পরদিন সকালেই কাকাবাবু মিংমাকে ডেকে বললেন, তাঁবু গোটাও। আমরা এবার সামনের দিকে এগোব।
মিংমা যেন আনন্দে একেবারে নেচে উঠল।
সে বলল, এভারেস্টে যাব, সাব? চলিয়ে সাব, আমি আপনাকে কন্ধে পর উঠাকে নিয়ে যাব।
কাকাবাবু বললেন, তার দরকার হবে না। আমি নিজেই যেতে পারব। আমাদের এক নম্বর ক্যাম্প হবে কালাপাথরে।
মিংমা ছুটে বেরিয়ে গেল অন্যদের খবর দিতে।
কাকাবাবু প্যাকিং বাক্স খুলে বার করলেন একটা ওয়্যারলেস সেট। এটাও তিনি এবার বিদেশ থেকে এনেছেন। বিদ্যুৎ ছাড়াই এটা ব্যাটারিতে চলে।
যন্ত্রটাকে চালু করতেই সেটের মধ্যে কর-র-র কট কট শব্দ শুরু হল। কাকাবাবু বললেন, সন্তু, তুই একটু বাইরে যা।
সন্তু গম্বুজের বাইরে চলে এল। কিন্তু মনে মনে খুব কৌতূহল রয়ে গেল তার। এই যন্ত্রটা কাকাবাবুকে আনতে সে দেখেছে, কিন্তু এর আগে কাকাবাবু ওটা একবারও ব্যবহার করেননি। কাকাবাবুকার সঙ্গে কথা বলছেন, আর এমন কী গোপন কথা, যা সন্তুর সামনে বলা যায় না?
বাইরে এসে সন্তু দেখল, শেরপা আর মালবাহকরা এরই মধ্যে খটখটি শব্দে তাঁবুর দড়িবাঁধা খুঁটি তুলতে শুরু করেছে। সন্তুও ওদের সঙ্গে হাত লাগাল।
খানিকবাদে কাকাবাবু বেরিয়ে এসে বললেন, যা সন্তু, এবার তোর জিনিসপত্র গুছিয়ে নে।
মিংমা বলল, ইধার সে খানা খা কে জায়গা? তাতেই সুবিধা হোবে।
কাকাবাবু বললেন, না, আকাশ পরিষ্কার আছে, তাড়াতাড়ি রওনা হলে দুপুরের মধ্যে কালাপাথর পৌঁছে যাব। সেখানে খানা পাকানো হবে।
মিংমা এক গেলাস ধোঁয়া ওঠা চা কাকাবাবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, কম সে কম এক গিলাস তো চ খেয়ে লিন।
সন্তু গম্বুজের দিকে যাচ্ছিল, মিংমা তাকেও ডেকে বলল, আরো সন্তু সাব, তুমি ভি থোড়া চায়ে পি লেও।
এখানে ঠাণ্ডার মধ্যে যতবার চা খাওয়া যায় ততবারই ভাল লাগে। গরম গেলাসটা দু হাত দিয়ে চেপে ধরলে আরাম লাগে খুব।
চা খেতে খেতে মিংমা জিজ্ঞেস করল, আংকেল সাব, কালাপাখরমে তো আজই পৰ্ছছে যাব। সিখানে ফিন কি রোজ থাকব আমরা-
কাকাবাবু মুচকি হেসে বললেন, সেখানে থাকব কেন? রাতটা কালাপাথরে ঘুমিয়ে আবার এগিয়ে যাব সামনের দিকে। এভারেস্টে যেতে হবে না?
মিংমা অবাকভাবে ভুরু তুলে বলল, তব ইধারমে ইতনা রোজ কাঁহে ঠােরা? সাতদিন স্রিফ চুপচাপ বৈঠে বৈঠে.
কাকাবাবু বললেন, এখানে থাকার দরকার ছিল। এত ঠাণ্ডার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে, তাই শরীরটাকে সইয়ে নেওয়া হল।—আচ্ছ বলে তো, মিংমা, কালাপাথর থেকে এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছতে কত দিন সময় লাগবে?
