প্রবল এক বাতাসের বেগে উত্তর-পূর্ব কোণের এক পাথুরে প্রদেশের উপর দিয়ে যখন ভিক্টরিয়া পরদিন সকালে উড়ে চলছিলো, তখন ফার্গুসনের ঘুম ভাঙলো। রাতে যখন তার ঘুম আসে তখন বেলুন যাচ্ছিলো এক বনের ওপর দিয়ে। তারপর ঘুমের ভিতর কখন যে এই নতুন এলাকার ওপর বেলুন চলে এসেছে, তা আর তিনি টের পাননি। চারদিকেই উঁচু-নিচু লাল পাথরের বন্ধুর সমারোহ-অনেকটা কবরখানার সমাধিফলকের মতো দেখতে। চোখা, থ্যাবড়া, তিনকোণা, পাঁচকোণা—নানা আকারের পাথর, দিনের বেলার স্বচ্ছ রোদ তাদের ওপর ঝলমলে আলো ফেলেছে।
এখন তারা কাজে থেকে একশো মাইল দূরে। কাজে আফ্রিকার একটি নামকরা প্রদেশ। সমুদ্রতীর থেকে প্রায় সাড়ে তিনশো মাইল দূরে তার অবস্থান, কিন্তু তবু তা ব্যাবসা-বাণিজ্যের একটি প্রধান কেন্দ্র। অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি সংগমস্থলে তার উপস্থিতি বলে উটের বহর নিয়ে সদাগরেরা আসে নানা দিক থেকে বিবিধ পণ্যসম্ভার নিয়ে হাতির দাঁতের জিনিশ, তুলো, পোশাক-আশাক, কাচের মালা, এ-সব তো বটেই, তার ওপরে এখানে আবার ক্রীতদাসও বেচা-কেনা হয়।
বেলা দুটো নাগাদ বেলুন কাজে পৌঁছুলো। ফার্গুসন বললেন, সেদিন সকাল ন-টায় সময় আমরা জানজিবার ছেড়ে রওনা হয়েছি, আর দু-দিন পরেই আজ কি না পাঁচশো মাইল দূরে কাজে তে এসে উপস্থিত হয়েছি! দেখেছো, বেলুনের আশ্চর্য ক্ষমতা! .
সীমানা-ঘেরা কতগুলি ছাউনির সমষ্টি, মাঝে-মাঝে বাঁশপাতা আর মাটির তৈরি অনেক কুঁড়েঘর। এখানকার আদি বাসিন্দারা আর ক্রীতদাসেরা এ-সব ছাউনি আর কুঁড়েঘরে থাকে; ছাউনির সামনে উঠোনের মতো একেক টুকরো জায়গা, তাতে নানা জাতের ফসল ফলে আছে।, একদিকে বাজার-কেনাবেচার বেসাতি, লোকজনের হৈ-চৈ আর শোরগোলে সরগরম। অনেক লোক বাজারে, তারা আবার নানা জাতের; সবাই যেন একসঙ্গে কথা বলছে, তাই এই চাচামেচি একেবারে অবোধ্য। ঢাক আর বাঁশির অদ্ভুত আওয়াজ, খচ্চরের ডাক, গাধার বিকট চীৎকার মেয়েগলার রিনরিনে আওয়াজ, শিশুদের কোলাহল–এইসব তো আছেই, কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে উটের বহরের সর্দারের তর্জন-গর্জন, আর এই মিশ্র শব্দের প্রবলতায় জায়গাটা যেন জাহান্নামের কোনো মেলার মতো হয়ে উঠেছে।
হঠাৎ যেন মন্ত্রবলে এই ভীষণ শোরগোল স্তব্ধ হয়ে গেলো। অবাক চোখে সবাই তাকিয়ে রইলো আকাশের দিকে। বিশাল ভিক্টরিয়া মন্থর গতিতে তাদের দিকে ভেসে আসছে দেখে বাজারের সেই লোজনেরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো। কিন্তু বেলুনটি যখন তারপর সোজাসুজি মাটির দিকে নেমে আসতে লাগলো, তখন নিমেষের মধ্যে সেখনকার আবালবৃদ্ধবনিতা, মরুভূমির সদাগর, আরব, ও নিগ্রো ক্রীতদাস—সবাই আতঙ্কে ভয়ে মুহ্যমান হয়ে আশপাশের কুটিরগুলোর ভিতর গিয়ে লুকিয়ে পড়লো।
কেনেডি বলে উঠলেন, কিন্তু, ফার্গুসন, ওরা সকলেই যদি এভাবে ভয় পায়, তাহলে ওদের কাছ থেকে জিনিশপত্র কেনাকাটা করবো কী করে?
ও কিছু নয়, ফার্গুসন উত্তর দিলেন, ওদের এই ভয় নেহাৎই সাময়িক। সংস্কার খুব প্রবল বটে, কিন্তু কৌতূহলের ক্ষমতা তার চেয়ে ঢের বেশি—ঐ কৌতূহলই ওদের আবার ঘর থেকে বের করে আনবে। তবে আমাদের কিন্তু খুব সাবধান থাকতে হবে, খুব হুঁশিয়ার, একটুও অসতর্ক থাকলে চলবে না। খুব সাবধানে এগুতে হবে ওদের কাছে, কেননা তীরধনুক অথবা বন্দুকের গুলির হাত থেকে বাঁচবার কোনো উপায়ই আমাদের নেই। ঐ দুটি পদার্থের কাছে আমাদের বেলুন কিন্তু বড় অসহায়।
তুমি কি এদের সঙ্গে আলাপ করতে চাও নাকি?
তোমার কথায় মনে হচ্ছে তুমি যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। কিন্তু আলাপ করলেই বা কী দোষ? দেখাই যাক না।
ভিক্টরিয়া আস্তে-আস্তে নিচের দিকে নেমে এসে বাজার থেকে বেশ খানিকটা দূরে একটি গাছের মাথায় নোঙর ফেললো।
আস্তে-আস্তে সেই ভয়-পেয়ে-লুকিয়ে-থাকা জনতার হারানো সাহস বোধহয় ফিরে এলো; একে-একে তারা বেরিয়ে এলো খোলা জায়গায়। সারা শরীরে বিদঘুটে উল্কিআঁকা শঙ্খের মালা পরা ওয়াগোগো জাতের কিছু লোক প্রথমে এগিয়ে এলো—এরা সব হলো ডাইনি-পুরুৎ! নারী, শিশু ও অন্য-সবাই এলো তাদের পেছনে-পেছনে। প্রবলভাবে বেজে উঠলো ঢাক আর শিঙা, আর তারা আকাশের দিকে তাকিয়ে বারবার প্রচণ্ড করতালি দিতে শুরু করে দিলে-মাঝে-মাঝে হাত বাড়িয়ে দিলে শূন্যের দিকে।
ফার্গুসন বললে, ওদের ধরন-ধারণ দেখে বোঝা যাচ্ছে, ওরা আসলে অনুগ্রহ প্রার্থনা করছে—এ-সবই ওদের প্রার্থনার ভঙ্গি। আমার আন্দাজ যদি ঠিক হয়, তাহলে এবার আমাদের বোধহয় কিছুটা অভিনয় করতে হবে।
এমন সময় সেই ডাইনি-পুরুতেরা পিছন দিকে হাত তুলে কী যেন ইশারা করলে, অমনি সব চ্যাঁচামেচি যেন জাদুবলে স্তব্ধ হয়ে গেলো। পুরুদের মধ্য থেকে দু-জন এগিয়ে এলো বেলুনের আবো-কাছে, তারপর উত্তেজিতভাবে এক অজ্ঞাত দুর্বোধ্য ভাষায় ফার্গুসনদের তড়বড় করে কী যেন বলে গেলো। বুঝতে না-পেরে ফার্গুসন আরবি ভাষায় কোনোরকমে কিছু বলতেই তৎক্ষণাৎ তাদের মধ্য থেকে সেই ভাষায় উত্তর এলো।
আরবি ভাষায় একটানা অনেক কিছু বললে লোকটি। তার বক্তব্য শুনে মোটামুটি ফার্গুসন বুঝতে পারলেন যে এখানকার লোকেরা ভিক্টরিয়াকে চাঁদ বলে ভেবেছে–আর তারা চাঁদেরই উপাসনা করে, ফলে চাঁদ স্বয়ং যেহেতু তার তিন পুত্রকে নিয়ে করুণাবশত তাদের এই উষ্ণ দেশকে দর্শন দিয়ে ধন্য করতে এসেছেন, এই পুণ্য দিবসের কথা তাই পুরুষানুক্রমে তারা সবাইকে গেয়ে শোনাবে। তারপর সে সন্ত্ৰমে প্রায় আভূমি নত হয়ে সশ্রদ্ধ মিনতি জানালে যে, চাঁদের এই তিন পুত্র যদি অসীম কৃপায় তাদের মাটিতে পদধূলি দেন, তাদের সুলতান নাকি আবার কয়েক বছর ধরে এক মরণাপন্ন অসুখে ভুগে-ভুগে প্রায় মুমূর্য হয়ে আছেন–যদি দর্শন দিয়ে তাকে নিরাময় করে যান, তাহলে তারা চিরবাধিত হয়ে ধন্য বোধ করবে।
লোকটির সব কথার সারমর্ম সঙ্গীদের ইংরেজিতে তর্জমা করে জানালেন ফার্গুসন।
এই কাফ্রি সুলতানের কাছে সত্যি যাবে নাকি তুমি? অবাক গলায় শুধোলেন। ডিক।
নিশ্চয়ই। ফার্গুসন বললেন, লোকগুলোকে তো ভালো বলেই মনে হচ্ছে। তাছাড়া আবহাওয়াও এখন বেশ শান্ত, কাজেই ভিক্টরিয়ার জন্যে আমাদের ভাবনার কোনো কারণ নেই।
কিন্তু তুমি সেখানে গিয়ে কী করবে?
এই ডাইনি-পুরুৎগুলোর হাত থেকে সুলতানকে বাঁচাতে চাচ্ছি আমি। সঙ্গে ওষুধের বাক্স নিয়ে যাচ্ছি। ঠিকমতো চিকিৎসা হয়নি বলেই তো সুলতানের অসুখ সারছে না—যদি ঠিক-ঠিক ওষুধ পড়ে, লাগসই দাওয়াই, তাহলেই তো সব অসুখ সেরে যাবে।