অষ্টম পরিচ্ছেদ – রাজপুরীতে
রাজপুরীর প্রাকার-বেষ্টনীর মধ্যে অনেকগুলি প্রাসাদ আছে; কোনটি সভাগৃহ, কোনটি কোষাগার, কোনটি মন্ত্রণাভবন; একথা পূর্বে বলা হইয়াছে। রাজকন্যা যে প্রাসাদে বাস করেন তাহা অবরোধ; তাহার পাশে রাজার জন্য পৃথক ভবন। উভয় প্রাসাদের মধ্যে অলিন্দের সংযোগ; উভয় প্রাসাদ ত্রিভূমক।
রাজপ্রাসাদের নিম্নতলে এক পাশের কয়েকটি কক্ষ লইয়া সন্নিধাতা হর্ষের বাসস্থান। রাজ-বৈভবের তুলনায় ইহা অপকৃষ্ট হইলেও সাধারণ মানুষের পক্ষে ঐশ্বর্যের চূড়ান্ত। কঞ্চুকী লক্ষ্মণ চিত্রককে এইস্থানে আনিয়া অধিষ্ঠিত করিল।
চিত্রক হৃষ্ট মনে আসন গ্রহণ করিতে না করিতে কঞ্চুকীর ইঙ্গিতে কয়েকটা অসুরাকৃতি সম্বাহক আসিয়া তাহাকে ধরিয়া ফেলিল এবং তাহাকে প্রায় উলঙ্গ করিয়া সবেগে তৈল মর্দন করিতে আরম্ভ করিয়া দিল। ইহা রাজকীয় সমাদরের প্রথম প্রবন্ধ।
অতঃপর চিত্রক শীতল জলে স্নান করিয়া নববস্ত্র পরিধান করিল; অঙ্গে চন্দন প্রলেপ দিয়া আহারে বসিল। প্রচুর পিষ্টক পৌলিক মোদক পরমান্নের আয়োজন, তদুপরি কঞ্চুকীর সবিনয় নির্বন্ধ। চিত্রক আকণ্ঠ ভরিয়া ভোজন করিল।
তারপর শরতের মেঘশুভ্র শয্যায় শয়ন। দুইজন নহাপিত আসিয়া অতি আরামদায়কভাবে হস্তপদ টিপিয়া দিতে লাগিল। এই আলস্যসুখ মুদিতচক্ষে উপভোগ করিতে করিতে, পুরুষভাগ্যের বিচিত্র ভুজঙ্গ-গতির কথা চিন্তা করিতে করিতে চিত্রক ঘুমাইয়া পড়িল।
ওদিকে সচিব চতুরানন ভট্ট মগধের লিপি পাঠ করিয়াছিলেন। তাঁহার আশঙ্কা মিথ্যা হয় নাই, রাষ্ট্রনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন না করিয়া যতখানি রূঢ়তা প্রকাশ করা যাইতে পারে ততখানি রূঢ়তার সহিত লিপিতে বিটঙ্ক রাজ্যের উপর নির্দেশ প্রেরিত হইয়াছে— বিটঙ্করাজ অচিরাৎ মগধের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করিয়া বক্রী রাজস্ব অর্পণ করুন; নচেৎ হূণহরিণকেশরী সম্রাট স্কন্দগুপ্ত স্বয়ং সসৈন্যে গান্ধার অভিমুখে যাইতেছেন, ইত্যাদি।
পত্র পাঠ করিয়া চতুর ভট্ট দীর্ঘকাল গভীর চিন্তায় মগ্ন রহিলেন; তারপর অন্য সচিবদের ডাকিয়া মন্ত্রণায় বসিলেন। শ্যেনপক্ষীর সচিত চটকের প্রতিস্পর্ধিতা সম্ভব নয়; চটকের পক্ষে হিতকরও নয়। কিন্তু রাজনীতির ক্ষেত্রে বাহুবলই সর্বস্ব নয়, কূটনীতিও আছে। স্কন্দগুপ্ত নূতন হূণ অভিযান প্রতিরোধ করিবার জন্য গান্ধারে আসিতেছেন; ঘোর যুদ্ধ বাধিবে; দীর্ঘকাল ধরিয়া যুদ্ধ চলিবে; শেষ পর্যন্ত ফলাফল কিরূপ দাঁড়াইবে কিছুই বলা যায় না। সুতরাং অবিলম্বে মগধের বশ্যতা স্বীকার না করিয়া ছলছুতা দ্বারা যদি কালহরণ করা যায়, হয়তো অন্তে সুফল ফলিতে পারে। একদিকে হূণ, অন্যদিকে স্কন্দগুপ্ত; এ অবস্থায় যথাসাধ্য নিরপেক্ষতা অবলম্বনই যুক্তি।
