সে তো হল। রবিবার না হয় মহিষাদলেই গেলুম। কিন্তু তারপর?
সবটাই কী রকম গোলমালে ঠেকছে। হতচ্ছাড়া কম্বলের আগাগোড়াই বিটকেল ব্যাপার। যখন নিরুদেশ হয়নি, তখন পাড়াসুদ্ধ লোকের হাড় ভাজাভাজা করে ফেলছিল; যখন উধাও হল তখনও মাথার ভেতরে বনবনিয়ে কুমোরের চাক ঘুরিয়ে দিলে।
আচ্ছা তোমারই বলল, লোকে কি আর নিরুদ্দেশ হয় না। পরীক্ষায় ফেল-টেল করে ঠেঙানি খাওয়ার ভয়ে কিংবা হয়তো ঠাকুদার কাছ থেকে একটা গিটার আদায় করবার আশায়, কেউ হয়তো বন্ধুর বাড়িতে চম্পট দেয়—আবার কেউ বা মাসি-পিসির বাড়িতে গিয়ে লুকিয়ে থাকে। তারপর যেই বিজ্ঞাপন বেরুল : প্রিয় ট্যাঁপা, শীঘ্র ফিরিয়া আইস! মা মৃত্যুশয্যায়, তোমাকে কেহ কিছু বলিবে না, কিংবা স্নেহের ন্যাদা, তোমার ঠিকানা দাও—সকলেই কাঁদিতেছে তখন গর্তের থেকে পিঁপড়ের মতো সব সুড়সুড় করে একে-একে বেরিয়ে এল। তারপর রাত বুঝে কারও অদৃষ্টে চাঁটানি, কারও বা হাওয়াইয়ান গিটার!
কিন্তু এই সব ভালো ছেলেদের মতো বুঝেসুঝে নিরুদ্দেশ হবে, কম্বলচন্দর কি সে জাতের নাকি? তার কাকা বলে বসল—সে চাঁদে গেছে, তার নাকি ছেলেবেলা থেকেই চাঁদে যাওয়ার ন্যাক আছে একটা। এসব বাজে কথা কে কবে শুনেছে? তারপরে ল্যাঠার পর ল্যাঠা! কোত্থেকে কান ঘেঁষে এক আমের আঁঠি, একটা যাচ্ছেতাই ছড়া—চাঁদনির বাজার, শেয়ালপুকুর, পাটকেলানন্দ, মা নেংটীশ্বরী, ঝোল্লা-গোঁফ চক্রধর সামন্তবাদুড়ের নাম অবকাশঞ্জিনীধুত্তোর, কোনও মানে হয় এসবের?
এতেও শেষ নয়। এখন আবার ঘাড়ে চড়াও হয়েছে এক তালঢ্যাঙা বিবেন। আবার তার সঙ্গে রবিবারে মহিষাদলে যেতে হবে। মহিষাদল নামটাই যেন কী রকম—শুনলেই মনে হয় একদল বুনো মোষ শিং বাগিয়ে তাড়া করে আসছে। কপালে কী আছে, কে জানে। চন্দ্রকান্ত নাকেশ্বর আমাদের কোন্ চাঁদে নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দেবে—তাই বা কে বলতে পারে।
তারপর আবার কী সব রসিদ-ফসিদের কথাও বলছি চক্রধর। তার মানে, অনেক গণ্ডগোল আছে ভেতরে। ক্যাবলা সমানে তো টিকটিক করছে, কিন্তু মহিষাদলের মোষদের পাল্লায় পড়ে–
আমি আর হাবুল সেন এসব নিয়ে অনেক গবেষণা করলুম।
হাবুল ভেবে-চিন্তে বললে, সত্য কইছিস প্যালা। আমরা ফ্যাচাঙে পড়ম।
আমি বললুম, পেছনে আবার পুলিশ আছে ওদের। কী করছে লোকগুলো কে জানে। শেষকালে আমাদের সুষ্ঠু ধরে নিয়ে যাবে।
হাবুল—তা লইয়া যাইব। লইয়া গিয়া রাম-পিটানি দিব।
আমি বললুম, আর বাড়িতে?
—কান ধইরা ছিড়া দিব। পুলিশের পিটুনির থিক্যাও সেটা খারাপ।
আমি বললুম, অনেক খারাপ। তোর হয়তো একটা কান ছিঁড়ে দেবে, কিন্তু মেজদার বরাবর নজর আমার কানের দিকেই। ওর ডাক্তারি কাঁচি দিয়ে কচাকচ করে কেটে নেবে।
হাবুল কিছুক্ষণ ভাবুকের মতো আমার কানের দিকে চেয়ে রইল। শেষে মাথা নেড়ে বললে, তা কাইট্যা নিলে তোরে নেহাত মন্দ দ্যাখাই না। তোর খাড়া খাড়া কান দুইখান
আমি বললুম, শাট আপ! বন্ধু-বিচ্ছেদ হয়ে যাবে হাবলা।
হাবুল ফের বললে, আইচ্ছা, মনে যদি কষ্ট পাস, তাইলে ওই সব কথা থাকুক। তোর আদরের কান দুইখ্যান লইয়া তুই ঘাস-ফাস চাবা। তা অখন কী করন যায়, তাই ক।
আমার ইচ্ছে করছিল হাবলাকে একটা চড় বসিয়ে দিই, কিন্তু ভেবে দেখলুম এখন গৃহযুদ্ধের সময় নয়। এই সব ঝামেলা মিটে যাক, তারপর হাবলার সঙ্গে একটা ফয়সালা করা যাবে।
রাগ-টাগ সামলে নিয়ে বললুম, তা হলে চল, ক্যাবলার কাছে যাই। তাকে গিয়ে বলি—যা হয়েছে বেশ হয়েছে। আর দরকার নেই, চন্দ্রকান্ত নাকেশ্বরের চাঁদবদন না দেখলেও আমাদের চলবে।
হাবুল বললে, হ। দ্যাখনের তো কত কী-ই আছে। ইচ্ছা হইলেই তো চিড়িয়াখানায় গিয়া আমরা জলহস্তীর বদনখান দেইখ্যা আসতে পারি। আর কম্বলরে দিয়াই বা আমাগো কী হইব? পোলা তো না—য্যান, একখানা চামচিকা। চক্ৰধরের অবকাশরঞ্জিনীর থিক্যাও খারাপ।
আমি সায় দিয়ে বললুম, বিক্রমসিংহের চাইতেও খারাপ। সে তো শুধু ছারপোকা, ও একটা কাঁকড়াবিছে।
এই সব ভালো ভালো আলোচনা করে আমরা ক্যাবলার কাছে গেলুম। কিন্তু তাকে বাড়িতে পাওয়া গেল না। তার মা—মানে মাসিমা ছানার মুড়কি তৈরি করছিলেন, আমাদের বসিয়ে তাই খেতে দিলেন। আমরা ক্যাবলার ওপর রাগ করে এত বেশি খেয়ে নিলুম যে ক্যাবলার জন্যে কিছু রইল বলে মনে হল না।
পেট ঠাণ্ডা হলে মন খুশি হয়, আমরা দুজনে বঙ্গ আমার জননী আমার গাইতে গাইতে যেই টেনিদার বাড়ির কাছে পৌঁছেছি, অমনি কোত্থেকে হাঁ হাঁ করে বেরিয়ে এল টেনিদা।
—বেলা দশটার সময় অমন গাঁক-গাঁক করে চ্যাঁচাচ্ছিস যে দুজনে? ব্যাপার কী? হাবুল বললে, আমারা সঙ্গীত-চর্চা করতে আছিলাম।
—সঙ্গীত-চর্চা? ওকে চচ্চড়ি বলে। তোদের গানের চোটে পাড়ায় আর কুকুর থাকবে মনে হচ্ছে। তা এত আনন্দ কেন? কী হয়েছে?
–আমরা ক্যাবলার বাড়িতে গিয়ে ছানার মুড়কি খেয়ে এসেছি। আমি জানালুম।
—অ, তাই এত ফুর্তি হয়েছে। তা আমাকে ডেকে নিলি না কেন? ক্যাবলাও এমন বিশ্বাসঘাতক?
–ক্যাবলাকে বাড়িতে পাইনি। আর তোমার কথা আমাদের মনে ছিল না।
—মনে ছিল না?-টেনিদা চটে গেল। মুখটাকে বেগুনভাজার মতো করে বলল, ভালো কাজের সময় মনে থাকবে কেন?—যা বেররা এখান থেকে, গেট আউট।
আমি বললুম, আউট আবার কোথায় হব? বেরুবার আর জায়গা কোথায়? আমরা তো রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে রয়েছি।
টেনিদার মুখটা এবারে ধোঁকার ডালনার মতো হয়ে গেল। আরও ব্যাজার হয়ে বললে, ইচ্ছে করছে, দুই চড়ে তোদের দাঁতগুলোকে দাঁতনে পাঠিয়ে দিই। তা হলে মর গে যা রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়ে কুকুর তাড়া গে।
হাবুল বললে, না, কুকুর তাড়ামু না। তোমার কাছে আসছি।
—আমাকে তাড়াতে চাস?
