?
ভানুমতীর কক্ষে কালিদাস পাঠ শেষ করিয়া পুঁথি বাঁধিতেছেন, রানীর দিকে চোখ তুলিয়া স্মিতহাস্যে বলিলেন— ‘ওই পর্যন্ত হয়েছে মহারানী।’
ভানুমতী প্রশ্ন করিলেন— ‘কবি, বাকিটুকু কত দিনে শুনতে পাব? আমার মন যেন আর ধৈর্য মানছে না। কবে কাব্য শেষ হবে?’
কালিদাস বলিলেন— ‘মহাকাল জানেন। তিনিই স্রষ্টা, আমি অনুলেখক মাত্র। এবার অনুমতি দিন দেবি!’
গুপ্ত অলিন্দে রাজা এতক্ষণ দেয়ালে ঠেস দিয়া ছিলেন, হঠাৎ সোজা হইয়া দাঁড়াইলেন। কঞ্চুকী মনে মনে অস্থির হইয়া উঠিয়াছিল, তাড়াতাড়ি তরবারিটি বাড়াইয়া ধরিল। রাজা তরবারির পানে আরক্ত দৃষ্টিপাত করিয়া সেটি নিজ হস্তে লইলেন, তারপর দীর্ঘ পদক্ষেপে বাহিরে চলিলেন।
কঞ্চুকীর মনে আশা জাগিল, এতক্ষণে রাজার রক্ত গরম হইয়াছে। সে উৎফুল্ল মুখে তাঁহার অনুবর্তী হইল।
রানীর কক্ষে কালিদাস পুঁথি হস্তে উঠিয়া দাঁড়াইয়াছেন, ভানুমতী দাঁড়াইয়া যুক্তকরে তাঁহাকে বিদায় দিতেছেন। মালিনী দ্বারের দিকে চলিয়াছে; কবিকে বাহিরে পৌঁছাইয়া দিয়া সে আবার ফিরিয়া আসিবে।
সহসা প্রবল তাড়নে দ্বার খুলিয়া গেল। মুক্ত তরবারি হস্তে বিক্রমাদিত্য সম্মুখে দাঁড়াইয়া। মালিনী সভয়ে পিছাইয়া আসিয়া আর্ত চিৎকার কণ্ঠমধ্যে রোধ করিল।
রাজা প্রবেশ করিলেন, পশ্চাতে কঞ্চুকী। রাজার তীব্রোজ্জ্বল চক্ষু একবার চারিদিকে বিচরণ করিল; মালিনী এক কোণে মিশিয়া গিয়া থর থর কাঁপিতেছে; কালিদাস তাঁর নিজের ভাষায় ‘চিত্রার্পিতারম্ভ’ ভাবে দাঁড়াইয়া; মহাদেবী ভানিমতী প্রশান্ত নেত্রে রাজার পানে চাহিয়া আছেন, যেন মন হইতে কাব্যের ঘোর এখনো কাটে নেই।
কবির দিকে একবার কঠোর দৃষ্টিপাত করিয়া রাজা ভানুমতীর সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইলেন, দুইজনে নিষ্পলক চক্ষে পরস্পর মুখের পানে চাহিয়া রহিলেন। ক্রমে রানীর মুখে ঈষৎ কৌতুকহাস্য দেখা গেল। রাজা চাপা গর্জনে বলিলেন— ‘মহাদেবি ভানুমতি, এই কি তোমার উচিত কাজ হয়েছে?’
ভানুমতী বলিলেন— ‘কি কাজ আর্যপুত্র?’
বিক্রমাদিত্য গভীর ভর্ৎসনাভরে বলিলেন— ‘এই দেব-ভোগ্য কবিতা তুমি এক-একা ভোগ করছ। আমাকে পর্যন্ত ভাগ দিতে পারলে না! এত কৃপণ তুমি!’