সচিবগণ একমত হইয়া মনস্থ করিলেন, পত্রের উত্তর দানে যথাসম্ভব বিলম্ব করা হোক; দূতটাকে বলা যাক, মহারাজ কপোতকূটে যতদিন না ফিরেন ততদিন পত্রের উত্তর দান সম্ভব নয়। ইতিমধ্যে মহারাজ রোট্টকে সব কথা জানাইয়া বার্তা প্রেরণ করা আবশ্যক। তিনি এখন চষ্টন দুর্গেই থাকুন, রাজধানীতে ফিরিবার কোনও তাড়া নাই। কিন্তু এত বড় গুরুতর সংবাদ তাঁহার গোচর করা সর্বাগ্রে কর্তব্য।
এইরূপ মনোনীত হইলে পর ত্বরিতগতি তুরঙ্গপৃষ্ঠে চষ্টন দুর্গে বার্তাবহ প্রেরিত হইল।
মন্ত্রগৃহে যখন এই সকল রাজকার্য চলিতেছিল, কুমারী রট্টা তখন নিজ ভবনে ছিলেন। আজ নানা কারণে তাঁহার মন কিছু উদ্ভ্রান্ত হইয়াছিল। প্রথমেই স্বপ্ন দেখিতে দেখিতে জাগরণ; তারপর চৌর ঘটিত ব্যাপারের অদ্ভুত পরিসমাপ্তি। মগধের দূত…মগধ…বিশ্ববিশ্রুত পাটলিপুত্র নগর…দিগ্বিজয়ী বীর স্কন্দগুপ্ত…দূত নিজের কী নাম বলিয়াছিল? চিত্রক বর্মা! চিত্রক…চিত্র ব্যাঘ্র…ব্যাঘ্রের সহিত কোথাও যেন সাদৃশ্য আছে…চোখের দৃষ্টি বড় নির্ভীক…
সর্বশেষে সুগোপার মাতার উদ্ধার। সুগোপার মাতা প্রাক্তন রাজপুত্রের ধাত্রী ছিল, কুমারী রট্টা তাহা জানিতেন। অভাগিনীর এই দুর্দশা হইয়াছিল? সকলের অজ্ঞাতে পঁচিশ বৎসর বন্দিনী ছিল! কেমন করিয়া বাঁচিয়া ছিল; কে তাহাকে আহার দিত? পৃথার দুরদৃষ্টের কথা ভাবিয়া রট্টার ঘন ঘন নিশ্বাস পড়িল। উঃ, পঁচিশ বৎসর পূর্বে হূণেরা কি বর্বরতাই না করিয়াছিল। রট্টা হূণদুহিতা, তবু—
সুগোপা মাতাকে উদ্ধার করিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে গৃহে লইয়া গিয়াছিল। সুগোপা বড় কান্না কাঁদিয়াছিল, স্মরণ করিয়া রট্টার চোখেও জল আসিল। তাঁহার ইচ্ছা হইল সুগোপার গৃহে গিয়া তাহাকে দেখিয়া আসেন। সুগোপার গৃহে তিনি বহুবার গিয়াছেন, যখন ইচ্ছা গিয়াছেন। কিন্তু আজ যাইতে তাঁহার সঙ্কোচ বোধ হইল। প্রিয়সখি সুগোপা মৃতকল্পা মাতাকে পাইয়া তুমুল হৃদয়াবেগের আবর্তে নিমজ্জিত হইয়াছে, এখন রট্টা তাহার কাছে যাইলে সে বিভ্রান্ত হইবে, বিব্রত হইবে।
মধ্যাহ্ন অতীত হইবার পর রট্টা গ্রহাচার্যকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। গ্রহাচার্য আসিলেন; স্বপ্ন-কথা শুনিয়া তিনি প্রশ্নগণনার আঁক কষিলেন, দিক্নির্ণয় করিলেন, লগ্ন নির্ধারণ করিলেন। তারপর ফলাদেশ করিলেন— ‘কল্যাণি, তোমার জীবনের এক মহা সন্ধিক্ষণ উপস্থিত। কিন্তু শঙ্কিত হইও না; অন্তে ফল শুভ হইবে। এক দিঙ্নাগসদৃশ মহাতেজস্বী পুরুষের সহিত তোমার পরিচয় ঘটিবে; এই পুরুষসিংহ তোমার প্রতি প্রসন্ন হইবেন। তোমার বিবাহের কালও আসন্ন। শুভমস্তু।’ গ্রহবিপ্রের ভাবগতিক দেখিয়া মনে হইল তিনি সব কথা খুলিয়া বলিলেন না, কিছু চাপিয়া গেলেন।
তিনি বিদায় হইলে রট্টা দীর্ঘকাল করলগ্নকপোলে বসিয়া রহিলেন, শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া ভাবিলেন— নিয়তির বিধান যখন অখণ্ডনীয় তখন চিন্তা করিয়া লাভ কি?