মিংমা বলল, আকাশের দেওতা যদি কৃপা করেন তো সাত রোজ, আট রোজের মধ্যেই পহুছে যাব।
সন্তু বলে উঠল, মোটে সাত আট দিন লাগবে?
মিংমা বলল, হাঁ সাব, উস। সে জাদ দিন নেহি লাগে গা। সাউথ কল সে উঠ জায়েগা-তুম রহেগা। হামারা সাথ।
কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে। তা হলে তো আমাদের সঙ্গে খাবার-দাবার যথেষ্টই আছে।
মিংমা। এর পর বিড় বিড় করে আপন মনেই যেন বলল, আভি তাক ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। আমরা কি সত্যিই এভারেস্টে উঠতে যাচ্ছি?
কাকাবাবু বেশ গলা চড়িয়ে বললেন, বিশ্বাস হচ্ছে না। মানে? আমি কি তোমাদের মিথ্যে কথা বলে এনেছি? আমরা নিশ্চয়ই এভারেস্টে উঠব। চুড়ায় উঠতে পারলে এ দলের সবাই অনেক টাকা পুরস্কার পাবে। ইন্ডিয়া গভর্নমেন্ট, নেপাল গভর্নমেন্ট দুই গভর্নমেন্টই পুরস্কার দেবে। দলের প্রত্যেককে।
মিংমা চট করে কাকাবাবুর খোঁড়া পা-টার দিকে একবার তাকাল।
কাকাবাবু বললেন, কী রে সন্তু, জিনিসপত্র গুছোতে গেলি না?
সন্তু তাড়াতাড়ি চলে গেল গম্বুজের দিকে।
ভেতরে ঢুকে সে প্রথমে খুব চমকে গেল, ঘরের মাঝখানে একজন লোক উবু হয়ে বসে আছে।
তারপর দেখল, সেই লোকটি হচ্ছে দ্বিতীয় শেরপা নোরবু।
নোরবুর পক্ষে এই গম্বুজের মধ্যে ঢোকা আশ্চর্য কিছু না। কাকাবাবুর জিনিসপত্র বার করতে হবে। কিন্তু নোরবু কোনও জিনিসপত্র বার করার বদলে কাচের বাক্সটার দিকে একদৃষ্টি চেয়ে বসে আছে স্থির হয়ে।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, কী নোরবু ভাই?
নোরবু যেন চমকে গেল খানিকটা, তারপর সেই অবস্থায় বসে থেকেই মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করল, সন্তু সাব, ইয়ে কেয়া হ্যায়।
সন্তু বলল, ইয়ে দাঁত হায়। একঠো দাঁত।
নোরবু বলল, কিসকা দাঁত?
সন্তু বলে ফেলতে যাচ্ছিল যে, ইয়েতির দাঁত ওটা। কিন্তু সামলে নিল, এরা সবাই ইয়েতির নামেই ভয় পায়। মিংমা বলেছিল, ইয়েতির কথা শুনলেই মালবাহকেরা ভয় পেয়ে পালিয়ে যাবে। কাকাবাবুও এই কাচের বাক্সটা ওদের সামনে কক্ষনো বার করেন না।
সে বলল, মালুম নেহি।
নোরবু তবুও জিজ্ঞেস করল, মানুষ কা দাঁত ইতনা বড়া নেহি হোতা হ্যায়। কিসিকা দাঁত হ্যায় এঠো?
নোরবু অন্য সময় প্রায় কথাই বলে না। খুব গভীর। তাকে এত কথা বলতে দেখে সন্তু বেশ অবাক হল।
নোরবু বাক্সটা খুলে দাঁতটা বার করতে গেল। সন্তু আমনি হাঁ-হাঁ করে উঠে বলল, আরে আরে, খুলো না, খুলো না।
নোরবু বেশ রুক্ষভাবে বলল, কাঁহে?
