০৮. পনেরো, ষোলো, হেঁসেলেতে চলো
পোয়ারো এলেন হার্ট ফোর্ডনায়ারে। সেখানের একটি ছোট্ট চায়ের দোকানে গিয়ে বসলেন। আগেই সেখানে হাজির ছিলেন অ্যাগনেস ফ্লেচার। কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে তাদের বেশ কিছুটা সময় কেটে গেল।
অ্যাগনেস তার মা ও বাবার গল্প বললেন পোয়ারোকে। তিনি মন দিয়ে মিস ফ্রেচারের কথা শুনছিলেন।
অ্যাগনেসের বাড়ি ছিল গ্লস্টারসায়ারের লিটল ডারলিংহামে। তারা দু’ভাইবোন। তার বাবা-মা সর্বদা পুলিশি ঝামেলা থেকে দূরে থাকতেন। তাদেরও সাবধানে থাকার পরামর্শ দিতেন। তাই এখন তার চিন্তা তিনি যদি পুলিশি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন। তাহলে তার বাবা-মা নিশ্চয়ই মারা যাবেন। আর তাদের মৃত্যুর দায় তাকেই নিতে হবে।
এরকুল পোয়ারো ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করলেন–আপনি মিস মর্লেকে কি কিছু জানিয়েছেন?
অ্যাগনেস বলল–না, স্যার, আমি তাকে কিছু জানাইনি। কারণ তিনি শুনলে আমার ওপর রাগ করতেন। কাগজে দেখলাম, কর্তামশাই ভুল করে কাউকে ওষুধ দিয়েছিলেন। পরে ভুল বুঝতে পেরেছিলেন এবং অনুতপ্ত হয়ে আত্মহত্যা করেন।
পরে অন্য ভাবনা এল কখন থেকে?
মিস নেভিলের প্রেমিক ফ্রাঙ্ক কার্টারের সংবাদ যেদিন কাগজে বেরিয়েছিল। আমিও সেই খবরটা পড়েছি। দেখলাম সে একজন ভদ্রলোককে গুলি করে মারার চেষ্টা করেছিল। তখনই ভাবলাম নিশ্চয়ই ওর মাথার গণ্ডগোল আছে। তার ধারণা ছিল চারপাশের সব মানুষই তার শত্রু। তাদের কাউকেই সে বিশ্বাস করত না। এরকম মানসিক রোগে অনেকেই ভোগেন শুনেছি। মি. কার্টারও তাদের মতোই একজন। আমি জানি মি. মর্লের ওপর মি. কার্টারের আক্রোশ আছে। কারণ মি. মর্লে মিস নেভিলকে ফ্র্যাঙ্ককে বিয়ে করতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু মিস নেভিল সে কথা কানে নেননি। তা সত্ত্বেও আমরা ভাবতে পারিনি তিনি আমার মনিবের হত্যাকারী হবেন। তাই ব্যাপারটা কি রকম। অদ্ভুত লাগছে আমার।
পোয়ারো প্রকৃত ঘটনা জানার জন্য বললেন–কি অদ্ভুত?
–যেদিন আমার মনিব আত্মহত্যা করেন সেদিনের ঘটনা। সকাল বেলার চিঠিগুলো চিঠির বাক্স থেকে বের করে অ্যালফ্রেড। তারপর সেগুলো মি. মর্লের টেবিলের ওপর রাখে। স্যার সময় সুযোগ মতো সেগুলো দেখে নেন। সেদিন অ্যালফ্রেড ব্যস্ত থাকায় চিঠিগুলো বের করতে পারেনি সেইজন্য আমি ভাবছিলাম বের করে আনার কথা। সেই কারণে সিঁড়ির নীচের ধাপে দাঁড়িয়ে। অ্যালফ্রেড কি করছে তা দেখার চেষ্টা করছিলাম। এমন সময় একজনকে দেখে আমি চমকে উঠি। ফ্র্যাঙ্ক কার্টার কর্তার ঘরের ওপরের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে। ও নীচের দিকে কি যেন খুঁজছিল। তার চোখে মুখে উত্তেজনা ফুঠে উঠেছিল। দৃশ্যটা যতই ভাবি ততই কেমন যেন অদ্ভুত মনে হচ্ছিল।
পোয়ারো জানতে চাইলেন তখন কটা বেজেছিল?
