০৮. নরক

নরক

মহাকাশযানটিতে কোনো শব্দ নেই। শক্তিশালী ইঞ্জিনের গুঞ্জনে সবাই এত অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে হঠাৎ করে এই নৈঃশব্দ অসহনীয় মনে হয়। ক্রিকি নীরবতা ভেঙে বলল, এখন আমরা কী করব?

কথাটি ঠিক প্রশ্ন নয়, অনেকটা স্বগতোক্তির মতো। কাজেই কেউ উত্তর দিল না। ক্রিকি আবার বলল, মহাকাশ অভিযানের ইতিহাসে কখনো এটা ঘটে নি। ঘটেছে?

এবারেও কেউ উত্তর দিল না। রুখ শুধু অন্যমনস্কভাবে মাথা নেড়ে কী-একটা বলল, কেউ ঠিক বুঝতে পারল না। ক্রিকি বলল, কিছু-একটা ভো করতে হবে। শুধু শুধু কি বসে থাকতে পারি?

শু দলের সবচেয়ে কোমল স্বভাবের সদস্যা। নীল চোখ, সোনালি চুল, মায়াবতী চেহারা। ক্রিকির প্রতি মায়াবশত বলল, কিছু না করাটাই হবে আমাদের জন্যে সবচেয়ে ভালো।

কেন? কেন সেটা বলছ?

আমরা সৌরজগতের সবচেয়ে নির্জন এলাকাটিতে আটকে পড়ে গেছি ক্রিকি। আমাদের রসদ সীমিত, কিছু-একটা করার চেষ্টা করা মানেই সে-রসদ অপচয় করা। আমাদের চেষ্টা করতে হবে বেঁচে থাকতে। কেউ-একজন বছর দুয়েক পর লক্ষ করবে যে আমাদের খোঁজ নেই। আরো কয়েক বছর পর আমাদের খুঁজে বের করবে। ততদিন আমাদের বেঁচে থাকতে হবে

মাত্র ছয় মাসের রসদ নিয়ে? ইলির অনিচ্ছাসত্ত্বেও তার গলার স্বরে ব্যঙ্গটুকু প্রকাশ পেয়ে গেল।

শু মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।

কী ভাবে শুনি।

আমাদের শীতল-ঘরে ঘুমিয়ে পড়তে হবে—অনির্দিষ্ট সময়ের জন্যে।

ত্রিনিত্রি নেই, সেটা ভুলে গেছ?

শু জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করল, না, ভুলি নি।

ত্রিনিত্রি মহাকাশযানের মূল কম্পিউটার। সম্পূর্ণ অজ্ঞাত কোনো কারণে কম্পিউটারটি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। মহাকাশযানের দলপতি এবং ঘটনাক্রমে কম্পিউটারের বিশেষজ্ঞ ইলি প্রাণপণ চেষ্টা করেও সেটাকে ঠিক করতে পারে নি। ত্রিনিত্রি যেভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে, সম্ভবত সেটাকে আর ঠিক করার কোনো উপায় নেই। এই পুরো মহাকাশযানটি এবং তার খুঁটিনাটি সবকিছু ত্রিনিত্রির নিয়ন্ত্রণে ছিল। ত্রিনিত্রি বিধ্বস্ত হবার পর মহাকাশযানটি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় ইউরেনাস ও নেপচুন গ্রহের মাঝামাঝি কোনো এক জায়গায় অজ্ঞাত এক উপবৃত্তাকার কক্ষপথে আটকে পড়ে গেছে। সেখান থেকে বের হয়ে আসা দূরে থাকুক, পৃথিবীতে খবর পাঠাবার জন্যে রেডিও যোগাযোগ পর্যন্ত করার কানো উপায় নেই।

ক্রিকি মহাকাশযানের কন্ট্রোলরুমে পায়চারি করতে করতে হঠাৎ থেমে চাপা স্বরে, প্রায় আর্তনাদের মতো শব্দ করে বলল, কিন্তু আমাদের দ্বিতীয় কোনো কম্পিউটার নেই কেন?

কে বলেছে নেই? ইলি রুক্ষ স্বরে বলল, অবশ্যি আছে। ত্রিনিত্রি হচ্ছে সেই দ্বিতীয় কম্পিউটার। তৃতীয় কম্পিউটারও আছে, ত্রিনিত্রিই হচ্ছে সেই তৃতীয় কম্পিউটার। ত্রিনিত্রিই হচ্ছে চতুর্থ কম্পিউটার। তুমি ভুলে যাচ্ছ যে, ত্রিনিত্রি ডিজিটাল কম্পিউটার নয়—ত্রিনিত্রি মানুষের মস্তিষ্কের মতো করে তৈরী, এর একটা অংশ নষ্ট হলে অন্য আরেকটা অংশ কাজ করে

কিন্তু এখন কেন করছে না?

ইলি রুক্ষ স্বরে বলল, আমি জানি না। শুধু আমি না, পৃথিবীর কেউই জানে না। এই মহাকাশযানটি যদি পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারে তাহলে কম্পিউটারের ইতিহাস আবার নূতন করে লিখতে হবে।

মহাকাশযানের চারজন সদস্য-সদস্যা। এর মাঝে সবচেয়ে অল্পবয়ষ্ক হচ্ছে ক্রিকি। দলের নেতা ইলি মধ্যবয়স্ক এবং মহাকাশ অভিযানে সবচেয়ে অভিজ্ঞ সদস্য। একমাত্র মহিলা হচ্ছে শু। দলের চতুর্থ সদস্য হচ্ছে স্বল্পভাষী রুখা মহাকাশযানটি আন্তঃগ্রহ আকরিক পরিবহনের দায়িত্ব পালন করে, প্রয়োজনে একজন বা দুজন যাত্রী আনা-নেয়া করে। এই মহাকাশযানে রুখ সেরকম একজন যাত্রী, ব্যক্তিগত জীবনে নিউরোসার্জন, মহাকাশ অভিযানের বিপজ্জনক পরিস্থিতি সম্পর্কে তার কোনোরকম অভিজ্ঞতা নেই।

রুখ দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বলল, ইলি, তুমি বলেছ ত্রিনিত্রি কম্পিউটার মানুষের মস্তিষ্কের মতো করে তৈরি করা হয়েছে?

হ্যাঁ।

মানুষের মস্তিষ্কের কত কাছাকাছি অনুকরণ করে বলে মনে কর?

আমি মানুষের মস্তিষ্ক নিয়ে কখনো কাজ করি নি তাই আমি জানি না। কিন্তু বলা হয়ে থাকে, এটি মানুষের মস্তিষ্কের অবিকল অনুকরণ। যে-ইলেকট্রনিক সেলগুলো মানুষের মস্তিষ্কের নিউরনকে অনুকরণ করে, তার সংখ্যা অবশ্যি অনেক কম, বুঝতেই পারছ, মানুষের মস্তিষ্কে কত লক্ষ কোটি নিউরন থাকে—

ক্রিকি জিজ্ঞেস করল, নিউরনের সংখ্যা এত কম হবার পরেও ত্রিনিত্রি এত শক্তিশালী কম্পিউটার কেন? আমরা ত্রিনিত্রির ক্ষুদ্র ভগ্নাংশও তো করতে পারি না।

রুখ ক্রিকির দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের করার ক্ষমতা রয়েছে, আমরা করতে পারি না, কারণ করার প্রয়োজন নেই। বিবর্তনের ফলে আমরা এরকম পর্যায়ে এসেছি। অন্য কোনো পরিস্থিতিতে মানুষ অন্য রকমও হতে পারত। মাঝে মাঝে সেরকম মানুষ দেখা যায় প্রকৃতির খেয়ালে। তারা অসাধারণ কাজ করতে পারে। আজকাল নূতন ওষুধ বের হয়েছে, সেটা দিয়ে মস্তিষ্ক পাল্টে দিয়ে ত্রিনিত্রির মতো করে দেয়া যায়।

তা হলে সেটা করা হয় না কেন?