ক্রমে অপরাহ্ণ হইল।
ওদিকে চিত্রক দীর্ঘ দিবানিদ্রার পর জাগিয়া উঠিয়াছে। শরীর বেশ স্বচ্ছন্দ; গত কয়েকদিনের নানা ক্লেশজনিত গ্লানি আর নাই। তাহার মনেরও শরীরের অনুপাতে প্রফুল্ল হওয়া উচিত ছিল; কিন্তু চিত্রক অনুভব করিল, তাহার মন প্রফুল্ল না হইয়া বরং ক্রমশ উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিতেছে।
রাজপুরীর আদর আপ্যায়নে সে অভ্যস্ত নয়; উপরন্তু কঞ্চুকী লক্ষ্মণ যেন একটু অধিক পরিচর্যা করিতেছে। সে দণ্ডে দণ্ডে আসিয়া চিত্রকের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের সন্দেশ লইতেছে; তদুপরি তাহার কয়েকটা অনুচর সর্বদাই চিত্রককে বেষ্টন করিয়া আছে। কেহ ব্যজন করিতেছে, কেহ শীতল তক্র বা ফলাম্লরস আনিয়া সম্মুখে ধরিতেছে, কেহ বা তাম্বূল দিতেছে। মুহূর্তের জন্যও সে একাকী থাকিতে পাইতেছে না। তাহার সন্দেহ হইল, এই সাড়ম্বর আপ্যায়নের অন্তরালে অদৃশ্য জাল তাহাকে ঘিরিয়া রহিয়াছে। সে মনে মনে অতিষ্ঠ হইয়া উঠিল। হঠতাবশে রাজকুমারী রট্টার নিমন্ত্রণ গ্রহণ না করিলেই বোধহয় ভাল হইত।
সন্ধ্যার প্রাক্কালে চিত্রক মনে মনে একটি সঙ্কল্প স্থির করিয়া গাত্রোত্থান করিল। উত্তরীয় স্কন্ধে লইতেই এক কিঙ্কর জোড়হস্তে আসিয়া সম্মুখে দাঁড়াইল— ‘কি প্রয়োজন আদেশ করুন আর্য— আণবেদু।’
চিত্রক বলিল— ‘বহির্ভাগে পরিভ্রমণ করিবার ইচ্ছা করিয়াছি। বায়ু সেবনের প্রয়োজন।’
কিঙ্কর পশ্চাৎপদ হইয়া অন্তর্হিত হইল।
চিত্রক রাজভবনের বাহিরে পদার্পণ করিয়াছে, কোথা হইতে কঞ্চুকী আসিয়া হাসিমুখে তাহার সহিত যোগ দিল। ‘সায়ংকালে বায়ু সেবনের ইচ্ছা হইয়াছে? ভাল ভাল, চলুন আপনাকে রাজপুরী দেখাই!’ বলিয়া লক্ষ্মণ কঞ্চুকী লক্ষ্মণ ভ্রাতার মতই তাহার সহগামী হইল।
দুইজনে পুরভূমির যত্রতত্র বিচরণ করিতে লাগিল। চিত্রক বুঝিল পুরীর বাহিরে যাইবার চেষ্টা বৃথা, সে পুরপ্রাকারের বাহিরে যাইবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলে কঞ্চুকী হয়তো বাধা দিবে না, কিন্তু নিজে সঙ্গে থাকিবে। সুতরাং বাহিরে যাইবার আগ্রহ প্রকাশ না করাই ভাল।