–তখন প্রায় সাড়ে বারোটা হবে, স্যার। অ্যাগনেস একটু থামল। তারপর আবার বলতে শুরু করল, এদিকে সেদিন মিস নেভিল অনুপস্থিত। তাই ভাবলাম একবার তার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। ঠিক সেই মুহূর্তে দেখলাম ফ্রাঙ্ক অস্থির পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যেখানে কর্তার সার্জারির ঘর আছে। আমি ভাবলাম ও মনস্থির করে ফেলেছে কর্তার সঙ্গে বোঝাঁপড়া করার। তাই আমার ভয় হল। কারণ কর্তা ওকে মোটেই পছন্দ করতেন না। বিশেষ করে রোগী দেখার সময়। নিশ্চয়ই তাদের মধ্যে বিবাদ শুরু হবে। এমন সময় মিস মর্লে আমাকে ডাকলেন আর আমিও ওপরে চলে যাই। পরে শুনলাম কর্তা নিজেই গুলি করে আত্মহত্যা করেছেন। খবরটা শুনে প্রথম মুহ্যমান হয়ে পড়ি যে ফ্র্যাঙ্কের কথাটা ভুলে গিয়েছিলাম।
এক নাগাড়ে এতগুলো কথা বলে একটু থামল অ্যাগনেস। দম নিল। মুহূর্ত কয়েক কেটে গেল। আবার বলে উঠল সে, এরপর পুলিশ এলো। সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করল। তারপর কর্তার মৃতদেহ নিয়ে সবাই চলে গেলে আমি এমাকে ফ্রাঙ্কের কথা বলি। কার্টার যে কর্তার ঘরে গিয়েছিল তা পুলিশের কাছে গোপন করেছি। এতে এমা অসন্তুষ্ট হন এবং বলেন পুলিশকে জানানো উচিত ছিল। কিন্তু আমরা কেউই চাইনি মিস নেভিলের বন্ধুকে বিপদে ফেলতে। তাই এতদিন মুখ বন্ধ করেছিলাম। সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। তারপর পুলিশের সিদ্ধান্ত জানতে পারলাম। তাদের মতে কর্তা আত্মহত্যা করেছেন। কেউ তাঁকে খুন করেনি। এতে স্বস্তি পেয়েছিলাম একথা ভেবে ফ্র্যাঙ্ক নির্দোষ। আবার যখন খবরের কাগজে দেখলাম সে একজনকে গুলি করেছে তখন অন্য ভাবনা মাথায় এল। ভাবলাম ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আর ওই কর্তাকে খুন করেছে।
পোয়ারো লক্ষ্য করলেন কথা বলার সময় অ্যাগনেসের চোখ ভয়ে বড় হয়ে উঠেছে। সে কাতরভাবে মিনতি করল–আমি যাতে বিপদে না পড়ি দেখবেন, স্যার।
পোয়ারো তাকে আশ্বস্ত করলেন। বললেন–ভয় নেই তোমার অ্যাগনেস। তোমার কোনো ক্ষতি হবে না। নিশ্চিন্ত থাকো। তবে আমাকে বলে তুমি ঠিক কাজই করেছো।
ধন্যবাদ, স্যার। আমার মনটা অনেকখানি হালকা হল। তখন থেকে চিন্তা হচ্ছে মা এটা কিভাবে নেবেন। পুলিশের সঙ্গে এভাবে জড়িয়ে পড়াটা বোধহয় ভালো হল না।
না, না, কিছু চিন্তা করো না অ্যাগনেস। তুমি আমাদের সহযোগিতা করায় আমাদের খুব সুবিধা হল। সব মায়েরা চান তাদের ছেলে মেয়েরা সর্বদা সুখে থাকুন।
এরকুল পোয়ারো অ্যাগনেসের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এলেন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে।
চিফ ইনসপেক্টর জ্যাপ সেই সময় তাঁর অফিস ঘরে বসেছিলেন। তাঁকে পোয়ারো বললেন–আমি একবার কার্টারের সঙ্গে দেখা করতে চাই। আপনি ব্যবস্থা করুন।
জ্যাপ কটাক্ষ করে বললেন–ব্যাপার কি, বন্ধু? কোনো খবর আছে কি?