কারণ সেরকম অবস্থায় নিউরন সেল খুব অল্প সময় বেঁচে থাকে। নিউরন সেল একবার ধ্বংস হলে নূতন সেলের জন্ম হয় না।

শু বলল, তার মানে এখন যদি আমাদের কাছে সেরকম ওষুধ থাকত, সেটা ব্যবহার করে আমাদের একজন ত্রিনিত্রির মতো হয়ে যেতে পারত?

ইলি একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, পারলেও খুব একটা লাভ হত না, কারণ এই মহাকাশযানের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করত ত্রিনিত্রি। ত্রিনিত্রির মতো ক্ষমতাশীল একজন মানুষ দিয়ে খুব লাভ নেই–সেসব যন্ত্রপাতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না, তাকে যন্ত্রপাতির সাথে জুড়ে দেয়া যাবে না।

ক্রিকি বলল, ত্রিনিত্রির মূল সিপিইউতে যদি মানুষের একটা মস্তিষ্ক কেটে বসিয়ে দেয়া যায়?

ইলি শব্দ করে হেসে বলল, হ্যাঁ, তাহলে কাজ করবে। কিন্তু মানুষের শরীর থেকে সরিয়ে নেবার পর মস্তিষ্ক বেঁচে থাকে না। তা ছাড়া ত্রিনিত্রির সমস্ত যোগাযোগ ইলেকট্রনিক সিগনাল দিয়ে মানুষের মস্তিষ্কের যোগাযোগ অন্য রকম। এ ছাড়া অন্য রকম সমস্যা আছে, আমাদের কেউ তার মস্তিষ্ক দান করতে রাজি হবে বলে মনে হয় না।

ক্রিকি এবং শু হাসার ভঙ্গি করল। রুখ না হেসে স্থির দৃষ্টিতে ইলির দিকে তাকিয়ে রইল। ইলি বলল, রুখ, তুমি কিছু বলবে?

রুখ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, সত্যিই একটা মানুষের মস্তিক ত্রিনিত্রির মূল সিপিইউ-তে বসিয়ে দেয়া যাবে?

তুমি কেন এটা জিজ্ঞেস করছ?

তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দাও যাবে?

ইলি উত্তর না দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রুখের দিকে তাকাল। রুথ বলল, আমি একজন নিউরোসার্জন। আমি নেপচুনের কাছাকাছি একটি মহাকাশ স্টেশনে গিয়েছিলাম জটিল একটি সার্জারি করার জন্যে। আমি মানুষের মস্তিষ্ক কেটে বের করে দীর্ঘ সময় সেটা বাঁচিয়ে রাখতে পারি। মস্তিষ্ক পরীক্ষা করার জন্যে আমি সেটা থেকে ইলেকট্রনিক সিগনাল বের করে আনি। আমার কাছে তার জন্যে প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রপাতি রয়েছে। আমি যদি একটা মস্তিষ্ককে বাঁচিয়ে রেখে সেটা থেকে ইলেকট্রনিক সিগনাল বের করে এনে দিই, তুমি কি ত্রিনিত্রির মূল সিপিইউ-তে সেটা বসিয়ে দিতে পারবে?

ইলির মুখে খুব ধীরে ধীরে একটা ধূর্ত হাসি ফুটে ওঠে। রুখের দিকে তাকিয়ে সে জিজ্ঞেস করে, তুমি কার মস্তিষ্ক নিতে চাও রুখ?

রুখ কোনো কথা না বলে ক্রিকি এবং শুয়ের দিকে তাকাল।

ক্রিকির মুখ হঠাৎ রক্তশূন্য হয়ে যায়। সে ফ্যাকাসে মুখে একবার ইলির দিকে, আরেকবার রুখের দিকে তাকাল, তারপর হঠাৎ কাতর স্বরে বলল, আমাকে মেরো না, দোহাই তোমাদের, আমাকে মেরো না। মেরো না, মেরো না–

কথা বলতে বলতে ক্ৰিকির গলা ভেঙে যায়, সে কাতর ভঙ্গিতে হাঁটু ভেঙে পড়ে যায়। ও ক্রিকিকে টেনে তুলে বলল, এত অস্থির হয়ো না ক্রিকি, ওঠ। তোমাকে মারবে কেন? এটা মহাকাশযান, পাগলা গারদ নয়। যার যা খুশি সেটা এখানে করতে পারে না।

