নীতিবোধ (উপনিষদ)
ভারতবর্ষে নীতিশাস্ত্রকে কখনো পৃথক চর্চার শাস্ত্ররূপে গণ্য করা হয় নি; প্ৰচলিত ধর্মীয় ভাবনার অন্তর্লীন ধারারূপেই তার অস্তিত্ব স্বীকৃত। যজ্ঞ যতদিন পর্যন্ত সর্বজনগ্রাহ্য ধর্ম ছিল, যজ্ঞানুষ্ঠানের আয়োজনকেই সৎকর্মরূপে গ্ৰহণ করা হত। সামাজিক ব্যবহাবের ঔচিত্য-অনৌচিত্য সম্পর্কে জনসাধারণের নিজস্ব ধারণা নিশ্চিত ছিল, যদিও বিশেষভাবে যজ্ঞের আলোচনায় পূর্ণ শান্ত্রসমূহে সুনির্দিষ্ট কোনো নীতির মানদণ্ড তৈরি হয় নি। কিন্তু কালক্রমে যজ্ঞানুষ্ঠান সম্পর্কে মনোযোগ যত শিথিল হ’ল এবং বহুজাতিক এ সমাজ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হতে লাগল, ততই সামাজিক ব্যবহার বিধি অধিকতর মনোযোগ আকর্ষণ করল। সমগ্র বৈদিক সাহিত্যের পরিধিতে একমাত্র উপনিষদেই নৈতিক আদর্শ সম্পর্কে প্রথম (?) একটি বিবরণ পাওয়া যায়।
তৈত্তিরীয় উপনিষদের একটি বিখ্যাত অংশে (১ : ১১ – ১-৪) আমরা যে সুস্পষ্ট নৈতিক ভাবাদর্শের সম্মুখীন হই, তা প্রকৃতপক্ষে কিছু বিচ্ছিন্ন ভাবনারই অভিব্যক্তি এবং অনেকাংশে অভিনব। এতে সত্য ও ধর্ম-এই দুটি মৌলিক তত্ত্বের উপর সম্পূর্ণ নুতনভাবে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ছান্দোগ্য উপনিষদের উপসংহারে বৈদিক আর্যজীবনের আদর্শটি উপস্থাপিত হয়েছে (৮ : ১৫ : ১)। এতে কৌতুহলজনক দিকটি হ’ল, পুনর্জন্ম নিবৃত্তির সঙ্গে এই আদর্শটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বিদ্যা, আচরণ ও সৎকর্ম সামাজিক মূল্যবোধের অঙ্গ; আবার এগুলি পিতৃলোক ও দেবলোক অর্জন করারও উপায় (বৃহদারণাক ১ : ৪ : ১৬ : ১০ : ৩ ও ছান্দোগ্য ৫ : ১০ : ২) উপনিষদে পিতৃযান ও দেবযানের যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তাতে গ্রাম ও অরণ্যের মধ্যবর্তী দ্বন্দ্ব ছাড়াও দ্বিবিধ লক্ষ্য, দ্বিবিধ পথ ও দ্বিবিধ গন্তব্যের মধ্যে বিরোধ আভাসিত হয়েছে। পাপ ও পুণ্যের দ্বন্দ্বও এই পর্বে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে (বৃহদারণ্যক ৩ : ২ : ১৩; কঠ ১ : ২ : ১) সত্য ও ধর্ম এখন একার্থিবহ ও অলঙ্ঘনীয়।
কর্ম, তপ, আত্মসংযম, সত্য, শ্রদ্ধা ইত্যাদি নবোদ্ভূত ভাবাদর্শগুলি এই যুগে অবশ্য পালনীয় সামাজিক মূল্যবোধরােপ স্বীকৃত ও সম্মানিত হয়েছে (কেন ৪ : ৮ : ৭; মুণ্ডক ৩ : ১ : ৭)। পার্থিব সম্পদ সম্পর্কে নিরাসক্তি, জীবনের প্রতি যথার্থ দৃষ্টিভঙ্গির সূচক হয়ে উঠেছে (ঈশ : ১)। কর্ম যেহেতু দোষাবহ ব’লে গণ্য, আকাঙ্ক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করা তাই কাম্য; নিষ্কাম কর্মী তাই শতায়ু হয়, এই বিশ্বাস জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। একটি প্রত্নকথায় দেবতা, মানুষ ও অসুরের মধ্যে নিহিত ব্যবধান ত্ৰিবিধ সামাজিক মূল্যবোধের পরিপ্রেক্ষিতে প্ৰদৰ্শিত হয়েছে (বৃহদারণ্যক ৫ : ৪ : ৫)। কিন্তু এতে যজ্ঞকেন্দ্ৰিক মূল্যবোধের পরিবর্তে সন্ন্যাসীর উপযুক্ত অহিংসা, উদারতা ও দয়ার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এতে মনে হয়, নৈতিক মূল্যবোধ ও আচরণবিধি মূলত সন্ন্যাসী সম্প্রদায়গুলিরই সৃষ্টি; এই ধারায় বহু চিন্তাবিদ মনীষী ও দার্শনিকের সৃষ্টি হয়েছিল।