নিশীতা ঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে আছে, রিয়াজ এক ধরনের অস্থিরতা নিয়ে ঘরের মাঝে পায়চারি করছে। ঘরের একমাথা থেকে অন্য মাথায় হেঁটে রিয়াজ ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে নিশীতার দিকে তাকাল। নিশীতা একটা নিশ্বান্স ফেলে বলল, আমি একটা জিনিস কিছুতেই বুঝতে পারছি না।
কী জিনিস?
মনে আছে আপনি বলেছিলেন এপসিলন আসলে খুব সহজ একটা প্রোগ্রাম? প্রশ্নের উত্তর দেয় প্রশ্ন করে?
হ্যাঁ।
কিন্তু সেটা তো আর সহজ প্রোগ্রাম হিসেবে থাকে নি। সেটা অত্যন্ত দক্ষ একটা প্রোগ্রাম হয়ে গেল–এত দক্ষ যে আমাকে সেলুলার ফোনে যোগাযোগ করে সতর্ক পর্যন্ত করে দিল।
হ্যাঁ। আমি লক্ষ করেছি।
সেটা কীভাবে সমম্ভব? সহজ একটা প্রোগ্রাম কেমন করে নিজ থেকে এত জটিল হয়ে যেতে পারে?
রিয়াজ হাসান মাথা নাড়ল, বলল, পারে না।
তা হলে কী হয়েছে?
ব্যাপারটা নিয়ে আমিও খুব বিভ্রান্তির মাঝে ছিলাম–ফ্রেডের কথা শুনে এখন আমি ব্যাপারটা খানিকটা আন্দাজ করতে পারছি।
কী আন্দাজ করতে পেরেছেন?
এখানে মহাজাগতিক প্রাণী পৌঁছানোর পর আমি আমার বাসায় যোগাযোগ করার কোডটি চালু করেছিলাম মনে আছে?
হ্যাঁ, মনে আছে।
সেই কোডটি মহাজাগতিক প্রাণীর পরিপূরককে নিয়ে আসছে।
নিশীতা মাথা নাড়ল, বলল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। পরিপূরক মানে কী?
রিয়াজ বলল, ব্যাপারটি জটিল, বলা যেতে পারে ব্যাপারটি একটি দার্শনিক ব্যাপার।
নিশীতা হাসার চেষ্টা করে বলল, ঘণ্টা দুয়েক পর মারা যাবার আগে মনে হয় দর্শন নিয়ে কথা বলাই সহজ।
হ্যাঁ ঠিকই বলেছ। আমি দেখি তোমাকে বোঝাতে পারি কি না। বুদ্ধিমত্তার গোড়ার কথা হচ্ছে এর মাঝে এক ধরনের সামঞ্জস্য থাকবে। ভালো–মন্দ খুব আপেক্ষিক কিন্তু বুদ্ধিমত্তার মাঝে যদি ভালো–মন্দ থাকে তা হলে তার মাঝে সামঞ্জস্য থাকবে। মোট কথা, ফ্রেডের মতো যদি পাজি মানুষের জন্ম হয় তা হলে তোমার মতো একজন ভালো মানুষেরও জন্ম হতে হবে। হিটলারের মতো দানবের জন্ম হলে দার তেরেসার মতো মহৎ মানুষের জন্ম হতে হবে।
চতুর্থ মাত্রার বুদ্ধিবৃত্তির জন্যও সেটা সত্যি। এর মাঝে যদি অশুভ অংশ থাকে তা হলে শুভ অংশ থাকতে হবে। ফ্রেড যে বর্ণনা দিয়েছে সেটি একেবারে খাঁটি অশুভ অংশ –কাজেই আমার ধারণা আমাদের আশপাশে তার পরিপূরক শুভ অংশটিও আছে। সেটাই এপসিলন ব্যবহার করে তোমার সাথে যোগাযোগ করছে। আমার সাথে যোগাযোগ করছে।
নিশীতা বলল, তার মানে পৃথিবীতে একটি মহাজাগতিক প্রাণী আসে নি–দুটি প্রাণী এসেছে। একটি ভালো একটি খারাপ? খারাপটি ফ্রেডের সাথে ভালোটি আমাদের সাথে?
