০৮. বিকেলবেলা আমি আর টিশা

বিকেলবেলা আমি আর টিশা লাইব্রেরিতে বসে পড়াশোনা করছিলাম। একটা প্রোটনের কাছে এনে একটা ইলেকট্রন ছেড়ে দিলে সেটা কেন প্রোটনের ভেতর পড়ে না গিয়ে একটা হাইড্রোজেনের পরমাণু হয়ে যায় সেটা নিয়ে খানিকক্ষণ তর্ক করে আমি লাইব্রেরির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছি তখন হঠাৎ মনে হলো বহুদূরে একটা ধূলিঝড় শুরু হয়েছে। আমি ধূলির ঝড়টার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ করে নিজের ভেতরে এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করি। এটা কি সত্যিই ধূলিঝড় নাকি একটা কনভয়? দস্যুদলের কনভয়?

আমি টিশাকে ডাকলাম, “টিশা এখানে এসে দেখো!”

আমার গলার স্বরে কিছু একটা ছিল যেটা শুনে টিশা ভয় পাওয়া গলায় বলল, “কী?”

“মনে হয় একটা কনভয় এদিকে আসছে।”

টিশা জানালার কাছে এসে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকাল বহু দূরে ধূলি উড়ছে, সেদিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “হ্যাঁ! একটা কনভয়।”

“কার কনভয়?” টিশা নিঃশ্বাস আটকে রেখে বলল, “দস্যুদলের।”

“কেমন করে বুঝলে দস্যুদল?”

“ওদের বাজনা শুনতে পাচ্ছ না?”

আমি কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম এবং সত্যি সত্যি বহুদূর থেকে একটা বাজনার শব্দ শুনতে পেলাম, কেমন যেন আতঙ্কের বাজনা।

টিশা বলল, “সব দস্যুদলের নিজস্ব বাজনা থাকে। যখন কোথাও আক্রমণ করতে যায় এরকম বাজনা বাজাতে বাজাতে যায়।”

আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম, তারপর জিজ্ঞেস করলাম, “ওরা কাকে আক্রমণ করতে যাচ্ছে?”

টিশা বলল, “এদিকেই তো আসছে। মনে হয় আমাদের শহরটা আক্রমণ করতে আসছে।”

আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, “আমাদের শহরটাকে? এই শহরে তুমি আর আমি ছাড়া কে আছে?”

“ওরা তো সেটা জানে না।”

আমি আর টিশা জানালা দিয়ে দূরে তাকিয়ে রইলাম, ধীরে ধীরে গাড়িগুলোর আকার বোঝা যেতে শুরু করেছে, বিদঘুঁটে কদাকার বিশাল বিশাল গাড়ি। দস্যুদলের বাজনাটাও অনেক স্পষ্ট হয়েছে, ভয়ংকর এক ধরনের বাজনা, বুকের ভেতর এক ধরনের কাঁপুনি ধরিয়ে দেয়।

আমি বললাম, “আমাদের এখনই শহর থেকে পালিয়ে যেতে হবে। দস্যুদল এখানে পৌঁছানোর আগেই অন্য কোথাও চলে যেতে হবে।”

টিশা মাথা নাড়ল, বলল, “না। তার জন্য দেরি হয়ে গেছে। দস্যুদল ওদের টেলিস্কোপ, মোশান সেন্সর, ভিডি ট্রেসার সবকিছু দিয়ে এই শহরটাকে স্ক্যান করছে। আমরা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে দেখে ফেলবে–তখন ওদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না।”

আমি মাথা নাড়লাম, “ঠিকই বলেছ। আমাদের এখানেই লুকিয়ে থাকতে হবে। পুরোপুরি ধসে গেছে এরকম কোনো জায়গায় লুকিয়ে থাকি। এত বড় শহরে আমাদের কখনো খুঁজে পাবে না।”

