সকল দেশেই কাপড়ে চোপড়ে কিছু না কিছু ভদ্রতা লেগে থাকে। ‘ব্যাতন না জানলে বোদ্র অবোদ্র বুঝবো ক্যামনে?’ শুধু ব্যাতনে নয়, ‘কাপড় না দেখলে ভদ্র অভদ্র বুঝবো ক্যামনে’ সর্বদেশে কিছু না কিছু চলন। আমাদের দেশে শুধু গায়ে ভদ্রলোক রাস্তায় বেরুতে পারে না, ভারতের অন্যান্য প্রদেশে আবার পাগড়ি মাথায় না দিয়ে কেউই রাস্তায় বেরোয় না। পাশ্চাত্য দেশে ফরাসীরা বরাবর সকল বিষয়ে অগ্রণী—তাদের খাওয়া, তাদের পোষাক সকলে নকল করে। এখনও ইওরোপের ভিন্ন ভিন্ন দেশে বিশেষ বিশেষ পোষাক বিদ্যমান; কিন্তু ভদ্র হলেই, দুপয়সা হলেই অমনি সে পোষাক অন্তর্ধান হন, আর ফরাসী পোষাকের আবির্ভাব। কাবুলী পাজামা-পরা ওলন্দাজী চাষা, ঘাগরা-পরা গ্রীক, তিব্বতী-পোষাক-পরা রুশ যেমন ‘বোদ্র’ হয়, অমনি ফরাসী কোট প্যাণ্টালুনে আবৃত হয়। মেয়েদের তো কথাই নেই, তাদের পয়সা হয়েছে কি, পারি রাজধানীর পোষাক পরতে হবেই হবে। আমেরিকা, ইংলণ্ড, ফ্রান্স ও জার্মানী এখন ধনী জাত; ও-সব দেশে সকলেরই একরকম পোষাক—সেই ফরাসী নকল। তবে আজকাল পারি অপেক্ষা লণ্ডনে পুরুষদের পোষাক ভব্যতর, তাই পুরুষদের পোষাক ‘লণ্ডন মেড’ আর মেয়েদের পারিসিয়েন নকল। যাদের বেশী পয়সা, তারা ঐ দুই স্থান হতে তৈয়ারী পোষাক বারমাস ব্যবহার করে। আমেরিকা বিদেশী আমদানী পোষাকের উপর ভয়ানক মাসুল বসায়, সে মাসুল দিয়েও পারি-লণ্ডনের পোষাক পরতে হবে। এ কাজ একা আমেরিকানরা পারে—আমেরিকা এখন কুবেরের প্রধান আড্ডা!
প্রাচীন আর্যজাতিরা ধুতি-চাদর পরত; ক্ষত্রিয়দের ইজার ও লম্বা জামা—লড়ায়ের সময়। অন্য সময় সকলেরই ধুতি-চাদর। কিন্তু পাগড়িটা ছিল। অতি প্রাচীনকালে ভারতবর্ষে মেয়ে-মদ্দে পাগড়ি পড়ত। এখন যেমন বাঙলা ছাড়া অন্যান্য প্রদেশে কপনি-মাত্র থাকলেই শরীর ঢাকার কাজ হল, কিন্তু পাগড়িটা চাই; প্রাচীনকালেও তাই ছিল—মেয়ে-মদ্দে। বৌদ্ধদের সময়ের যেসকল ভাস্কর্যমূর্তি পাওয়া যায়, তারা মেয়ে-মদ্দে কৌপীন-পরা। বুদ্ধদেবের বাপ কপনি পরে বসেছেন সিংহাসনে; তদ্বৎ মাও বসেছেন—বাড়ার ভাগ, এক-পা মল ও এক-হাত বালা; কিন্তু পাগড়ি আছে!! সম্রাট্ ধর্মাশোক ধুতি পরে, চাদর গলায় ফেলে, আদুড় গায়ে একটা ডমরু-আকার আসনে বসে নাচ দেখছেন! নর্তকীরা দিব্যি উলঙ্গ; কোমর থেকে কতকগুলো ন্যাকড়ার ফালি ঝুলছে। মোদ্দা পাগড়ি আছে। নেবু টেবু সব ঐ পাগড়িতে। তবে রাজসামন্তরা ইজার ও লম্বা জামা পরা—চোস্ত ইজার ও চোগা। সারথি নলরাজ এমন রথ চালালেন যে, রাজা ঋতুপর্ণের চাদর কোথায় পড়ে রইল; রাজা ঋতুপর্ণ আদুড় গায়ে বে করতে চললেন। ধুতি-চাদর আর্যদের চিরন্তন পোষাক, এইজন্যই ক্রিয়াকর্মের বেলায় ধুতি-চাদর পরতেই হয়।