রিয়াজ মাথা নেড়ে বলল, চতুর্থ মাত্রার প্রাণীর জন্য এত সহজে বলা যায় না।
কেন বলা যায় না?
মানুষের কথা ধরা যাক। আমাদের সবার মাঝে কি খানিকটা অশুভ যানিকটা শুভ অংশ নেই? তা হলে কোনটা সত্যি–শুভ অংশটুকু নাকি অশুভ অংশটুকু? একঙন মানুষ কি প্রাণের ইউনিট নাকি পুরো মানবজাতি প্রাণের ইউনিট? নাকি আমাদের শরীরের এক একটি কোষ এক একটি প্রাণ? তুমি ব্যাপারটা কীভাবে দেখতে চাও তার ওপর সেটা নির্ভর করে। মানুষ যদি চতুর্থ মাত্রার বুদ্ধিমত্তায় পৌঁছায় তা হলে কীভাবে দেখা হচ্ছে ব্যপারটি তার ওপর আর নির্ভর করবে না। এখানেও তাই—এই প্রাণীর বুদ্ধিমত্তার শুভ–অশু অংশ আছে সেটি একই প্রাণী না ভিন্ন প্রাণী আমরা আর সেই প্রশ্ন করতে পারি না।
নিশীতা মাথা নেড়ে বলল, আপনার কথা শুনে প্রথমে মনে হয়েছিল খানিকটা বুঝেছি, কিন্তু ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার পর আর কিছুই বুঝতে পারছি না!
আমি দুঃখিত–_
আপনার দুঃখিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। তপনি আমার সহজ একটা প্রশ্নের উত্তর দেন। মহাজাগতিক প্রাণীর শুভ অংশটুকু আমাদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য ডিজিটাল ইলেট্রনিক্স, কম্পিউটার, সেলুলার ফোন, রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি এইসব তুচ্ছ সহজ জিনিস বেছে নিয়েছে। এপসিলন প্রোগ্রামটা সে ব্যবহার করছে।
হ্যাঁ। সেটাই আমার ধারণা।
সেটাই যদি সত্যি হবে তা হলে যখন আমাদের সবচেয়ে বিপদ তখন সে আমাদের সাথে যোগাযোগ করছে না কেন?
কীভাবে করবে?
আমার সেলুলার ফোন দিয়ে।
তোমার সেলুলার ফোনে ব্যাটারির চার্জ নেই।
যে প্রাণী অন্য গ্যালাক্সি থেকে এখানে চলে আসতে পারে সে একটা ব্যাটারি নিজে চার্জ করতে পারে না আমি সেটা বিশ্বাস করি না।
রিয়াজ ঘরের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। প্রাণীটার এখন আমাদের সাথে যোগাযোগ করার কথা।
নিশীতা তার ব্যাগ খুলে তার সেলুলার ফোনটা হাতে নিয়ে কয়েকবার নেড়েচেড়ে দেখল, কানে লাগিয়ে বৃথাই কিছু শোনার চেষ্টা করল। নম্বরের বোতামগুলো ইতস্তত চাপ দিয়ে শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে মেঝেতে রেখে দিল। হঠাৎ সে বিস্ময়ে দেখল সেলুলার ফোনটির আলো জ্বলে উঠে রিং করতে শুরু করেছে। নিশীতা আনন্দে চিৎকার করে রিয়াজের দিকে তাকাল, রিয়াজ নিশীতার কাছে ছুটে আসে। নিশ্বাস বন্ধ করে বলল, তুলে নাও, নিশীতা কথা বল।
নিশীতা কাঁপা হাতে টেলিফোনটা তুলে নিয়ে বলল, হ্যালো।
কে? নিশীতা?
হ্যাঁ। আমি নিশীতা।
তোমাদের অনেক বড় বিপদ নিশীতা।
আমরা জানি–কিন্তু বিপদ থেকে উদ্ধারের একটা ব্যবস্থা করবে না?
তোমাদের সভ্যতার মাঝে আমার প্রবেশ করার কথা নয়। তাই তোমাদের টেকনোলজি ব্যবহার করে তোমাদের সাথে তোমাদের মতো করে দু একটি কথা বলতে পারি, এর বেশি কিছু নয়।
কিন্তু সেটি হলে তো হবে না। তুমি তো জান ফ্রেন্ড লিস্টার আমাদের মেরে ফেলবে।
হ্যাঁ জানি।
তা হলে আমাদের এখান থেকে বের করে নিয়ে যাও।
কীভাবে?
সেটা আমি কীভাবে বলব? আমাদের উড়িয়ে নিয়ে যাও। কিংবা ভাসিয়ে নিয়ে যাও, কিংবা টেলিট্রান্সপোর্ট করে নিয়ে যাও।
টেলিফোনের অন্যপাশ থেকে হাসির মতো এক ধরনের শব্দ হল, এপসিলানের স্বর বলল, আমার পক্ষে অবাস্তব কিছু করার ক্ষমতা নেই। আমি তোমাদের সভ্যতাকে স্পর্শ করতে পারব না।
নিশীতা গলায় জোর দিয়ে বলল, সেটা বললে তো হবে না। তোমাদের অশুভ অংশ এসে মানুষের শরীরের ভিতরে ঢুকে মানুষকে ব্যবহার করতে শুরু করেছে, আর তুমি আমাদের প্রাণটাও বাঁচাবে না? তোমার কি পৃথিবীর জন্য কোনো দায়দায়িত্ব নেই?
আছে বলেই তো আমি কাছাকাছি আছি।
শুধু থাকলে হবে না, কিন্তু একটা কিছু কর। আমাদের এখান থেকে বের করে দাও।
টেলিফোনে কিছুক্ষণ নীরবতা থাকার পর আবার এপসিলনের গলা শোনা গেল, আমি তোমাদের কিছু তথ্য দিতে পারি, এর বেশি কিছু করতে পারব না। বাকি কাজটুকু তোমাদের করতে হবে।
কী তথ্য?
তোমাদের এই ঘরটির উপরে যে সিলিংটি দেখছ– সেটি হালকা প্লাইউডের। মাঝামাঝি জায়গায় একটা ডাক্ট আছে সেখান দিয়ে এই বিল্ডিঙের যাবতীয় ইলেকট্রিক তার গিয়েছে। এই ডাক্টটি দিয়ে কিছুদূর এগিয়ে গেলে তোমরা কাছাকাছি একটা ঘরে বের হতে পারবে। সেখান থেকে দরজা খুলে বের হয়ে যেতে পারবে।
নিশীতা উপরের দিকে তাকাল, সিলিংটি বেশি উঁচু নয়, আধুনিক বিল্ডিঙে জায়গা বাঁচানোর জন্য বিন্ডিংগুলো বেশি উঁচু করা হয় না। একজনের কাঁধে আরেকজন দাঁড়িয়ে মনে হয় সিলিংটা পর্যন্ত যাওয়া যাবে। নিশীতা বলল, ঠিক আছে ধরে নিলাম আমরা বিল্ডিং থেকে বের হলাম, কিন্তু তারপর আর কোনো গেট নেই?
আছে।
সেখানে দারোয়ান নেই? গার্ড নেই?
আছে।
সেখান থেকে কীভাবে বের হব?
বাইরে গ্যারেজে কয়েকটা গাড়ি রয়েছে। কোনো একটা ড্রাইভ করে নিয়ে যেতে পার। এখানকার গাড়ি হলে গেটে আটকাবে না। আর যদি আটকায় তোমাদের সেরকম কিছু একটা করতে হবে।
কিন্তু
কিন্তু কী?
