বাসা থেকে যখন মাইক্রোবাসটা রওনা দিল তখন সবারই মনে একধরনের ফুরফুরে আনন্দের ভাব। সবচেয়ে বেশি আনন্দ টোটনের মনে। সে একটানা কথা বলে যাচ্ছে কিন্তু সে যেহেতু তিতুনিকে মানুষ বলেই বিবেচনা করে না তাই তার কথাবার্তা সব আবু-আম্মুর সাথে। কথার বিষয়বস্তু অবশ্যি কম্পিউটার গেম আর ফ্রায়েড চিকেনের বাইরে যাচ্ছিল না।
মাইক্রোবাসটা রওনা দিতেই টোটন বলল, “আব্ব, আমাকে একটা কম্পিউটার কিনে দেবে?”
“কী করবি কম্পিউটার দিয়ে?”
টোটন প্রশ্নটা শুনে অবাক হলো, বলল, “কী করব মানে? গেম খেলব। কী ফাটাফাটি গেম আছে তুমি জানো আব্বু?”
আব্বু মাথা নেড়ে জানালেন যে জানেন না। টোটন বলল, “একটা গেম আছে খুবই মজার। তুমি গাড়ি চালাবে আর পাবলিককে চাপা দিবে। যত বেশি চাপা দিবে তত পয়েন্ট।”
আম্মু বললেন, “এটা আবার কী রকম গেম?”
টোটন দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বলল, “যখন একজনকে চাপা দিবে তখন ফটাস করে মাথাটা ফেটে যায়, না হলে ভ্যাড়াৎ করে হুঁড়ি ফেঁসে যায়
আম্মু আবার বললেন, “ছিঃ!”
টোটন তবু থামল না, “মাথার মগজ নাড়ি ভুড়ি রক্ত সব ছিটকে ছিটকে যাবে। যা মজার গেম, তোমরা চিন্তাও করতে পারবে না। খুবই রিয়েলিস্টিক।”
আব্বু বললেন, “থাক, অনেক হয়েছে রিয়েলিস্টিক গেম।”
টোটন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমার যদি একটা কম্পিউটার থাকত তাহলে দিন-রাত আমি কম্পিউটারে গেম খেলতাম। চব্বিশ ঘন্টার মাঝে বাইশ ঘণ্টা।”
অন্য-তিতুনি বেশি কথা বলছিল না। এবারে একটু চেষ্টা করল, জিজ্ঞেস করল, “বাকি দুই ঘণ্টা?”
টোটন মুখ শক্ত করে বলল, “বাকি দুই ঘণ্টা খেতাম। ফ্রায়েড চিকেন।”
অন্য-তিতুনি বলল, “কিন্তু কম্পিউটার তৈরি হয়েছে প্রোগ্রামিং করার জন্যে”
টোটন বলল, “আমি প্রোগ্রামিংয়ের খেতা পুড়ি।”
অন্য-তিতুনি বলল, “ও!” তারপর থেমে গেল।
টোটন আবার কথা শুরু করল, বলল, “আম্মু, ফুপুর বাসার কাছেই একটা ফ্রায়েড চিকেনের দোকান আছে। যা মজা, তুমি চিন্তাও করতে পারবে না। বেসন দিয়ে মাখিয়ে ডুবা তেলে ভাজে। তেল চপচপ ফ্রায়েড চিকেন। ইয়াম ইয়াম।”
কথা শেষ করে টোটন মুখে লোল টেনে নিল। আব্বু বললেন, “ফ্রায়েড চিকেন একটা খাওয়ার জিনিস হলো?”
