পাহাড়ের উপর থেকে নিচের উপত্যকাটির দিকে তাকিয়ে রিদি বলল, এই হচ্ছে সেই লাল পাহাড়।
রুহান বলল, এটা লালও না পাহাড়ও না তাহলে এর নাম লাল পাহাড় কেন?
রিদি হেসে বলল, আমাকে জিজ্ঞেস করো না। আমি এর নাম দিই নি।
তুমি এখানে আসতে চেয়েছ–এটা সম্পর্কে নিশ্চয়ই তুমি জান।
এমন কিছু জানি না, শুধু শুনেছি এই লাল পাহাড়টা কারো এলাকা না। সবার ভেতরে একটা অলিখিত নিয়ম হয়ে গেছে যে এটা কেউ দখল করে নেবে না।
কেন?
রিদি ঘাড় বাঁকিয়ে বলল, সবারই ব্যাবসাপাতি করতে হয়। অস্ত্র কিনতে হয়। সৈনিক বিক্রি করতে হয়। যন্ত্রপাতি ঠিক করতে হয়। তাই লাল পাহাড়টা এই সব করার জন্যে রেখে দিয়েছে।
রুহান আঁকাবাঁকা রাস্তাটির দিকে তাকিয়ে রইল, সেটা পাহাড় ঘিরে নিচে উপত্যকায় নেমে গেছে। তাদেরকে এই পথ দিয়ে হেঁটে হেঁটে নেমে যেতে হবে। এরকম বেশ কয়েকটি রাস্তা চারদিক থেকে এসেছে। ওরা ইচ্ছে করলে ক্ৰিভনকে নিয়ে একেবারে উপত্যকায় নেমে যেতে পারত কিন্তু তা না করে এখানে নেমে পড়েছে। ক্রিভনের গলায় একটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র চেপে ধরে রেখে বিশাল একটা বুলেটপ্রুফ গাড়ি করে শহরের ভেতর ঢুকলে শহরের সব মানুষ নিশ্চয়ই বিস্ফারিত চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকবে। তারা কারো চোখে আলাদা করে পড়তে চায় না, যে ঘটনা ঘটিয়ে এসেছে সেটা নিশ্চয়ই কয়েকদিনে জানা-জানি হয়ে যাবে কিন্তু তারাই যে সেই ঘটনার নায়ক সেটা তারা কাউকে জানতে দিতে চায় না। তাই দুজনে মাঝপথে নেমে গেছে, বাকীটা হেঁটে যাবে।
রিদি বলল, এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে চল হাঁটি। পাহাড় ঘিরে পথটা গেছে, অনেকদূর হেঁটে যেতে হবে।
উঁহু। রুহান মাথা নেড়ে বলল, আমাদের এখন রওনা দেয়া ঠিক হবে না।
কেন?
অনেকটা পথ। কমপক্ষে তিন চার ঘণ্টা তো লাগবেই। এখন এই রাস্তা আমাদের এতক্ষণ থাকা ঠিক না।
কেন? রাস্তায় থাকলে কী হবে?
ক্ৰিভনকে আমরা যেভাবে ধরে এনেছি সেটা একটা যুদ্ধবাজ নেতার জন্যে খুব বড় অপমান। বিশেষ করে এত হাজার হাজার মানুষের সামনে-
হ্যাঁ। সেটা ভুল বল নি।
রুহান বলল, সেই অপমান থেকে রক্ষা পাবার তার এখন একটাই পথ।
রিদি মাথা নেড়ে বলল, আমাদের ধরে নিয়ে দশ হাজার মানুষের সামনে একটা ভয়ঙ্কর শাস্তি দেয়া?