আমি গাড়ি ড্রাইভিং জানি না।
রিয়াজ বলল, আমি জানি। তবে গাড়ি চালিয়েছি আমেরিকাতে, রাস্তার ডানদিক দিয়ে।
নিশীতা বলল, এখন ডান বামের সময় নেই! ইঞ্জিন স্টার্ট করে গাড়িটাকে মোটামুটিভাবে নাড়াতে পারলেই হবে।
কিন্তু গাড়ির চাবি? চাবি ছাড়া স্টার্ট করব কেমন করে?
হট ওয়ার করে।
রিয়াজ মাথা চুলকে বলল, আমি কখনো করি নি।
সেলুলার টেলিফোনে এপসিলন বলল, আমি বলে দেব।
চমৎকার! এখন তা হলে কাজ শুরু করে দেওয়া যাক। সা
থে সাথে নিশীতার সেলুলার টেলিফোনটি নীরব হয়ে গেল।
নিশীতা রিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি আমাকে ঘাড়ে নিতে পারবেন?
মনে হয় পারব।
সিলিংটা ধরার জন্য আপনার ঘাড়ে আমাকে দাঁড়াতে হবে।
হ্যাঁ। সার্কাসে এ রকম করতে দেখেছি। তুমি কি পারবে?
পারতে হবে।
ব্যালান্সের একটা ব্যাপার আছে।
দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে শুরু করব যেন দেয়াল ধরে ব্যালান্স করতে পারি। একবার দাঁড়িয়ে সিলিংটা ছোঁয়ার পর আপনি ঘরের মাঝখানে যাবেন।
রিয়াজ চিন্তিত মুখে বলল, ধরা যাক তুমি হাঁচড়–পাঁচড় করে কোনোভাবে উঠে গেলে। কিন্তু আমি কীভাবে উঠব?
নিশীতা চারদিকে তাকাল, এই ঘরে কোনো আসবাবপত্র নেই। শুধুমাত্র মেঝেতে একটা কম্বল বিছিয়ে রাখা হয়েছে, সেখানে নিশীতাকে শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল। কম্বলটার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ নিশীতার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বলল, কম্বলটা উপর থেকে আটকে দিতে পারলে আপনি এটা ধরে উঠতে পারবেন না?
রিয়াজ দুর্বলভাবে হাসল, বলল, কখনো কম্বল ধরে কোথাও উঠি নি।
নিশীতা চোখ বড় বড় করে বলল, মাঝে মাঝে কয়েক জায়গায় ফুটো করে দেওয়া যাক, তা হলে ফুটোয় হাত ঢুকিয়ে ধরতে পারবেন। আর একবার উপরে উঠতে পারলে আমিও আপনাকে টেনে তুলব।
তুমি?
হ্যাঁ আমাকে আপনি যত দুর্বল ভাবছেন, আমি তত দুর্বল নই!
শুনে খুশি হলাম– রিয়াজ দুর্বলভাবে হেসে বলল, আর আমাকে তুমি যত শক্তিশালী ভাবছ আমি তত শক্তিশালী নই!
সেটা দেখা যাবে। যখন প্রাণ বাঁচাতে হয় তখন নাকি শরীরে অসুরের শক্তি এসে যায়।
কম্বলের মাঝে কয়েকটা ফুটো করার জন্য কোথাও ধারালো কিছু পাওয়া গেল না। হাতে কম্বল পেঁচিয়ে আঘাত করে তখন জানালার কাচ ভেঙে সেখান থেকে একটা ধারালো কাচ বের করে আনা হল। সেটা দিয়ে খুঁচিয়ে কম্বলে কয়েকটা ফুটো করা হল। চাকুর মতো একটা কাচের টুকরোকে নিশীতা তার ব্যাগে রেখে দিল–ভবিষ্যতে কী প্রয়োজন হতে পারে কে জানে!