আমি আর টিশা আর দেরি করলাম না। কিছু শুকনো খাবার আর কয়েকটা পানির বোতল নিয়ে শহরের এক প্রান্তে পুরোপুরি ধসে পড়া একটা বিল্ডিংয়ের কিছু ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে ছোট একটা ঘুপচি ঘরে লুকিয়ে রইলাম। দস্যুদল শহরে ঢুকেই বুঝতে পারবে এটা জনমানবহীন পরিত্যক্ত একটা শহর। তখন শহরের যা কিছু আছে লুটপাট করে নিয়ে যাবে, আমাদের দুজনকে নিশ্চয়ই খোজার চেষ্টা করবে না।

ঘণ্টা খানেকের ভেতরেই দস্যুর দলটা আমাদের শহরে পৌঁছে গেল, ভয়ংকর একটা বাজনা থেকে আমরা সেটা বুঝতে পারলাম। দলটা শহরের ভেতরে ঘুরে বেড়াল, ইতস্তত কিছু গোলাগুলি করল এবং আমরা ছোট-বড় নানাধরনের কিছু বিস্ফোরণের শব্দ শুনলাম।

ভয়ংকর বাজনাটা হঠাৎ থেমে গেল এবং একজন হঠাৎ খনখনে গলায় কথা বলতে শুরু করল। মানুষটার কথা খুবই বিচিত্র, উচ্চারণ বিদঘুঁটে এবং কথা বলার সময় প্রত্যেকটা শব্দের শেষে হিসহিস করে এক ধরনের শব্দ করে। তার সব কথা আমরা বুঝতে পারলাম না, শুনলাম খনখনে গলায় বলল, “চিকি চিকি চিকি চিকিরি মুঙ্গা আবে কানা লুলা মাজা ভাঙা পার্টনার ক্ষান্তি দে। দম লে বোম ফাটা। আয় এই শহরটা গুঁড়া করে যাই। চিকিরি দুঙ্গা! মনে লয় এই শহরে কুনো ইন্দুর নাই, থাকলেও জানের ভয়ে টিংরি দিছে না হয় গর্তে ঢুকছে। আবে কানা লুলা মাজাভাঙা ভুঁড়ি ফাসা কুত্তার বাচ্চারা খুঁইজা বার কর কারা আছে। কলিজা প্যাকেট কইরা লয়া যাই। চিকি চিকি চিঙ্গিরা! কাম শুরু কর কুত্তার বাচ্চারা। দুনিয়াটা দখল না করলে শান্তি নাই। এখনো একটা নিউঁকিলিয়ার বুমা খুঁইজা পাইলাম না কামটা কী ঠিক হইল? কুত্তার বাচ্চারা তোরা করস কী? তোগো মগজে আমি কি কেরেনিয়াল লাগাই নাই? সেই মগজে রস দেই নাই? চিকি চিকি চিঙ্গিরা। যখন দরকার পড়ছে তোগো বিপদ আপদ বুমা গুলি বিজলি বাজলা ঘাউ কামুড় থেকে বাঁচাই নাই…”

মানুষটা এই ভাষায় খনখনে গলায় কথা বলেই যেতে লাগল–কথার মাঝে মাঝে দস্যুদলের লোকেরা চিৎকার করতে লাগল, হল্লা করতে লাগল। আমরা কথার কিছু বুঝতে পারলাম, বেশির ভাগ বুঝতে পারলাম না। তবে মোটামুটি একটি জিনিস বুঝতে পারলাম শহরে কোনো মানুষ থাকলে তাদেরকে খুঁজে বের করতে এই দস্যুদল খুবই ব্যস্ত। মানুষকে অবশ্যি মানুষ না বলে ইঁদুর বলছে। যে কোনো কারণেই জীবন্ত মানুষ এদের কাছে খুবই মূল্যবান।

আমি আর টিশা এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে ধসে যাওয়া বিল্ডিংয়ের ধ্বংসস্তূপের খুপরিতে অন্ধকারে মাথা খুঁজে পড়ে রইলাম। বাইরে নানা ধরনের শব্দ হইহল্লা এবং মাঝে মাঝেই গোলাগুলি এবং বিস্ফোরণের শব্দ। কান ফাটানো এক ধরনের বাজনা এবং তার সাথে বিদঘুঁটে স্বরে গান শুনতে পেলাম। খনখনে গলার মানুষের বিচিত্র ভাষার কথা এবং গালাগাল মাঝে মাঝেই শুনতে হচ্ছিল। সে নিশ্চয়ই এই দস্যুদলের নেতা, সে যখন কথা বলে তখন সবার কথাবার্তা হই হল্লা থেমে যায়।