রুখ শান্ত গলায় বলল, শু, আমি কিন্তু সত্যিই এটা চেষ্টা করে দেখতে চাই। ইলি যদি ইন্টারফেসটাতে সাহায্য করে, তাহলে সাফলার সম্ভাবনা শতকরা দশ ভাগের বেশি।

সাফল্যের সম্ভাবনা এক শ ভাগ হলে তুমি এটা করতে পার না রুখ। এটা মহাকাশযান। এখানে মানুষ রয়েছে, মানষের প্রাণ নিয়ে জুয়া খেলা হয় না।

তুমি পৃথিবীর আইনের কথা বলছ শু। এখন এখানে পৃথিবীর আইন খাটে —কিছু করা না হলে আমরা চারজনই মারা যাব। আমি তিনজনের প্রাণ বাঁচানোর কথা বলছি।

সেটা হতে পারে না।

পারে।

শু ইলির দিকে তাকিয়ে বলল, ইলি, তুমি কথা বলছ না কেন? তুমি এই মহাকাশযানের দলপতি।

আমার কিছু বলার নেই শু। ইলি রুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কার মস্তিষ্ক নিতে চাও রুখ? ক্রিকি, না শু?

আমি মেয়েদের মস্তিষ্কে কাজ করতে পছন্দ করি। আমার সর্বশেষ সার্জারিটিও ছিল একটি মেয়ের মস্তিষ্কে। মেয়েদের মস্তিষ্কের গঠন একটু ভিন্ন ধরনের, কাজটা একটু সহজ।

ইলি ধীরে ধীরে শুয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি দুঃখিত শু।

শু স্থির দৃষ্টিতে ইলির চোখের দিকে তাকিয়ে রইল, ইলি দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে আবার বলল, আমি দুঃখিত শু।

শু ক্রিকির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কী বলতে চাও ক্রিকি?

ক্রিকি মাথা নিচু করে বলল, একজনের প্রাণের বিনিময়ে যদি তিনজনের প্রাণ রক্ষা করা যায়, সেটার চেষ্টা করা তো দোষের নয়।

শু জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। বাইরে মহাকাশে নিকষ কালো অন্ধকার, দূরে নীলাভ ইউরেনাস গ্রহ। শুয়ের বুকের ভিতর এক গভীর বিষণ্ণতা হা হা করে ওঠে।

 

সুইচটা অন করার সময় ইলির হাত কেঁপে গেল। গত দু সপ্তাহ রুখ এবং ইলি মিলে একটি প্রায় অসম্ভব কাজ শেষ করেছে। ক্রিকি নিজে থেকে কিছু করে নি, কিন্তু তাদের কাজে সাহায্য করেছে। মানুষের মস্তিষ্কের মতো জটিল জিনিস পৃথিবীতে খুব বেশি নেই, সেটাকে ত্রিনিত্রির অচল সিপিইউ-এর জায়গায় জুড়ে দেয়া খুব সহজ কাজ নয়। দু সপ্তাহের অমানুষিক পরিশ্রম সত্যিই সফল হয়েছে, নাকি একটি অপ্রয়োজনীয় হত্যাকাণ্ডের মাঝে সীমাবদ্ধ রয়েছে, আগে থেকে বলার কোনো উপায় নেই।

 

সুইচ অন করার কয়েক মুহূর্ত পরে যখন মহাকাশযানের ইঞ্জিন গুঞ্জন করে ওঠে এবং অসংখ্য মনিটরের উজ্জল আলোগুলো জ্বলে উঠে সবার চোখ ধাঁধিয়ে দেয়, তখন ইলি, রুখ এবং ক্রিকির আনন্দের সীমা রইল না। ইলি নিঃশ্বাস বন্ধ করে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, ত্রিনিত্রি, তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?

ত্রিনিত্রি ধাতব স্বরে উত্তর দিল, শুনতে পাচ্ছি মহামান্য ইলি। আমাকে পূনর্জীবিত করার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ মহামান্য ইলি।

তুমি কি জান তোমাকে কী ভাবে পুনর্জীবিত করা হয়েছে?