রিয়াজ ঘরের দেয়াল ধরে হাঁটু গেড়ে বসল। নিশীতা রিয়াজের ঘাড়ে উঠে দাঁড়াল। রিয়াজ তখন সাবধানে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। নিশীতা দেয়াল ধরে নিজের ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করে, রিয়াজ পুরোপুরি সোজা হয়ে দাঁড়ানোর পর নিশীতা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমার ওজন কি খুব বেশি?
রিয়াজ বলল, না বেশি নয়। তবে তোমাকে দেখতে যেরকম হালকাঁপাতলা দেখায় ঘাড়ের উপর দাঁড়ানোর পর সেরকম মনে হচ্ছে না।
রিয়াজ সামনে অগ্রসর হতে থাকে, নিশীতা সিলিং ধরে ভারসাম্য বজায় রেখে বলল, আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি যদি এই গাড়া থেকে বের হতে পারি তা হলে ডায়েটিং করে ওজন পাঁচ কেজি কমিয়ে ফেলব।
তার প্রয়োজন নেই নিশীতা। এখান থেকে যদি বের হতে পারি তা হলে তোমাকে ঘাড়ে নিয়ে আমাকে আর হাঁটাহাঁটি করতে হবে না।
তা ঠিক। নিশীতা সিলিংটা হাত দিয়ে উপরে ঠেলে আলাদা করে ভিতরে মাথা ঢুকিয়ে দেখল, এপসিলন ঠিকই বলেছে, একটা বড় ডাক্ট সিলিঙের উপর দিয়ে চলে গেছে। নিশীতা রিয়াজকে বলল, এখন আপনাকে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে হবে। আমি উপরে উঠছি।
গুডলাক নিশীতা।
সিলিঙে উঠতে যত কষ্ট হবে মনে হয়েছিল নিশীতা তার থেকে অনেক সহজে উঠে গেল। রিয়াজ নিচে থেকে তার পা ধরে উপরে ধাক্কা দিয়ে সাহায্য করায় ব্যাপারটি বেশ সহজ হয়ে গেল। নিশীতা সিলিঙে লোহার বিমগুলোতে পা ঝুলিয়ে বসে বলল, ভাগ্যিস আমি শাড়ি পরে আসি নি।
শাড়ি পরে এলে কী হত?
শাড়ি পরলে সিলিং বেয়ে ওঠা হয়তো এত সহজ হত না
কিন্তু মেয়েদের জন্য শাড়ি থেকে সুন্দর কোনো পোশাক নেই।
যদি কখনো এই গাড্ডা থেকে বের হতে পারি তা হলে আমি একদিন শাড়ি পরে আপনার সাথে দেখা করতে আসব। আপনার কাছে প্রমাণ করিয়ে যাব যে আমি শাড়িও পরতে পারি।
চমৎকার! রিয়াজ বলল, তখন আমার কি বিশেষ কিছু করতে হবে?
না। আপনাকে কিছু করতে হবে না। আমার সাথে পরিচয় হওয়ার কারণে আপনার জীবনে যেসব ভয়ঙ্কর ব্যাপার ঘটতে শুরু করেছে সেদিন আপনার কাছ থেকে সে জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতে পারি।
নিশীতা উপর থেকে কম্বলটা একটা লোহার বীমের সাথে বেঁধে ঝুলিয়ে দিল। রিয়াজ কম্বলটা ধরে উপরে ওঠার চেষ্টা করতে করতে বলল, আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা কি তুমি চাইবে না আমি চাইব? বিষফোড়া ফ্রেন্ড লিস্টার তো তোমার বন্ধু নয়–আমার বন্ধু।
নিশীতা নিচু হয়ে হাত বাড়িয়ে রিয়াজকে ধরে ফেলে উপরে টেনে তোলার চেষ্টা করতে লাগল, দুজনে প্রায় জড়াজড়ি করে কোনোমতে ঊপরে এসে হাজির হল। নিশীতা হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠল, রিয়াজ একটু অবাক হয়ে বলল, কী হল? হাসছ কেন?
