বনগমনাভিলাষী ধৃতরাষ্ট্রের প্রজাসম্ভাষণ
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “তাত! আপনি যেরূপ কহিলেন, আমি তদনুরূপ কাৰ্য্যেরই অনুষ্ঠান করিব। এক্ষণে আপনি পুনরায় আমাকে কিঞ্চিৎ উপদেশ প্রদান করুন। পিতামহ ভীষ্ম স্বর্গগমন করিয়াছেন, মহাত্মা বাসুদেব এ স্থানে উপস্থিত নাই এবং মহামতি বিদুর ও সঞ্জয়ও আপনার সহিত বনে গমন করিবেন। সুতরাং আপনার বনগমনের পর আর কে আমাকে উপদেশ প্রদান করিবে? আপনি আমার হিতৈষী হইয়া আজ আমাকে যে উপদেশ প্রদান করিবেন, আমি অবশ্যই তদনুসারে কাৰ্য্য করিব। আপনি সুখী হউন।”
ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির এই কথা কহিলে, রাজা ধৃতরাষ্ট্র তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “বৎস! আমার অত্যন্ত পরিশ্রম হইয়াছে, অতএব তুমি নিবৃত্ত হও। আর আমি বাক্যব্যয় করিতে পারি না।” অন্ধরাজ যুধিষ্ঠিরকে এই কথা কহিয়া গান্ধারীর ভবনে প্রবেশপূৰ্ব্বক আসনে সমাসীন হইলেন। তখন ধর্ম্মচারিণী দেবী গান্ধারী সেই প্রজাপতিতুল্য ভর্ত্তাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “নাথ! মহর্ষি বেদব্যাস আপনাকে বনগমনে আজ্ঞা করিয়াছেন। ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরও ঐ বিষয়ে সম্মত হইয়াছেন। এক্ষণে আপনি কোন দিন বনে গমন করিবেন, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “গান্ধারি! আমি মহর্ষি বেদব্যাসকর্ত্তৃক অনুজ্ঞাত হইয়াছি; মহাত্মা যুধিষ্ঠিরও আমার বনগমনবিষয়ে সম্মত হইয়াছেন। এক্ষণে আমি প্রজাগণকে এই স্থানে আনয়ন করাইয়া দ্যূতক্রীড়ানিরত মৃতপুত্রদিগের উদ্দেশে কিঞ্চিৎ ধনদান করিয়া অচিরাৎ অরণ্যে গমন করিব।”
মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারীকে এই কথা কহিয়া যুধিষ্ঠিরের নিকট আপনার অভিপ্রায় প্রকাশ করিলে ধৰ্ম্মরাজ অচিরাৎ তাঁহার আদেশানুসারে কুরুজাঙ্গলস্থ প্রজাসমুদয়কে আহ্বান করিলেন। তখন কুরুজাঙ্গলবাসী যাবতীয় ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র মহাহ্লাদিত হইয়া রাজভবনে আগমন করিতে লাগিলেন। উহারা সমাগত হইলে নরপতি ধৃতরাষ্ট্র অন্তঃপুর হইতে বহির্গমনপূর্ব্বক সেই সমুদয় প্রজা ও অন্যান্য বন্ধুবান্ধবগণকে সমবেত অবগত হইয়া তাঁহাদিগকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে মহামান্য ব্যক্তিগণ! আপনারা চিরকাল কৌরবদিগের সহিত একত্র বাস করিয়াছেন। আপনাদিগের বিলক্ষণ সৌহার্দ্য জন্মিয়াছিল। আপনারা কৌরবদিগের পরমহিতৈষী; কৌরবগণও সতত আপনাদের হিতসাধনে যত্নবান হইয়া থাকেন। এক্ষণে আমি আপনাদিগের নিকট যাহা প্রার্থনা করিতেছি, আপনাদিগকে অবিচারিতচিত্তে তাহাতে সম্মত হইতে হইবে।
“আমি মহর্ষি বেদব্যাস ও কুন্তীতনয় যুধিষ্ঠিরের অনুমতি অনুসারে গান্ধারীর সহিত বনগমন করিতে প্রস্তুত হইয়াছি। এক্ষণে আপনারা আমাকে অনুজ্ঞা প্রদান করুন। আমাদিগের সহিত আপনাদিগের যেরূপ চিরসৌহার্দ্য আছে, বোধ হয় অন্য দেশস্থ নরপতিদিগের সহিত সেরূপ নাই। এক্ষণে আমি ও গান্ধারী আমরা উভয়েই একে বৃদ্ধ হইয়াছি তাহাতে আবার আমাদের পুত্ৰসমুদয় বিনষ্ট হইয়াছে; বিশেষতঃ আমরা অনেক দিন উপবাস করিয়া অত্যন্ত কৃশ হইয়াছি, সুতরাং এ সময়ে বনগমন করাই আমাদের শ্রেয়ঃ। যুধিষ্ঠিরের রাজ্যে আমার যথেষ্ট সুখভোগ হইয়াছে। বোধ হয়, দুর্য্যোধনের অধিকার সময়ে আমার এরূপ সুখভোগ হয় নাই। যাহা হউক, আমি একে জন্মান্ধ, তাহাতে আবার বৃদ্ধ ও পুত্র-পৌত্রবিহীন হইয়াছি, সুতরাং এক্ষণে বনগমন ভিন্ন আর আমার শ্ৰেয়োলাভের উপায়ান্তর নাই। অতএব আপনারা আমাকে বনগমনে অনুমতি প্রদান করুন।”
অন্ধরাজ এই কথা কহিলে, কুরুজাঙ্গলবাসী প্রজাসমুদয় বাম্পাকুলনয়নে গদগদস্বরে রোদন করিতে লাগিল, কেহই কিছুমাত্র উত্তর প্রদান করিল না।