আমরা কতক্ষণ এভাবে বসেছিলাম জানি না। হঠাৎ করে খুব কাছে থেকে মানুষের গলার শব্দ শুনতে পেলাম। একটা পুরুষ কণ্ঠ বলল, “এই যে এই দিকে গেছে। ইন্দুরের বাচ্চা এই দিকে গেছে।”

আমার বুকটা ধক করে উঠল, তাহলে কি আমাদের খোঁজ পেয়ে গেছে? কেমন করে পেল?

একটা নারীকণ্ঠ বলল, “কুত্তাটাকে শুকতে দাও। কুত্তাটা কে কে বের করে ফেলবে।”

আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। দস্যুদল একটা কুকুর নিয়ে এসেছে। কুকুরটা ঘ্রাণ এঁকে এঁকে আমাদের বের করে ফেলছে। আমি হাতে অস্ত্রটা টেনে নিলাম, টিশা তখন আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল, ফিসফিস করে বলল, “না। অস্ত্র ব্যবহার কোরো না। দেখা যাক কী হয়।”

আমরা ঘাপটি মেরে বসে রইলাম, পুরুষ এবং মহিলাটি নিচু গলায় কুৎসিত গালি দিতে দিতে এগিয়ে আসতে থাকে এবং কিছুক্ষণের মাঝে ধ্বংসস্তৃপটা সরিয়ে আমাদের ঘুপচি ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। ভয়ংকর অস্ত্র হাতে একজন পুরুষ এবং নারী এবং তাদের হাতে শেকল দিয়ে বাঁধা একটা প্রাণী, আবছা অন্ধকারে শুধু অবয়বটা দেখা যায়, চেহারা বোঝা যায় না।

গলায় শেকল বাঁধা প্রাণীটা মাটিতে গন্ধ শুকে শুকে আমাদের কাছে এগিয়ে এসে গর্জন করে আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং ঠিক তখন পুরুষ এবং মহিলাটি শিকল টেনে ধরে প্রাণীটাকে সরিয়ে আমাদের রক্ষা করল।

আমি আর টিশা হতবাক হয়ে কুকুরের মতো প্রাণীটার দিকে তাকিয়ে রইলাম, কারণ প্রাণীটি একজন মানুষ। কোমরে জড়ানো এক টুকরো পলিমার ছাড়া শরীরে কোনো কাপড় নেই, মাথায় লম্বা চুল, মুখভর্তি দাড়িগোঁফ। শেকল দিয়ে আটকে রেখেছে বলে আমাদের কাছে আসতে পারছে না, দূর থেকে হিংস্র ভঙ্গিতে গর্জন করতে লাগল।

পুরুষ আর নারীটির হাতে তীব্র আলোর দুটো ফ্ল্যাশ লাইট জ্বলে উঠল, তার আলোতে আমাদের চোখ পুরোপুরি ধাধিয়ে যায়। আমরা হাত দিয়ে চোখ দুটো ঢাকার চেষ্টা করলাম। পুরুষ মানুষটা বলল, “হাইয়ারে হাইয়া! চিকি চিকি চিকড়া।” মেয়েটা বলল, “একটাও পাই না। এখন দেখি এক জোড়া।”

পুরুষটা বলল, “শুধু এক জোড়া না। একটা বেটা একটা বেটি।”

কুকুরের মতো মানুষটা ছুটে আমাদের দিকে আসার চেষ্টা করে গরগর করে শব্দ করল। পুরুষ মানুষটা শিকলটা শক্ত করে ধরে রেখে বলল, “ইন্দুরের বাচ্চা ইন্দুর গর্ত থেকে বের হ তাড়াতাড়ি।”

আমি কথা বলার চেষ্টা করলাম, বললাম, “তোমরা কী চাও?”