বিস্তৃত পুরভূমির স্থানে স্থানে বৃক্ষ-বাটিকা, লতা-মণ্ডপ। মানুষ বেশি নাই; যাহারা আছে তাহারা অধিকাংশই সশস্ত্র প্রতীহার কিম্বা রক্ষী, দুই চারিজন উদ্যানপালও আছে। তাহারা সকলে নিজ নিজ কার্যে নিযুক্ত।
ইতস্তত ভ্রমণ করিতে করিতে চিত্রক অনুভব করিল, কঞ্চুকী ছাড়াও অন্য কেহ তাহার উপর লক্ষ্য রাখিয়াছে, নিজে অলক্ষ্যে থাকিয়া তাহাকে অনুসরণ করিতেছে। চিত্রক চকিতে কয়েকবার ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল, কিন্তু সন্ধ্যার মন্দালোকে বিশেষ কিছু ঠাহর করিতে পারিল না।
তারপর এক বৃক্ষ-বাটিকার নিকটে চিত্রক তাহার অদৃশ্য অনুসরণকারীকে মুখোমুখি দেখিতে পাইল। এক বৃক্ষের অন্তরাল হইতে একজোড়া ভয়ঙ্কর চক্ষু তাহার দিকে চাহিয়া আছে, হিংসাবিকৃত মুখে জ্বলন্ত দু’টা চক্ষু। চিত্রক চমকিয়া বলিয়া উঠিল— ‘ও কে?’ সঙ্গে সঙ্গে মূর্তি ছায়ার ন্যায় মিলাইয়া গেল।
কঞ্চুকী বলিল— ‘ও গুহ। আপনাকে নূতন মানুষ দেখিয়া বোধহয় কৌতূহলী হইয়াছে।’
চিত্রকের গত রাত্রির কথা মনে পড়িল; হাঁ, সেই বটে। কিন্তু গত রাত্রে গুহর চোখে এমন তীব্র দৃষ্টি ছিল না। চিত্রক কঞ্চুকীকে প্রশ্ন করিলে কঞ্চুকী সংক্ষেপে পাগল গুহর বৃত্তান্ত বলিল। তখন চিত্রক অন্ধকূপে পৃথার নিকট যে কাহিনী শুনিয়াছিল তাহার সহিত মিলাইয়া প্রকৃত ঘটনা অনেকটা অনুমান করিয়া লইল। গুহই পৃথাকে হরণ করিয়া কূটরন্ধ্রে লুকাইয়া রাখিয়াছিল, ইচ্ছা ছিল যুদ্ধ শেষ হইলে ফিরিয়া আসিয়া তাহাকে দখল করিবে, কিন্তু মস্তকে আঘাত পাইয়া তাহার স্মৃতিভ্রংশ হয়। তবু সে সব কথা ভোলে নাই; কোন অর্ধ-বিভ্রান্ত বৃত্তির দ্বারা পরিচালিত হইয়া গোপনে পৃথাকে খাদ্য দিয়া যাইত। শতাব্দীর একপাদ ধরিয়া সে এই কাজ করিয়াছে। আশ্চর্য মস্তিষ্কের ক্রিয়া, আশ্চর্য জীবনের সহজাত সংস্কার!
ক্রমে দিবালোক মুছিয়া গিয়া চাঁদের আলো ফুটিয়া উঠিল। রাজপুরীর ভবনে ভবনে দীপমালা জ্বলিল।
প্রদোষের এই সন্ধিক্ষণে চারিদিকে চাহিয়া চিত্রকের মনে হইল সে এই নির্বান্ধব পুরীতে একান্ত একাকী, নিতান্ত অসহায়। কাল বন্দী হইবার পর অন্ধকার কারাকূপের মধ্যে তাহার যে অবস্থা হইয়াছিল, আজ রাজপুরীর দীপোদ্ভাসিত প্রাঙ্গণে সে অবস্থার কিছুমাত্র পরিবর্তন হয় নাই।
সহসা তাহার অন্তর অসহ্য অধীরতায় ছট্ফট্ করিয়া উঠিল; সে যেন জল হইতে তীরে নিক্ষিপ্ত মীন। কিন্তু সে তাহার মনের অবস্থা সযত্নে গোপন করিয়া কঞ্চুকী সমভিব্যাহারে নিজ বাসভবনের দিকে ফিরিয়া চলিল।
রাত্রির মধ্যযামে রাজপুরীর আলোকমালা নির্বাপিত হইয়াছিল; শুক্লা চতুর্দশীর চন্দ্র পশ্চিমদিকে ঢলিয়া পড়িয়াছিল। মাঝে মাঝে লঘু মেঘখণ্ড আসিয়া স্বচ্ছ আবরণে চন্দ্রকে ঢাকিয়া দিতেছিল।
রাজভবন সুপ্ত; কোথাও শব্দ নাই। চিত্রক আপন শয়নকক্ষে শয্যায় লম্বমান ছিল, ধীরে ধীরে উঠিয়া বসিল। সে ঘুমায় নাই, কেবল চক্ষু মুদিত করিয়া শয্যায় পড়িয়া ছিল।
ঘরের এক কোণে স্তিমিত বর্তিকা অস্পষ্ট আলোক বিকীর্ণ করিতেছে; মুক্ত বাতায়ন পথে মৃদু বায়ুর সহিত জ্যোৎস্নার প্রতিভাস কক্ষে প্রবেশ করিতেছে। চিত্রক নিঃশব্দে পালঙ্ক হইতে নামিয়া বাতায়নের সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল। কোনও জনমানব নাই; চন্দ্রিকালিপ্ত পুরী নিথর দাঁড়াইয়া আছে।
চন্দ্রবিম্ব স্বচ্ছ মেঘে ঢাকা পড়িল; বহির্দৃশ্য আবছায়া হইয়া গেল। চিত্রক তখন বাতায়ন হইতে সরিয়া আসিয়া দ্বারপথে উঁকি মারিল। দ্বারের বাহিরে একটা কিঙ্কর বসিয়া বসিয়া ঘুমাইতেছে; অন্য কেহ নাই। চিত্রক নিঃশব্দে ফিরিয়া আসিল। প্রাচীর-গাত্রে তাহার সকোষ আসি ঝুলিতেছিল, সে তাহা কোমরে বাঁধিল।
তারপর লঘু পদে বাতায়ন লঙ্ঘন করিয়া সে পুরভূমিতে উত্তীর্ণ হইল। দীর্ঘনিশ্বাস টানিয়া ভাবিল, একটা বাধা উত্তীর্ণ হইয়াছি, আর একটা বাকি— পুরপ্রাকার। ইহা পার হইলেই মুক্তি।
অদূরে একটি লতা-মণ্ডপের অন্তরাল হইতে দুইটি তীক্ষ্ণ চক্ষু যে তাহাকে লক্ষ্য করিতেছে তাহা সে জানিতে পারিল না।
চন্দ্রের মুখে আবার মেঘের আচ্ছাদন পড়িল। এই সুযোগে চিত্রক ত্বরিত পদে প্রাকারের দিকে চলিল। প্রাকারের ভিতর দিকে স্থানে স্থানে প্রাকারশীর্ষে উঠিবার সঙ্কীর্ণ সোপান আছে, তাহা সে সায়ংকালে লক্ষ্য করিয়াছিল।
প্রাকারশীর্ষে উঠিয়া চিত্রক বাহিরের দিকে উঁকি মারিল। প্রাকার বহির্ভূমি হইতে প্রায় পঞ্চদশ হস্ত উচ্চ; তাহার মসৃণ পাষাণ-গাত্র বাহিয়া নামিবার বা উঠিবার উপায় নাই। এক উপায়, বজ্রাঙ্গবলী পবনপুত্রকে স্মরণ করিয়া নিম্নে লাফাইয়া পড়া; কিন্তু তাহাতে যদি বা প্রাণ বাঁচে, হস্ত পদ রক্ষা পাইবে না; অস্থি ভাঙ্গিবে। তখন পলায়নের চেষ্টা হাস্যকর প্রহসনে পরিণত হইবে।
তবে এখন কী কর্তব্য? আবার চুপি চুপি গিয়া শয্যায় শুইয়া থাকা? না, আরও চেষ্টা করিতে হইবে। বাহির হইবার একমাত্র পথ তোরণ-দ্বার। তোরণ-দ্বারে প্রতীহার আছে — তাহার চোখে ধূলা দিয়া বাহির হওয়া কি অসম্ভব? কে বলিতে পারে, প্রতীহার হয়তো ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। —
চিত্রক প্রাকারের উপর দিয়া তোরণ-দ্বারের অভিমুখে চলিল। সাবধানে চলিতে চলিতে তাহার মনে হইল পশ্চাতে কেহ আসিতেছে। সে চকিতে ফিরিয়া চাহিল, কিন্তু কাহাকেও দেখিতে পাইল না।
তোরণ-স্তম্ভের কাছে পৌঁছিয়া চিত্রক সন্তর্পণে নিম্নে দৃষ্টি প্রেরণ করিল; দেখিল প্রতীহার দ্বারের লৌহ কবাটে পৃষ্ঠ রাখিয়া পদদ্বয় প্রসারণপূর্বক ভূমিতে বসিয়া আছে, তাহার চিবুক বক্ষের উপর নত হইয়া পড়িয়াছে, ভল্লটি জানুর উপর স্থাপিত। প্রতীহার যে নিদ্রাসুখ উপভোগ করিতেছে তাহাতে সন্দেহ নাই।
তাহাকে দেখিতে দেখিতে চিত্রকের নাসাপুটি স্ফুরিত হইতে লাগিল, ললাটের টীকা ধীরে ধীরে রক্তবর্ণ ধারণ করিল। দেহের স্নায়ুপেশী কঠিন করিয়া সে ক্ষণকাল চিন্তা করিল, তারপর নিঃশব্দে কোষ হইতে তরবারি বাহির করিল। ইহাই এখন একমাত্র উপায়। তোরণ-দ্বারের গাত্রে যে ক্ষুদ্র কবাট আছে তাহা খুলিয়া সে বাহির হইবার চেষ্টা করিবে। প্রতীহারকে না জাগাইয়া যদি বাহির হইতে পারে ভাল, আর যদি প্রতীহার জাগিয়া ওঠে, তখন—
নিকটেই শীর্ণ সোপানশ্রেণী; চিত্রক নীচে নামিল। তোরণ-স্তম্ভের গা ঘেঁষিয়া অতি সতর্ক পদসঞ্চারে নিদ্রিত প্রতীহারের দিকে অগ্রসর হইল। এতক্ষণে সে প্রতীহারের মুখ দেখিতে পাইল; দেখিল গত রাত্রির সেই প্রতীহার।
ওষ্ঠাধর দৃঢ়বদ্ধ করিয়া চিত্রক আর এক পদ অগ্রসর হইল। কিন্তু আর তাহাকে অগ্রসর হইতে হইল না। এই সময়ে পশ্চাতে একটা গভীর গর্জনধ্বনি হইল; সঙ্গে সঙ্গে ভল্লুকের মত একটা জীব তাহার স্কন্ধে লাফাইয়া পড়িয়া দুই বজ্রবাহু দিয়া তাহার কণ্ঠ চাপিয়া ধরিল।
অতর্কিত আক্রমণে চিত্রক সম্মুখ দিকে পড়িয়া গেল। আক্রমকও সঙ্গে সঙ্গে পড়িল, কিন্তু তাহার বাহুবন্ধন শ্লথ হইল না। চিত্রকের শ্বাস রোধ হইবার উপক্রম হইল। শত্রু পৃষ্ঠের উপর— চিত্রক তাহাকে দেখিতে পাইল না। অন্ধভাবে মাটিতে পড়িয়া সে অদৃশ্য আততায়ীর সহিত যুদ্ধ করিতে লাগিল; তাহার মুষ্টি হইতে তরবারি পড়িয়া গেল। দুই হাতে প্রাণপণে চেষ্টা করিয়াও কিন্তু সে আততায়ীর নাগপাশ হইতে নিজ কণ্ঠ মুক্ত করিতে পারিল না।
এদিকে প্রতীহার আচম্বিতে ঘুম ভাঙ্গিয়া দেখিল সম্মুখে গজ-কচ্ছপের যুদ্ধ বাধিয়া গিয়াছে। কিছু না বুঝিয়াই সে লাফাইয়া উঠিল এবং কটি হইতে একটা তূরী বাহির করিয়া তাহাতে ফুৎকার দিতে লাগিল। তূর্যের তারধ্বনিতে চারিদিক সচকিত হইয়া উঠিল।
চিত্রকের অবস্থা ততক্ষণে শোচনীয় হইয়া উঠিয়াছে; তাহার সংজ্ঞা লুপ্ত হইয়া আসিতেছে। কণ্ঠ মুক্ত করিবার চেষ্টা বৃথা। অন্ধভাবে চিত্রক মাটিতে হাত রাখিল; তরবারিটা তাহার হাতে ঠেকিল। মোহগ্রস্তভাবে তরবারি মুষ্টিতে লইয়া চিত্রক কোনও ক্রমে জানুর উপর উঠিল, তারপর তরবারি পিছন দিকে ফিরাইল; আততায়ী যেখানে তাহার পৃষ্ঠের উপর জড়াইয়া ধরিয়াছে সেইখানে তরবারির অগ্রভাগ রাখিয়া দুই হাতে আকর্ষণ করিল। তরবারি ধীরে ধীরে আততায়ীর পঞ্জর মধ্যে প্রবেশ করিল।
কিছুক্ষণ আততায়ী তদবস্থ রহিল; তারপর তাহার বাহুবন্ধন সহসা শিথিল হইল। সে চিত্রকের পৃষ্ঠ হইতে গড়াইয়া মাটিতে পড়িয়া গেল।
ফুস্ফুস্ ভরিয়া শ্বাসগ্রহণপূর্বক চিত্রক টলিতে টলিতে উঠিয়া দাঁড়াইল। ইতিমধ্যে তূরীধ্বনিতে আকৃষ্ট হইয়া কয়েকজন পুরবাসী ভূত্য ছুটিয়া আসিয়াছিল এবং দণ্ডাদির দ্বারা চিত্রককে প্রহার করিতে উদ্যত হইয়াছিল; কিন্তু চিত্রক উঠিয়া দাঁড়াইলে তাহার মুখ দেখিয়া তাহারা নিরস্ত হইল।
তোরণ-প্রতীহার ভল্ল অগ্রবর্তী করিয়া কাছে আসিয়া মহা বিস্ময়ে বলিয়া উঠিল— ‘আরে এ কি! এ যে কাল রাত্রির চোর— না না। — মগধের দূত মহাশয়! এত রাত্রে এখানে কি করিতেছেন? ওটা কে?’
চিত্রক ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলিতে ফেলিতে বলিল— ‘জানি না। আমাকে পিছন হইতে আচম্বিতে আক্রমণ করিয়াছিল—’
আততায়ীর অসিবিদ্ধ দেহটা অধোমুখ হইয়া পড়িয়া ছিল, একজন গিয়া তাহাকে উল্টাইয়া দিল। তখন চন্দ্রলোকে তাহার মুখ দেখিয়া সকলে স্তব্ধ হইয়া গেলা— গুহ।
গুহ মরিয়াছে; তাহার দেহটা শিথিল জড়পিণ্ডে পরিণত হইয়াছে।
প্রতীহার বিস্ময়-সংহত কণ্ঠে বলিল— ‘কি আশ্চর্য— গুহ! গুহ আপনাকে আক্রমণ করিয়াছিল! কিন্তু সে বড় নিরীহ— কখনও কাহাকেও আক্রমণ করে নাই। আজ সহসা আপনাকে আক্রমণ করিল কেন?’
চিত্রক উত্তর দিল না, একদৃষ্টে, গুহর মৃত মুখের পানে চাহিয়া রহিল। গুহর মুখ শান্ত; যেন দীর্ঘ জাগরণের পর সে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। এই মানুষটাই ক্ষণেক পূর্বে হিংস্র ঋক্ষের ন্যায় তাহার কণ্ঠনালী চাপিয়া মারিবার উপক্রম করিয়াছিল তাহা বুঝিবার উপায় নাই। এই খর্ব ক্ষুদ্র দেহে এমন পাশবিক শক্তি ছিল তাহাও অনুমান করা যায় না।
প্রতীহার ওদিকে প্রশ্ন করিয়া চলিয়াছে— ‘কিন্তু গুহ আপনার প্রতি এমন মারাত্মক আক্রমণ করিল কেন? সে অবশ্য পাগল ছিল, কিন্তু কাহাকেও অকারণে আক্রমণ করা—’
চিত্রক বলিল— ‘অকারণ নয়। আমার প্রতি তাহার বিদ্বেষের কারণ বুঝিয়াছি। পৃথার মুক্তি। গুহ ভাবিয়াছিল, আমিই তাহার গুপ্তধন চুরি করিয়াছি।’
গুহর পাশে নতজানু হইয়া চিত্রক ধীরে ধীরে তাহার পঞ্জর হইতে তরবারি বাহির করিয়া লইল। মৃত্যুর পরপারে গুহ আবার তাহার লুপ্ত স্মৃতি ফিরিয়া পাইয়াছে কিনা কে জানে!