হ্যাঁ। আমরা ক্ৰিভনকে এখানে ছেড়ে দিয়েছি। ক্ৰিভন জানে আমরা এখন এই পথ দিয়ে হেঁটে হেঁটে যাব। ঘণ্টা তিনেক লাগবে পৌঁছাতে। সে নিশ্চয়ই এই সময়ে তার দলবল নিয়ে আমাদের ধরতে ফিরে আসবে। কাজেই আমাদের এখন এই রাস্তায় থাকা ঠিক হবে না।
রিদি কিছুক্ষণ রুহানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ঠিকই বলেছ।
রুহান বলল, রাস্তা দিয়ে না হেঁটে আমরা এই পাহাড়ের ঢালু দিয়ে হেঁটে যাই। আমার মনে হয় আমরা তাহলে অনেক তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাব।
রিদি আবার মাথা নেড়ে বলল, চমৎকার বুদ্ধি।
যদি দরকার হয় আমরা তাহলে ভালো একটা জায়গায় অপেক্ষা করতে পারি। যদি ক্ৰিভনের দলের সাথে যুদ্ধ করতেই হয় আমরা সেটা করব একটা সুবিধাজনক জায়গা থেকে।
রিদি বলল, রুহান, তোমার মাথা খুব পরিষ্কার। তোমার মাথায় ইলেকট্রড বসিয়ে যে সক্রেটিস বানায় নি সেটাই আশ্চর্য।
চেষ্টা করেছিল। রুহান বলল, আমি ধোকা দিয়ে বের হয়ে এসেছি। রিদি চোখ বড় বড় করে বলল, আশ্চর্য!
আশ্চর্যের কিছু নেই। এখন চল ঢালু বেয়ে হাঁটতে শুরু করি। অন্ধকার হবার আগে পৌঁছে গেলে খারাপ হয় না।
চল।
দুজন তখন পাহাড়ী ছাগলের মতো পাথরের উপর লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে শুরু করে। এই পথ দিয়ে মানুষ হাঁটে না, তাই চারদিক গাছপালা ঝোপঝাড়ে ঢেকে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা গভীর জঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে গেল। পাহাড়ী পথে ক্রিভনের লোকজন চলে এলেও তারা কোনোদিন তাদের খুঁজে পাবে না।
একটা পাহাড়ী ঝর্ণার কাছে বসে তারা যখন ঘষে ঘষে তাদের মুখের রং ওঠানোর চেষ্টা করছিল তখন তারা অনেকগুলো সাজোয়া গাড়ির শব্দ শুনতে পেল। গাড়িগুলো কর্কশ শব্দ করতে করতে রাস্তায় ছোটাছুটি করছে। অনেক মানুষের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর এবং কিছু বিক্ষিপ্ত গোলাগুলির শব্দও তারা শুনতে পেল। নিশ্চয়ই ক্রিভনের বাহিনী এসে তাদের খোঁজ করছে, তারা যেখানে আছে সেখানে কখনোই তারা খুঁজে পাবে না। ঘণ্টাখানেক পর রুহান আর রিদি আবার সাজোয়া গাড়িগুলোর কর্কশ শব্দ শুনতে পেল, তাদের খুঁজে না পেয়ে সেগুলো ফিরে যেতে শুরু করেছে।
রিদি রুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার সন্দেহটা একেবারে একশ দশ ভাগ সত্যি ছিল।
রুহান বলল, তার অর্থ কী জান?
কী?
আমি এখন অপরাধীদের মতো চিন্তা করি।
রিদি শব্দ করে হেসে বলল, অপরাধীর মতো চিন্তা করা অপরাধ না, অপরাধীর মতো কাজ করা হচ্ছে অপরাধ।
রুহান বলল, কিন্তু তুমি আসল বিষয়টা ভুলে যাচ্ছ। অপরাধীর মতো চিন্তা করা অপরাধ না হতে পারে কিন্তু এটা খুব কষ্ট। আমি আগে এরকম ছিলাম না।
রিদি রুহানের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি কী একটা জিনিস লক্ষ্য করেছ?
কী?
আমরা দুজন একজন আরেকজন সম্পর্কে কিছুই জানি না।
রুহান মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। আমাদের একজন আরেকজনকে খুন করার কথা ছিল। অথচ এখন একজন আরেকজনকে ছাড়া থাকতে পারব না। বেঁচে থাকার জন্যে তোমার আমাকে আর আমার তোমাকে দরকার।
রিদি এক দৃষ্টে রুহানের দিকে তাকিয়ে রইল। রুহান জিজ্ঞেস করল, কী লো? তুমি এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছ কেন?
তোমাকে দেখছি।
আমাকে কী দেখছ?
যে মানুষটার সাথে আমার থাকতে হবে তার চেহারাটা কেমন সেটা এখনো ভালো করে দেখতে পারি নি। তোমার চেহারাটা দেখার চেষ্টা করছিলাম, তুমি কী জান—
জানি।
রিদি অবাক হয়ে বলল, কী জান?
তুমি নিশ্চয়ই বলতে চাইছ ঝর্ণার পানি দিয়ে আমি আমার মুখের রং ধুতে পারি নি। উল্টো সেই রং ছড়িয়ে পড়ে এখন আমাকে একটা ভূতের মতো দেখাচ্ছে।
রিদি শব্দ করে হেসে বলল, হ্যাঁ, আমি সেটাই বলতে যাচ্ছিলাম। তবে তুমি যখন নিজেই এটা আবিষ্কার করেছ তার একটাই অর্থ। আমিও আমার মুখের রং ধুতে পারি নি। আমাকেও নিশ্চয়ই ভূতের মতোই লাগছে!
ঠিকই অনুমান করেছ। চেষ্টা করে লাভ নেই। চল আগে লোকালয়ে যাই। তখন একটা কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
লোকালয়ের মানুষেরা আমাদের দেখে ভয় পেয়ে যাবে।
তোমার তাতে কোনো আপত্তি আছে?
না। কোনো আপত্তি নেই। রিদি উঠে দাঁড়াল। বলল, চল যাই। তুমি বিশ্বাস করবে কী না জানি না, আমার খিদে পেতে শুরু করেছে।
রুহান বলল, অবশ্যই বিশ্বাস করব। আমারও ভয়ঙ্কর খিদে পেয়েছে। লাল পাহাড়ে গিয়ে ভালো কিছু খেতে পাব তো?
পাব। নিশ্চয়ই পাব।
দুজন আবার ঝোপঝাড় ভেঙ্গে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে নামতে থাকে।
রুহান এবং রিদি ভেবেছিল লাল পাহাড়ে পৌঁছানোর পর তাদের বিচিত্র পোশাক, রং মাখা মুখ এবং শরীরে ঝুলিয়ে রাখা নানা ধরনের অস্ত্র দেখে নিশ্চয়ই তাদের ঘিরে একটা ভিড় জমে যাবে, কিন্তু সেরকম কিছু হলো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা কারণটা বুঝে গেল। পুরো লাল পাহাড় এলাকাটাই আসলে বিচিত্র মানুষের এলাকা। অনেক মানুষই মুখে বিচিত্র রং লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, অনেকের পোশাক বিচিত্র, অনেকেই নানা ধরনের অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুরো এলাকাটা একটা বড় মেলার মতো, নানা ধরনের আনন্দোৎসবের ব্যবস্থা রয়েছে। নানা ধরনের দোকানপাট ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। নানা ধরনের মানুষের ভিড়ে পুরো এলাকাটা গমগম করছে। এখানে নানা বয়সের নারী আর পুরুষ রয়েছে কিন্তু কোনো শিশু কিশোর নেই। দেখেই বোঝা যায় এই এলাকাটি ক্ষণস্থায়ী, মানুষ এখানে আসবে কিছু সময় কাটিয়ে চলে যাবে। কেউ এখানে পাকাপাকিভাবে থাকবে না।
রিদি মানুষের ভিড়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল, রুহান জায়গাটা আমার পছন্দ হয়েছে।
রুহান হেসে বলল, আমরা যেরকম জায়গা থেকে এসেছি তারপর সরাসরি নরক না হলেই জায়গাটা আমাদের পছন্দ হবার কথা।
রিদি বলল, একটা জিনিস লক্ষ্য করেছ? এখানকার মানুষের চোখে মুখে সেই ভয় আর আতঙ্ক নেই।
হ্যাঁ। অনেকের মুখে হাসি। রুহান নিজেও হাসার চেষ্টা করে বলল, হাসতে কেমন লাগে ভুলেই গেছি।
রিদি বলল, পেটে কিছু পড়লে তুমিও হাসতে পারবে।
খুঁজে খুঁজে দুজনে একটা ভালো খাওয়ার জায়গা বের করল। পাথরের একটা বাসার সামনে চেয়ার টেবিল সাজানো। কাছেই পাথরের চুলোতে গনগনে আগুনে সত্যিকারের মাংস মশলা মাখিয়ে ঝলসানো হচ্ছে। অনেক মানুষের ভিড় তার মধ্যে দুজনে ঠেলেঠুলে একটা টেবিল দখল করে নিল। কমবয়সী একটা মেয়ে তাদের টেবিলে উত্তেজক পানীয়ের একটা জগ দিয়ে গেল। পাথরের গ্লাসে ঢেলে এক চুমুক খাওয়ার পরেই তাদের মন ভালো হয়ে যায়। তারা বসে বসে পা দুলিয়ে চারপাশের মানুষগুলোকে দেখতে থাকে।
তোমাদের সাথে বসতে পারি? গলার স্বর শুনে দুজনে তাকিয়ে দেখে মাঝবয়সী একজন মানুষ, উষ্কখুষ্ক চুল, চোখ দুটো জ্বলজ্বলে এবং অস্থির।
রুহান পা দোলানো বন্ধ করে বলল, হ্যাঁ, পার।
রিদি বলল, ইচ্ছে করলে আমাদের পানীয়ও এক ঢোক খেতে পার।
মানুষটি তাদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, তোমরা নিশ্চয়ই এই এলাকার মানুষ নও।
কেন?
এই এলাকার মানুষেরা পরিচয় হবার আগেই কাউকে তার পানীয়তে ভাগ বসাতে দেয় না।
রিদি আর রুহান দুজনেই শব্দ করে হাসল। রুহান বলল, অন্যদিন তোমাকে এত সহজে আমাদের পানীয়তে ভাগ বসাতে দেব না। আজ দিচ্ছি। আজ আমাদের মনটা খুব ভালো।
মানুষটা জিজ্ঞেস করল, কেন? তোমাদের মন ভালো কেন?
রুহান সরাসরি উত্তর দিল না, বলল, অনেকগুলো কারণ আছে, তোমাকে কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি? তা ছাড়া মন ভালো হতে কী আর কারণের দরকা। হয়? এই উত্তেজক পানীয় এক ঢোক খেলেই মন ভালো হয়ে যায়।
মানুষটি মাথা নেড়ে তার পানীয়ে চুমুক দিয়ে বলল, সেটা ঠিকই বলেছ। একটা সময় ছিল যখন সবসময়ে মানুষের মন খারাপ থাকত–কখন কী হয় সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করত। এখন উল্টো। ধরেই নিয়েছে জীবনটা যে কোনো সময় শেষ হয়ে যাবে। তাই যে কয়দিন আছে সেই কয়দিন ফূর্তি করে নাও।
রিদি আর রুহান দুজন কোনো কথা না বলে অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়ল। মানুষটি বলল, তোমরা এখানে নতুন এসেছ?
রুহান মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ।
লাল পাহাড় ঘুরে দেখেছ?
না। এখনো দেখি নি। এখানে কী আছে দেখার মতো?
মানুষটি চোখ বড় বড় করে উৎসাহ নিয়ে বলল, এই এলাকার সবচেয়ে বড় বাজারটি এখানে। এমন কোনো জিনিস নেই যেটা এখানে পাওয়া যায় না। অস্ত্র পাতি গোলাবারুদ থেকে শুরু করে মানুষ মেয়েমানুষ সবকিছু এখানে পাওয়া যায়।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। মানুষটি একটু ঝুঁকে বলল, কিনবে তোমরা কিছু? সুন্দরী মেয়েদের একটা চালান আসছে শুনেছি।
রিদি মাথা নেড়ে বলল, না আমরা কিছু কিনব না।
মানুষটার একটু আশাভঙ্গ হলো বলে মনে হলো। বলল, তোমরা এত ক্ষমতাশালী মানুষ, তোমরা যদি কিছু ইউনিট খরচ না কর তাহলে বাজার চালু থাকবে কেমন করে?
রুহান সোজা হয়ে বসে বলল, ক্ষমতাশালী? আমরা? তোমার এরকম ধারণা হলো কেমন করে?
বাহ্! মানুষটা দুই হাত তুলে বলল, তোমরা কী রকম অস্ত্র নিয়ে ঘুরছ দেখেছ? এরকম একটা অস্ত্র কত ইউনিটে বিক্রি হয় জান?
রুহান কিংবা রিদি দুজনের কেউই সেটা জানে না, তবে তারা সেটা প্রকাশ করল না, সাবধানে মাথা নাড়ল।
মানুষটা বলল, সারা লাল পাহাড়ে কারো কাছে এই অস্ত্র নেই, আর তোমাদের একজনের কাছেই আছে তিনটা করে! ক্ষমতা না থাকলে এগুলো হয় না।
রুহান আর রিদি একজন আরেকজনের দিকে তাকাল তারা এই বিষয়টা আগে। এভাবে চিন্তা করে নি। মানুষটা বলল, তোমরা কী কিছু কিনবে? ফূর্তি-ফার্তা করবে?
উঁহু। রুহান মাথা নাড়ল।
মানুষটা মাথা আরেকটু এগিয়ে আনল, নিচু গলায় ষড়যন্ত্রীর মতো বলল, কোনো গোপন রোগের চিকিৎসা করাতে চাও? আমার পরিচিত ভালো ডাক্তার আছে।
রুহান মাথা নাড়াতে গিয়ে হেসে বলল, না, আমাদের কোনো গোপন রোগ নেই।
আজকাল খুব একটা জনপ্রিয় অপারেশন হচ্ছে। পুরুষ মহিলা হওয়ার অপারেশন। মাত্র সাতদিন ক্লিনিকে থাকতে হয়—
রিদি আর রুহান দুজনেই মাথা নাড়ল। রিদি বলল, রক্ষে কর। এতদিন থেকে পুরুষ মানুষ হয়ে আছি অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন আমি মহিলা হতে পারব না।
মানুষটি তবু হাল ছাড়ল না, বলল, আমারও তাই ধারণা। এরকম হাট্টাকাট্টা জোয়ান পুরুষ মানুষ, খামোখা অপারেশন করে মেয়ে হতে যাবে কেন? তোমাদের বরং দরকার বাড়তি পৌরুষত্ব। খুব ভালো হরমোন আছে এখানে। ব্ল্যাক মার্কেটের এক নম্বর জিনিস। লাগবে?
রুহান মাথা নেড়ে বলল, না লাগবে না।
তাহলে দুই নম্বর হৃৎপিণ্ড? ছোট্ট শিশুর ভালো হৃৎপিণ্ড আছে। বুকের ভতর বসিয়ে দেবে টেরও পাবে না। আসল হৃৎপিণ্ডের সাথে সাথে চলবে। এখন যত পরিশ্রম করতে পার তার ডবল পরিশ্রম করতে পারবে।
রুহান হেসে বলল, না, আমার মনে হচ্ছে একটা হৃৎপিণ্ডতেই আমার বেশ কাজ চলে যাচ্ছে।
মানুষটি এবারে রীতিমতো হতাশ হয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে মনমরা হয়ে বসে পড়ল।
রিদি বলল, যদি একান্তই আমাদের সাহায্য করতে চাও তাহলে বলো রাত কাটানোর জন্যে ভালো একটা জায়গা কোথায় পাব? কোনো হাঙ্গামা হুঁল্লোড় চাই না, শুধু নিরিবিলি ঘুমাব।
রুহান বলল, ঘুমানোর আগে গরম পানিতে ভালো করে রগড়ে গোসল করব।
রিদি মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, সেটাও করতে হবে।
এলোমেলো চুলের মানুষটা এবারে সোজা হয়ে বসল। চোখ বড় বড় করে বলল, এখানে চাররকম থাকার জায়গা আছে। প্রথমটা হচ্ছে দামি, অনেক ইউনিট লাগে–
না না না। রুহান বাধা দিল, আমরা খুব কম ইউনিটে থাকতে চাই। সম্ভব হলে কোনো ইউনিট খরচ না করে।
মানুষটা অবাক হয়ে বলল, কোনো ইউনিট খরচ না করে?
হ্যাঁ। মনে করো কাজের বিনিময়ে খাদ্য। কিংবা কাজের বিনিময়ে নিদ্রা।
মানুষটা কিছুক্ষণ তাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বল, সত্যি তোমাদের কোন ধরনের কাজ দরকার?
রিদি আর রুহান দুজনেই মাথা নাড়ল। মানুষটা জিজ্ঞেস করল, কা ধরনের কাজ?
রুহান বলল, সেটা ভালো করে জানি না।
তোমাদের কাছে এত রকম অস্ত্র –সেগুলো নিশ্চয়ই ব্যবহার করতে পার?
রুহান আর রিদি একজন আরেকজনের দিকে তাকাল, রিদি হাসি গোপ করে বলল, একটু একটু পারি।
তাহলে তোমরা হয়তো কোনো ব্যবসায়ীর বডিগার্ড হিসেবে কাজ করতে পারবে। কিংবা কোনো দোকানে নিরাপত্তা কর্মী। কী বলো?
রিদি আর রুহান কোনো কথা না বলে একটু কাঁধ ঝাঁকাল।
তোমরা ইচ্ছে করলে নিজেদের একটা দল খুলতে পার। কিছু মানুষ নিয়ে তাদের ট্রেনিং দিয়ে—
রুহান বলল, ডাকাতের দল? রক্ষে করো!
ডাকাত? ডাকাত বলছ কেন।
অস্ত্র নিয়ে ট্রেনিং দিয়ে হামলা করাকে বলে ডাকাতি।
মানুষটা শব্দ করে হেসে বলল, তোমরা খুব মজার মানুষ। এটা ডাকাতি হবে কেন? এটা এখন সবাই করে।
রিদি কিংবা রুহান কোনো কথা না বলে পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দিল। রুহান বলল, তার চাইতে ভালো থাকার জায়গা কোথায় আছে বলো।
তোমরা যদি সোজা হেঁটে যাও, একেবারে পাহাড়ের নিচে দেখবে ছোট ছোট ঘর আছে। রাতের জন্যে ভাড়া দেয়। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। পাহাড়ের নিচে। বলে অবশ্যি রাতে ঝড়ো বাতাসের খুব শব্দ হয়।
হোক। রুহান বলল, ঝড় বাতাস আমার ভালোই লাগে।
মানুষটি এবারে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দুজনকে লক্ষ্য করে বলল, আচ্ছা। তোমরা বলবে তোমরা কারা? কী করো, কোথায় থাক?
রিদি বলল, এখনো জানি না। যখন জানব তখন বলব। নিশ্চয়ই বলব।
জান না মানে?
আমাদের দুজনের দেখা হয়েছে আজ দুপুরে। একজন আরেকজনকে ভালো করে চিনিই না। শুধু একজন আরেকজনের নামটা জানি।
মানুষটি কিছুক্ষণ তাদের দিকে তাকিয়ে হা হা করে হেসে বলল, তোমরা খুব মজার মানুষ। তারপর চোখ টিপে বলল, বুঝতে পারছি সত্যি কথাটি বলতে চাইছ না। না বললে নাই–এখানে কেউ সত্যি কথা বলে না। শুধু আমি বলি। আমার নাম দ্রুচেন। এজেন্ট দ্রুচেন। সবাই চেনে আমাকে। কোনো দরকার হলে আমাকে খবর দিও। আমি নিয়ম মেনে চলি, তোমাদের কাজ জোগাড় করে দেব। দশ ভাগ কমিশন আমার।
ঠিক আছে।
তাহলে তোমরা ডিনার করো, আমি যাই। পানীয়ের জন্যে ধন্যবাদ।
রুহান হাসিমুখে বলল, লাল পাহাড়ের ভেতরের খবর দেবার জন্যে তোমাকেও ধন্যবাদ।
খাওয়া শেষ করে রিদি আর রুহান এলাকাটাতে খানিকক্ষণ ইতস্তত হাঁটে। বাজারের কাছাকাছি এলাকায় নাচ গান হচ্ছে। মানুষজন তাল-লয়হীন বিকট সঙ্গীতের সাথে নাচানাচি করছে। নেশা করে তাদের চোখ মুখ রক্তাভ, চালচলন কথাবার্তা সংযত। তারা সেখানে বেশি সময় না থেকে সরে এলো, আশেপাশে নানা ধরনের দোকানপাট। অস্ত্রের দোকান সবচেয়ে বেশি, সেখানে নানারকম স সাজানো আছে, মানুষজন সেগুলো নেড়েচেড়ে দেখছে, কিনছে। পাশাপাশি বেশ কয়েকটা বড় নার্সিং হোম। সেখানে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বেচা-কেনা tlk। গাড়ির বেশ বড় বড় দোকান। নানা ধরনের গাড়ি সাজানো রয়েছে। পোশকের অনেকগুলো দোকান। মনে হয় পোশাকের এক ধরনের পরিবর্তন হয়েছে, বেশিরভাগই বিদঘুটে রঙের বিচিত্র সব পোশাক।
রিদি আর রুহান হাঁটতে হাঁটতে শহরের এক পাশে চলে এলো, সেখানে ছোট ছোট দোকান। রাস্তার পাশে স্থপ করে রেখে নানা ধরনের বিচিত্র পত্র বিক্রি হচ্ছে। ঘরে সাজিয়ে রাখার জন্যে ফর্মালিনে ড়ুবিয়ে রাখা মানুষের আঙুল, চোখ, জিব। জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে তৈরি করা কিছু বিচিত্র জন্তু। সীসার কৌটায় ভরে রাখা তেজক্রিয় মৌল। বিভিন্ন জাদুঘর থেকে চুরি করে আনা প্রাচীন মূর্তির অংশ। রুহান হঠাৎ অবাক হয়ে দেখল কমবয়সী একজন মানুষ অনেকগুলো বই নিয়ে বসে আছে। সে কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে যায়। রিদি জিজ্ঞেস করল, এগুলো কী?
কমবয়সী মানুষটি বলল, জানি না। তাহলে এগুলো বিক্রি করছ কেন?
কমবয়সী মানুষটি দাঁত বের করে হেসে বলল, আমি না জানলে ক্ষতি কী অন্য কেউ তো জানতে পারে।
রুহান বলল, আমি জানি। এগুলোকে বলে বই। আগে যখন মানুষের কাছে ক্রিস্টাল রিডার ছিল না তখন তারা এভাবে তথ্য বাঁচিয়ে রাখত।
রিদি অবাক হয়ে বলল, কী আশ্চর্য! এখানে কীভাবে তথ্য বাঁচিয়ে রাখবে?
রুহান বিষয়টা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে থেমে গেল। কমবয়সী মানুষটা যদি বুঝতে পারে সে বই নামের বিষয়টা সম্পর্কে জানে এমনকী সে অল্প বিস্তর পড়তেও পারে তাহলে শুধু শুধু বইগুলোর দাম বাড়িয়ে দেবে। সে দুই-একটা বই কিনতে চায়। বইগুলো উল্টে পাল্টে সে কয়েকটা বই বেছে নেয়। দাম নিয়ে কিছুক্ষণ দরাদরি করে বইগুলো কেনে। রিদি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কী করবে এগুলো দিয়ে?
