একটু থেমে ঘনাদা বললেন, কিন্তু বলা আর হল না। ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠল। রিসিভার তুলে দুবার শুধু হ্যাঁ বলে জবাব দিয়ে নুটসন আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আর আমার বাঁচার উপায় নেই।
উপায় নেই?নুটসনের কথায় সত্যিই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে, কী?
হঠাৎ ঝড়ে পড়ানো গাছের মতো একেবারে ভেঙে পড়ে ফ্যাকাশে মুখে নুটসন বললেন, ওরা এসে গেছে। নীচে হোটেলের কাউন্টারে এসে আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়ে আমার অনুমতির অপেক্ষায় বসে আছে।
আপনার সঙ্গে দেখা করবার অনুমতি চেয়ে? আমি যেমন অবাক তেমনই নুটসনের ওপর কিছুটা রেগেই বললাম, আপনার সঙ্গে দেখা করবার অনুমতি ওরা চাইবে কী বলে? আপনার আসল নকল কোনও নামই কি ওরা জানে? ওদের সঙ্গে আপনি যখন রহস্য-সংকেতের কাগজ নিয়ে দেখা করতে যান তখন তো তাতে নামটাম নয়, শুধু আপনার দেখা করবার পাস-এর একটা নম্বর দেওয়া ছিল।
হ্যাঁ, নামটাম নয়, শুধু তাই ছিল, হতাশভাবে বললেন নুটসন, তাই ওরা এখানে এসে দারুণ চালাকি করেছে। নামটাম বলেনি। শুধু আমার চেহারার বর্ণনা দিয়ে বলেছে যে, এই চেহারার একজন ভদ্রলোক খুব সম্ভব এই হোটেল থেকেই আজ সকালে তাদের সঙ্গে একটা বিশেষ কারণে দেখা করতে যান। তিনি যদি এই হোটেলেরই বোর্ডার হন তা হলে তাঁর নিজেরই বিশেষ দরকারে এখনই তাঁর দেখা পাওয়া অত্যন্ত দরকার।
যেভাবে কথাগুলো বলা হয়েছে তাতে সন্দেহ করবার এমন কিছু নেই। হোটেলের কর্তারা তাই সরল বিশ্বাসে চেহারার বর্ণনা থেকে তাঁর নামটা বুঝে নিয়ে এইমাত্র ফোনে তাঁর কাছে দুজন দর্শনপ্রার্থীকে পাঠাবার অনুমতি চেয়েছে।
বুঝলাম। গম্ভীর হয়েই আবার বলেছি, আপনি কী বলেছেন তাতে? আমি—আমি— হতাশ গলায় নুটসন বলেছেন, কী আর বলতে পারি আমি? ওদের লবিতে অপেক্ষা করতে বলে এখনই যাচ্ছি বলে জানিয়েছি।
একটু থেমে নিজের রঙ করা লালচে চুলগুলো মুঠো করে যেন ছেঁড়ার চেষ্টা করে নুটসন পাগলের মতো বললেন, এখন—এখন আমার এই হোটেলের জানলা থেকে নীচে ঝাঁপ দিয়ে মরা ছাড়া আর কিছু করবার নেই।
থামুন, রীতিমত কড়া গলায় ধমক দিয়ে এবার বললাম, আপনার কাণ্ড দেখে আমি অবাক হচ্ছি। কারবারি দুনিয়াকে শুধু বুদ্ধির প্যাঁচে যে নাকানিচোবানি খাওয়ায়, আপনি যে সেই হিসেবের ভোজবাজির জাদুকর, একথা আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না। শুনুন, হাত-পা ছেড়ে চোখে অন্ধকার দেখার মতো কিছু হয়নি। যা বলছি শুধু তাই করুন এখন। আপনি নিজে ওদের সঙ্গে দেখা করতে যাবেন না। তার বদলে ওদেরই এখানে পাঠিয়ে দিতে বলুন আপনার হোটেলের কর্তাদের। আর
ওদের এখানে পাঠিয়ে দিতে বলব? আঁতকে উঠলেন নুটসন। তারপর তারপর—বাঁচবার কোনও উপায় যে আর
হাঁ, হ্যাঁ, থাকবে। নুটসনকে আশ্বাস দিয়ে বললাম, আপনার কোনও ভাবনা নেই। যা-যা বলছি, শুধু তা-ই করুন। ওরা দুজনে এখানে পৌঁছবার পর যেন অত্যন্ত খুশি হয়ে ওদের সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়ে বলবেন, ভাল, ভাল। ভারতীয় জ্যোতিষের গণনা তা হলে শেষ হয়েছে। ওরা কিছু বলবার আগেই অধীর আগ্রহে আবার বলবেন, বলুন, বলুন, গণনায় শেষ পর্যন্ত কী জানা গিয়েছে? আমি এখনই আমার কর্তাদের জানিয়ে দেব।
নিজেরা জ্যোতিষ গণনার বিষয়ে কিছু বলতে না পেরে আপনার কর্তারা আবার কারা তা ওরা জানতে চাইবে না নিশ্চয়। আপাতত আপনার নাম-ঠিকানাটা জানতে পারাই যথেষ্ট লাভ মনে করে আবোলতাবোল কিছু বলে ওরা বিদায় নেবে নিশ্চয়ই।
কিন্তু তারপর? নুটসন হতাশভাবে জিজ্ঞেস করলেন, তারপর ওরা কি লকনেসের জলে হাত-পা ধুয়ে ব্যাপারটায় দাঁড়ি টেনে চলে যাবে নিজেদের ধান্দায়?
না, তা যাবে না। গম্ভীরভাবেই বললাম, তারপরেই বড় খেলা আরম্ভ বলতে পারেন। কিন্তু আপাতত এই প্রথম ফাঁড়াটা কাটিয়ে উঠুন তো! নিন, ফোন করুন নীচের লবিতে। আমি ততক্ষণ এদিক-ওদিক একটু ঘুরে দেখি। কামরার ওধারে ওই বিরাট ওয়ার্ডরোবের ভেতরেই গিয়ে লুকোচ্ছি।
ওয়ার্ডরোবের ভেতরে!নুটসন বেশ চিন্তিতভাবে বললেন, কিন্তু ওখানে যদি–
না, নুটসনকে আশ্বাস দিয়ে একটু হেসে বললাম, ওখানে ওরা খোঁজাখুঁজি করবে। আর তা ছাড়া, ওয়ার্ডরোবের ভেতরে থাকা আমার একরকম অভ্যাসই হয়ে যাচ্ছে।
নুটসনের স্যুইটের এদিকে-ওদিকে একটু ঘুরে যা দেখবার দেখে নিয়ে বিরাট ওয়ার্ডরোবটায় গিয়ে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করার কিছু পরেই নুটসনের দুই দর্শনপ্রার্থীকে জ্যানিটর এই স্যুইটে পৌঁছে দিল।
প্রথম দিকে যেমনভাবে বলে দিয়েছিলাম সেই মতোই আলাপ করে নুটসন তার দুই দুশমনকে বেশ একটু বেকায়দাতেই ফেলেছিল, কিন্তু তারপরই প্রসঙ্গটা বদলে তারা যে বেয়াড়া প্রশ্ন করে বসল, অপ্রস্তুত নুটসনের তাতে নিশ্চয় হাত-পা ঠাণ্ডা হবার উপক্রম হলেও আমি সেইরকম কিছুর জন্য তৈরি হয়েই ছিলাম।
নুটসনের মুখে আমার শেখানো প্রশ্ন ক-টার জবাব দিতে বেশ খানিক বিব্রত হয়ে হঠাৎ তারা ফাঁদের আসল ফাঁসটাই টেনে বসল।
কিছু যদি মনে করেন, শুঁটকো ডুগান তার প্যাঁচালো বুদ্ধিতে কথাগুলো শানিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলে, আপনার পাসপোর্টটা যদি একবার একটু দেখান।
পাসপোর্ট? নুটসনের হতভম্ব গলায় বিস্ময়ের সঙ্গে আতঙ্কটাও আর গোপন রইল না। পাসপোর্ট কেন?