পোয়ারো দ্রুত বললেন–আপনার অনুমতি পাওয়া যাবে কি?
জ্যাপ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন–ওহ, বন্ধু, এত চটে যাচ্ছেন কেন? আমি কি আপত্তি করেছি। করে কি লাভ হবে? হোম সেক্রেটারির প্রিয়পাত্র স্বয়ং এসেছেন। সমস্ত ক্যাবিনেট যাঁর অঙ্গুলি হেলনে ওঠাবসা করে। তাকে আমি দেব বাধা। এত সাহস আমার নেই।
এরকুল পোয়ারোর চোখের সামনে ভেসে উঠল বহুদিনের পুরোনো একটি ঘটনা, অভিযান স্টেবল সাঙ্গ করার ঘটনা। তিনি বললেন–কত মাথা খাঁটিয়ে বুদ্ধি বের করতে হয়েছে বলুন। এটা অস্বীকার করতে পারবেন না, বন্ধু।
আপনিই একমাত্র সেই মানুষ যিনি এতবড় ঝুঁকি নিতে পারেন। সত্যিই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন সেদিন। আমার মনে হয় আপনার জীবনের প্রতি মায়া নেই। জ্যাপ পোয়ারোর দিকে তাকালেন। তাঁর মুখ গম্ভীর হয়ে রয়েছে। তিনি আবার বললেন–আপনি কার্টারের সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন কেন? শুনতে পারি কি কারণটা?
জ্যাপকে অবাক করে দিয়ে পোয়ারো বললেন–ওকে জিজ্ঞাসা করব সে কি মি. মর্লেকে খুন করেছে?
জ্যাপ হাসতে হাসতে বললেন–আর কার্টারও আপনার কথায় সায় দেবে?
পোয়ারো গম্ভীর স্বরে বললেন–হয়তো বলবে, আবার নাও বলতে পারে।
পোয়ারোর দিকে আড় চোখে তাকিয়ে জ্যাপ বললেন–আপনাকে আমি বহু বছর ধরে চিনি। তবু আজও আপনাকে ভালোভাবে বুঝতে পারলাম না। আপনি কখন কি উদ্দেশ্যে কাজ করেন তা জানি না। তবে এটা জানি আপনার মনে কোনো রকম সন্দেহ উদয় হলে একাজ করে থাকেন। তবে কি ধরে নেব ফ্র্যাঙ্ক কার্টার সম্পর্কে এমন কোন অভিযোগ পেয়েছেন যা আপনাকে অস্থির করে তুলেছে। আপনি যাচাই করে নিঃসন্দেহ হতে চান সে নির্দোষ কিনা?
পোয়ারো সজোরে মাথা নেড়ে বললেন–না, না, আপনি ভুল করছেন, বন্ধু এর উল্টোও হতে পারে।
মাঝে মাঝে আমার মনে হয় আপনি বড় বেশি আবেগপ্রবণ। ফ্র্যাঙ্কের প্রেমিকার জন্যই বুঝি তাকে বাঁচাতে চাইছেন? কথাটা বলে জ্যাপ হেসে উঠলেন।
পোয়ারো উত্তেজিত হয়ে বললেন–আমি আবেগতাড়িত নই। এটা আমার স্বভাববিরুদ্ধ। এটা ইংরেজদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আমি যুক্তি দিয়ে বিবেচনা করি। ফ্র্যাঙ্ক কার্টার যদি খুনি প্রমাণিত হয় তাহলে আমি নিশ্চয়ই চাইব না মিস নেভিল তাকে বিয়ে করুক। আবেগের বশবর্তী হয়ে যদি বিয়ে করে তাহলে দু-এক বছরের মধ্যে তাকে বিধবা হতে হবে। কারণ সে ক্ষেত্রে ফ্র্যাঙ্ক কার্টারের ফাঁসি অবধারিত।
–তাহলে কেন আপনি মানতে পারছেন না যে সে অপরাধী?