রুহান কিছু বলার আগেই কমবয়সী মানুষটা বলল, ঘরে সাজিয়ে রাখা যায়। আর নেশা করার কাজে লাগে। কাগজ ছিঁড়ে গোল করে পাকিয়ে ভিসুবিচিরাস নাক দিয়ে টানা যায়। হাশিস খাবার জন্যে আগুন জ্বালাতেও খুব সুবিধা। একটা একটা করে কাগজ ছিঁড়ে আগুন জ্বালাবে।
রিদি একটু চোখ বড় বড় করে মানুষটার দিকে তাকাল। মানুষটা মুখে। হাসি আরেকটু বিস্তৃত করে বলল, তা ছাড়া বাথরুম করার পর মুছে ফেলা। কাজেও লাগানো যায়–
রুহান রিদির হাত ধরে টেনে সরিয়ে নিতে নিতে বলল, চল, বইয়ে। ব্যবহার সম্পর্কে আরো জটিল কিছু বের হওয়ার আগে কেটে পড়ি।
মানুষটি আবার দাঁত বের করে হেসে বলল, আমার কাছে আরো মজার মজার সব বই আছে।
রুহান যেতে যেতে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, তুমি এগুলো কোথা থেকে আনো।
মানুষটি চোখ মটকে বলল, জানতে চাও?
রুহান মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ।
আমাকে কত ইউনিট দেবে বল?
এক ইউনিটও দেব না। কথা শুনতে ইউনিট দিতে হয় কে বলেছে?
মানুষটা চোখ মটকে বলল, কথার যদি দাম থাকে তাহলে দাম দেবে না?
রুহান মাথা নাড়ল। না, দাম দিয়ে কথা শুনতে হলে কথা শুনবই না।
এক হাজার ইউনিট। মানুষটা মুখ গম্ভীর করে বলল, আমাকে এক হাজার ইউনিট দিলে তোমাকে বলে দেব, এগুলো কোথায় পাওয়া যায়।
রুহান আবার মাথা নেড়ে বলল, কিছু প্রয়োজন নেই।
সে হেঁটে চলে যাচ্ছিল, লোকটা পিছন থেকে চিৎকার করে বলল, ঠিক আছে! পাঁচশ ইউনিট!
রুহান মাথা নেড়ে বলল, এক ইউনিটও না।
রিদি আর রুহান হাঁটতে হাঁটতে শুনতে পেল মানুষটা পিছন থেকে চিৎকার করে বলল, ঠিক আছে! একশ ইউনিট।
রুহান এবারে আর কথার উত্তর দিল না। মানুষজনের ভিড় ঠেলে হেঁটে একটু এগিয়ে যেতেই কে যেন রুহানের আস্তিন টেনে ধরে। রুহান মাথা ঘুরিয়ে দেখে ঢুলুঢুলু চোখের একজন মানুষ, রুহানের হাতের বইগুলো দেখিয়ে বলল, তুমি এইগুলো ইউনিট খরচ করে কিনেছ?
হ্যাঁ, কেন? কী হয়েছে?
পূর্ব দিকে জঙ্গলের কাছে একটা দালান ভেঙ্গে পড়ে আছে, সেখানে গুলো পড়ে থাকে–হাজার হাজার। পোকা মাকড়ে খায়। আর তুমি বেকুব, এগুলো ইউনিট খরচ করে কিনেছ! তোমাদের মতো বোকা মানুষ আছে বলে অন্যেরা খেয়ে পরে বেঁচে থাকে।
রুহান হাসি চেপে রেখে বলল, কথাটা তুমি ভুল বল নাই। তবে তুমি আমাকে যতটা বোকা ভেবেছ, আমি তত বোকা নই। এই বইগুলো কোথায় পাওয়া যায় সেই খবরের জন্যে আমি কিন্তু একটা ইউনিটও খরচ করি না!
ঢুলুঢুলু চোখের মানুষটা বলল, তোমরা এখানে নতুন এসেছ?
হ্যাঁ।
তোমাদের কিছু লাগবে? কিছু সুন্দরী মেয়ে বিক্রি হচ্ছে।
রুহান আর রিদি একসাথে মাথা নেড়ে বলল, না লাগবে না।
খুব ভালো ক্লিনিক আছে পরিচিত। জটিল অপারেশন করাতে পার। গোপন অসুখ থাকলে-–
রিদি মাথা নেড়ে বলল, না, কোনো গোপন অসুখ নেই আমাদের।
ঢুলুঢুলু চোখের মানুষটা আবার কী একটা বলতে যাচ্ছিল, রুহান আর রিদি তাকে কোনো সুযোগ না দিয়ে দ্রুত সামনে হেঁটে যেতে শুরু করল।