–বালাই, ষাইট। তোমারে তাড়াইব কেডা? তুমি হইলা আমাগো লিডার—যারে কয় ছত্রপতি। তোমার কাছে অ্যাঁকটা নিবেদন আছিল।
—ইস্, ছানার মুড়কি খেয়ে খুব যে ভালো-ভালো কথা মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে। টেনিদা একটা ভেংচি কাটল : তা, নিবেদন কী?
আমরা মহিষাদলে যামু না। মইষে গুঁতাইয়া মারব।
যাসনে। বাঘাটে গলায় টেনিদা বললে, লোকের বাড়ি বাড়ি চেয়ে-চিন্তে খেয়ে বেরা। কাপুরুষ কোথাকার। কাওয়ার্ডস মেনি ডেথ ডাইজ—ইয়েটাইম—মানে বিফোর—
আমি বললুম, উঁহু, ভুল হল। কাওয়ার্ডস ডাই মেনি ডেথস—
ছানার মুড়কির রাগ টেনিদা ভুলতে পারছিল না, চিৎকার করে বললে, শাটা! তোকে আর আমার ইংরিজী শুদ্ধ করতে হবে না—নিজে তো একত্রিশের ওপরে নম্বর পাস্ না! মরুক গে, কোথাও যেতে হবে না তোদের। আমি আর ক্যাবলা যাব, একটা দারুণ চক্রান্ত থেকে উদ্ধার করব কম্বলকে, বীরচক্র পুরস্কার পাব আর তোরা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকবি। কম্বলের কাকা যখন খ্যাঁট দেবে, তখন পোলাওয়ের গন্ধে দরজায় তোরা ঘুরঘুর করবি, ঢুকতে দেবে না, পিটিয়ে তাড়িয়ে দেবে।
এই বলে টেনিদা বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ল, তারপর ধড়াস করে বন্ধ করে দিল দোরটা।
তখন আমি আর হাবুল সেন এ ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলুম। আমি বললুম, বুঝলি হাবল, ব্যাপারটা রীতিমতো সঙ্গিন।
হাবুল বললে, হ। টেনিদা যারে পুঁদিচ্চেরি কয়, তাই। কীরকম য্যান মেফিস্টোফিলিস মেফিস্টোফিলিস মনে হইতাছে।
আমি বললুম, তা হলে তো যেতেই হয়, কী বলিস?
হইবই তো। বীরচক্র আমরাই বা পামু না ক্যান? আর কম্বলের কাকা যখন অগো মাংস-পোলাউ খাওয়াইব–
আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললুম, আর বলিসনি, মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। দেখিস, আমরাও খাব, নিশ্চয় খাব।
যা থাকে কপালে—পটলডাঙা জিন্দাবাদ! আমরা চারজন—সেই কথামতো-চক্রধরের দোকানের সামনে থেকে, বিন্দেবনের সঙ্গে, মহিষাদলে বেরিয়ে পড়েছি। বাড়িতে বলে এসেছি, রবিবারে এক বন্ধুর ওখানে নেমন্তন্ন খেতে যাচ্ছি, সন্ধেবেলায় ফিরে আসব।
আসবার আগে মেজদা বলে দিয়েছে, পরের বাড়িতে গিয়ে মওকা পেয়ে যা-তা খাসনে। ওই তোর পিলে-পটকা শরীর, শেষকালে একটা কেলেঙ্কেরি বাধাবি।
কী খাওয়া যে কপালে আছে—সে শুধু আমিই বুঝতে পারছি। কিন্তু বেঁচে থাকতে কাওয়ার্ড হওয়া যায় না—না হয় মোষের তোতেই প্রাণ দেব। আমি কেবল বললুম, আচ্ছা—আচ্ছা।
-আচ্ছা-আচ্ছা কী? যদি পেটের গোলমাল হয়, তা হলে তোকে ধরে আটটা ইজেকশন দেব—সে কথা খেয়াল থাকে যেন।
বাড়ির ছোট ছেলে হওয়ার সবচাইতে অসুবিধে এই যে, কোথাও কোনও সিমপ্যাথি পাওয়া যায় না। এমনি ভালোমানুষ ছোটদি পর্যন্ত খ্যাখ্যা করে হাসছিল। আমি চটে-মটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি। এই সব অপমান সহ্য করার চাইতে মৃত্যুও ভালো।
পাঁশকুড়া লোক্যালে চেপে আমরা রওনা হয়েছি হাওড়া থেকে। বিন্দেবন বললে, আমাদের নামতে হবে মেচেদায়, সেখান থেকে বাসে করে তমলুক হয়ে মহিষাদল। শুনে যতদূর মনে হচ্ছে তা নয়—যেতে বেশি সময় লাগবে না।
কিন্তু মেচেদা নাম শুনেই আমার কী-একটা ভীষণভাবে মনে পড়ছিল। একবার মামার সঙ্গে মেদিনীপুরে যাওয়ার সময়—এই মেচেদাতে—ঠিক ঠিক!