না, অন্য কিছু নয়, শুঁটকো ডুগান আশ্বাস দিয়ে বললে, ওই জ্যোতিষের গণনার জন্যে আপনার পাসপোর্টের ক-টা নম্বর নাকি দরকার। তা পাসপোর্টটা দেখাতে আপনার আপত্তি কিছু–
ডুগানের কথা আর শেষ হল না। নুটসনের মুখে যে আতঙ্ক খানিক আগে থেকে ফুটে উঠেছে, সেই আতঙ্কেরই গাঢ় ছায়া তখন তার আর কার্ভালোরও মুখের ওপর।
দু-তিন সেকেন্ড কান খাড়া করে স্থির হয়ে বসে তারা লাফ দিয়ে উঠে সুইটের বাইরে এক জানলার ধার থেকে নীচে নেমে যাওয়া ফায়ার এসকেপের দিকে ছুটে গেল।
হ্যাঁ, সমস্ত হোটেলে তখন প্রচণ্ড শব্দে ফায়ার এলার্ম মানে আগুন লাগলে তা থেকে পালাবার জন্য হুঁশিয়ারির সাইরেন বাজছে।
গোলমেলে কিছু অবস্থা দেখা দিলে তা থেকে রক্ষা পাওয়ার এই ফন্দি এঁটে আমি আগেই বৈদ্যুতিক তার-টার নেড়েচেড়ে তবেই ওয়ার্ডরোবে ঢুকেছিলাম।
ফায়ার অ্যালার্ম বাজবার পর সমস্ত হোটেলে রীতিমত হুলুস্থুলু যে পড়ে গেছল তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। প্রথম হইচই থামবার পর খোঁজাখুঁজি করে অবশ্য এরকম সাইরেন বাজবার কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে বৈদ্যুতিক যোগাযোগের ত্রুটিতে এরকম ভুল হুঁশিয়ারি কখনও কখনও হয় বলেই এটাকে সন্দেহজনক কিছু বলে কেউ মনে করেনি।
হোটেলের অন্য বোর্ডারদের সঙ্গে নীচের ফাঁকা জায়গায় নেমে তাদের ভিড়ের ভেতর থেকে লুকিয়ে নুটসন, ডুগান আর কার্ভালোর ওপর আমি নজর রাখতে যতটা সম্ভব কাছাকাছিই ছিলাম।
সেদিনকার মতো নুটসনের কাছে বিদায় নিয়ে যাওয়ার সময় শেষ কথা তারা যা বলে গেল, সেইটি শোনার অপেক্ষাতেই অবশ্য আমি ছিলাম।
হোটেলের এই গোলমালে সেদিনকার মত চলে যাওয়া উচিত মনে করলেও তার পরের দিনই নুটসনের পাসপোর্টটা দেখতে আসবে বলে জানিয়ে গেল।
আগুন লাগার মিথ্যে হুঁশিয়ারি সাইরেন নিয়ে হোটেলের শোরগোল ক্রমশ থেমে যাবার পর নুটসন তার স্যুইটে ফিরে গেলে সেখানে তার সঙ্গে দেখা করলাম।
তার অবস্থা তখন প্রায় আধা-পাগলের মতো। একটা মাঝারি সাইজের স্যুটকেসে নেহাত দরকারি কিছু জিনিস খুঁজেপেতে নেবার জন্য সমস্ত কামরায় এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতে করতে আমায় দেখতে পেয়ে খোঁজাখুঁজি থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে প্রায় কাঁদোকাঁদো গলায় বললেন, কী হল, দেখলেন তো? এখন এক্ষুনি এখান থেকে না। পালালে নয়।
তার কথায় সায় দিয়ে বললাম, তা তো নয়ই। আর এইটেই তো চেয়েছিলাম।
চমকে আমার দিকে চেয়ে অবিশ্বাসের সুরে নুটসন বললেন, চেয়েছিলেন মানে? আজ রাত্রে এই অবস্থায় তাড়া-খাওয়া চোরের মতো আমি যাতে পালাই, তাই আপনি চেয়েছিলেন? ওই ভুল সাইরেন বাজায় তা হলে আপনি খুশি?
নিজেই যার ব্যবস্থা করেছি, সরল ভাবেই বললাম, তাতে খুশি হব না?
তার মানে? নিজের কান দুটোকে ঠিক যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না এমন বিমূঢ় গলায় নুটসন বললেন, ওই মিথ্যে সাইরেন বাজানোটা আপনারই কারসাজি?
