বলেন বৈশম্পায়ন শুন জন্মেজয়।
দ্রৌপদীরে তেয়াগিয়া পাণ্ডুর তনয়।।
শোক মোহ কাম ক্রোধ লোভ আদিছাড়ি।
পঞ্চ ভাই গঙ্গাতীরে যান স্বর্গপুরী।।
যাইতে উত্তরমুখে পাণ্ডুর নন্দন।
তাম্রচূড় গিরি করিলেন আরোহণ।।
পর্ব্বত দেখিয়া সুখী পাণ্ডুর তনয়।
শঙ্খনাদে পূরিল সর্ব্বত্র জয় জয়।।
আকাশ পরশে চূড়া অতি ভয়ঙ্কর।
সপ্ত অশ্ব রথে যায় দেবতা ভাঙ্কর।।
কালচক্র ফিরে সদা আপনার কাছে।
বৃক্ষ লতা নাহি তথা ভাস্করের তেজে।।
পাপিষ্ঠ পরাণী যদি তথা গতি করে।
আরোহণ মাত্রে সেইক্ষণে পুড়ে মরে।।
দেখিয়া বিস্ময়াপন্ন ভাই পঞ্চজন।
কালাগ্নি রুদ্রের পুরী ভয়ঙ্কর বন।।
অতিশয় প্রচণ্ড প্রতাপ তেজ তাঁর।
নিকটে যাইতে শক্তি নাহিক কাহার।।
আছেন ঈশ্বর তথা দশমূর্ত্তি ধরি।
দ্বারে থাকি পঞ্চ ভাই নমস্কার করি।।
স্তব করি বর পেয়ে করিল গমন।
ক্রৌঞ্চ নামে পর্ব্বতে করিল আরোহণ।।
ক্রৌঞ্চের নির্ম্মাণ পুরী অতিশয় শোভা।
ইন্দ্রের খাণ্ডব জিনি কনকের প্রভা।।
স্বর্গ হৈতে নামে তাতে গঙ্গা সরস্বতী।
হংস চক্রবাক জলে চরে হৃষ্টমতি।।
সুবর্ণের পাখা পক্ষী আছে বহুতর।
জল স্থল আবাস উদ্যান মনোহর।।
নির্ম্মল উজ্জ্বল জল স্ফটিক আকার।
তীরে তপ করে মুনি জ্ঞান অনুসার।।
দেখিয়া হরিষ বড় পাণ্ডু পুত্রগণ।
স্বর্ণের মণ্ডপ তথা দেখি বিচক্ষণ।।
অতি অপরূপ পুরী প্রাসাদ মন্দির।
অন্ধকারে আলো করে জিনিয়া মিহির।।
পুষ্করাক্ষ নামে শিব মণ্ডপ ভিতর।
তাঁর পূজা করে দেব দানব ঈশ্বর।।
কিন্নরের রাজপুরী অতি অনুপম।
স্থাপিয়াছে দেব দেব মহাদেব নাম।।
বীণা বংশী বাজে কেহ গায় শিবগীত।
গন্ধর্ব্ব কিন্নর যক্ষ সবে আনন্দিত।।
চারিপাশে স্তুতি করে নাচয়ে নর্ত্তনী।
অন্য জাতি নারী নাহি সকল ব্রাহ্মণী।।
কেহ গন্ধ চুয়া দেয় পুষ্প পারিজাত।
বিল্বপত্রে গালবাদ্যে পূজে বিশ্বনাথ।।
স্তবপাঠ করে কেহ শিবের সাক্ষাতে।
একপদে স্তব কেহ করে যোড়হাতে।।
সেবিলে সকল পাপ হয় তার ক্ষয়।
অনেক তপস্বী ঋষি করয়ে আশ্রয়।।
নিরবধি সবে সেবে শিবের চরণ।
অন্তরীক্ষে আছে কেহ যোগপরায়ণ।।
দেখি পঞ্চভাই করিলেন স্নানদান।
লোভ মোহ ছাড়িয়া পাইল দিব্যজ্ঞান।।