ফ্রেন্ড লিস্টার এখন আমাদের দেখলে খুব খুশি হত। ব্যাটা ধড়িবাজ কত কষ্ট করে কম্পিউটার দিয়ে আমাদের দুজনের ছবি তৈরি করেছে। এখন আমরা নিজেরাই একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে টানাটানি করছি! শুধু দরকার একজন ক্যামেরাম্যান?
রিয়াজ হাসিতে যোগ দিয়ে বলল, না নিশীতা। তুমি একটা ব্যাপার মিস করে গিয়েছ। সে কম্পিউটার দিয়ে ছবিতে যে জিনিসটা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছে সেটা হচ্ছে রোমান্স। আর একটু আগে তুমি যেভাবে আমার শার্টের কলার ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে তুলে এনেছ তার মাঝে আর যাই থাকুক, কোনো রোমান্স নেই!
বোঝা যাচ্ছে আপনি হিন্দি সিনেমা দেখেন না।
কেন?
দেখলে বুঝতেন রোমান্স আজকাল কত জায়গায় গিয়েছে। সেই আগের যুগের মিষ্টি গলায় গান গাওয়ার রোমান্স আর নেই। এখন খুন জখম মারপিট ছাড়া রোমান্স হয় না।
দুজনে মিলে প্লাইউডের সিলিং প্যানেলটা জায়গামতো বসিয়ে দিতেই ভিতরে অন্ধকার হয়ে এল। এখন এই ডাক্টের ভিতর দিয়ে গুঁড়ি মেরে তাদের এগিয়ে যেতে হবে। প্রথম নিশীতা এবং তার পিছু পিছু রিয়াজ এগিয়ে যেতে থাকে। সোজা বেশ খানিকদূর এগিয়ে গিয়ে নিশীতা একটা সিলিং প্যানেল তুলে ভিতরে উঁকি দিল। নিচে একটা বড় সেক্রেটারিয়েট টেবিল ঘিরে বেশ কয়েকজন আমেরিকান বসে আছে। টেবিলের উপর একটা বড় ম্যাপ, ম্যাপের উপরে নানা জায়গায় ছোট ছোট ফ্ল্যাগ লাগানো। সিলিং প্যানেলটা সাবধানে আগের জায়গায় বসিয়ে তারা গুঁড়ি মেরে নিঃশব্দে আরো সাবধানে এগিয়ে যেতে থাকে। খুব কাছেই কোনো একটা জায়গা থেকে একটা বড় ফ্যানের শব্দ আসছে–সম্ভবত এই বিল্ডিঙের কোনো একটি এক্সহস্ট ফ্যান। এর কাছাকাছি পৌঁছানোর সাথে সাথে টেলিফোনটি বেজে উঠল। নিশীতা টেলিফোনটি কানে ধরতেই এপসিলনের কথা শুনতে পেল, নিশীতা?