হ্যাঁ, বাহাদুরিটা সানন্দে স্বীকার করে বললাম, ওটা আমার এক ঢিলে দুই পাখি মারার কৌশল বলতে পারেন। ঠিক সময়মত ওটা বাজিয়ে একদিকে আপনার পাসপোর্ট দেখানোটা তখনকার মতো যেমন থামিয়ে রেখেছি তেমনই আজ রাত্রেই যাতে ইনভারনেস ছেড়ে পালাতে হয় সেব্যবস্থাও করেছি ওই এক চালে।
আপনি—আপনি—নুটসন রাগে প্রায় বাকশক্তি হারিয়ে সেটা যতক্ষণে ফিরিয়ে আনবার চেষ্টা করছেন, সেই অবসরে নিজের কথাটা তাঁকে বুঝিয়ে বললাম, একবার পাসপোর্ট দেখবার বুদ্ধি যখন ওদের মাথায় এসেছে তখন আজ না দেখবার সুযোগ পেলেও এই খোঁজে ওরা লেগে থাকবেই। নিজেরা না পারলে শেষ পর্যন্ত এখানকার পুলিসের কাছেই ওরা একটা হারানো পাসপোর্ট খোঁজার জন্য সাহায্য চাইবে, আর সে পাসপোর্ট অন্য কারও নয়, আপনার আসল যা নাম সেই গুস্তাভ নুটসন নামে— সুতরাং বুঝতেই পারছেন, এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, আর আমার মতে— এক্ষুনি, আপনার না পালালে নয়। শুধু তাই নয়, পালিয়ে যেমন দুশমনদের হাত থেকে ছাড়া পাবেন, তেমনই যে জন্য জীবনপাত করছেন, সকনেসের সেই রহস্যও ভেদ করতে পারবেন।
সেই রহস্য ভেদ করতে পারব এখান থেকে পালিয়ে? এতক্ষণে বাকশক্তি ফিরে পেয়ে রীতিমত ক্ষিপ্ত হয়ে টসন বললেন, আপনি কি নিজে উন্মাদ, না আমার সঙ্গে জড়ভরতের বুদ্ধি নিয়ে রসিকতা করছেন? কনেসের অজানা জলচর দানবের রহস্য এখানে এই ইনভারনেসে, আর আপনি বলছেন আমি তা ভেদ করার উত্তর পাব এখান থেকে পালিয়ে? পালিয়ে যাব কোথায়? শুধু পালালেই কার্যসিদ্ধি হবে?
না, জোর দিয়ে বললাম, যেখানে তোক নয়, পালাতে হবে বিশেষ একটি জায়গায়।
সেটা কোথায়? কোনওরকমে এক উন্মাদের সঙ্গে কথা বলার ধৈর্য না হারিয়ে জিজ্ঞেস করলেন নুটসন।
সেটা ধরুন মাদাগাস্কারে।
আমার কথায় এবার হোহো করে হেসে উঠে নুটসন বললেন, ঠিক, ঠিক! ঠিক নিশানাই দিয়েছেন এবার। অবশ্য এর বদলে কামস্কাটকা কি গুয়াতেমালাও বলতে পারতেন?
না, গম্ভীর হয়েই এবার বললাম, গুয়াতেমালা কি কামস্কাটকা নয়, যেতে হবে ওই মাদাগাস্কার ছাড়া আর কোথাও নয়।
বটে! ঠিক উন্মাদকে প্রশ্রয় দেবার মতো গলায় নুটসন বললেন, তা শুধু ওখানেই কেন?