টোটন মহা উৎসাহে বলল, “বার্গারও পাওয়া যায়। আর পিতজা।”
টোটন খাওয়ার আলোচনাটা আরো খানিকক্ষণ চালিয়ে যেতে চাইছিল কিন্তু তখন রাস্তার মোড়ে ছোট একটা ভিড় চলে এলো এবং ড্রাইভার এমনভাবে হর্ন দিতে লাগল যে কারো আর কোনো কথা শোনার উপায় থাকল না।
আব্বু একটু বিরক্ত হয়ে ড্রাইভারকে বললেন, “এত জোরে হর্ন দেওয়ার কোনো দরকার আছে? দেখছেন না সামনে ভিড়।”
ড্রাইভার হর্ন থামানোর কোনো লক্ষণ দেখাল না, বলল, “এই মানুষগুলা এমনি এমনি সরবি মনে করেন? এরা সরবি না। হর্ন দিলেও সরবি না। দুই-একটারে চাপা দিলে যদি সরে।”
অন্য-তিতুনি বলল, “ভাইয়ার কম্পিউটার গেমের মতো।”
টোটন না শোনার ভান করে সামনে তাকিয়ে রইল। শেষ পর্যন্ত ভিড়টা পার হয়ে মাইক্রোবাসটা বড় রাস্তায় উঠে পড়ল এবং তখন হঠাৎ করে সবাই বুঝতে পারল এই ড্রাইভার একেবারে পাগলের মতো গাড়ি চালায়। আবু কয়েক মিনিট সহ্য করার চেষ্টা করলেন, তারপর বললেন, “ড্রাইভার সাহেব, করছেন কী? আস্তে গাড়ি চালান অ্যাক্সিডেন্ট হবে তো।”
ড্রাইভার গাড়ির স্পিড কমানোর কোনো নিশানা দেখাল না, গুলির মতো ছুটিয়ে নিতে নিতে বলল, “আমি মতি ড্রাইভার, সতের বছর থেকে গাড়ি চালাই, কুনোদিন এসকিডেন্ট হয় নাইক্কা।”
আব্বু ‘এসকিডেন্ট’ শব্দটাকে শুদ্ধ করার কোনো চেষ্টা করলেন না, বললেন, “আগে কখনো এসকিডেন্ট হয় নাই মানে না যে এখন হতে পারে না। আস্তে চালান।”
মতি ড্রাইভাই বলল, “আমি আস্তেই চালাবার লাগছি বস। আপনারা বাচ্চাকাচ্চা নিয়া উঠছেন তাই পুরা স্পিড এখনো দেই নাইক্কা।”
কথা বলতে বলতে সে বিপজ্জনকভাবে একটা ট্রাককে ওভারটেক করে সামনের দিক থেকে ছুটে আসা একটা বাসের মুখোমুখি হয়ে গেল, একেবারে কপাল জোরে মুখোমুখি অ্যাক্সিডেন্ট থেকে বের হয়ে রাস্তা থেকে ছিটকে বের হতে হতে আবার রাস্তায় চলে এলো। মতি ড্রাইভার হা হা করে হেসে বলল, “দেখলেন বস? হইচে এসকিডেন্ট? হইছে?”
আব্বু নিঃশ্বাস আটকে রেখে বললেন, “না হয় নাই। কিন্তু হতে পারত।”
“হবে নাইক্কা। কুনোদিন হয় নাই।”
মতি ড্রাইভার বিকট স্বরে হর্ন বাজাতে বাজাতে রাস্তা দিয়ে প্রায় উড়ে যেতে লাগল। বাস-ট্রাক ওভারটেক করে যখন খুশি রাস্তার অন্য পাশে যেতে থাকল এবং উল্টো দিক থেকে আসা গাড়িগুলোকে রীতিমতো ভয় দেখিয়ে রাস্তা থেকে নেমে পাশে সরে যেতে বাধ্য করতে লাগল। একটা ট্যাক্সিকে এভাবে রাস্তা থেকে নামিয়ে আনন্দে হা হা করে হাসতে হাসতে বলল, “বুঝলেন বস? আমারে গাড়ি চালান শিখাইছে আমার ওস্তাদ। ওস্তাদের নাম ছিল বুলন্দ খান।” মতি ড্রাইভার এই সময় স্টিয়ারিং থেকে হাত ছেড়ে কপাল ছুঁইয়ে তার ওস্ত দিকে সালাম জানিয়ে আবার শুরু করল, “ওস্তাদ ছিলেন কামেল মানুষ। বারো চাক্কার ট্রাক চালাইতেন, কুনো ঘুম ছাড়া একবার বাহার ঘণ্টার ট্রিপ দিছিলেন।”
বিপজ্জনকভাবে আরেকটা মাইক্রোবাসকে ওভারটেক করে সামনে থেকে আসা আরেকটা ট্রাকের পাশ দিয়ে বের হয়ে মতি ড্রাইভার আবার শুরু করল, “সেই ওস্তাদ বলত, বুঝলি মতি, গাড়ি চালানোর জন্যে লাগে দুইটা জিনিস। একটা হচ্ছে সাহস। কুনো ভয় পাবি না, সামনে দিয়ে দৈত্যের মতন ট্রাক আসতাছে? গাড়ি নিয়া সামনে দাঁড়াবি, সেই ট্রাক তোরে সাইড দিতে বাধ্য। সেই ট্রাকের বাবা তোরে সাইড দিব।”
আব্বু চোখ কপালে তুলে বললেন, “আপনার ওস্তাদ আপনাকে তাই শিখিয়েছে?”
