বিরাট রন্ধনগৃহে ভীমের শয়ন।
নিদ্রা যায় বৃকোদর হয়ে অচেতন।।
সঙ্কেতে বলেন দেবী চাপি দুই পায়।
উঠ উঠ, কত নিদ্রা যাও মৃতপ্রায়।।
হীনজন সাধ্যমত আপন ভার্য্যারে।
প্রাণপণে করি রক্ষা সঙ্কটেতে তারে।।
সভামধ্যে যত মম অপমান কৈল।
সিংহের রমণী লৈতে শৃগাল ইচ্ছিল।।
চরণ চাপিতে ভীম হন জাগরিত।
দ্রৌপদী কাতর দেখি উঠেন ত্বরিত।।
কহ ভদ্রে, এত রাত্রে কেন আগমন।
দুঃখিতের প্রায় দেখি মলিন বদন।।
যে কথা কহিতে আছে, শীঘ্র কহ মোরে।
কেহ পাছে দেখে শুনে, যাহ নিজ ঘরে।।
ভীমবাক্য শুনি আরো বৃদ্ধি পায় দুঃখ।
নয়নে সলিল পড়ে, কৃষ্ণা অধোমুখ।।
ভীম বলে, কহ প্রিয়ে কি হেতু শোচন।
কি দুঃখ তোমার কহ করিব মোচন।।
এত শুনি সকরুণে বলেন পার্ষতী।
কি দুঃখ শোচন, যার যুধিষ্ঠির পতি।।
জানিয়া শুনিয়া কেন জিজ্ঞাসিছ মোরে।
আপনার দুঃখ কিবা বলিব তোমারে।।
হস্তিনায় দুঃশাসন যতেক করিল।
কুরুসভা মধ্যে সবে বসিয়া দেখিল।।
একবস্ত্রা পরিধানা আমি রজঃস্বলা।
কেশে ধরি আনিবেক করিয়া বিহুলা।।
তদন্তরে অরণ্যেতে দুষ্ট জয়দ্রথ।
বলে ধরি লয়ে গেল পাপিষ্ঠ উন্মত্ত।।
দ্বাদশ বৎসর বনে দুঃখে বঞ্চি শেষে।
মৎস্যদেশে সুদেষ্ণার দাসী হৈনু এসে।।
গোরোচনা চন্দনাদি ঘষি নিরন্তর।
দেখ দেখ কলঙ্কিত হৈল দুই কর।।
সে সব দুঃখের কথা নাহি করি মনে।
তোমা সবা দুঃখ দেখি ভুলি ক্ষণে ক্ষণে।।
বিনা অপরাধে মোরে কীচক দুর্ম্মতি।
সবার সাক্ষাতে মোরে মারিলেক লাথি।।
এ ছার জীবনে মোর নাহি প্রয়োজন।
এত লঘু হয়ে জীব কিসের কারণ।।
রাজকন্যা হয়ে মোর সমান দুঃখিনী।
স্বামীর জীয়ন্তে কেহ, না দেখি, না শুনি।।
আজি যদি কীচকেরে তুমি না মারিবে।
নিশ্চয় আমার বধ তোমারে লাগিবে।।
গরল খাইব কিংবা প্রবেশিয়া জলে।
প্রভাতে মরিব আমি কীচকে দেখিলে।।
নিত্য আসে দুরাচার আমার নিলয়।
মোর ভার্য্যা হও বলি অনুক্ষণ কয়।।
সৈরন্ধ্রী বলিয়া মোরে করে উপহাস।
ধিক্ মোর ছার প্রাণে, আর কিবা আশ।।
হস্ত-সুখে নরপতি দেবন খেলিল।
যাঁহার কর্ম্মেতে এত দুঃখ উপজিল।।
এমন করেছে কোন্ রাজা কোন্ দেশে।
সবান্ধবে রাজ্য ত্যজি অরণ্যে প্রবেশে।।
কোটি কোটি গজ বাজী গবী গৃহবাস।
সব ত্যজি এবে হৈল বিরাটের দাস।।
মূঢ় লোক থাকে যথা কর্ম্ম ধ্যান করি।
সেইমত বসি আছ, নিল সব অরি।।
নিরবধি সেবে দশ সহস্র সুন্দরী।
অতিথি সেবনে দশ সহস্রক নারী।।
যত অন্ধ, যত খঞ্জ আশ্রমেতে থাকে।
লক্ষ রাজা দাণ্ডাইয়া থাকয়ে সম্মুখে।।
দুষ্ট দ্যূতে হরিলেক এতেক সম্পদ।
আজ বিরাটের দাস পেয়ে কঙ্কপদ।।
অতুল গাণ্ডীবধারী বীর ধনঞ্জয়।
এক রথে করিলেক ত্রৈলোক্য বিজয়।।
ইন্দ্র জিনি করিলেক ঐলোক্য বিজয়।