আমি বলে ফেললুম, খুব ভালো সিঙাড়া পাওয়া যায় কিন্তু!
টেনিদার চোখ চকচক করে উঠল। কিন্তু বিন্দেবনের সামনে প্রেস্টিজ রাখবার জন্যেই বোধহয়, দাঁত খিঁচিয়ে আমাকে ধমক দিলে একটা : এটা একটা রাক্ষস। রাতদিন কেবল খাই-খাই।
বিন্দেবনকে যতটা খারাপ লোক ভেবেছিলুম, দেখলুম সে তা নয়। মিটমিট করে বললে, তা ছেলেমানুষ, খিদে তো পেতেই পারে। খাওয়াব খোকাবাবু—মেচেদার সিঙাড়া খাওয়াব, কিচ্ছুটি ভাবতে হবে না! তারপর কলেজের ছেলে হয়েও তোমরা যখন আমাদের দলে এয়েছ, তখন তো মাথার মণি করে রাখব তোমাদের।
দলে এয়েচ! এই কথাটাই আমার কেমন ভালো লাগল না। মনে পড়ল মা নেংটীশ্বরীর সেই মূর্তি—যেন দাঁত বের করে কামড়াতে আসছে। মনে পড়ল, হঠাৎ সেই ম্যাও-ম্যাও এসে হাজির—চারিদিকে কী রকম সামাল-সামাল রব। এদের পাল্লায় পড়ে কোথায় চলেছি আমরা? কী আছে আমাদের কপালে?
টেনিদার দিকে চেয়ে দেখলুম। হাঁড়ির মতো মুখ করে বসে রয়েছে। বীরচক্র পাবার জন্যে তখন খুব লাফালাফি করছিল বটে, কিন্তু এখন যেন কেমন ভেবড়ে গেছে বলে মনে হল। হাবুলকে বোধহয় গাড়ির বেঞ্চিতে ছারপোকায় কামড়াচ্ছিল—সেই বিক্রমসিংহই কি না কে জানে—সে কিছুক্ষণ পা-টা চুলকে হঠাৎ বিচ্ছিরি গলায় গান ধরল :
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি-সকল দেশের রানী–ইয়ে একবার খুব জোরে গা চুলকে প্রায় দাপিয়ে উঠল : ইস্ কী কামড়াইতেছে রে! সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি–
তার গান আর গা চুলকোনোতে প্রায় খেপে গেল টেনিদা। চেঁচিয়ে বললে, জন্মভূমি না তোর মুণ্ডু! চুপ কর বলছি হাবলা, নইলে জানালা গলিয়ে বাইরে ফেলে দেব তোকে।
বিন্দেবন বললে, আহা দাদাবাবু তো ভালোই গাইছেন! থামিয়ে দিচ্ছেন কেন?
তা হলে হাবুলের গানও কারও ভালো লাগে! হাবুল এত আশ্চর্য হল যে, গা চুলকোতে পর্যন্ত ভুলে গেল। ক্যাবলা একটা ওয়াইড ওয়ার্লর্ড ম্যাগাজিন পড়ছিল, সেটা খসে পড়ল তার হাত থেকে। টেনিদা বললে, কী ভয়ানক!
বিন্দেবন জানলার বাহিরে মুখ বাড়িয়ে বললে, এই যে, কোলাঘাট এসে গিয়েছে। এর পরেই আমরা পৌঁছে যাব মেচেদায়।