স্নান করি পাণ্ডব হইল কুতূহলী।
পিতৃলোকে উদ্দেশিয়া দেন জলাঞ্জলি।।
প্রবেশ করেন সবে মণ্ডপ ভিতরে।
বিবিমতে পঞ্চভাই পূজিল শঙ্করে।।
করযোড়ে প্রভু রুদ্রে মাগিলেন বর।
পুনঃ জন্ম নাহি হয় মর্ত্ত্যের ভিতর।।
এত বলি প্রণমিয়া যান তথা হৈতে।
দেবপুষ্প পড়ে আসি ভূপতির মাথে।।
দেখিয়া তপস্বিগণ প্রফুল্ল অন্তরে।
আদর করিল বড় রাজা যুধিষ্ঠিরে।।
এই তীর্থে থাক রাজা মোসবার সঙ্গে।
কোথাকারে কোন্ হেতু যাবে কোন্ ভাগে।।
এত শুনি যুধিষ্ঠির বলেন হাসিয়া।
নিষ্কণ্টক নিজ রাজ্য, সকলি ত্যজিয়া।।
সঙ্কল্প করেছি আমি মর্ত্ত্যের ভিতর।
স্বর্গপুরে যাইব দেখিব দামোদর।।
আশীর্ব্বাদ কর মোরে সব মুনিগণ।
স্বর্গে গিয়া দেখি যেন দেব নারায়ণ।।
এত শুনি বলে তারে ক্রৌঞ্চ মুনিবর।
তব তুল্য রাজা নাহি অবনী ভিতর।।
সমস্ত ত্যজিয়া যাহ স্বর্গের বসতি।
দেখিয়া গোবিন্দ পদ পাবে দিব্যগতি।।
তাঁরে নমস্কার করি ধর্ম্মের নন্দন।
উত্তরমুন্ডেতে যাত্রা করেন তখন।।
বদরিকা শ্রমে দেখি জাহ্নবীর কূলে।
বদরিক বৃক্ষ তথা শোভে ফল ফুলে।।
অমৃত জিনিয়া স্বাদু পিক নাদে ডালে।
জরা মৃত্যু ভয় নাহি তথায় থাকিলে।।
দুর্ব্বাসার বরে বৃক্ষে অক্ষয় অব্যয়।
নানা বর্ণে নানা স্থল দিব্য দেবালয়।।
করয়ে তপস্যা তীরে কত শত মুনি।
তরঙ্গ নির্ম্মল বহে গঙ্গা মন্দাকিনী।।
দুর্ব্বাসা গৌতম ভরদ্বাজ পরাশর।
অশ্বথামা আঙ্গিরস আর সোমেশ্বর।।
ঋষিগণ বলে তবে রাজাকে দেখিয়া।
হেথায় থাকহ রাজা আমা সবা লৈয়া।।
দেবতা গন্ধর্ব্ব এথা আছে শত শত।
পঞ্চভাই থাক সুখে সবার সহিত।।
অশ্বথামা আসিয়া মিলিল পঞ্চজনে।
পূর্ব্ব শোক স্মরিয়া কান্দয়ে দুঃখমনে।।
অশ্বথামা বলে থাক বদরিকাশ্রমে।
পাপ মুক্ত হৈয়া, হরি পাবে পরিণামে।।
এতেক শুনিয়া বলিলেন যুধিষ্ঠির।
না করিব স্থিতি মোরা থাকিতে শরীর।।
সঙ্কল্প করিনু আমি কৃষ্ণের সাক্ষাতে।
যাইব অমরপুরে সুমেরু পর্ব্বতে।।
সঙ্কল্প লঙ্ঘিলে হয় ব্রহ্মবধ ভয়।
অতএব কহি শুন তপস্বী তনয়।।
যে হোক সে হোক, থাকে যায় বা জীবন।
যাইব বৈকুণ্ঠপুরী যথা নারায়ণ।।
অশ্বথামা বলে, কোথা দ্রুপদ নন্দিনী।