“জে। একেবারে একশ ভাগ খাঁটি কথা। অন্য ড্রাইভার ভয় পায়, আমি পাই না। বুকের মাঝে ভয়-ডর থাকলে এই লাইনে আসা ঠিক না। ওস্তাদের জবান খাঁটি জবান।” বলে মতি ড্রাইভার আবার কপালে হাত দিয়ে ওস্তাদকে সালাম জানাল।
টোটন খুবই মনোযোগ দিয়ে ড্রাইভারের কথা শুনছিল, এবারে জিজ্ঞেস করল, “আরেকটা কী?”
“দুই নম্বর জিনিস হচ্ছে–”, হঠাৎ করে মতি ড্রাইভার থেমে গিয়ে রিয়ার ভিউ মিররে পিছনে তাকিয়ে বলল, “নাহ্, সেইটা এখন বলা যাবে না।”
“কেন বলা যাবে না?”
“তুমরা পুলাপান মানুষ, তুমাদের সামনে বলা ঠিক নাইক্কা।”
“কেন বলা ঠিক না বলেন।” টোটনের শোনার খুবই আগ্রহ।
মতি ড্রাইভার খুবই অনিচ্ছার ভঙ্গি করে বলল, “আরেকটা হচ্ছে বোতল।”
“বোতল?” টোটন অবাক হয়ে বলল, “কীসের বোতল?”
আব্বু টোটনকে একটা ধমক দিলেন, বললেন, “তুই চুপ করবি এখন?”
ড্রাইভার অনেকটা নিজের মনে বলল, “ট্রিপ দেওয়ার আগে আধা বোতল, ট্রিপের শেষে আধা বোতল, ব্যস কুনো ঝুট-ঝামেলা নাই।”
আব্বু খুবই বিরক্ত হয়ে বললেন, “আপনি কথা না বলে এখন ঠিক করে গাড়ি চালান।”
ড্রাইভার বলল, “জি বস। গাড়ি চালাই।” বলে গ্যাসের প্যাডালে চাপ দিয়ে মাইক্রোবাসের স্পিড আরো বাড়িয়ে ফেলল। গাড়ির সবাই একেবারে নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকে।
যেকোনো সময় যা কিছু ঘটে যেতে পারত কিন্তু কিছু ঘটল না। ঘণ্টা খানেক পর যখন ঢাকার কাছাকাছি পৌঁছেছে তখন হঠাৎ দেখা গেল সামনে গাড়িগুলো লাইন বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। আব্বু জিজ্ঞেস করলেন, “কী ব্যাপার? জ্যাম নাকি?”
মতি ড্রাইভার বলল, “জে না। ক্রসিং।” “রেল ক্রসিং?”
“জে বস।” বলে সামনের গাড়িগুলোর পিছনে থেমে না গিয়ে সে পাশের ফাঁকা লেন দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে। আব্বু ভয় পেয়ে বললেন, “কী হলো? কই যান?”
“ক্রসিং পার হই।”
“ক্রসিং পার হন মানে?”
“এই ট্রেন কখন আসবে কুনো ঠিক আছে? ঠিক নাইক্কা। উল্টা লেনে সামনে গিয়া রেললাইন ক্রস কইরা সামনে আবার ঠিক লেনে উইঠা যামু। আপনি খালি দেখেন।”
আব্বু বললেন, “সামনে রেল গেট ফেলে রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে না?”
“পুরাটা করে নাই। মাইক্রো যাওনের ফাঁক আছে।”
“ফাঁক আছে বলেই উল্টা রাস্তায় আপনি এখন রেললাইন ক্রস করবেন?”