–আমি বিশ্বাস করি সে নিরপরাধী।
–আপনি এত জোর দিয়ে বলছেন কি করে? তাহলে কিছু কি আপনি জানতে পেরেছেন? যদি জানেন তাহলে গোপন করছেন কেন আমাকে? আমার পরিষ্কারভাবে জানা উচিত। বলুন, পোয়ারো।
পোয়ারো শান্ত স্বরে বললেন–সময় হলে সব জানাব আপনাকে। কিছুদিনের মধ্যেই একজন প্রত্যক্ষদশীকে আপনার কাছে এনে হাজির করব। সে আপনাদের তদন্তের কাজে সহযোগিতা করবে। তার সাক্ষে কার্টারের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ সহজ হয়ে যাবে। আর তদন্তের কাজও দ্রুত এগিয়ে যাবে।
জ্যাপ বিরক্ত হয়ে বললেন–তাহলে তার সঙ্গে দেখা করার দরকার কি আপনার? আমার সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।
পোয়ারো বললেন নিজেকে খুশি করার জন্য।
জ্যাপ আর কথা না বাড়িয়ে পোয়ারোকে নিয়ে গেলেন গারদের কাছে। যেখানে ফ্র্যাঙ্ক কার্টারকে রাখা হয়েছিল।
বিপর্যস্ত, ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল ফ্র্যাঙ্ককে। রুক্ষ মেজাজ। তার সাক্ষাপ্রার্থী এরকুল পোয়ারোকে দেখে সে বেশ অসন্তুষ্ট হল। সে মুখ বিকৃত করে বলল–লালমুখো গোয়েন্দা, এখানেও এসেছেন? কি চাই আপনার? আমাকে গ্রেপ্তার করেও খুশি হননি আপনি?
পোয়ারো শান্ত স্বরে বললেন–আপনাকে কিছু বলার আছে।
–বেশ, আমার উত্তর কিন্তু আপনি পাবেন না। অন্তত আমার উকিল না আসা পর্যন্ত। যা বলার আমি তার সামনেই বলতে চাই। আমার অধিকার আছে উকিল নেবার। এর বিরুদ্ধাচরণ করতে পারেন না আপনি।
–অবশ্যই উকিল নেবার অধিকার আপনার আছে। তাকে আপনি ডাকতে পারেন। তবে আমি পরামর্শ দেব এখন তাকে ডাকার প্রয়োজন নেই। আপনার মঙ্গলের জন্যই বলছি।
ফ্র্যাঙ্ক দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলল–কৌশলে আমার থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করার মতলব করেছেন বুঝি। নিজেকে খুব চালাক মনে করেন তাই না।
–এটা আপনার ভুল ধরণা। এটা আমাদের গোপন সাক্ষাৎ। আমরা তিনজন ছাড়া আর কেউ জানতে পারবে না।
ফ্র্যাঙ্ক কার্টার বিদ্রূপ করে বলল–সেটাই আশ্চর্য লাগছে। নিশ্চয় আড়ালে অন্য পুলিশরা রয়েছে। তাছাড়া আমি আপনার ফাঁদে পা দিচ্ছি না। বুঝেছেন?
পোয়ারো ধীরে ধীরে বললেন–অ্যাগনেস ফ্রেচার নামে কোনো মহিলাকে আপনি চেনেন?
ফ্র্যাঙ্ক সংক্ষেপে উত্তর দিল না। কখনো নাম শুনিনি।
–সে ৫৮ কুইন শার্লট স্ট্রিটের পার্লার মেইড।
হতে পারে, তাতে আমার কি?