আমার প্রশ্ন শুনে পুরুষ এবং মহিলাটা এমনভাবে হাসতে শুরু করল যেন আমি খুবই হাসির একটা কথা বলে ফেলেছি। পুরুষটা এগিয়ে এসে আমার চুল ধরে টেনে এনে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল, “কথা না বলে হাঁটা দে পচা ঘা। একবার মুখ খুললে তোরে আস্ত না নিয়ে টুকরো টুকরো করে কেটে ব্যাগে ভর্তি করে নিব।”

আমি আর কথা বলার চেষ্টা করলাম না। মানুষগুলো একটু ঘুরতেই আমি প্রথমবার তাদের পেছনে ক্রেনিয়ালের ধাতব গর্তগুলো দেখতে পেলাম। কুকুরের মতো মানুষটার পেছনেও ক্রেনিয়াল লাগানো তবে তার ক্রেনিয়ালে একটা টিউব ঢোকানো আছে। টিউবের পেছনে একটা বাতি জ্বলছে এবং নিভছে। নিশ্চয়ই তার মাথার ভেতরে সরাক্ষণ কোনো রকম তথ্য ঢোকানো হচ্ছে। একজন মানুষকে পুরোপুরি কুকুরের মতো তৈরি করে ফেলা নিশ্চয়ই খুব সহজ না। উল্টোটা কী সম্ভব? একটা কুকুরকে কি মানুষের মতো করা যাবে?

আমি অবশ্যি চিন্তা করার খুব বেশি সময় পেলাম না। তার আগেই দস্যুদলের বিশাল কনভয়ের মাঝে আমাদেরকে নিয়ে এসেছে। শহরের রাস্তায় দস্যুদলের বিশাল এবং বিদঘুঁটে গাড়িগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা হয়েছে। গাড়িগুলোর উপর নানা ধরনের যন্ত্রপাতি, নানা ধরনের অস্ত্র। অনেকগুলো গাড়ির উপর বিশাল বিশাল স্পিকার, সেখান থেকে বিচিত্র এক ধরনের বাজনা বাজছে।

দস্যুরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, পুরুষ এবং মহিলা প্রায় সমান সমান। বেশির ভাগই মাঝবয়সী, চেহারার মাঝে এক ধরনের নিষ্ঠুরতার ছাপ। শরীরে নানা ধরনের উল্কি, নাকের মাঝে জিবের মাঝে ধাতব রিং। মরুভূমির গরম আবহাওয়ার জন্যই কিনা কে জানে, তাদের শরীরে কাপড় খুব কম, নগ্নতা নিয়ে তাদের কোনো রকম সংকোচ আছে বলে মনে হয় না।

আমাদের দুজনকে ধরে যখন নিয়ে যাচ্ছে তখন অনেকেই আমাদের দেখার জন্য এগিয়ে এল। তারা আমাদের ধরে টিপে টুপে দেখল। চুল ধরে টানল, হাত ধরে ঝাঁকুনি দিল, ঘাড়ে ধরে উঁচু করে ওজন আন্দাজ করার চেষ্টা করল। পেটে গুঁতো দিল, একজন মুখ হাঁ করে দাঁতগুলো দেখল। আমাদের মনে হতে লাগল আমরা বুঝি মানুষ নই, আমরা বুঝি জন্তু-জানোয়ার।

কনভয়ের পাশে দিয়ে যখন হেঁটে যাচ্ছি তখন হঠাৎ করে স্পিকারে সেই খনখনে গলায় আওয়াজ শুনতে পেলাম, বিচিত্র দুর্বোধ্য এবং কেমন জানি ভীতিকর। মানুষটি চিৎকার করে বলতে লাগল, “চিকি চিকি চিংড়া! টিকি টিকি টিংড়া। দুইটা ইন্দুর ধরা পড়েছে। একটা নয় আধাটা না, আস্তো দুইটা ইন্দুর। কানা লুলা মাজাভাঙা কুত্তার বাচ্চারা যারা নিজের চোখে দুইটা ইন্দুর দেখতে চাস আমার খাঁচার মাঝে চলে আয়! আজকে খানি দানি হবে ফুর্তি ফার্তা হবে। মগজের মাঝে কেরেনিয়াল পরিষ্কার করে রাখবি! আরে রে রে চিকি চিকি চিংড়া! চিকি চিকি চিংড়া!”