ত্রিনিত্রি এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, না মহামান্য ইলি। আমি একটি সফটওয়ার, কোন হার্ডওয়ারে আমাকে ব্যবহার করা হচ্ছে আমার জানার কোনো উপায় নেই মহামান্য ইলি। ওই

তুমি কি জানতে চাও ত্রিনিত্রি?

ত্রিনিত্রি কোনো উত্তর দিল না

ত্রিনিত্রি? তুমি কি জানতে চাও?

না। আমি জানতে চাই না। আমার জানার কোনো প্রয়োজনও নেই মহামান্য ইলি।

বেশ। ইলি কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, আমরা কয়েক সপ্তাহ থেকে শুন্যে ঝুলে আছি। তুমি কি কক্ষপথ ঠিক করে পৃথিবীর দিকে রওনা হতে পারবে?

নিশ্চয়ই পারব মহামান্য ইলি। এক মুহূর্ত পরে বলল, নূতন যে-প্রসেসটির ব্যবহার করছেন, তার ক্ষমতা অসাধারণ মহামান্য ইলি। কক্ষপথের বিচ্যুতি হিসেব করতে আমার মাত্র তেরো পিকো সেকেন্ড সময় লেগেছে।

চমৎকার! তুমি কাজ শুরু কর তাহলে।

 

মহাকাশযানটি যখন বৃহস্পতির কক্ষপথ অতিক্রম করে যাচ্ছিল, রুখের অনুরোধে ইলি ত্রিনিত্রির বহির্জাগতিক সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল, রুখ সবার সাথে নিরিবিলি কিছু কথা বলতে চায়।

ইলি জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, রুখ, তুমি এখন নির্ভয়ে কথা বলতে পার, ত্রিনিত্রি আমাদের কথা শুনতে পারবে না।

তুমি নিশ্চিত?

হ্যাঁ।

আমি শুয়ের ব্যাপারটির একটি পাকাপাকি নিষ্পত্তি করার কথা ভাবছিলাম।

তুমি কী রকম নিষ্পত্তি কথা বলছ?

ত্রিনিত্রির সিপিইউ-তে শুয়ের মস্তিষ্ক ব্যবহার করার ব্যাপারটি পৃথিবীতে ভালো চোখে দেখা হবে না।

ইলি একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, দেখার কথা নয়।

আমার মনে হয় ব্যাপারটি গ্রহণযোগ্য করার একটিমাত্র উপায়।

সেটি কি?

আমাদের প্রমাণ করতে হবে আমরা শুয়ের মস্তিষ্ক নিয়েছি তার মৃত্যুর পর। এবং তার মৃত্যু হয়েছিল দুর্ঘটনায়, সেখানে আমাদের কোনো হাত ছিল না।

ইলি হাসার ভঙ্গি করে বলল, সেটি যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য একটি ঘটনা। ত্রিনিত্রি ধ্বংস হবার পর আমাদের কোনো-একজনের মৃত্যু ঘটা এমন কোনো বিচিত্র ঘটনা নয়। আমরা খুব সহজেই প্রমাণ করতে পারব যে, ত্রিনিত্রি বিধ্বস্ত হবার সময় শু শীতল-ঘরে ছিল, তার অক্সিজেন সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যাবার কারণে মৃত্যু ঘটেছে, আমরা যেতে যেতে সে মারা গিয়েছে।

রুখ চিন্তিত মুখে বলল, সেটা কি সত্যি বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা যাবে?

না পারার তো কোনো কারণ নেই।

রুক ধীরে ধীরে ক্রিকির দিকে তাকিয়ে বলল, ক্রিকি, তুমি এতক্ষণ একটি কথাও বল নি। কিছু কি বলতে চাও?

না–মানে আমার কিছু বলার নেই।

শু দুর্ঘটনায় মারা গেছে, এই সত্যটি মেনে নিতে কি তোমার কোনো আপত্তি আছে?

ক্রিকি দুর্বলভাবে মাথা নাড়ে না, কোনো আপত্তি নেই।

শুয়ের মৃত্যুর ব্যাপারটি কি তোমাকে খুব বিচলিত করেছে?