–যেদিন সকালে হেনরি মর্লেকে গুলি করা হয় সেদিন সে আপনাকে ওখানে দেখেছিল। সেদিন সে উপরের তলায় সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। নীচের তলায় অ্যালফ্রেডকে সে তখন খুঁজছিল। আর সেই সময় আপনাকে দেখতে পায় মি. মর্লের ঘরের দিকে যেতে। সময়টা বারোটা থেকে সাড়ে বারোটার মধ্যে হবে।
ফ্র্যাঙ্ক কার্টারের শরীর কেঁপে উঠল; সে দরদর করে ঘামতে লাগল। সে অস্থির হয়ে উঠল। সে চিৎকার করে বলল–বাজে কথা! আপনারা ওকে টাকা খাইয়ে মিথ্যে সাক্ষী সাজিয়েছেন। আমাকে ফ্যাসাদে ফেলার জন্য। ও মিথ্যে বলছে। আমি তখন ওখানে ছিলাম না। ও আমাকে দেখতে পারে না।
–আপনি পুলিশকে জানিয়েছেন সেই সময় আপনি মেরিলিবোস রোড দিয়ে হাঁটছিলেন। তাই তো?
–হুঁ, ঠিক তাই। সে আমাকে দেখে থাকলে আগে পুলিশকে জানায়নি কেন?
–সে একটু দোটানায় পড়েছিল। বুঝতে পারছিল না। তার কি করা উচিত। সে তার বন্ধু এমাকে বলেছিল। এমা মি. মর্লের বাড়ির রাঁধুনি। যখন আদালতের সিদ্ধান্ত জানতে পারল তারা তখন নিশ্চিন্ত বোধ করল। ভাবল মি. মর্লে আত্মহত্যা করেছেন। তাই তোমার কথা তারা পুলিশকে জানানো দরকার মনে করল না।
আমি এসব কথা বিশ্বাস করি না। আপনারা ষড়যন্ত্র করে ওদের দিয়ে এইসব কথা বলাচ্ছেন। ফ্র্যাঙ্ক ক্ষিপ্ত হয়ে গাল দিয়ে চলল।
পোয়ারো ও জ্যাপ চুপ করে শুনছেন। ধীরে ধীরে কার্টারের রাগ স্তিমিত হল। সে শান্ত হতে পোয়রো বলতে শুরু করলেন রাগ করলে আর বোকার মতো গালমন্দ করলে আপনার ক্ষতিই হবে। লাভ কিছুই হবে না। ওই দুজন মহিলা এখনও পুলিশকে কিছুই জানায়নি। তবে কোনো একদিন জানাবে নিশ্চয়। অ্যাগনেস ফ্রেচার আপনাকে দেখে চিনতে পেরেছিল। ওই সময় আপনি ছাড়া অন্য কেউ সেখানে ছিল না। আর আপনি সত্যিই মি. মর্লের ঘরে গিয়েছিলেন। তারা সত্যি কথাই বলছে। আর পুলিশও তা বিশ্বাস করবে। কার্টারের ভাব বোঝার চেষ্টা করলেন তিনি। তিনি অপেক্ষায় রইলেন। আবার তিনি বলতে শুরু করলেন, এবার আপনি বলুন এরপর কি হয়েছিল?
ক্রুদ্ধ স্বরে বলল–সব মিথ্যে সব মিথ্যে!