হ্যাঁ, কথা বলছি।
আমি এখন তোমাদের কোনদিক যেতে হবে বলব, তোমার কোনো কথা বলার প্রয়োজন নেই, কারণ তোমরা এখন যে ঘরটির উপর দিয়ে যাচ্ছ সেখানে সিকিউরিটির অনেকগুলো মানুষ।
নিশীতা কোনো কথা বলল না। এপসিলন বলল, তোমাদের একটু তাড়াতাড়ি যেতে হবে, কারণ কিছুক্ষণের মধ্যেই ফ্রেড লিস্টার তোমাদের ঘরে যাবে, সেখানে তোমাদের না দেখেই খোজাখুঁজি শুরু করবে।
নিশীতা ফিসফিস করে বলল, ঠিক আছে।
এখন সোজা যেতে থাক। সামনে গিয়ে ডানদিকে ঘুরে যাও।
নিশীতা আর রিয়াজ সামনে গিয়ে ডানদিকে ঘুরে গেল।
এবারে সোজা সামনে এগিয়ে যাও। সামনে একটা গোল গর্ত রয়েছে, সেদিক দিয়ে নিচে নেমে যাবে।
নিশীতা আর রিয়াজ সামনে গিয়ে গোল গর্তটা দিয়ে নিচে নেমে গেল। গর্তের ভিতরে রাজ্যের জঞ্জাল, মাকড়সার জাল এবং নানারকম পোকামাকড়। এসব ব্যাপার নিয়ে এখন মাথা ঘামানোর সময় নেই।
সেলুলার ফোন বলল, সোজা সামনে গিয়ে সিলিং প্যানেলটা তুলে নিচে লাফিয়ে পড়। এই ঘরে কেউ নেই।
ফোনের নির্দেশকে অন্ধের মতো–নুসরণ করে তারা ঘরের মাঝে লাফিয়ে পড়ল। দরজা খুলে বের হয়ে ডান দিকে যাও। নিশীতা আর রিয়াজ ঘর থেকে বের হয়ে ডানদিকে গেল।
সাবধান! সামনে দিয়ে দুজন আসছে, বাম পাশের পিলারের পিছনে লুকিয়ে পড়।
নিশীতা আর রিয়াজ দ্রুত পিলারের পিছনে লুকিয়ে পড়ল। দেখতে পেল স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে দুজন আমেরিকান হেঁটে গেল।
এবারে তোমাদের দশ সেকেন্ড সময় পুরো করিডোরের একমাথা থেকে অন্য মাথায় যাবার জন্য। শুরু কর
নিশীতা আর রিয়াজ নিশ্বাস বন্ধ করে শেষ মাথা পর্যন্ত ছুটে গেল।
চমৎকার। দরজার পাশে টেবিলের পিছনে দুই মিনিট লুকিয়ে থাক, এই দরজা দিয়ে কিছু মানুষ যাবে এবং আসবে।
নিশীতা আর রিয়াজ টেবিলের পিছনে লুকিয়ে থেকে টের পেল বেশ কিছু মানুষ ব্যস্ত পায়ে হাঁটাহাঁটি করছে।
তোমরা দৌড়ানোর জন্য প্রস্তুত হও। মাত্র তিন সেকেন্ডের মধ্যে নিঃশব্দে দরজা খুলে বাইরে গিয়ে ডান দিকে লাফিয়ে পড়বে। ফুল গাছগুলোর পিছনে লুকিয়ে থাকবে। মনে থাকে যেন তিন সেকেন্ড সময়।
নিশীতা আর রিয়াজ নিশ্বাস বন্ধ করে বসে রইল।
যাও!
দুজনে উঠে দাঁড়িয়ে দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে ডান দিকে ফুলগাছগুলোর পিছনে লাফিয়ে পড়ল।
চমৎকার! এখানে দশ সেকেন্ড অপেক্ষা কর। তারপর মাথা না তুলে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে যেতে থাক। কোনো অবস্থাতেই মাথা তুলবে না।
নিশীতা আর রিয়াজ মাথা না তুলে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে যেতে লাগল। কাদা, মাটি, খোয়া পাথরে হাতের চামড়া উঠে খানিকটা রক্তাক্ত হয়ে গেল, তারা সেটাকে গ্রাহ্য করল না।
থাম।
দুজনেই থেমে গেল।
গ্যারেজে তিনটি গাড়ি দেখতে পাচ্ছ?