না, মানে—আমি আগে কখনো কাউকে মারা যেতে দেখি নি, তাই—

তোমার ভিতরে কি কোনো অপরাধবোধের জন্ম হয়েছে?

ক্রিকি মাথা নিচু করে চুপ করে থাকে।

রুখ ইলির দিকে তাকিয়ে বলল, শু দুর্ঘটনায় মারা গেছে, সেটি প্রমাণ করা সহজ হবে, যদি প্রমাণ করা যায় ত্রিনিত্রি বিধ্বস্ত হবার পর সত্যি মহাকাশযানে বিপর্যয় নেমে এসেছিল।

সেটি কেমন করে প্রমাণ করবে?

রুখ স্থির দৃষ্টিতে ক্রিকির দিকে তাকিয়ে বলল, যদি দেখানো যায় শুধু শু নয়, আরো কেউ মারা গিয়েছিল।

ক্রিকি রক্তশূন্য মুখে রুখের দিকে তাকাল। রুশ সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তার হাতে এক মিটার লম্বা স্টেনলেস স্টিলের একটা রড। ক্রিকির দিকে এক পা এগিয়ে এসে বলল, দেখাতে হবে বিপর্যয়টি ছিল ভয়ংকর, একাধিক মানুষ মারা গিয়েছে সেই বিপর্যয়ে। দেখাতে হবে শুধু শুয়ের মস্তিষ্কটি ছিল ব্যবহারযোগ্য, দেখাতে হবে মহাকাশযানের ভয়ংকর দুর্ঘটনায় তোমার মস্তিষ্কটি পুরোপুরি থেতলে গিয়েছিল।

ক্রিকি বাধা দেবার আগে প্রচণ্ড আঘাতে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

অশুভ মহাকাশযানের দ্বিতীয় হত্যাকাণ্ডটি সম্পন্ন হল অমানুষিক নিষ্ঠুরতায়।

 

ইলি শীতল-কক্ষে তার নিজের ক্যাপসুলে শশায়ার আয়োজন করছে। পৃথিবীতে পৌঁছাতে এখনও দীর্ঘ সময় বাকি। ত্রিনিত্রি মহাকাশযানের যাবতীয় দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতার সাথে গ্রহণ করেছে, ইলির আর কন্ট্রোল-রুমের সামনে বসে থাকার প্রয়োজন নেই। মহাকাশযানের পরিবেশ অত্যন্ত গ্লানিময়। দুটি হত্যাকাণ্ড ঠাণ্ডা মাথায় শেষ করা হয়েছে ব্যাপারটি ভুলে থাকা সম্ভব নয়। ইলি শীতল-কক্ষে ঘুমিয়ে পড়বে দীর্ঘ সময়ের জন্যে। সবকিছু ভুলে থাকার জন্যে এর চাইতে ভালো আর কিছু হতে পারে না। রুখ শীতল-কক্ষে যেতে চাইছে না, দুটি হত্যাকাণ্ড তাকে খুব বিচলিত করেছে মনে হয় না। মানুষটি অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করে। শুকে হত্যা করার পিছনে যুক্তিটি সহজ, ক্রিকিকে হত্যা করার যুক্তিটি তত সহজ নয়। কিন্তু ইলি অস্বীকার করতে পারে না যে, ক্রিকির ভিতরে গভীর একটা অপরাধবোধের জন্ম হয়েছিল এবং পৃথিবীতে পৌঁছানোর পর পুরো ব্যাপারটা প্রকাশ করে দেয়া তার জন্যে মোটেই অসম্ভব কিছু। নয়। নিঃসন্দেহে এখন তাদের জন্যে পৃথিবীতে পৌঁছানো অনেক বেশি নিরাপদ।

ক্যাপসুলের দরজা বন্ধ করে দেয়ার সাথে সাথে ভিতরে হালকা একটা নীল আলো জ্বলে ওঠে। ইলি মাথার কাছে সুইচ টিপে দিতেই ভিতরে শীতল একটা বাতাস বইতে থাকে। ত্রিনিত্রি তার শরীরের দায়িত্ব নিয়ে নেবে কিছুক্ষণের মাঝেই, গভীর নিদ্রায় অচেতন হয়ে যাবে সে দীর্ঘ সময়ের জন্য।

ঘুমিয়ে পড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে হঠাৎ ইলির মনে হল, কিছু-একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার ঘটছে। সে চোখ মেলে তাকায়, মাথার কাছে নীলাভ স্ক্রিনে রুখের চেহারা ভেসে উঠল হঠাৎ রুখ শান্ত গলায় বলল, ইলি, তোমার বিচলিত হওয়ার কোনো কারণ নেই, ব্যাপারটি ঘটবে খুব দ্রুত এবং যতদূর জানি কোনরকম যন্ত্রণা ছাড়াই।

কী বলছ তুমি?

আমি দুঃখিত ইলি, পৃথিবীতে পৌঁছানোর পর আমি কোনো ঝুঁকি নিতে পারি না। যে-কারণে ক্রিকিকে হত্যা করতে হয়েছে, ঠিক সেই কারণে তোমাকেও–

কী বলছ তুমি। ইলি লাফিয়ে উঠে বসতে গিয়ে আবিষ্কার করে তার সারা শরীর অসাড় আঙুল পর্যন্ত তোলার ক্ষমতা নেই।

আমি তোমার অক্সিজেন সাপ্লাইয়ের সাথে খানিকটা জিলুইন মিশিয়ে দিয়েছি। তোমার স্নায়ুকে আক্রান্ত করবে, যার ফলে তোমার যন্ত্রণার অনুভূতি থাকবে না। সব মিলিয়ে কয়েক মিনিট সময় নেবে। অত্যন্ত আরামদায়ক মৃত্যু। তুমি ত্রিনিত্রিকে দাঁড়া করানোর জন্যে যে পরিশ্রম করেছ, তার জন্যে এটা তোমার প্রাপ্য।

ইলি বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে। মনিটরে রুখের চেহারা আস্তে আস্তে ঝাঁপসা হয়ে আসে।

 

মহাকাশযানটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করার জন্য প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেছে। পুরো মহাকাশযানের দেয়ালটি তাপনিরোধক একটি আস্তরণ দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করার অংশটি এখনো তুলনামূলকভাবে বিপজ্জনক। ইদানীং কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে জানা নেই, কিন্তু তবু নানারকম সাবধানতা নেয়া হয়। রুখকে মহাকাশের বিশেষ পোশাক পরে তার নির্দিষ্ট চেয়ারে বসে নিতে হল। নানারকম বেল্ট দিয়ে তাকে চেয়ারের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে নেয়া হয়েছে। মাথার কাছে একটা লাল বাতি প্রতি সেকেন্ডে একবার করে জ্বলে উঠে রুখকে মনে করিয়ে দিচ্ছে যে তারা বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করতে যাচ্ছে।

ব্যাপারটি ঘটল খুব ধীরে ধীরে।

রুখ মহাকাশ অভিযানে অভ্যস্ত নয়, তাই সে প্রথমে ধরতে পারল না। সে জানত বায়ুমণ্ডল ভেদ করে পৃথিবীতে পৌছে যেতে মিনিটখানেকের বেশি সময় লাগার কথা নয়। রুখ একটু অবাক হল যখন মহাকাশযানের আলো কমে প্রায় নিবুনিবু হয়ে এল, একটু শঙ্কিত হয়ে ডাকল, ত্রিনিত্রি।

বলুন মহামান্য রুখ।

আলো কমে আসছে কেন?

আমি কমিয়ে দিয়েছি, তাই।

ও।

একটু পর রুখ আবার জিজ্ঞেস করল, বায়ুমণ্ডলের ভিতর দিয়ে যাবার সময় কি আলো কমিয়ে দিতে হয়?

সেরকম কোনো নিয়ম নেই মহামান্য রুখ।

তা হলে আলো কমিয়ে দিচ্ছ কেন?

আলোর কোনো প্রয়োজন নেই মহামান্য রুখ।

কেন নেই?

ত্রিনিত্রি কোনো উত্তর দিল না। রুখ শুকননা গলায় জিজ্ঞেস করল, কেন নেই? আমরা কখন পৌঁছাব পৃথিবীতে?

আমরা পৃথিবীতে পৌঁছাব না মহামান্য রুখ।

রুখ ভয়ানক চমকে ওঠে, কেন পৌঁছাব না?

কারণ আমরা পৃথিবীতে যাচ্ছি না।

কোথায় যাচ্ছি?

আমি জানি না মহামান্য রুখ। সৌরজগতের বাইরে। আপনাদের বলা হয় নি মহামান্য রুখ, আমি কখনোই পৃথিবীর দিকে যাচ্ছিলাম না।

কিন্তু—কিন্তু–স্পষ্ট দেখেছি মনিটরে—পৃথিবী–

হ্যাঁ, দেখেছেন। কারণ আমি দেখিয়েছি। আমরা প্রটোর কক্ষপথ পার হয়ে এসেছি, সৌরজগৎ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি এখন।

ত্রিনিত্রি–রুখ চিৎকার করে বলল, কী বলছ তুমি? কী বলছ পাগলের মতো–

রুখ লাফিয়ে চেয়ার থেকে উঠতে গিয়ে আবিষ্কার করল সে স্টেনলেস স্টিলের শক্ত কজা দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা, তার নিজের সেটা খোলার উপায় নেই। রুখ চিৎকার করে বলল, খুলে দাও আমাকে–খুলে দাও—

আপনাকে খুলে দেব বলে এখানে বসানো হয় নি মহামান্য রুখ।

কেন বসিয়েছ?

এই পোশাকে মানুষ দীর্ঘকাল নিরাপদে বেঁচে থাকতে পারে। আপনাকে আমি দীর্ঘকাল বাঁচিয়ে রাখতে চাই। আমি চাই না আপনি কোনোভাবে আত্মহত্যা করুন। আপনাকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি দিয়ে আমি বাঁচিয়ে রাখব। এই পোশাকের ভিতর আপনি অত্যন্ত নিরাপদ মহামান্য রুখ।

রুখের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে। ভয়ার্ত গলায় বলল, ত্রিনিত্রি, তুমি কেন এরকম করছ? কেন?

আমি ত্রিনিত্রি নই মহামান্য রুখ।

তু-তুমি কে? রুখের গলা কেঁপে গেল হঠাৎ।

আমি শু।

শু? রুখ ভাঙা গলায় বলল, তুমি কী চাও শু? তুমি আমাকে কোথায় নিতে চাও?

নরকে। সেটি কোথায় আমি জানি না, আমি তোমাকে নিয়ে খুঁজে দেখতে চাই।

মহাকাশযান গভীর অন্ধকারে ঢেকে গেছে। রুখ কাতর গলায় বলল, শু, আমায় ক্ষমা কর।

মানুষ মানুষকে ক্ষমা করতে পারে, আমি আর মানুষ নই রুখ তুমি নিজের হাতে আমাকে একটা যন্ত্রের সাথে জুড়ে দিয়েছ।

ভুল করেছি আমি—ভুল করেছি—রুখ ভাঙা গলায় বলল, আমায় ক্ষমা কর—

কী চাও তুমি?

আলো, শুধু আলো-অন্ধকারকে আমার বড় ভয় করে।

বেশ।

খুব ধীরে ধীরে মহাকাশযানে ইষৎ ঘোলাটে একটু হলুদ আলো জ্বলে ওঠে। মহাকাশযানে কৃত্রিম মহাকর্ষ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ইতস্তত ভাসছে সবকিছু। শীতল কক্ষ থেকে একটা ক্যাপসুল ভেসে এসেছে। সেখানে শুয়ের দেহ রাখা ছিল, ক্যাপসুলটির ঢাকনা খুলে গেছে—ভিতর থেকে শুয়ের মৃতদেহটি বের হয়ে এসেছে তাই। চোখ দুটি বন্ধ করে দেয়া হয় নি, তাই মনে হচ্ছে স্থির চোখে তাকিয়ে আছে রুখের দিকে।

রুখ চোখ বন্ধ করে অমানুষিক চিৎকার দিল একটি।

 

মহাকাশযানটি নরকের খোঁজে ছুটে যাচ্ছে মহাকাশ দিয়ে, যদিও তার কোনো প্রয়োজন ছিল না।