বিদেশি বারোজনের মধ্যে চারজন আহত, বাকিরা পুলিশের সঙ্গে একটুক্ষণ লড়াই চালাবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দেয়।
তাদের সবাইকে বন্দি করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে দুটি গাড়িতে। আর তাদের এদেশি শাগরেদ কয়েকজনকে হাতকড়া পরিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে। হোটেলের সামনে।
নরেন্দ্র হোটেলের ফার্স্ট এইড বক্স আনিয়ে কাকাবাবুর কাঁধে একটা ব্যান্ডেজ বেঁধে দিতে দিতে বললেন, অনেক রক্ত বেরিয়েছে। অন্য কেউ হলে এতক্ষণে কাত হয়ে পড়ত। তুমি দিব্যি হাসিখুশি আছো কী করে?
কাকাবাবু বললেন, ছুরিটা যদি আর ছ ইঞ্চি নীচে লাগত, তাতে আমার হৃৎপিণ্ডটা ফুটো হয়ে যেত। তা যে হয়নি, সেই আনন্দেই আমার কোনও যন্ত্রণার বোধ হয়নি!
নরেন্দ্র বললেন, তুমি পারোও বটে! এখনও চা খাওনি তো? আমিও চা খাওয়ার সময় পাইনি। এই হোটেলে এরা চা দেবে না? কুক, বেয়ারা, এরা তো আর চোর-ডাকাত নয়!
হোটেলের সাধারণ কর্মচারীরা ভয়ে কুঁকড়েমুকড়ে এক জায়গায় বসে ছিল। নরেন্দ্র তাদের ডেকে বললেন, তোমাদের পরিচয়পত্র পরীক্ষা করে দেখা হবে। কিছু গণ্ডগোল না থাকলে তোমাদের ভয়ের কিছু নেই। এখন আমাদের চা খাওয়াও।
একটু পরেই চা আর টোস্ট এসে গেল। নরেন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা রাজা, তুমি তো বলেছিলে এই জেলভাঙার কেসটা তুমি কিছুতেই নিতে চাও না। তবু মানালি না গিয়ে এখানে চলে এলে কেন?
কাকাবাবু বললেন, সে অনেক ব্যাপার আছে। নিয়তি, নিয়তি! কেন যে আমি এইসবের মধ্যে জড়িয়ে পড়ি, নিজেই জানি না।
নরেন্দ্র বললেন, এবারে তুমি কী দারুণ কাণ্ড করেছ, তা তুমি সত্যিই এখনও জানো না। এই চার্লস শিরাক নামে লোকটা, একটা আন্তর্জাতিক কুখ্যাত ড্রাগ স্মাগলার। ভারতে বসে ছদ্মবেশে কারবার চালাচ্ছে, আমরা কিছুই বুঝতে পারিনি। ক্যানাডা, আমেরিকায় পুলিশের হুলিয়া আছে ওর নামে। ওখানকার পুলিশ আমাদের কাছে ওর সম্পর্কে জানতে চাইলে আমরা বলেছি, মিসিং, মিসিং। পাহাড়ে হারিয়ে গেছে। ওর সেই পোস্টারের কপি পাঠিয়ে দিয়েছি। ওই যে ধরমবীর সেজে আমাদের নাকের ডগা দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তা তুমি না ধরতে পারলে কেউ বুঝতেও পারত না। পৃথিবীর সব কাগজে এ খবর ছাপা হবে। ভারত সরকার এজন্য তোমাকে পুরস্কার দেবে। তুমি তো টাকা-পয়সা নিতে চাও না, তাই একটা কিছু বিশেষ সম্মান…
কাকাবাবু তাঁকে বাধা দিয়ে বললেন, কে বলল টাকা-পয়সা নিতে চাই না? আমার বুঝি টাকার দরকার নেই? তোমরা দিতে চাও না, তাই মুখ ফুটে কিছু বলি না।
নরেন্দ্র হাসতে হাসতে বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে, তুমি এত পরিশ্রম করেছ, তার জন্য একটা ফি দেওয়া হবে। আর একটা বিশেষ পুরস্কারেরও ব্যবস্থা করছি।
কাকাবাবু বললেন, সে পুরস্কার তোমরা জোজোকে দিয়ে। এবারে সবকিছুর জন্য জোজোরই কৃতিত্ব বেশি।
জোজো আর সন্তু দূরে অন্য একটা টেবিলে বসে আছে। কথাটা শুনে জোজো বলল, আমার আর সন্তুর। ভূতেশ্বরের মূর্তিটা তো আমরাই দুজনে উদ্ধার করে বারান্দা থেকে ঘরে এনে রেখেছি!
কাকাবাবু বললেন, চা খাওয়া হয়ে গেছে? চলো, আর দেরি নয়। এখনই মানালির দিকে রওনা হই। এরপর বিশুদ্ধ বেড়ানো।
উঠে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, ও, একটা কাজ বাকি আছে। যাদের হাতকড়া পরিয়ে বসিয়ে রেখেছ, তাদের মধ্যে টাকমাথা একজন লোক আছে। তাকে এখানে আনো তো! ও আমার নাকে ঘুসি মেরেছিল।
নরেন্দ্র বললেন, বুঝেছি, বুঝেছি, তুমি ওকে নিজের হাতে শাস্তি দিতে চাও তো! দেখো রাজা, তোমার এক হাতে ব্যান্ডেজ, এখন তোমাকে গায়ের জোর ফলাতে হবে না। বরং আমি একটু হাতের সুখ করে নিই।
লোকটিকে সামনে আনার পর নরেন্দ্র বললেন, তুই এই সাহেবের নাকে নাকি ঘুসি মেরেছিলি, তাই না? দ্যাখ, নাকে ঘুসি খেতে কেমন লাগে!
দড়াম করে তিনি তার মুখে একটা ঘুসি কষালেন। লোকটির নাক দিয়ে রক্ত পড়তে লাগল। লোকটি যন্ত্রণায় আঁ আঁ শব্দ করতে করতে বসে পড়ল মাটিতে।
নরেন্দ্র জোজোকে জিজ্ঞেস করলেন, কাকাবাবু ঘুসি খেয়ে ওরকম শব্দ করেছিলেন?
জোজো বলল, একটুও না।
নরেন্দ্র বললেন, জানি। পা খোঁড়া, কিন্তু অসম্ভব ওঁর মনের জোর। চলো, তোমাদের গাড়িতে তুলে নিই।
কয়েক পা যাওয়ার পর কিছু একটা মনে পড়ায় তিনি কোমরে দুহাত দিয়ে হা হা করে হেসে উঠলেন খুব জোরে।
কাকাবাবু বললেন, এ কী, হঠাৎ হাসছ কেন?
নরেন্দ্র বললেন, সবকটা বিদেশি স্মাগলার ধুতি-পাঞ্জাবি পরে বাঙালি সেজেছিল! তোমাদের বাঙালিদের কীরকম সুনাম, বুঝে দ্যাখো!
কাকাবাবুও যোগ দিলেন সেই হাসিতে।