তার বলার ধরন দেখে এরকুল পোয়ারোর ভীষণ খারাপ লাগল। তিনি ভাবলেন, ফ্র্যাঙ্ক কার্টার একজন মিথ্যেবাদী, অসৎ প্রকৃতির মানুষ। তাকে রক্ষা করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এ না থাকলে কারো কোনো ক্ষতি হবে না। এ যেভাবে মিথ্যে বলছে তাতে মৃত্যুদণ্ডই তার উপযুক্ত শাস্তি হবে।
তবুও পোয়ারো একবার শেষ চেষ্টা করলেন। তিনি বললেন–আমি চাই সত্যিটা প্রকাশ পাক।
ফ্র্যাঙ্ক কার্টার বোকা নয়। সে বুঝতে পারল এই মিথ্যে বলাই তার আত্মসমর্থনের শ্রেষ্ঠ অস্ত্র। সে যদি একবার বলে ওই সময় মর্লের ঘরে গিয়েছিল তাহলে বিপদ বাড়বে বই কমবে না। আর তার অন্যান্য কথাও মিথ্যে বলে ধরা হবে।
সুতরাং সে ঠিক করল সে মিথ্যেই বলবে। ক্রমাগত মিথ্যে বলে চললে পোয়ারোর আর কিছু করার থাকবে না।
এরকুল পোয়ারো ভীষণ ক্লান্ত বোধ করলেন। তিনি চলে যেতে উদ্যত হলেন।
সেই মুহূর্তে তীক্ষ্ণ চিৎকার করে ফ্র্যাঙ্ক কার্টার বলল আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে।
কিছু সময় কেটে গেল। পোয়ারো চলে গেলেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি অপেক্ষা করলেন।
পোয়ারো এবার ফ্র্যাঙ্কের খুব কাছে ঝুঁকে দাঁড়ালেন। তাঁর কণ্ঠস্বরে ব্যক্তিত্বের তীব্র প্রকাশ। তিনি বললেন আমি মিথ্যে বলছি না। আমাকে বিশ্বাস করলে ঠকবেন না। আমার আশা আমি আপনাকে বাঁচাতে পারব। নির্দোষ প্রমাণ করব। যদি আপনি সত্যি কথা বলেন। আপনি যদি মর্লেকে হত্যা না করে থাকেন তাহলে সত্যি বলতে আপনার অসুবিধা কোথায়? সেদিন সকালে ঠিক কি ঘটেছিল খুলে বলুন আমাকে।
ফ্র্যাঙ্ক কার্টার চঞ্চল হয়ে উঠল। সে জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটল। তার চোখের তারা স্থির হয়ে গেছে। ঠাণ্ডা দুটি চোখে বাস্তবিকই আতঙ্ক ফুটে উঠল। সে নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হল সে।
সে রূঢ় স্বরে বলল–ঠিক আছে, আমি সব বলব। আপনাকেই আমি গোপন জবানবন্দী দেব। আর যদি আপনি আমাকে প্রতারণা করেন তাহলে ঈশ্বর আপনাকে ক্ষমা করবেন না। আমি স্বীকার করছি আমি সেদিন মি. মর্লের চেম্বারে গিয়েছিলাম। আমার আশা ছিল তখন উনি ঘরে একা থাকবেন। ওই মহিলা সত্যিই আমাকে দেখতে পেয়েছে, ও মিথ্যে বলেনি। আমি সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম। তখনই মর্লের ঘর থেকে একজন বেরিয়ে এল। সে নীচে চলে যেতেই আমি ঘরে প্রবেশ করলাম। অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করলাম না। আমি ইতিমধ্যে মনস্থির করে ফেলেছি যা করার এই সুযোগে করতে হবে। উত্তেজনার বশে কি করব ঠিক করতে পারছিলাম না। ভেবেছিলাম তার সাথে দেখা করে দু-চার কথা শুনিয়ে দেব। আমার বিরুদ্ধে আমার বান্ধবীকে বলে তার মন ভেঙে দেওয়ার উচিত শিক্ষা দেব। কিন্তু ঘরের ভেতরে গিয়ে দেখলাম
একটু থামল ফ্র্যাঙ্ক। সে ঘন ঘন নিশ্বাস নিতে লাগল।
তারপর অনুনয়ের সুরে বলল-আপনি বিশ্বাস করুন, আমি একটিও কথা মিথ্যে বলছি না। দেখলাম মি. মর্লে মাটিতে পড়ে আছেন। প্রথমে চমকে উঠেছিলাম। কাছে গিয়ে দেখলাম তার নিশ্বাস পড়ছে না। তিনি মারা গেছেন। সারা শরীর বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। কপালে গুলির গর্ত। আর সেখান থেকে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। দৃশ্যটা মনে পড়ায় ফ্র্যাঙ্ক শিউরে উঠল।
পরক্ষণে বুঝতে পারলাম ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে চলেছি। সবাই বলবে আমিই তাকে গুলি করেছি। আমি তার হাত ও দরজার হাতল ধরেছিলাম। সেগুলোতে আমার হাতের ছাপ পড়েছিল। তাই রুমাল দিয়ে ভাল করে মুছে ছিলাম। এবং দ্রুতবেগে নীচে নেমে এলাম। একেবারে সোজা বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসি আমি। তখন আমার কোনো হিতাহিত জ্ঞান ছিল না।
আমি প্রতিজ্ঞা করে বলছি এতে এক বর্ণ মিথ্যে নেই। তিনি আমার যাওয়ার আগেই মারা গিয়েছিলেন। আমাকে বিশ্বাস করুন। ভয়ার্ত চোখে সে পোয়ারার দিকে তাকাল।
এরকুল পোয়ারো করুণ কণ্ঠে বললেন আমি বিশ্বাস করছি।
পোয়ারো যাবার জন্য পা বাড়ালেন। ফ্র্যাঙ্ক কার্টার চিৎকার করে বলল পুলিশ জানতে পারলে আমাকে ফাঁসি দেবে। আপনি আমায় বাঁচান।
পোয়ারো তাকে আশ্বস্ত করে বললেন–সত্য প্রকাশ করে আপনি নিজেকে ফাঁসির দড়ি থেকে রক্ষা করেছেন।
কিন্তু, ওরা বলবে।
পোয়ারো বাধা দিয়ে বললেন–আপনার বক্তব্য আমার অনুমানের সাথে মিলে যাচ্ছে। এখন আমি কি করি তাই দেখুন।
এরকুল পোয়ারো সেখান থেকে চলে এলেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে না যে তিনি সন্তুষ্ট হয়েছেন।
ইলিং-এ মি. বার্নেসের বাড়ি। এরকুল পোয়ারো যখন তাঁর বাড়ি পৌঁছলেন তখন সাতটা বাজে। মি. বার্নেস বাড়িতেই ছিলেন। তিনি পোয়ারোকে সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন।
বসার ঘর। তাঁরা দুজনে পাশাপাশি দুটি সোফায় বসে কথাবার্তা শুরু করলেন।
মি. বার্নেস বললেন–ভীষণ গরম পড়েছে। একটু বৃষ্টির প্রয়োজন। তা নাহলে আমার বাগানের সমস্ত ফুল গাছ নষ্ট হয়ে যাবে।
হঠাৎ পোয়ারোর গম্ভীর মুখের দিকে তার নজর পড়ল। তিনি বললেন–আপনাকে খুব ডিসটার্ব দেখাচ্ছে। কোনো তদন্ত নিয়ে চিন্তায় আছেন?
পোয়ারো বললেন–হ্যাঁ, আপনি ঠিক ধরেছেন। মাঝে মধ্যে এমন কেস আমার হাতে আসে যা ইচ্ছে না থাকলেও করতে হয়, মি. বার্নেস।
মি. বার্নেস সহানুভূতির সুরে বললেন আমি তা বুঝি, মঁসিয়ে পোয়ারো।
বাড়িতে ঢোকার মুখে পোয়ারো বাগানটি লক্ষ্য করেছিলেন। তিনি বার্নেসের রুচিবোধের প্রশংসা করে বললেন, বাগানটি খুব সুন্দর করে সাজিয়েছেন তো। বাহারি ফুলের গাছ লাগিয়েছেন। প্রত্যেকটি যেমন চমৎকার তেমনি সুগন্ধী। ছোট হলেও বাগানটি সত্যিই মনোরম।
বার্নেস প্রশংসায় কর্ণপাত করলেন না। তিনি শান্ত ও স্বাভাবিক কণ্ঠস্বরে বললেন, আশা করি, আপনি অপরাধীর খোঁজ পেয়েছেন?
-কে? ফ্র্যাঙ্ক কার্টার?
–অবশ্যই সে।
–আপনি হয়তো ভাবেননি এটা কোনো ব্যক্তিগত খুন?