আমাদের দুজনকে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে একটা লরির সামনে নিয়ে যাওয়া হলো। লরির ভেতর থেকে একজন মানুষ লাফিয়ে বের হয়ে এল। আমাদের কয়েক মুহূর্ত লাগল বুঝতে যে মানুষটি একজন মহিলা। মাথার চুল ছোট ছোট করে ছাঁটা। সারা শরীর বিচিত্র উল্কি দিয়ে ঢাকা। শরীরে ছোট ছোট দুই টুকরো নিও পলিমারের কাপড়। গলায় ধাতব একটা মালা, কোমর থেকে একটা যন্ত্র ঝুলছে, বাম হাতের সাথে একটা অস্ত্র স্ট্রাপ দিয়ে বাঁধা।

এই বিচিত্র মহিলাটি আমাদের দুজনের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠল, “চিকি চিকি চিকি চিকি চিংড়া চিংড়া!” সাথে সাথে পুরো শহরটি তার খনখনে গলার স্বরে কেঁপে উঠল। মনে হয় তার ভোকাল কর্ডে মাইক্রোফোন লাগানো হয়েছে, যে কথাটিই বলে, পুরো কনভয়ে সেটা শোনা যায়।

মহিলাটি নিশ্চয়ই দস্যুদলের নেতা। সে খপ করে টিশার কাঁধ ধরে নিজের কাছে টেনে আনল, তারপর তার মুখটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল, কানের ভেতর উঁকি দিল, মুখ হাঁ করিয়ে ভেতরে দেখল। তারপর তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে আমার দিকে তাকল, চোখের রং সবুজ, আমি অবাক হয়ে দেখলাম সবুজ চোখ দুটি দেখতে দেখতে লাল হয়ে গেল এবং সেই লাল চোখ দিয়ে মহিলাটি আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করতে থাকি এবং সেই ভয়ংকর চেহারার মহিলাটি হঠাৎ অপ্রকৃতিস্থের মতো হি হি করে হাসতে শুরু করল, আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম মহিলাটির দাঁতগুলো ধারালো এবং দুই পাশের দুটি দাঁত হিংস্র পশুর মতো বড় বড়। মহিলাটি হঠাৎ ধাক্কা দিয়ে আমাকেও সরিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বলল, “সিস্টিম ডাউনলোড।”

তারপর মনে হয় সিস্টেম ডাউনলোড প্রক্রিয়াটা দেখার জন্যে মহিলাটি লরির একটা ধাতব অংশে বসে পড়ে। আমাদের দুজনকে ঘিরে কয়েকজন দস্যু, কিছু যন্ত্রপাতি নিয়ে ছোটাচ্চুটি করতে থাকে। বিচিত্র কিছু যন্ত্র নিয়ে আসা হয় এবং সেগুলোর সাথে অন্য যন্ত্র লাগিয়ে সেখান থেকে লম্বা লম্বা তার বের করে আনা হয়। কী হচ্ছে বুঝতে না পেরে আমি আর টিশা এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে যন্ত্রগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি। মনে হয় মজা দেখার জন্যই বেশ কিছু দস্যু আমাদের দুজনকে ঘিরে দাঁড়াল। পাহাড়ের মতো বড় একজন দস্যু আমাকে ধরে দস্যুদলের নেতা মহিলার দিকে তাকিয়ে বলল, “মায়ী মায়ী, ক্রেনিয়ালে কানেকশন দিব?”