শুধু ওখানেই এই জন্যে যে, আমি শান্ত গলায় ধীরে-ধীরে বললাম, যাকে নিয়ে কনেসের রহস্য, সেই জলচর দানবটি পৃথিবীর আদ্যিকালের প্লিসিওসোরাসের বংশধর বলে বহু বৈজ্ঞানিক মনে করছেন। ফসিল মানে। জীবাশ্মের প্রমাণে প্লিসিওসোরাসের বংশ যদিও বহু কোটি বছর আগে লুপ্ত হয়ে। গেছে বলে ধরে নেওয়া হয়, তবু পৃথিবীর জীবজগতের বিবর্তনের কোটি কোটি বছরের ইতিহাসে লক্ষ লক্ষ জীবগোষ্ঠীর ধারার মধ্যে এরকম এক-আধটা ধারা প্রায় অমর হওয়ার দৃষ্টান্ত একেবারে বিরল নয়। লকনেসের বেলায় তাই যদি হয়ে থাকে তা হলে তা চাক্ষুষভাবে প্রমাণ করবার উপায় ওই মাদাগাস্কারেই পাওয়া যেতে পারে। কেন, কেমন করে তা পাওয়া সম্ভব, তা বোঝাবার জন্য আমার সংকেত-লিপির সংস্কৃত শ্লোকটি আর একবার মনে করিয়ে দিচ্ছি—শ্লোকটির আরম্ভেই পাচ্ছি:
প্রলয়পয়োধিজলে ধৃতবানসিবেদং
বিহিতবহিত্ৰচরিত্ৰখেদ…
কেশব ধৃতমীনশরীর। জয় জগদীশ হরে।
একটা আশ্চর্য কথা একটু মন দিয়ে এবার শুনুন, নুটসন। পৃথিবীর কোনও দেশের প্রাচীন শাস্ত্রে পুরাণে যা নেই, আমাদের এই ভারতবর্ষের যোগী-ঋষি-সাধকেরা সভ্যতার উন্মেষের আগে কোন দিব্যদৃষ্টির শক্তিতেই অবতার রূপে কল্পনা করে পর পর যে-সব জীবগোষ্ঠীর উদ্ভব ও প্রাধান্যের কথা তাঁরা বলে গেছেন, আধুনিক বিজ্ঞানে সেইসব অনুমানই সঠিক বলে স্বীকৃত হয়েছে। ভারতের প্রাচীন ঋষিদের। দিব্যদৃষ্টিতে প্রথম অবতার বলে যে জীবগোষ্ঠীর নাম করা হয়েছিল তা হল মৎস্য। মৎস্যের পর এসেছে কুর্মের নাম, তারপর অবতার রূপে কল্পনা করা হয়েছে বরাহের। বরাহের পর নৃসিংহ ও বামনরূপী অবতারকে যেভাবে কল্পনা করা হয়েছে। তাতেই আধুনিক বিজ্ঞানের সুদীর্ঘ সন্ধানী আবিষ্কারে তাঁরা কেমন করে পৌঁছেছিলেন, ভেবে অবাক হতে হয়।
অন্য সকলের কথা ছেড়ে দিয়ে প্রথম মৎস্যাৰতারের কথাই ধরলে কোটি-কোটি বছর আগেকার প্লিসিওসোরাসই তার আদিরূপ ভাবলে বোধহয় খুব ভুল হয় না।
কালে-কালে নিজের সঙ্গী-সাথী আর ধারা একে একে নির্বংশ হয়ে গেলেও লকনেসের বুকে একটি শাখা যদি কোনওরকমে বিলুপ্তি থেকে রক্ষা পেয়ে থাকে, তা হলে কোনও গুপ্ত খাত দিয়ে ইনভারনেসের পাহাড়তলির তলায় কোনও বিরাট পাতালসাগরে পালিয়ে থাকবার যথেষ্ট সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তাদের একটি-দুটিকে অন্তত নির্ভুল চার আর টোপের প্রলোভনে বার করে এনে ধরা যেতে পারে। সে নির্ভুল টার আর টোপ বলতে কী বুঝব? লকনেসের রহস্যময় জলদানবদের বহু
কোটি বছর আগে বিলুপ্ত বলে ধরে নেওয়া যে জীবগোষ্ঠীর একটি অতি ক্ষীণ, আশ্চর্যভাবে টিকে থাকা প্রতিনিধি বলে মনে করা হয়, সেই প্লিসিওসোরাসের আহার ও বিচরণক্ষেত্র বলতে যা বোঝায় তাই বুঝব নিশ্চয়ই।
বহু কোটি বছর আগে যার মূলধারা বিলুপ্ত হয়ে গেছে, সে প্রাণীর মনের মতো চেনা খাবার আর পরিবেশ কি এখন আর পাওয়া সম্ভব? পরিবেশ না হোক, আহারটা পাওয়া সত্যিই যে অসম্ভব নয়, এইটিই এ যুগের পরমাশ্চর্য এক আবিষ্কার।
ব্যাপারটা ঠিক মতো বুঝিয়ে দিতে হলে বলতে হয়, প্লিসিওসোরাস আমাদের ভারতীয় শাস্ত্র-পুরাণের আদি মৎস্যাবতার। অর্থাৎ সৃষ্টিতে জীব বিবর্তনের ইতিহাসে এই মৎস্যাবরই আদি মনুর রক্ষক আর বাহন।
আদি মনুর বাহন বা রক্ষক সেই মৎস্যাবতারকে প্রলুব্ধ করে ধরবার জন্য একমাত্র মান্ধাতার টোপই তা হলে প্রয়োজন।
কোথায় মিলবে সে মান্ধাতার টোপ? তা পাওয়া কি সম্ভব?