–না, আমি তা ভাবিনি। অ্যামবেরিওটিস এবং অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টের ব্যাপারে আমি ভেবেছিলাম এটা কোনো গুপ্তচরদের কাজ।
–প্রথমে আপনার এই সন্দেহের কথাটা জানিয়েছিলেন আমাকে, মি. বার্নেস।
–হ্যাঁ, মনে পড়ছে। কারণ আমি তখন এই ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম।
–কিন্তু আপনার সন্দেহ ভুল ছিল।
–হ্যাঁ, সে কথা বলে আর লজ্জা দেবেন না, মঁসিয়ে পোয়ারো। ঝামেলায় পড়লে সকলে পূর্ব অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে। আর তার থেকেই নানা রকম মন্তব্য করে থাকে।
–পোয়ারো মিষ্টি হেসে বললেন আপনি কখনো কোনো ম্যাজিসিয়ানের তাসের জাদু খেলা দেখেছেন? অনেকগুলো তাসের মধ্যে থেকে একটি বেছে নিতে বলে।
–হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
–এখানেও ঠিক তাই করা হয়েছে। যখনই কেউ হেনরি মর্লের মৃত্যুর কোনো ব্যক্তিগত কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছে তখনই মাথায় এসেছে কয়েকটি শব্দ। তা হল অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট, অ্যামবেরিওটিস, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি। আর সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্ত করেছেন আপনি, মি.বার্নেস। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন এরকুল পোয়ারো।
মি. বার্নেস বিষণ্ণ সুরে বললেন–দুঃখিত, মঁসিয়ে পোয়ারো আমাকে ক্ষমা করবেন।
–আপনি দেশের অনেক খবর রাখেন। আমি আশা করেছিলাম আপনিই আমাকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে পারবেন। তাই আপনার কথায় গুরুত্ব দিয়েছিলাম আমি।
–তাহলে আপনি বলছেন মি. মর্লের মৃত্যুর পেছনে কারো ব্যক্তিগত আক্রোশ আছে।
–হ্যাঁ। খুনের মোটিভ অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমি ইতিমধ্যে অনেক সময় ব্যয় করেছি। যদিও এই ব্যাপারে ভাগ্য আমাকে সহায়তা করেছে।
বার্নেস ভ্রু কুঁচকে বললেন–ঠিক বুঝলাম না।
পোয়ারো কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন–কথাবার্তার কিছু অংশ আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। যদিও তখন এর তাৎপর্য বুঝতে পারিনি আমি।
বার্নেস বললেন–আপনি কেন হেঁয়ালি করে কথা বলছেন?
–আমাকে বিশ্বাস করে খোলাখুলি ভাবে কোনো কথা বলেননি আপনি। আমি আপনার কথার ভিত্তিতে এগোতে চেয়েছিলাম। তাই আপনার ভুল তথ্যের জন্য আমি দুঃখ পেয়েছিলাম।
বার্নেস অবাক হয়ে বললেন–আমি?
পোয়ারো কণ্ঠে তীব্রতা এনে বললেন–হ্যাঁ, আপনিই।
বার্নেস কাতর স্বরে বললেন–মঁসিয়ে পোয়ারো আপনি বিশ্বাস করুন ফ্র্যাঙ্ক কার্টারের সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না। আমি যেটুকু শুনেছি সে মর্লের মৃত্যুর আগেই তাঁর বাড়ি ছেড়ে ছিল। তার কথার সূত্র থেকে আপনি জানতে পেরেছেন আসল তথ্যটা। ফ্র্যাঙ্ক সেসময় সেই বাড়িতেই হাজির ছিল।
পোয়ারো বললেন–ফ্র্যাঙ্ক তখন ওই বাড়িতে ছিল বলেই খুনিকে দেখতে পেয়েছিল।
–তাহলে কার্টার নির্দোষ আর সে কি খুনিকে দেখতে পেয়েছিল, মঁসিয়ে পোয়ারো?
পোয়ারো মাথা নেড়ে জানালেন সেটা এখনও জানা যায়নি।