প্রাচীন গ্রীক ও রোমানদের পোষাক ছিল ধুতি-চাদর; একথান বৃহৎ কাপড় ও চাদর—নাম ‘তোগা’, তারি অপভ্রংশ এই ‘চোগা’। তবে কখনও কখনও একটা পিরানও পরা হত। যুদ্ধকালে ইজার জামা। মেয়েদের একটা খুব লম্বাচৌড়া চারকোণা জামা, যেমন দুখানা বিছানার চাদর লম্বালম্বি সেলাই করা, চওড়ার দিক্ খোলা। তার মধ্যে ঢুকে কোমরটা বাঁধলে দুবার—একবার বুকের নীচে, একবার পেটের নীচে। তারপর উপরের খোলা দুপাট দুহাতের উপর দু জায়গায় তুলে মোটা ছুঁচ দিয়ে আটকে দিলে যেমন—উত্তরাখণ্ডের পাহাড়ীরা কম্বল পরে। সে পোষাক অতি সুন্দর ও সহজ। ওপরে একখান চাদর।
কাটা কাপড় এক ইরানীরা প্রাচীনকাল হতে পরত। বোধ হয় চীনেদের কাছে শেখে। চীনেরা হচ্ছে সভ্যতার অর্থাৎ ভোগবিলাসের সুখস্বচ্ছন্দতার আদিগুরু। অনাদিকাল হতে চীনে টেবিলে খায়, চেয়ারে বসে যন্ত্র তন্ত্র কত খাওয়ার জন্য, এবং কাটা পোষাক নানা রকম, ইজার-জামা টুপিটাপা পরে।
সিকন্দর শা ইরান জয় করে, ধুতি-চাদর ফেলে ইজার পরতে লাগলেন। তাতে তাঁর স্বদেশী সৈন্যরা এমন চটে গেল যে বিদ্রোহ হবার মত হয়েছিল। মোদ্দা সিকন্দর নাছাড় পুরুষ—ইজার-জামা চালিয়ে দিলেন।
গরমদেশে কাপড়ের দরকার হয় না। কৌপীনমাত্রেই লজ্জানিবারণ, বাকী কেবল অলঙ্কার। ঠাণ্ডা দেশে শীতের চোটে অস্থির, অসভ্য অবস্থায় জানোয়ারের ছাল টেনে পরে, ক্রমে কম্বল পরে, ক্রমে জামা-পাজামা ইত্যাদি নানানখানা হয়। তারপর আদুড় গায়ে গয়না পরতে গেলেই তো ঠাণ্ডায় মৃত্যু, কাজেই অলঙ্কার-প্রিয়তাটা ঐ কাপড়ের উপর গিয়ে পড়ে। যেমন আমাদের দেশে গয়নার ফ্যাশন বদলায়, এদের তেমনি ঘড়ি ঘড়ি বদলাচ্ছে কাপড়ের ফ্যাশন।
ঠাণ্ডা দেশমাত্রেই এজন্য সর্বদা সর্বাঙ্গ না ঢেকে কারু সামনে বেরুবার যো নেই। বিলেতে ঠিক ঠিক পোষাকটি না পরে ঘরের বাইরে যাবার যো নেই। পাশ্চাত্য দেশের মেয়েদের পা দেখান বড়ই লজ্জা, কিন্তু গলা ও বুকের খানিকটা দেখান যেতে পারে। আমাদের দেশে মুখ দেখান বড়ই লজ্জা; কিন্তু সে ঘোমটা টানার চোটে শাড়ী কোমরে ওঠেন উঠুন, তায় দোষ নেই। রাজপুতানার ও হিমাচলের অষ্টাঙ্গ ঢেকে তলপেট দেখানো!
পাশ্চাত্য দেশের নর্তকী ও বেশ্যারা লোক ভুলাবার জন্য অনাচ্ছিদিত। এদের নাচের মানে, তালে তালে শরীর অনাবৃত করে দেখানো। আমাদের দেশের আদুড় গা ভদ্রলোকের মেয়ের; নর্তকী বেশ্যা সর্বাঙ্গ ঢাকা। পাশ্চাত্য দেশে মেয়ে ছেলে সর্বদাই গা ঢাকা, গা আদুড় করলে আকর্ষণ বেশী হয়; আমাদের দেশে দিনরাত আদুড় গা, পোষাক পরে ঢেকেঢুকে থাকলেই আকর্ষণ অধিক। মালাবার দেশে মেয়ে-মদ্দের কৌপীনের উপর বহির্বাসমাত্র, আর বস্ত্রমাত্রই নেই। বাঙালীরও তাই, তবে কৌপীন নাই এবং পুরুষদের সাক্ষাতে মেয়েরা গা-টা মুড়ি-ঝুড়ি দিয়ে ঢাকে।
পাশ্চাত্য দেশে পুরুষে পুরুষে সর্বাঙ্গ অক্লেশে উলঙ্গ হয়—আমাদের মেয়েদের মত। বাপ-ছেলেয় সর্বাঙ্গ উলঙ্গ করে স্নানাদি করে, দোষ নেই। কিন্তু মেয়েদের সামনে, বা রাস্তা-ঘাটে, বা নিজের ঘর ছাড়া—সর্বাঙ্গ ঢাকা চাই।
এক চীনে ছাড়া সর্বদেশেই এ লজ্জা সম্বন্ধে অনেক অদ্ভুত বিষয় দেখছি—কোন বিষয়ে বেজায় লজ্জা, আবার তদপেক্ষা অধিক লজ্জাকর বিষয়ে আদতে লজ্জা নেই। চীনে মেয়ে-মদ্দে সর্বদা আপাদমস্তক ঢাকা। চীনে কনফুছের চেলা, বুদ্ধের চেলা, বড় নীতি-দুরস্ত; খারাপ কথা, চাল, চলন—তৎক্ষণাৎ সাজা। ক্রিশ্চান পাদ্রী গিয়ে চীনে ভাষায় বাইবেল ছাপিয়ে ফেললে। এখন বাইবেল-পুরাণ হচ্ছেন হিঁদুর পুরাণের চোদ্দ পুরুষ—সে দেবতা-মানুষের অদ্ভুত কেলেঙ্কার পড়ে চীনে তো চটে অস্থির। বললে, ‘এই বই কিছুতেই এ দেশে চালানো হবে না, এ তো অতি অশ্লীল কেতাব’; তার উপর পাদ্রিনী বুকখোলা সান্ধ্য পোষাক পরে, পর্দার বার হয়ে চীনেদের নিমন্ত্রণে আহ্বান করলেন। চীনে মোটাবুদ্ধি, বললে—‘সর্বনাশ! এই খারাপ বই পড়িয়ে, আর এই মাগীদের আদুড় গা দেখিয়ে, আমাদের ছোঁড়া বইয়ে দিতে এ ধর্ম এসেছে।’ এই হচ্ছে চীনের ক্রিশ্চানের উপর মহাক্রোধ। নতুবা চীনে কোন ধর্মের উপর আঘাত করে না। শুনছি যে, পাদ্রীরা এখন অশ্লীল অংশ ত্যাগ করে বাইবেল ছাপিয়েছে; কিন্তু চীনে তাতে আরও সন্দিহান।
আবার এ পাশ্চাত্য দেশে দেশবিশেষে লজ্জাঘেন্নার তারতম্য আছে। ইংরেজ ও আমেরিকানের লজ্জা-শরম একরকম; ফরাসীর আর একরকম; জার্মানের আর একরকম। রুশ আর তিব্বতী বড় কাছাকাছি; তুরস্কের আর এক ডোল; ইত্যাদি।