আব্বু রীতিমতো চিৎকার করে বললেন, “থামান। গাড়ি থামান।”
ড্রাইভার আব্বকে সান্ত্বনা আর সাহস দেয়, “বস, এত ঘাবড়ান কীসের লাইগ্যা? কুনো ভয় নাইক্কা। আর এইখানে গাড়ি থামানুর উপায় আছে?” বলে সে মাইক্রোবাসটা একেবারে রেল গেটের কাছে এসে উল্টো লেন থেকে বাঁকা হয়ে রেললাইনের উপর উঠে পড়ল। সাথে সাথে দূর থেকে ট্রেনের প্রচণ্ড হুইসিলের শব্দ শোনা যায়, প্রচণ্ড গতিতে দৈত্যের মতো একটা ট্রেন আসছে। ট্রেনের হুইসিল শুনে এইবার মতি ড্রাইভার পর্যন্ত ঘাবড়ে যায়। ট্রেন লাইনটা সোজাসুজি পার না হয়ে কোনাকুনি পার হওয়ার চেষ্টা করছে বলেই কি না কে জানে মাইক্রোবাসটা শেষ মুহূর্তে রেললাইনের উপর আটকে গেল। ট্রেনের ইঞ্জিন বিকট শব্দে হুইসেল দিয়ে এগিয়ে আসছে, ভয়ে-আতঙ্কে গাড়ির ভেতরে সবাই চিৎকার করে উঠল। মতি ড্রাইভার পাগলের মতো শেষবার চেষ্টা করল, গ্যাস প্যাডেলে প্রাণপণে চাপ দিয়ে কয়েকবার চেষ্টা করার পর হঠাৎ গাড়িটা কোনোভাবে ছুটে এলো এবং একটা ঝটকা দিয়ে সেটা লাইন থেকে সরে যেতেই দৈত্যের মতো বিশাল ট্রেনটা প্রচণ্ড গুইসেল দিতে দিতে বাতাসের ঝাঁপটা দিয়ে গাড়িটার একেবারে গা ঘেঁষে বের হয়ে গেল।
মতি ড্রাইভার কোনোমতে গাড়িটাকে রাস্তার ওপর তুলে এবারে ঠিক লেনে ছুটে যেতে থাকে। আব্বু একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিলেন, কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “ড্রাইভার সাহেব, গাড়ি থামান।”
“কী বললেন বস? গাড়ি থামামু?”
“হ্যাঁ। গাড়ি থামান।”
ট্রেন ক্রসিংয়ের জন্যে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলোর পাশে দিয়ে ছুটে যেতে যেতে ড্রাইভার বলল, “কী জন্যে বস?”
আব্বু গর্জন করে বললেন, “বলছি গাড়ি থামান।”
মতি ড্রাইভার বলল, “কিছু তো হয় নাইক্কা।”
“কিছু হয়েছে কী হয় নাই আমি সেটা নিয়ে কথা বলছি না। গাড়ি থামান।”
আম্মুও এতক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছেন, কাঁপা গলায় বললেন, “গাড়ি থামান।”
টোটনও যোগ দিল, বলল, “থামান, গাড়ি থামান।”
শুধু অন্য তিতুনি কিছু বলল না। মতি ড্রাইভার নার্ভাসভাবে একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, “বস, গাড়ি তো এখন থামান যাবে নাইক্কা। দিরং হয়ি যাবি। আপনাদের নামানোর পর আরেকটা বড় ট্রিপ আছে কক্সবাজার। ঐ ট্রিপ তো মিস করা যাবি না। কাস্টমার খুব ত্যাড়া।”
আব্বু হুংকার দিয়ে বললেন, “আমি কিছু শুনতে চাই না। গাড়ি থামান, আমরা নেমে যাব।”
সামনের দিক থেকে আসা আরেকটা ট্রাককে খুবই বিপজ্জনকভাবে পাশ কাটিয়ে গিয়ে মতি ড্রাইভার মুখ শক্ত করে বলল, “রাগ করেন ক্যান বস। আমি বলছি গাড়ি থামান যাবি না।”
মতি ড্রাইভার কথা শেষ করার আগেই গাড়ির ইঞ্জিন একটা বিদঘুঁটে শব্দ করল, গাড়িটা একটা ঝাঁকুনি দিল, তারপর কেমন যেন কাশির মতো শব্দ করতে করতে রাস্তার পাশে থেমে গেল। কেন হঠাৎ করে গাড়ির ইঞ্জিনটা বন্ধ হয়ে গেল সেটা অন্য-তিতুনি ছাড়া আর কেউ জানল না। একটু আগে ট্রেন লাইনে আটকে যাওয়া মাইক্রোবাসটা কেমন করে শেষ মুহূর্তে ছুটে এসেছে সেটাও কেউ জানে না। পুরো রাস্তার বিপজ্জনক ওভারটেকগুলোতে প্রত্যেকবার কেমন করে নিরাপদে পার হয়ে এসেছে সেটাও অন্য-তিতুনি ছাড়া আর কেউ জানে না।
গাড়িটা থেমে যাওয়াতে মতি ড্রাইভার খুবই অবাক হলো, দাঁতে দাঁত ঘষে চাপা গলায় একটা গালি দিয়ে বলল, “আরে, একি মুসিবত! মাত্র সার্ভিসিং করছি, ধোলাইখাল থেকে রিকন্ডিশন ইঞ্জিন ফিট করছি, এখন রাস্তার মাঝে গাড়ি বন হইল, ব্যাপারটা কী?”