দৈত্যে মারি নিষ্কন্টক কৈল দেবগণ।।
বজ্রঘাত ডাকে যার ধনুর নির্ঘোষে।
কন্যাগণ মধ্যে থাকে নপুংসক বেশে।।
মাথায় কিরীট যার সূর্য্যপ্রভা জিনি।
সে মস্তকে হের আজি লম্ববান বেণী।।
দ্রুপদের কন্যা, ধৃষ্টদুন্নের ভগিনী।
পঞ্চ স্বামী ভজি তবে হৈনু অনাথিনী।।
বজ্রের অধিক মোর কঠিন শরীর।
তেঁই এত কষ্টে প্রাণ না হয় বাহির।।
এত বলি কান্দে দেবী মুখে দিয়া কর।
নেত্রনীরে তিতিল কৃষ্ণার কলেবর।।
কৃষ্ণার ক্রন্দন দেখি কান্দে বৃকোদর।
করপদ কাঁপে ঘন, কাঁপে ওষ্ঠাধর।।
ধিক্ মোর বাহুবল, ধিক্ ধনঞ্জয়।
তোমার এতেক কষ্ট দেখি প্রাণ রয়।।
আমারে কি বল কৃষ্ণা, আমি কি করিব।
আত্মবশ হৈলে কেন এত দুঃখ পাব।।
যেখানে তোমারে দুষ্ট মারিলেক লাথি।
সেইখানে পাঠাতাম যমের বসতি।।
সভাসহ মারিতাম নৃপতি সহিতে।
কাহারে না রাখিতাম অন্যেরে কহিতে।।
বিদিত হইলে পুনঃ যাইতাম বন।
এত অপমান অঙ্গে হয় কি সহন।।
কটাক্ষে চাহিয়া মোরে রাজা মানা কৈল।
সে কারণে দুরাচার কীচক বাঁচিল।।
যুধিষ্ঠির বাখ্য আমি লঙ্ঘিতে না পারি।
নহিলে এ গতি কেন হইবে সুন্দরী।।
ইন্দ্রের অধিক সুখ শত্রুগণে দিয়ে।
এত দুঃখ হৈল শুধু তাঁর বাক্যে রয়ে।।
সভামধ্যে করিলেক যত দুঃশাসন।
মৃত্যু ইচ্ছা হয় তাহা করিলে স্মরণ।।
সে সকল অপমান বসি দেখিলাম।
যুধিষ্ঠির আজ্ঞা লাগি সব সহিলাম।।
ক্রন্দন সম্বর দেবি, দুঃখ হৈল ক্লেশ।
কহিলে যে, মোর সম দেখি ধরণী।।
তোমা হৈতে দুঃখ পাইয়াছে বহুতর।
কহিব সে সব কথা, অবধান কর।।
ছিলেন বৈদেহী সীতা জনক দুহিতা।
লক্ষ্মী অবতার হন রামের বনিতা।।
চৌদ্দ বর্ষ হেতু বনে গমন করিল।
ফল মূলাহার করি কষ্টেতে বঞ্চিল।।
অরণ্যে হরিয়া লয় দুষ্ট দশানন।
বহু কষ্ট দিল তথা রাক্ষস দুর্জ্জন।।
অনাহারে ক্ষীণ তনু অস্থি-চর্ম্ম-সার।
নিত্য নিশাচরীগণ করিত প্রহার।।
এত কষ্ট সহিলেন জনক কুমারী।
সীতা উদ্ধারিলা রাম রাবণেরে মারি।।
অগস্ত্যের ভার্য্যা, রূপে গুণে অনুপাম।
রাজার কুমারী হয়, লোপামুদ্রা নাম।।
তাঁহার যতেক কষ্ট, কহনে না যায়।
বল্মীক-মৃত্তিকা সব বেড়িলেক গায়।।
বহুকাল সেইরূপে কষ্টেতে রহিল।
এত কষ্ট সহি পুনঃ অগস্ত্যে পাইল।।
ভীমপুত্রী দময়ন্তী নলের গৃহিনী।
তাঁহার ঘতেক কষ্ট অদ্ভুত কাহিনী।।
মহাঘোর বনমাঝে ছাড়ি গেল পতি।
ক্রমে ক্রমে গেল পুনঃ বাপের বসতি।।
বহু কষ্ট সহি পুনঃ স্বামীরে পাইল।
কতেক কহিব দুঃখ, যতেক সহিল।।
তুমিও সেমত দুঃখ পাইলে অপার।
ক্ষমা কর অল্প দিন দুঃখ আছে আর।।
তের বর্ষ পূর্ণ হৈতে বিংশতি রজনী।
পুনরপি নিজদেশে হবে ঠাকুরাণী।।
মহাভারতের কথা অমৃত-লহরী।
কাশীরাম দাস কহে, শুন কর্ণ ভরি।।