যুধিষ্ঠির কন, পথে ত্যজিল পরাণী।।
শুনি হাহাকার করি কান্দে দ্রোণসুত।
হাহা কৃষ্ণা সুবদনী রূপ গুণযুত।।
তবে গুরুপুত্রে বন্দিলেন সর্ব্বজন।
উত্তর মুখেতে যান পাণ্ডুর নন্দন।।
কতদূরে গঙ্গাতীরে দেখে নৃপবর।
পর্ব্বত রৈবত নামে অতি মনোহর।।
স্বর্গ মর্ত্ত্য দুর্ল্লভ বিচিত্র উপবন।
অরোহেণ সে পর্ব্বতে ভাই পঞ্চজন।।
রেবা নামে পুণ্য নদী পর্ব্বত উপর।
অতি সুনির্ম্মল জল শোভে মনোহর।।
তীরে রেবানাথ বিষ্ণুমূর্ত্তি চতুর্ভুজ।
প্রণমেন যুধিষ্ঠির সহিত অনুজ।।
মণি মরকত পুরী অতি শোভা করে।
চৌরশী যোজন তার উপরে বিস্তারে।।
বৃক্ষে অন্ধকার নাহি জানি দিবারাতি।
তিন লক্ষ কিরাত কুৎসিত মূর্ত্তি অতি।।
নানাবর্ণে অস্ত্র ধরে প্রচণ্ড কিরণ।
মণি রত্নে বিভূষিত লোহিত বরণ।।
পিন্ধন গাছের ছাল তাম্রবর্ণ কেশ।
কর্ণে রামকড়ি সাজে ভয়ঙ্কর বেশ।।
কেহ মালসাট মারে কেহ দেয় লম্ফ।
কেহ অন্তরীক্ষে কেহ জলে দেয় ঝম্ফ।।
বাণ বৃষ্টি করিয়া করিল অন্ধকার।
ভাবেন না দেখি পথ পাণ্ডুর কুমার।।
মহাহিমে কাঁপে তনু পায়ে বাজে শীলা।
বিষণ্ণ হইয়া তবে ভাবিতে লাগিলা।।
তিন লক্ষ কিরাত করিল বানবৃষ্টি।
প্রলয়কালেতে যেন সংহারিতে সৃষ্টি।।
সাত্যবাদী পাণ্ডুপুত্র গোবিন্দ সহায়।
একগুটি বাণ তার না লাগিল গায়।।
দেখিয়া কিরাতগণ অদ্ভুত মানিল।
এড়িয়া ধনুক বাণ নমস্কার কৈল।।
জিজ্ঞাসিল তোমা সবে কোন মহাজ্ন।
কিবা নাম কোথা ধাম কোথায় গমন।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন শুন পরিচয়।
চন্দ্রবংশে জন্ম মম পাণ্ডুর তনয়।।
দ্বাপর হইল শেষ কলি আগমন।
স্বর্গপুরে যাই মোরা তথির কারণ।।
রাজার বচনে বলে কিরাত প্রধান।
এই দেশে রাজা হও তুমি পুণ্যবান।।
স্বর্গসুখ পাবে তুমি এস্থানে রাজন।
নিরন্তর তোমারে সেবিবে দেবগণ।।
তা সবারে মৃদুভাষ বিদায় করিয়া।
স্বর্গপথে পান রাজা গোবিন্দ স্মরিয়া।।
যাইতে পর্ব্বত মধ্যে দেখেন রাজন।
করয়ে শিবের সেবা কিরাত ব্রাহ্মণ।।
অপূর্ব্ব দেখিয়া ভাবিলেন মনে মন।
বর মাগি লইল শঙ্করে পঞ্চজন।।
মহাশীতে হিমে ভেদি যান কতদূর।
সহদেব বীর পড়ি অঙ্গ হৈল চুর।।