ব্যাপারটা কী সেটা নিয়ে আব্বু-আম্মু কিংবা টোটনের কোনো আগ্রহ নেই। অন্য-তিতুনি যেহেতু এটা ঘটিয়েছে তারও কোনো আগ্রহ নেই। আব্বু গাড়ির দরজা খুলে সবাইকে নিয়ে নেমে পড়লেন। মেঘস্বরে ড্রাইভারকে ডেকে বললেন, “ড্রাইভার সাহেব, গাড়ি থেকে নামেন। আপনার সাথে কথা আছে।”
মতি ড্রাইভার গাড়ি থেকে নামার কোনো আগ্রহ দেখাল না। তার সিটে বসে কিছুক্ষণ খুটখাট করে আবার গাড়ি স্টার্ট করার চেষ্টা করল আর সত্যি সত্যি হঠাৎ ইঞ্জিনটা স্টার্ট নিয়ে নেয়। ড্রাইভার গাড়ির ভেতরে বসে আনন্দের মতো শব্দ করে বলল, “উঠেন গাড়িতে। গাড়ি স্টার্ট নিছে।”
আব্বু বললেন, “রাখেন আপনার গাড়ি। আগে নিচে নেমে আসেন।”
মতি ড্রাইভার গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ না করেই দরজা খুলে খুবই অনিচ্ছার সাথে তার ড্রাইভারের সিট থেকে নিচে নেমে এলো। মুখে একটা বিরক্তির ভাব ফুটিয়ে রেখে সে কাছে এসে রুক্ষ গলায় বলল, “কী হইছে বস? আপনার সমিস্যা কী?”
“আমার কোনোই সমস্যা নেই। আমরা আপনার গাড়িতে যাব। আমাদের ব্যাগগুলো নামিয়ে দেন।”
আব্বুর কথা শুনে সে খুবই অবাক হয়েছে এই রকম ভান করল, তারপর কী একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। হঠাৎ করে মনে হলো তার মাথাটা ঘুরে উঠেছে, হাত বাড়িয়ে মাইক্রোবাসটাকে ধরে সে তাল সামলানোর চেষ্টা করে। তার চোখগুলো ঘুরতে থাকে, দেখে মনে হয় সে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে।
আলু ভয় পেয়ে বললেন, “কী হয়েছে? আরে কী হয়েছে আপনার?”
ড্রাইভার কোনো কথা বলল না, তারপর হঠাৎ কেমন জানি জেগে উঠে পিটপিট করে সবার দিকে তাকাল। আব্বু বললেন, “ঠিক আছেন আপনি?”
“জে বস ঠিক আছি।” মতি ড্রাইভার হাত দিয়ে তার কপালটা মুছে বলল, “হঠাৎ মাথাটা কেমন জানি ঘুরে উঠল। জে বস আপনি কী যেন বলছিলেন?”
“আমি বলেছি যে আমরা আপনার গাড়ি করে যাব না। আমাদের ব্যাগগুলো নামিয়ে দেন।”
ড্রাইভার কেমন জানি শূন্য দৃষ্টিতে আব্বুর দিকে তাকিয়ে রইল, মনে হলো আব্বুর কথা সে কিছুই শুনছে না। আব্বু বললেন, “কী হয়েছে আপনার?
“ভুলে গেছি।”
“কী ভুলে গেছেন?”
“গাড়ি চালানো।”
আব্বু অবাক হয়ে বললেন, “গাড়ি চালানো ভুলে গেছেন মানে?”
মতি ড্রাইভার আব্বুর কথার উত্তর না দিয়ে হেঁটে হেঁটে ড্রাইভারের দরজার কাছে দাঁড়াল, কেমন যেন ভয়ে ভয়ে ভেতরে তাকাল। আব্বু এবং সাথে অন্য সবাই তার পিছু পিছু এগিয়ে গেল। ড্রাইভার আব্বুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে কেমুন করে?”
আব্বু কয়েক মুহূর্ত মতি ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কেন চাবি দিয়ে?”
“চাবি কই?” বলে সে উপরে-নিচে তাকাতে লাগল। গাড়ির চাবি কোথায় থাকে সে আর জানে না।
আব্বু বললেন, “ঐ যে, স্টিয়ারিংয়ের নিচে।”
“ইস্টিয়ারিং? ইস্টিয়ারিং কী?”
আব্বু অবাক হয়ে বললেন, “আপনি সত্যিই স্টিয়ারিং হুইল কি সেইটা ভুলে গেছেন?”
“জে বস। সব ভুলে গেছি।” বলে সে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল, জিজ্ঞেস করল, “কোনটা ইস্টিয়ারিং?”
আবু স্টিয়ারিং হুইলটা দেখালেন। মতি ড্রাইভার খুব সাবধানে আঙুল দিয়ে সেটা একবার ছুঁয়ে দেখল। তারপর তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে নিল, বলল, “কী আচানক।”
আম্মু বললেন, “আপনার এখন কোথাও বসে মাথায় একটু ঠাণ্ডা পানি ঢালা দরকার। মনে হয় আপনার মাথা গরম হয়ে গেছে।”
মতি ড্রাইভার বলল, “না ম্যাডাম আমার মাথা গরম হয় নাইক্কা, আমি সব ভুলে গেছি।”
“আর কী কী ভুলেছেন? স্ট্রোক হলে মানুষ সবকিছু ভুলে যায়।”
“আর কিছু ভুলি নাইক্কা। সব মনে আছে।”
“আপনার নাম? ঠিকানা? টেলিফোন নম্বর?”
“মনে আছে। সব মনে আছে।”
“শুধু গাড়ি চালানো ভুলে গেছেন? এটা কেমন করে হতে পারে?”
মতি ড্রাইভার একবার মাথা চুলকাল, একবার পেট চুলকাল, তারপর অনেকক্ষণ ধরে বগল চুলকাল, তারপর বলল, “কিছু মনে নাইক্কা। কিছু মনে নাইক্কা।”
সে মাইক্রোবাসটা ঘুরে ঘুরে দেখে, ড্রাইভারের দরজা খুলে কেমন যেন হাঁ করে গাড়ির ড্যাশবোর্ডের দিকে তাকিয়ে থাকে। খুব সাবধানে একবার গিয়ারটা ছুঁয়ে দেখে, নিচে গ্যাস প্যাডেল আর ব্রেকের দিকে তাকায়, তারপর আবার প্রথমে মাথা, তারপর পেট এবং শেষে বগল চুলকাতে থাকে।
আব্বু বললেন, “ইঞ্জিনটা বন্ধ করে রাখেন, শুধু শুধু গ্যাস খরচ হচ্ছে।”
“আমি তো পারমু না। বললাম না ভুলে গেছি।”
আব্বু গাড়ির চাবিটা দেখিয়ে বললেন, “ঐটা ঘোরান। ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাবে।”
মতি ড্রাইভার খুব সাবধানে চাবি ঘুরিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করল, তারপর চাবিটা বের করে কেমন জানি অবাক হয়ে গাড়ির চাবিটার দিকে তাকিয়ে রইল।
আব্বু বললেন, “ড্রাইভার সাহেব, আপনাকে একটা কথা বলি?”
“জে বস। বলেন।”
“এইটা মনে হয় ভালোই হয়েছে যে আপনি গাড়ি চালানো ভুলে গেছেন। এটা কেমন করে সম্ভব আমি জানি না, কিন্তু যেহেতু দেখছি এটা ঘটেছে, মেনে নেন। আপনার জন্যে ভালো, প্যাসেঞ্জারদের জন্য ভালো। আপনি যেভাবে গাড়ি চালান সেটা খুবই ডেঞ্জারাস। আপনি নিজে মারা যাবেন, প্যাসেঞ্জারদের মারবেন। বুঝেছেন?”
“জে বস। বুঝেছি।”
“আপনি অন্য কিছু করেন।”
“অন্য কিছু?”
আব্বু বললেন, “হ্যাঁ। ব্যবসাপাতি। কন্ট্রাক্টরি। আপনার স্বাস্থ্য ভালো আছে, সিকিউরিটির চাকরি নিতে পারেন। বুঝেছেন?”
মতি ড্রাইভার মাথা নাড়ল, বলল, “বুঝেছি। কিন্তু—”
“কিন্তু কী?”
“আমার ওস্তাদ বুলবাল খান দিলে খুবই দাগা পাবে। আমি তার এক নম্বর ছাত্র ছিলাম।”
ওস্তাদ বুলবাল খানের এক নম্বর ছাত্র মতি ড্রাইভার মুখটা ভোঁতা করে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে চুল, পেট আর বগল শেষ করে এবারে তার কান চুলকাতে লাগল।
.
গাড়ি থেকে সবার ব্যাগ নামিয়ে একটু হেঁটে সামনে একটা গ্যাস স্টেশন পাওয়া গেল। আব্বু সবাইকে দাঁড় করিয়ে একটা ট্যাক্সি ক্যাব খুঁজতে গেলেন। ঢাকা শহরের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে, এখন খুব সমস্যা হওয়ার কথা না।
এক পাশে দাঁড়িয়ে লাইন বেঁধে গাড়িগুলোকে সি.এন.জি. নেয়া দেখতে দেখতে টোটন আবার তার কথা শুরু করল। যেহেতু তিতুনিকে সে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে না তাই আম্মুকে বলল, “আম্মু, মাইক্রোবাসের ড্রাইভারটা কিন্তু খুবই এক্সপার্ট ড্রাইভার।”
আম্মু ভুরু কুঁচকে বললেন, “এক্সপার্ট?”
“হ্যাঁ। রেল ক্রসিংয়ে মাইক্রোটাকে কেমন করে ছুটিয়ে এনেছ দেখোনি?”
“ঐখানে গিয়ে আটকাল কেন সেটা দেখবি না?”
টোটন সেটাকে বেশি গুরুত্ব দিল না, বলল, “একেবারে কম্পিউটার গেমের মতো গাড়ি চালায়। হুশহাশ করে ওভারটেক করে।”
অন্য-তিতুনি বলল, “খালি একটা পার্থক্য, কম্পিউটার গেমে অনেকগুলো লাইফ থাকে। এইখানে লাইফ খালি একটা।”
একশ ভাগ সত্যি কথাটার কোনো ঠিক উত্তর দিতে পারল না বলে টোটন খুবই বিরক্ত হয়ে অন্য পাশে সরে গিয়ে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। গ্যাস নেয়ার সময় প্যাসেঞ্জারদের গাড়ি থেকে নামতে হয়, তারাও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের কাছাকাছি খুব ফিটফাট একজন মানুষ, তার ধবধবে সাদা শার্ট, কুচকুচে কালো প্যান্ট, চোখে চশমা, মুখে সিগারেট। মানুষটার মাথায় চুল খুব বেশি নেই কিন্তু যেটুকু আছে তার জন্যে নিশ্চয়ই অনেক মায়া, তাই পকেট থেকে সবুজ রঙের একটা চিরুনি বের করে একবার চুলগুলো আঁচড়ে নিল।
গ্যাস স্টেশনে বেশ কয়েকজন ভিখারি ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করছে। ছোট ছোট কয়েকটা ছেলে-মেয়ে সিদ্ধ ডিম, পপ কর্ন আর আচার বিক্রি করার চেষ্টা করছে। একটা ছোট মেয়ে তার সিদ্ধ ডিমের ঝুড়ি নিয়ে ফিটফাট মানুষটার কাছে গিয়ে সেগুলো বিক্রি করার চেষ্টা করল। কী কারণ জানা নেই মানুষটা খুবই বিরক্ত হয়ে একেবারে খেঁকিয়ে উঠল, মেয়েটা তারপরেও হাল ছাড়ল না আবার করুণ মুখ করে কিছু একটা বলল। ফিটফাট মানুষটা এবারে রেগে উঠে মেয়েটাকে একটা ধাক্কা মেরে বসে, এর জন্যে মেয়েটা প্রস্তুত ছিল না, তাই একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। ঝুড়ি থেকে বের হয়ে ডিমগুলো ছিটকে পড়ে গড়িয়ে যেতে থাকে। কিছু একেবারে থেঁতলে গেল।
দৃশ্যটা দেখে টোটন মনে হয় একটু আমোদ পেল, তাই ভালো করে দেখার জন্যে আরো কাছে এগিয়ে গেল। তিতুনিও টোটনের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। যেন কিছুই হয়নি এ রকম মুখের ভাব করে ছোট মেয়েটা তার গড়িয়ে যাওয়া ডিমগুলো তুলতে থাকে। ঘেঁতলে যাওয়া ডিমটা বিক্রি করতে পারবে কি না সেটা নিয়ে তার ভেতরে একটু দুর্ভাবনা হয় কিন্তু সেটা নিয়ে সে বেশি মাথা ঘামাল না। তার এই ছোট জীবনে সে প্রতিদিন এর থেকে অনেক বড় বড় বিপদ পার করে। তবে সে নিশ্চয়ই খুবই অবাক হতো যদি জানতে পারত ঝুড়ির ভেতরে এ্যাতলানো ডিমগুলো রাখতেই সেগুলো ম্যাজিকের মতো ঠিক হয়ে যাচ্ছে।
অন্য-তিতুনি নিচু গলায় টোটনকে বলল, “কাজটা ঠিক হলো না।”
“কোন কাজটা?”
“এই যে মেয়েটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। এখন মানুষটার ঝামেলা হবে।”
টোটন ভুরু কুঁচকে বলল, “কী ঝামেলা?”
অন্য-তিতুনি গ্যাস স্টেশনের ছাউনির উপর বসে থাকা কয়েকটা কাককে দেখিয়ে বলল, “ঐ কাকগুলো দেখেছ?”
“কী হয়েছে কাকের?”
“এরা পুরো ব্যাপারটা দেখে খুব রেগে গেছে মনে হয়।”
কথাটা শুনে টোটন এমনভাবে তাকাল যেন অন্য-তিতুনির মাথা পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেছে। সে মুখে একটা বিদ্রুপের হাসি এনে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই সত্যি সত্যি একটা কাক ছাউনি থেকে উড়ে এসে ঠিক ফিটফাট মানুষের মাথায় বাথরুম করে দিল। ছোট একটা কাকের পেটে এত বিপুল পরিমাণ বাথরুম থাকতে পারে কে জানত! কারণ দেখা গেল কাকের বাথরুম তার মাথা, চোখ, গাল বেয়ে ধবধবে সাদা শার্ট পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে।
হতচকিত মানুষটা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে একবার নিজের দিকে তারপর মাথা উঁচু করে কাকটার দিকে তাকাল। আর ঠিক তখন অন্য কাকগুলো কা কা করে উড়ে এসে মানুষটার মাথা, ঘাড়, মুখে ঠোকরাতে শুরু করে। মানুষটা দুই হাতে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করে, কিন্তু কাক খুবই ভয়ংকর পাখি, দল বেঁধে থাকলে তাদেরকে ঠেকানো সোজা কথা নয়। মানুষটা নিজেকে বাঁচানোর জন্যে দৌড়ে তার গাড়িটাতে ওঠার চেষ্টা করে কিন্তু তার আগেই সে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল।
কাকগুলো যে রকম হঠাৎ করে এসেছিল ঠিক সে রকম হঠাৎ করে উড়ে আবার তাদের ছাউনির উপর ফিরে গেল। সেখানে বসে খুবই নিরাসক্তভাবে কাকগুলো ফিটফাট মানুষটাকে দেখতে থাকে।
কাকদের এই ঝটিকা আক্রমণ দেখে বেশ কিছু মানুষ ছুটে আসে। মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা মানুষটাকে টেনে দাঁড় করায়। চশমাটা ভেঙে গেছে, নাকটা মনে হয় থেঁতলে গেছে। মাথায়, মুখে, ঘাড়ে কাকের ধারালো ঠোঁটের আঘাতের চিহ্ন। বেশিরভাগ মানুষ শুধু কাকের ঝটিকা আক্রমণটুকু দেখেছে, মেয়েটাকে ধাক্কা দিয়ে ঢেলে দেয়ার আগের অংশটুকু দেখেনি, তাই তাদের সমবেদনাটা এই মানুষটার জন্যে, তারা হভাগা কাকগুলোকে গালি দিতে দিতে তাকে ঠিকঠাক করার চেষ্টা করতে থাকে।
ছোট মেয়েটা তার সবগুলো সিদ্ধ ডিম ঝুড়িতে ভরে সোজা হয়ে দাঁড়াল। ঝুড়িটা দুই হাতে বুকে জড়িয়ে ধরে মানুষটাকে দেখল, তার চোখে-মুখে একধরনের ভয়ের ছাপ নেমে আসে। কাকদের এই ঝটিকা আক্রমণের জন্যে তাকেই দায়ী করে তার উপর আরো বড় কোনো শাস্তি নেমে আসবে কি না কে জানে। সে দ্রুত সরে যেতে যেতে একবার টোটন আর অন্য-তিতুনির দিকে তাকাল। অন্য তিতুনির চোখের দিকে তাকিয়ে সে কী দেখল কে জানে, বিড়বিড় করে নিচু গলায় তাকে বলল, “আল্লাহর মাইর চিন্তার বাইর।”
তারপর সে ছুটে পালিয়ে যেতে থাকে। ঠিক তখন আব্বু একটা ক্যাব নিয়ে হাজির হলেন। বললেন, “চলো, সবাই ঝটপট উঠে পড়ো।”