কক্ষ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হইয়া রহিল। কালিদাসের মুখে চোখে নবোদিত বিস্ময়। কঞ্চুকী হঠাৎ ব্যাপার বুঝিতে পারিয়া খাবি খাওয়ার মত শব্দ করিয়া কাঁপিতে আরম্ভ করিল। মহারাজ তাহার দিকে দৃষ্টি ফিরাইলেন; কঞ্চুকীর অন্তরাত্মা শুকাইয়া গেল, সে ভয়ে প্রায় কাঁদিয়া উঠিল— ‘মহারাজ, আমি— আমি বুঝতে পারিনি।’
রাজা ঈষৎ চিন্তার ভান করিয়া বলিলেন— ‘সম্ভব। তুমি জানতে না যে মহাদেবী পাশার বাজি জিতে এই পণ চেয়ে নিয়েছিলেন। যাও, তোমাকে ক্ষমা করলাম। কিন্তু— ভবিষ্যতে মহাদেবী ভানুমতী সম্বন্ধে মনে মনেও আর এমন ধৃষ্টতা কোরো না।’
বিক্রমাদিত্য হাতের তরবারিটা কঞ্চুকীর দিকে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিলেন; মসৃণ হর্ম্যতলে তরবারি পিছলাইয়া কঞ্চুকীর দুই পায়ের ফাঁক দিয়া গলিয়া গেল! কঞ্চুকী লাফাইয়া উঠিল, তারপর তরবারি কুড়াইয়া লইয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে ঘর ছাড়িয়া পলায়ন করিল।
রাজার মুখে এতক্ষণে হাসি দেখা দিল। তিনি কালিদাসের দিকে অগ্রসর হইয়া গেলেন, কবির স্কন্ধে হস্ত রাখিয়া বলিলেন— ‘তরুণ কবি, তোমার ধৃষ্টতা ক্ষমা করা আমার পক্ষে আরও কঠিন। তুমি আমাকে উপেক্ষা করে রানীকে তোমার কাব্য শুনিয়েছ। তোমার কি বিশ্বাস বিক্রমাদিত্য শুধু যুদ্ধ করতেই জানে, কাব্যের রস গ্রহণ করতে সে অক্ষম?’
কালিদাস ব্যাকুলম্বরে বলিয়া উঠিলেন— ‘মহারাজ— আমি—’
বিক্রমাদিত্য বাধা দিয়া বলিলেন— ‘কোনো কথা শুনব না। তোমার শাস্তি, আবার আমাকে তোমার কাব্য গোড়া থেকে শোনাতে হবে। আড়াল থেকে যতটুকু শুনেছি তাতে অতৃপ্তি আরো বেড়ে গেছে—’ রানীর দিকে হস্ত প্রসারিত করিয়া বলিলেন— ‘এস দেবি, আমরা দু’জনে কবির পায়ের কাছে বসে আজ দেব-দম্পতির মিলন-গাঁথা শুনব।’
রাজা ও রানী পাশাপাশি ভূমির উপর উপবেশন করিলেন; কালিদাস ঈষৎ লজ্জিতভাবে নিজ আসনে বসিবার উপক্রম করিলেন।
মালিনী এতক্ষণ এক কোণে লুকাইয়া কাঁপিতেছিল, এখন পরিস্থিতির পরিবর্তন অনুভব করিয়া দ্বিধাজড়িত পদে বাহির হইয়া আসিল। কবিকে অক্ষতদেহে আবার কাব্য পাঠের উদ্যোগ করিতে দেখিয়া তাহার মন নির্ভয় হইল— বিপদ বুঝি কাটিয়াছে।
রাজা মালিনীকে দেখিতে পান নাই, কালিদাসকে উদ্দেশ করিয়া বলিলেন— ‘কবি, কাব্যপাঠ আরম্ভ করবার আগে তোমাকে একটা কথা বলতে চাই। আজ থেকে তুমি আমার সভাকবি হলে।’
কালিদাস ত্রস্তবিব্রত হইয়া বলিলেন— ‘না না মহারাজ, আমি এ সম্মানের যোগ্য নই।’
রাজা বলিলেন— ‘সে কথা বিশ্ববাসী বিচার করুক। আগামী শারদোৎসবের দিন আমি মহান কবি-সভা আহ্বান করব, দেশ-দেশান্তরের রাজা পণ্ডিত রসজ্ঞদের নিমন্ত্রণ করব— তাঁরা এসে তোমার কাব্য শুনবেন।’
কালিদাস অভিভূতভাবে বসিয়া রহিলেন। রাজা পুনশ্চ বলিলেন— ‘কিন্তু বসন্তের কোকিলের ন্যায় তুমি কোথা থেকে এলে কবি? তোমার নাম কি?’
কবি বলিলেন— ‘অধমের নাম কালিদাস।’
‘কালিদাস— কালিদাস—’ রাজা স্মৃতি মন্থন করিতে করিতে বলিলেন— ‘কয়েক মাস আগে ঋতুসংহার নামে একটি মধুর রসের কাব্য পড়েছিলাম, মনে হচ্ছে কবির নাম ছিল কালিদাস! তুমি কি সেই কালিদাস?’
কবি বলিলেন— ‘হাঁ আর্য। ইতিপূর্বে ঋতুসংহার ও মেঘদূত নামে দু’টি খণ্ডকাব্য লিখেছি।’
রাজা বলিলেন— ‘মেঘদূত! কৈ, আমি তো দেখিনি। বোধহয় আমার বর্তমান সভাকবি সেটি আমার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছেন। যা হোক, তুমি উজ্জয়িনীতে কোথায় বাস কর?’
মালিনী এতক্ষণে রাজার পিছনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল, কালিদাসকে ইতস্তত করিতে দেখিয়া বলিল— ‘উনি যে নদীর ধারে কুঁড়ে ঘর তৈরি করেছেন— সেইখানেই থাকেন।’
রাজা ঘাড় ফিরাইয়া মালিনীকে দেখিলেন, তাহার হাত ধরিয়া টানিয়া পাশে বসাইলেন; ছদ্ম কোপের কণ্ঠে বলিলেন— ‘দূতী! দূতী! তুমি ফুলের বেসাতি কর, না ভোমরার?’
মালিনী ঈষৎ ভয় পাইয়া বলিল— ‘ফ্ ফুলের, মহারাজ।’
রাজা বলিলেন— ‘হুঁ। ভেবেছ তোমার কথা আমি কিছু জানি না? সব জানি। আর, শাস্তিও দেব তেমনি। কঞ্চুকীর সঙ্গে তোমার বিয়ে দেব— তখন বুঝবে।’
পরিহাস বুঝিতে পারিয়া মালিনী হাসিল। রাজা কালিদাসের পানে ফিরিলেন— ‘কিন্তু নদীর ধারে কুঁড়ে ঘর! তা তো হতে পারে না। তোমার জন্য নগরে প্রাসাদ নির্দিষ্ট হবে, সেখানে তুমি থাকবে।’
কালিদাস হাত জোড় করিলেন— ‘মহারাজ, আপনার অসীম কৃপা। কিন্তু আমার কুটিরে আমি পরম সুখে আছি।’
রাজা বলিলেন— ‘কিন্তু কবিকে বিষয়-চিন্তা থেকে মুক্তি দেওয়া রাজার কর্তব্য। নইলে কবি কাব্য রচনা করবেন কি করে? অন্নচিন্তা চমৎকারা কাতরে কবিতা কুতঃ!’
কালিদাস বলিলেন— ‘রাজাধিরাজ, আমার কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই। মহাকাল আমাকে যা দিয়েছেন তার অধিক আমি কামনা করি না। মনের দৈন্যই দৈন্য মহারাজ।’
‘ধনসম্পদ চাও না?’
‘না আর্য। আমি মহাকালের সেবক। আমার দেবতা চির-নগ্ন, তাই তিনি চির-সুন্দর। আমি যেন চিরদিন আমার নগ্নসুন্দর দেবতার উপাসক থাকতে পারি।’