অন্তকাল জানিয়া চিন্তিল নারায়ণ।
অবাক হইয়া পড়ি ছাড়িল জীবন।।
যুধিষ্ঠিরে শুনাইল বৃকোদর ধীর।
পর্ব্বতে ত্যজিল প্রাণ সহদেব বীর।।
পড়িল কনিষ্ঠ ভাই শুনহ রাজন।
দেখি শোকে কান্দিলেন ধর্ম্মের নন্দন।।
কোথাকারে গেল ভাই পরাণ আমার।
জ্যোতিষ শাস্ত্রের গুরু বুদ্ধির আধার।।
আমাদিকে ছাড়ি ভাই গেলে কোথাকারে।
বিপদে পড়িলে বুদ্ধি জিজ্ঞাসিব কারে।।
পরম পণ্ডিত ভাই মন্ত্রী চূড়ামণি।
যার বুদ্ধে রাজ্য পাই কুরুগণে জিনি।।
এত বলি পড়িলেন আছাড় খাইয়া।
হায় সহদেব বলি ভূমে লোটাইয়া।।
ভারত সমরে জয় কৈলা কুরুগণে।
শকুনিরে সংহারিলা সবা বিদ্যমানে।।
দিগ্বিজয় করিয়া করিলে মহাক্রতু।
মোরে এড়ি পর্ব্বতে পড়িলা কোন হেতু।।
বিষম সঙ্কটে বনে পাইয়াছ ত্রাণ।
পর্ব্বতে পড়িয়া ভাই হারাইলে প্রাণ।।
জননী কুন্তীর তুমি বড় প্রিয়তর।
হেন ভাই পর্ব্বতে রহিলা একেশ্বর।।
ধবল পর্ব্বতে কৃষ্ণা কৃষ্ণ বিষ্ণুলোকে।
কে জানিবে মম দুঃখ কহিব কাহাকে।।
দশদিক অন্ধকার দেখেন নয়নে।
স্থিরচিত্ত নৃপতির হৈল কতক্ষণে।।
ভীম জিজ্ঞাসেন রাজা কহিবে আমাতে।
কোন পাপে সহদেব পড়িল পর্ব্বতে।।
যুধিষ্ঠির বলেন যে শুন সাবধান।
সহদেব জ্ঞাত ভূত ভাবি বর্ত্তমান।।
পাশাতে আমারে আহবানিল দুর্য্যোধন।
বিদ্যমান ছিল ভাই মাদ্রীর নন্দন।।
হারিব জিনিব সেই ভাল তাহা জানে।
জানিয়া আমারে না করিল নিবারণে।।
বারণাবতেতে যবে দিল পাঠাইয়া।
আমাদিগে কপটে মারিতে পোড়াইয়া।।
জানিয়া না বলিলেক কুলের বিনাশ।
অধর্ম্ম হইল তেঁই পাপের প্রকাশ।।
এই পাপে যাইতে নারিল স্বর্গপুরে।
শুন বৃকোদর ভাই জানাই তোমারে।।
এত বলি যান রাজা করিয়া ক্রন্দন।
ভীমার্জ্জুন নকুল পশ্চাতে তিনজন।।
পথমধ্যে সরোবর দেখি বিদ্যমান।
যুধিষ্ঠির তাতে করিলেন স্নানদান।।
দেব ঋষি পিতৃলোকে করিয়া তর্পন ।
শুচি হৈয়া করিলেন স্বর্গ আরোহণ।।
সহদেব দ্রৌপদী চলিল স্বর্গপুরে।
ভেটিল গোবিন্দে আতি সানন্দ অন্তরে।।
জ্ঞাতি গোত্রগণ সঙ্গে হইল মিলন।
যুধিষ্ঠির পথ চাহি আছে সর্ব্বজন।।
ভারত পঙ্কজ রবি মহামুনি ব্যাস।
বিরচিল পাঁচালী প্রবন্ধে কাশীদাস।।