হ্যাঁ, সম্ভব। বহু কোটি বছর আগে বিলুপ্তপ্রায় প্লিসিওসোরাসের একটি সমবয়সী জীবগোষ্ঠীর ধারা এখনও ক্ষীণভাবে তাদের অস্তিত্ব বজায় রেখে চলেছে।
চলেছে আর কোথাও নয়, আফ্রিকার দক্ষিণ-পশ্চিমের মাদাগাস্কার দ্বীপের সমুদ্রে। কোটি কোটি বছর ধরে একই চেহারা-চরিত্র আর দেহ-বৈশিষ্ট্য নিয়ে তারা যে টিকে আছে মাদাগাস্কারের সমুদ্র উপকূলে গত দুই-তিন দশকে মৎস্য-শিকারিদের ছিপে আর জালে ধরা পড়া নিদর্শনে তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ রয়েছে।
শুনুন, মি. নুটসন, এখন আর কোথাও নয়, এখান থেকে পালিয়ে সেই মাদাগাস্কারে গিয়েই একটি অন্তত জীবন্ত মান্ধাতার টোপ আপনাকে সংগ্রহ করে আনতে হবে। আদি মনুর বাহন ও রক্ষক প্রথম মৎস্যাবতারের নাম যেমন প্লিসিওসোরাস, তাকে প্রলুব্ধ করে ধরবার এই মান্ধাতার টোপেরও বৈজ্ঞানিক নাম তেমনি হল সিলাকান্থ।
এই সিলাকান্থ-এর একটা-দুটো ছানাপোনা যদি কোনও রকমে সংগ্রহ করে এনে এই লকনেসের জলে ছাড়তে পারেন তা হলে কী ভোজবাজি হয়ে যাবে তা বুঝতে পারছেন কি?
লকনেসের গহনে গভীরে আদি প্লিসিওসোরাস গোষ্ঠীর যে কটা বংশধর যেখানেই এখনও টিকে থাকুক, দু-দশ হাজার নয়, এমন দশ-বিশ কোটি বছরের সঙ্গী থাকার স্মৃতির টানে, আর কোনও কিছু নয়, শুধু একটু গা-ঘষাঘষির লোভেই তারা পিলপিল করে ছুটে আসবে। তখন একটু বুদ্ধি করে জাল ফেলার ব্যবস্থা করে তাদের একটা-আধটাকে ধরা তো কোনও সমস্যাই নয়।
শুনুন, কথায় কথায় অনেক রাত হয়েছে, তবু আপনার বিশ্রামের অবসর আর নেই। হোটেল থেকে লুকিয়ে বার হয়ে আপনি সোজা গলিঘুজির পথে ইনভারনেস স্টেশন ইয়ার্ডে চলে যান। কোনও যাত্রী-ট্রেন সেখান থেকে এখন আর পাবেন না। কিন্তু আমি খোঁজ নিয়ে জেনে এসেছি যে, একটি খালি মালগাড়ি সেখান থেকে মাঝ রাত্রে ছেড়ে এডিনবরা পর্যন্ত যাবে। সেই মালগাড়ির একটা খালি ভ্যানে উঠে লুকিয়ে এডিনবরা পর্যন্ত চলে যান, তারপর সেখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জাহাজে প্লেনে সোজা মাদাগাস্কার। ইচ্ছে মতো খরচ করবার যথেষ্ট টাকা জোগাড়ের ক্ষমতা আর উপায় যে আপনার আছে তা আমি ভাল করেই জানি। সুতরাং মাদাগাস্কারে গিয়ে জীবন্ত সিলাকান্থ ধরে আনতে যে আপনি পারবেন, সে বিশ্বাস আমার আছে। আপনার দুশমনেরা যাতে শেষ মুহূর্তে কোনও শয়তানি না করতে পারে, সেই পাহারায় আমি এখানে রইলাম। আপনি এক্ষুনি রওনা হয়ে যান।
ঘনাদা একটু থেমে আমাদের সকলের দিকে চেয়ে প্রসন্ন মুখেই বললেন, ইনভারনেস থেকে নুটসনের বাজিমাতের টেলিগ্রামের জন্যই অপেক্ষা করে আছি। খুব বেশি দেরি বোধহয় আর হবে না।