সন্তু বলল, কাকাবাবু বারণ করেছেন। ওটায় কারুর হাত দেওয়া নিষেধ।
নোর বুবলল, হাম চিজ তো দেখে গা।
সন্তু এবার ধমক দিয়ে বলল, বারণ করছি না, ওটায় হাত দিলে কাকাবাবু রাগ করবেন। নোরবু ভাই, তুমি এই প্যাকিং বাক্সটা বাইরে নিয়ে যাও বরং। নোরবু সে কথায় কান না দিয়ে কাচের বাক্সটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। নোরকুর এরকম ব্যবহার দেখে হঠাৎ খুব রাগ হয়ে গেল সন্তুর। সে এক্ষুনি গম্বুজের বাইরে গিয়ে কাকাবাবুকে ডেকে আনতে পারে। কাকাবাবু তাকে সব সময় এই বাক্সটা চোখে চোখে রাখতে বলেছেন।
কিন্তু সে কাকাবাবুকে ডাকল না, নোরবুর সামনে দাঁড়িয়ে চোখ রাঙিয়ে বলল, কী হচ্ছে কী? এই বাক্সটায় হাত দিতে বারণ করছি না?
নোরবু যেন কেমন হয়ে গেছে। চোখ দুটো ঘোলাটে মতন। সে সন্তুকে এক ধাক্কায় ঠেলে সরিয়ে দিয়ে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। সন্তু ছিটকে পড়ে আছিল, সেই অবস্থাতেই সে তারাটের পাঁচ নোপুর চোয়ালে কাল এক লাথি।
সন্তুর চেয়ে নোরবু অনেক বেশি জোয়ান, তবু সেই আঘাতেই সে দড়াম করে পড়ে গেল মাটিতে।
অমনি সন্তুর মুখ থেকে বেরিয়ে গেল এই রে।
সন্তু ভয় পেয়ে গেছে। নোরবুর হাত থেকে ছিটকে কাচের বাক্সটাও পড়ে গেছে মাটিতে। নিশ্চয়ই ভেঙে চুরমার।
কিন্তু বাক্সটা ভাঙেনি। মাটিতে পড়ে সেটা সামান্য একটু লাফিয়ে উঠল। সেটা আসলে কাচের নয়! খুব সূক্ষ্ম প্লাস্টিকের মতন জিনিসে তৈরি, ঠিক কাচের মতন দেখায়।
মাটিতে পড়ে নোরবু একেবারে হতভম্ব। সন্তুর মতন একটা বাচ্চা ছেলে প্যাঁচ কষিয়ে তাকে ফেলে দিল! সে আবার উঠে ঝাঁপিয়ে পড়ল সন্তুর ওপর, সন্তু ঠিক সময় সরে গেল তার তলা থেকে। নোরবু আবার মাটিতে আছড়ে পড়ল। গায়ে জোর থাকলেও নোরবুলড়াইয়ের কোনও নিয়ম জানে না।
নোরবু আবার উঠে দাঁড়াবার আগেই কাকাবাবু ঢুকলেন ভেতরে। নোরবুকে পড়ে থাকতে দেখে তিনি বললেন, কী হল?
নোরবু কোনও উত্তর দিল না।
সন্তু দ্রুত চিন্তা করতে লাগল। নোরবু যে হঠাৎ এরকম অদ্ভুত ব্যবহার করতে শুরু করেছে, সে কথা শুনলে কাকাবাবু নিশ্চয়ই খুব রেগে যাবেন। ওকে কোনও কঠিন শাস্তিও দিতে পারেন। এমনকী নোরবুকে হয়তো আর অভিযানে সঙ্গে নেবেনই না।
সন্তু বলল, কিছু হয়নি। ও এমনি পা পিছলে পড়ে গেছে।
কাকাবাবু সন্তুকে জিজ্ঞেস করলেন, কাচের বাক্সটা নিয়ে কী করছিস?
এটা আমি সঙ্গে নিয়ে যাব।
না, ওটা আমার কাছে থাকবে। নোরবু, তুমি লোকজনকে ডেকে এ ঘরের মালপত্র বার করার ব্যবস্থা করে।
নোরবু কোনও কথা না বলে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল।