এইরূপে অন্ধেরে কহেন মুনিবর।
মায়ের নিকটে যান পঞ্চ সহোদর।।
গান্ধারীরে প্রণাম করেন পঞ্চজনে।
আর্শীর্ব্বাদ কৈল দেবী প্রসন্ন বদনে।।
কুন্তীরে প্রণাম কৈল পঞ্চ সহোদর।
বসেন কুন্তীর কোলে মাদ্রীর কোঙর।।
পুত্র কোলে করি কুন্তী করিল চুম্বন।
প্রণাম করিল আসি যত বধুগণ।।
এইমতে সর্ববজনে পূরিল কানন।
হেনকালে কহিলেন মুনি দ্বেপায়ন।।
দ্বারকা নগরে আমি যাব শীঘ্রগতি।
বরে কার্য্য থাকে যদি মাগ নরপতি।।
বর মাগ থাকে যদি কিছু প্রয়োজন।
অবশ্য যাইব আমি দ্বারকা ভুবন।।
গান্ধারী সুবলসুতা শুনি হেন কথা।
করযোড় করি বলে সতী পতিব্রতা।।
কৃপার সাগর তুমি মুনি মহাশয়।
তোমার মহিমা যত মুনিগনে কয়।।
তোমার অসাধ্য দেব নাহি ত্রিজগতে।
সে কারণে একবর মাগিযে তোমাতে।।
পুত্রশোক সম আর নাহি ত্রিভুবনে।
শত পুত্র আমার সংহার হৈল রণে।।
সেই শোকে দহে ম সকল শরীর।
তিলেক না হয় ক্ষান্ত নয়নের নীর।।
শোকের সাগরে ভাসি নাহিকউপায়।
সে কারণে মুনিরাজ নিবেদি তোমায়।।
একবার তাদের পাইলে দরশন।
শোকসিন্ধু হৈতে তবে হইব মোচন।।
প্রসবিয়া আমি না দেখিনু পুত্রমুখ।
এই মম হৃদয়ে আছয়ে বড় দুঃখ।।
এই বর মাগি দেব তব পদতলে।
কৃপায় দেখাও মোরে তনয় সকলে।।
অন্ধরাজ বলিলেন এই মনোনীত।
কৃপা কর মুনিরাজ কহিনু নিশ্চিত।।
আমার মনের দুঃখ মনেতে রয়েছে।
কাহারে কহিব সদা হৃদয় দহিছে।।
তুমি সর্ব্ব সারাৎসার কৃপার সাগর।
তুমি যে অকুল কর্ত্তা মহিমা অপার।।
ক্ষণেক যোগের বলে এই চরাচর।
পুনর্ব্বার করিবারে পার মুনিবর।।
সকল করিতে পার তুমি মহাঋষি।
কহিতে সকল কথা আঁখি নীরে ভাসি।।
বলিব বলিব বলি করিতেছি মনে।
শোকেতে দহিছে অঙ্গ না চাহি নয়নে।।
পান্ডবের গতি তুমি পান্ডবের পতি।
তোমা হৈতে পান্ডুকুল হইল সংহতি।।
কুলক্ষয় হৈল দেব মল সব বীর।
স্মরিতে হৃদয় দহে ঝরে আঁখি নীর।।
কেন বিধি হেন জন্ম দিয়াছিল মোরে।
আঁখির পুত্তলী সব গেল কোথাকারে।।
সতত নয়ন মোর সেই মুখ চায়।
দারুণ অন্তর দহে কি কহিব হায়।।
বিধি বিড়ম্বিল আমা কারে দিব দোষ।
শুনিয়া তোমার বাণী হইনু সন্তোষ।।
কুন্তীদেবী কহিছেন যুড়ি দুই কর।
মম মনস্কাম সিদ্ধ কর মুনিবর।।
কর্ণপুত্র নয়নে দেখিব একবার।
অতিমন্যু ঘটোৎকচ পঞ্চপুত্র আর।।
কৃপা করি দেখাও যদ্যপি মহাশয়।
হৃদয়ের শেল মম তবে দূর হয়।।
অনন্তর পাঞ্চালী পাঞ্চাল-রাজসুতা।
প্রণাম করিয়া কহে মনোদুঃখযুতা।
কিবা কব মুনিরাজ তোমার চরণে।
সদা মম দগ্ধচিত্ত শোকের আগুনে।।
দীনবন্ধু ভগবান যিনি অন্তর্য্যামী।
তিনি তো সকল জ্ঞাত কি কহিব আমি।।
এমন অভাগী আমি জন্মেছিনু ভবে।
কান্দিয়া যে জন্ম গেল মৃত্যু হবে কবে।।
শ্বশুরকুলের অন্ত আমা হতে হৈল।
আমি যে মহাপাতকী নাহি সমতুল।।
মোর সম ভাগ্যহীনা নাহি তিন লোকে।
পিতৃকুলক্ষয় হেতু সৃজিল আমাকে।।
ধৃষ্টদ্যুম শিখণ্ডী প্রভৃতি ভ্রাতৃগণ।
সবংশে মরিল পিতা পাঞ্চাল রাজন।।
মোর পঞ্চ পুত্র ম’ল দৈবের বিপাকে।
শোকসিন্ধু মধ্যে বিধি ডুবাইল মোকে।।
যদি পুণঃ তা সবারে করি দরশন।
এ শোক-সাগর তবে হইবে মোচন।।
কান্দিয়া সুভদ্রা কহে যুড়ি দুই কর।
নিবেদন অবধান কর মুনিবর।।
আমা হেন হতভাগ্য নাহি ত্রিভুবনে।
অভিমন্যু হেন পুত্র হত হৈল রণে।।
দ্বিতীয় কুমুদবন্ধু রূপের বর্ণনা।
ধনুর্দ্ধর মধ্যে কেহ নাহিক তুলনা।।
জনক অর্জ্জুন যার মাতুল মুরারী।
জ্যেষ্ঠতাত ভীমসেন ধর্ম্ম অধিকারী।।
সবা বিদ্যমানে পুত্র হইল সংহার।
আমা সম অভাগিনী কেবা আছে আর।।
মৎস্যদেশে এল পুত্র বিবাহ কারণ।
পুনঃ আমা সহিত না হৈল দরশন।।
সকলি নিরাশ বিধি করিল আমারে।
কেমনে ধরিব প্রাণ এ পাপ শরীরে।।
কৃপার সাগর মুনি কর প্রতীকার।
অভিমন্যু আমারে দেখাও একবার।।
ধৃতরাষ্ট্র বধূগণ দুঃশলা সুন্দরী।
প্রনমিয়া কহে কথা মুনি বরাবরি।।
কম্পিতবদনী রামা পরিহরি লাজ।
করযোড়ে কহে অবধান মুনিরাজ।।
আমাদের পরিতাপ কর বিমোচন।
স্বামী পুত্র সহিত করাও দরশন।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন শুন মহাশয়।
কৃপায় খন্ডাও মম মনের বিস্ময়।।
ইষ্ট বন্ধু বান্ধব কুটুম্ব মিত্রগণ।
ভারত যুদ্ধেতে হত হৈল যত জন।।
যদি পুনঃ তা সবারে দেখিব নয়নে।
শোকসিন্ধু হৈতে পার হইব আপনে।।
ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ শল্য রাজা দুর্য্যোধন।
বিরাট দ্রুপদ আদি যত বন্ধুগন।।
সবার সহিত দেখা করাও আমার।
তোমা বিনা এ কর্ম্ম করিতে শক্তিকার।।
পূর্ব্বে পিতামহ মুখে শুনিয়াছি আমি।
বেদশাস্ত্র প্রকাশিতে নারায়ণ তুমি।।
এত বলি নিবর্ত্তিল ধর্ম্মের নন্দন।
নিজ নিজ কামনা কহিল সর্ব্বজন।।
ক্ষণেক চিন্তিয়া তবে ব্যাস তপোধন।
আশ্বাসিয়া সবাকারে বলেন বচন।।
যে বাসনা করিলে আমার কাছে সবে।
আজি নিশাযোগে এ বাসনা পূর্ন হবে।।
হৃষ্টচিত্ত হৈল সবে মুনির বচনে।
নিশ্চয় হইবে দেখা করিলেন মনে।।
কতক্ষণে দিন যাবে হইবে রজনী।
অস্তগত হৈল অনুমানি দিনমনি।।
হেনমতে দিন গেল রজনী প্রবেশে।
কুতূহল সর্ব্বজন হরিষ বিশেষে।।
করযোড়ে স্তব করে মুনির গোচর।
মনের বাসনা পূর্ণ কর মুনিবর।।
তবে সত্যবতী সুত ব্যাস মহামুনি।
অদ্ভূত যাঁহার কর্ম্ম কি দিব নিছনি।।
উর্দ্ধদৃষ্টি করি ডাকি কহে মুনিরাজ।
দুই হস্ত তুলি ডাকে যতেক সমাজ।।
ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ বলি ডাকে মুনিবর।
দুর্য্যোধন শল্য আদি যত ধনুর্দ্বর।।
সত্বরে আইস সবে আমার বচনে।
বিলম্ব না কর এস আমার এখানে।।
ধ্যান করি মুনিবর ডাকে ঘনে ঘন।
কার শক্তি লঙ্ঘিবেক ব্যাসের বচন।।
ইন্দ্রপুরে নিবাস করয়ে যত বীর।
দেব সঙ্গে বৈসে সবে দেবতা শরীর।।
ব্যাসমুনি স্থানে সবে জানিয়া কারণ।
সত্বরে মুনির অগ্রে চলে সর্ব্বজন।।
কৌরব পান্ডব যত ছিল বীরগণ।
ব্যাস মুনি অগ্রেতে চলিল সর্ব্বজন।।
মহাভারতের কথা সুধাসিন্ধুবত।
পাঁচালী প্রবন্ধে কাশীদাস বিরচিত।।