নিশীতা কোনো কথা না বলে হ্যাঁ সূচকভাবে মাথা নাড়ল।
মাঝখানের গাড়িটাতে উঠবে। স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিকল ফোর হুইল ড্রাইভ। দুই হাজার সিসি ইঞ্জিন। মনে রেখো ড্রাইভিং সিট ডান পাশে।
নিশীতা মাথা নাড়ল।
এখানে তিরিশ সেকেন্ড অপেক্ষা কর।
সামনে দিয়ে একটা গাড়ি চলে গেল, দুজন মানুষ গাড়ি থেকে নেমে বিল্ডিঙের ভিতর ঢুকল।
দৌড়াও।
দুজনে দৌড়ে গাড়ির কাছে গেল, রিয়াজ ডানদিকে ড্রাইভিং সিটে নিশীতা বাম দিকে।
এখন গাড়ি স্টার্ট করতে হবে।
নিশীতা বলল, চাবি নেই। হট ওয়ার ব্যবহার করে করতে হবে। বল কী করতে হবে।
এপসিলন বলল, সময় নেই। ফ্রেন্ড লিস্টার তোমাদের ঘরে গিয়ে দেখেছে তোমরা নেই। সবাই ছোটাছুটি করছে। এক্ষুনি টেলিফোন করে গেটে বলে দেবে কেউ যেন বের হতে না পারে।
সর্বনাশ! তা হলে?
হঠাৎ করে গাড়িটা গর্জন করে স্টার্ট হয়ে গেল।
গার্ডকে টেলিফোন করছে। টেলিফোন তোলার আগে বের হয়ে যেতে হবে। যাও।
রিয়াজ গিয়ার টেনে ড্রাইভে এনে এক্সেলেটরে চাপ দিল, গাড়িটা সোজা গেটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গার্ড গেট খুলে দিচ্ছে, রিয়াজ বুক থেকে আটকে থাকা নিশ্বাস বের করে এগিয়ে যায়। হঠাৎ কী হল, একজন গার্ড ছুটে এসে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থামার ইঙ্গিত করল, গেটটা আবার বন্ধ করে ফেলছে, কাউকে বের হতে দেবে না।
নিশীতা চিৎকার করে বলল, থেমো না।
রিয়াজ থামল না, এক্সেলেটর চাপ দিয়ে গাড়ির বেগ মুহূর্তে বাড়িয়ে দিল, টায়ার পোড়া গন্ধ ছুটিয়ে শক্তিশালী গাড়িটা প্রচণ্ড বেগে গেটের দিকে ছুটে গেল। শেষ মুহূর্তে গার্ড লাফিয়ে সরে যায়, গাড়িটা প্রচণ্ড বেগে গেটে ধাক্কা দিল, গেটের একটি অংশ ভেঙ্গে দুমড়েমুচড়ে গেল এবং তার উপর দিয়ে গাড়িটা বের হয়ে গেল। গাড়িটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে যাচ্ছিল, কোনোভাবে রিয়াজ সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করে আবার রাস্তার উপর নিয়ে এল। নিশীতা শক্ত করে গাড়ির সিট ধরে রেখেছিল এবার চিৎকার করে বলল, বাম দিকে রাস্তার বাম দিকে।
সামনে দিয়ে একটা ট্রাক আসছিল, বিপজ্জনকভাবে সেটাকে পাশ কাটিয়ে রিয়াজ আবার রাস্তার বামপাশে চলে এসে বুকের ভিতর আটকে থাকা একটা নিশ্বাস বের করে দিয়ে বলল, এটাই হচ্ছে আমার সমস্যা।
কী?
ঠিক যখন ইমার্জেন্সি তখন সব সময় ভুল ডিসিশন নিই।
আপনার এখন দুশ্চিন্তার কারণ নেই, যখনই ডান দিকে যাবেন আমি আপনাকে মনে করিয়ে দেব।
থ্যাংকস। এখন কোথায় যাব?।
নিশীতা পিছন দিকে তাকিয়ে বলল, মনে হচ্ছে আমাদের পিছনে পিছনে একটা গাড়ি আসছে। কাজেই আপাতত চেষ্টা করা যাক এখান থেকে সরে যেতে।