মহিলাটির নাম মায়ী মায়ী নাকি তাকে এই নামে সম্বোধন করা হয় বুঝতে পারলাম না। মহিলাটি মাথা নাড়ল, বলল, “দাও। সিস্টিম ডাউনলোড কর।” তারপর মুখে লোল টানার মতো শব্দ করে বলল, “তিন নম্বর সিস্টিম দিবি।”

পাহাড়ের মতো দস্যুটি মাথা নেড়ে আমার চুলগুলো ধরে আমার মাথার পিছনে তাকাল, মনে হলো সেখানে ক্রেনিয়ালটা খুঁজল, কিন্তু না পেয়ে অবাক হয়ে বলল, “ক্রেনিয়াল কই?”

আমি বললাম, “আমার মাথায় ক্রেনিয়াল লাগানো হয়নি।”

মানুষটি চিৎকার করে বলল, “কী বললি? মগজে ক্রেনিয়াল নাই?”

আমি মাথা নাড়লাম, “না।”

দস্যুদলের নেতা মহিলাটি যাকে মায়ী মায়ী বলে সম্বোধন করা হচ্ছে প্রায় লাফ দিয়ে উঠে আমার কাছে এসে আমার মাথার পেছনে দেখল, তারপর টিশার মাথার পিছনে দেখল। দুজনের কারো মাথাতেই ক্রেনিয়াল নেই, মায়ী মায়ী প্রথমে খুব অবাক হলো, তারপর রেগে উঠল, তারপর হঠাৎ শব্দ করে হাসতে শুরু করল! হাসতে হাসতে বলল, “এই কানা লুলা মাজা ভাঙা কুত্তার বাচ্চারা, তোরা শুনলে বেকুব হয়ে যাবি! দুইটা ইন্দুরের বাচ্চাকে ধরে এনেছি তাদের মাথায় কেরেনিয়াল নাই।” কোনো একটা বিচিত্র কারণে মায়ী মায়ী নামের মহিলাটি ক্রেনিয়াল উচ্চারণ করতে পারে না, এটাকে বলে কেরেনিয়াল! কথা শেষ করার আগেই মায়ী মায়ী অপ্রকৃতিস্থের মতো হি হি করে হাসতে থাকে। বিশাল স্পিকারে সেই বিচিত্র হাসি সারা শহরে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।

পাহাড়ের মতো মানুষটা বলল, “মায়ী মায়ী, এখন এই দুইটারে কী করব?”

“একটা খাঁচার ভেতরে আটকে রাখ।”

পাহাড়ের মতো মানুষটা সত্যি সত্যি আমাদের দুজনকে একটা খাঁচার ভেতরে ঢুকিয়ে খাঁচাটা একটা গাড়ি থেকে বের হওয়া ধাতব দণ্ড থেকে ঝুলিয়ে দিল। আমরা মাটি থেকে প্রায় দশ মিটার উপরে ঝুলতে থাকলাম।

উপর থেকে পুরো কনভয়টা দেখা যায়। সন্ধে নেমে আসছে, বিদঘুঁটে গাড়ির সামনে ছোট ছোট আগুন জ্বালানো হয়েছে, পুরো এলাকাটা ধোঁয়ায় ভরে গেছে। দস্যুদলের মানুষগুলো আগুন ঘিরে বসে হাসি-তামাশা করতে লাগল। আমি টিশার দিকে তাকিয়ে বললাম, “টিশা।”

“বলো।”

“এখানে কী হচ্ছে বুঝতে পারছ টিশা।”

“একটু একটু বুঝতে পারছি।”

“আমাদের এখন কী হবে বলে মনে হয়?”

টিশা বলল, “ডিটিউন হওয়া ভালো ছিল নাকি এটা ভালো হলো বুঝতে পারছি না।”

কথাটা মোটেও হাসির কথা নয় কিন্তু টিশা হঠাৎ হাসতে শুরু করল। আমাকে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল, “এরকম একটা অবস্থা হবে জানলে তুমি কি আমাকে উদ্ধার করতে আসতে?”

আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, “মনে হয় আসতাম।”

টিশা বলল, “চমৎকার। খুব খারাপ হলে দস্যু হয়ে থাকতে হবে। যাযাবর হতে গিয়ে দস্যু হয়ে গেলাম, খারাপ কী?”

কথা শেষ করে টিশা আবার হাসতে থাকে। আমি অবাক হয়ে এই বিচিত্র মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকি।