[স্বামীজীর এই বক্তৃতাটি ১৯০০ খ্রীঃ ৩ এপ্রিল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিস্কো শহরে ওয়াশিংটন হলে প্রদত্ত। সাঙ্কেতিক লিপিকার ও অনুলেখিকা—আইডা আনসেল। যেখানে লিপিকার স্বামীজীর কিছু কিছু কথা ধরিতে পারেন নাই, সে-সব স্থলে কয়েকটি বিন্দুচিহ্ন … দেওয়া হইয়াছে। প্রথম বন্ধনীর () মধ্যেকার শব্দ বা বাক্য স্বামীজীর নিজের নয়, ভাব-পরিস্ফুটনের জন্য নিবদ্ধ হইয়াছে। মূল ইংরেজী বক্তৃতাটি হলিউড বেদান্তকেন্দ্রের মুখপত্র Vedanta and the West পত্রিকায় ১১২তম সংখ্যায় (মার্চ-এপ্রিল, ১৯৫৫) মুদ্রিত হইয়াছে।]
সকল ধর্মই ‘ধ্যান’-এর উপর বিশেষ জোর দিয়াছে। যোগীরা বলেন ধ্যানমগ্ন অবস্থাই মনের উচ্চতম অবস্থা। মন যখন বাহিরের বস্তু অনুশীলনে রত থাকে, তখন ইহা সেই বস্তুর সহিত একীভূত হয় এবং নিজেকে হারাইয়া ফেলে। প্রাচীন ভারতীয় দার্শনিকের উপমায় মানুষের মন যেন একখণ্ড স্ফটিকের মত—নিকটে যাহাই থাকুক, উহা তাহারই রঙ ধারণ করে। অন্তঃকরণ যাহাই স্পর্শ করে, … তাহারই রঙে উহাকে রঞ্জিত হইতে হয়। ইহাই তো সমস্যা। ইহারই নাম বন্ধন। ঐ রঙ এত তীব্র যে, স্ফটিক নিজেকে বিস্মৃত হইয়া বাহিরের রঙের সহিত একীভূত হয়। মনে কর—একটি স্ফটিকের কাছে একটি লাল ফুল রহিয়াছে; স্ফটিকটি উহার রঙ গ্রহণ করিল এবং নিজের স্বচ্ছ স্বরূপ ভুলিয়া নিজেকে লাল রঙের বলিয়াই ভাবিতে লাগিল। আমাদেরও অবস্থা ঐরূপ দাঁড়াইয়াছে। আমরাও শরীরের রঙে রঞ্জিত হইয়া আমাদের যথার্থ স্বরূপ ভুলিয়া গিয়াছি। (এই ভ্রান্তির) অনুগামী সব দুঃখই সেই এক অচেতন শরীর হইতে উদ্ভূত। আমাদের সব ভয়, দুশ্চিন্তা, উৎকণ্ঠা, বিপদ, ভুল, দুর্বলতা, পাপ সেই একমাত্র মহাভ্রান্তি—‘আমরা শরীর’ এই ভাব হইতেই জাত। ইহাই হইল সাধারণ মানুষের ছবি। সন্নিহিত পুষ্পের বর্ণানুরঞ্জিত স্ফটিকতুল্য এই জীব! কিন্তু স্ফটিক যেমন লাল ফুল নয়, আমরাও তেমনি শরীর নই। ধ্যানাভ্যাস অনুসরণ করিতে করিতে স্ফটিক নিজের স্বরূপ জানিতে পারে এবং নিজ রঙে রঞ্জিত হয়। অন্য কোন প্রণালী অপেক্ষা ধ্যানই আমাদিগকে সত্যের অধিকতর নিকটে লইয়া যায়। …
ভারতে দুই ব্যক্তির দেখা হইলে (আজকাল) তাঁহারা ইংরেজীতে বলেন, ‘কেমন আছেন?’ কিন্তু ভারতীয় অভিবাদন হইল, ‘আপনি কি সুস্থ?’ যে মুহূর্তে আত্মা ব্যতীত অন্য কিছুর উপর নির্ভর করিবে, তোমার দুঃখ আসিবার আশঙ্কা আছে। ধ্যান বলিতে আমি ইহাই বুঝি—আত্মার উপর দাঁড়াইবার চেষ্টা। আত্মা যখন নিজের অনুধ্যানে ব্যাপৃত এবং স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত, তাহার তখনকার অবস্থাটিই নিশ্চিতরূপে সুস্থতম অবস্থা। ভাবোন্মাদনা, প্রার্থনা প্রভৃতি অপরাপর যে-সব প্রণালী আমাদের রহিয়াছে, সেগুলিরও চরম লক্ষ্য ঐ একই। গভীর আবেগের সময়ে আত্মা স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হইতে চেষ্টা করে। যদিও এ আবেগটি হয়তো কোন বহির্বস্তুকে অবলম্বন করিয়া উঠিয়াছে, কিন্তু মন সেখানে ধ্যানস্থ।
ধ্যানের তিনটি স্তর। প্রথমটিকে বলা হয় (ধারণা)—একটি বস্তুর উপরে, একাগ্রতা অভ্যাস। এই গ্লাসটির উপর আমার মন একাগ্র করিতে চেষ্টা করিতেছি। এই গ্লাসটি ছাড়া অপর সকল বিষয় মন হইতে তাড়াইয়া দিয়া শুধু ইহারই উপর মনঃসংযোগ করিতে চেষ্টা করিতে হইবে। কিন্তু মন চঞ্চল। … মন যখন দৃঢ় হয় এবং তত চঞ্চল নয়, তখনই ঐ অবস্থাকে ‘ধ্যান’ বলা হয়। আবার ইহা অপেক্ষাও একটি উন্নততর অবস্থা আছে, যখন গ্লাসটি ও আমার মধ্যে পার্থক্য সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয় (সমাধি বা পরিপূর্ণ তন্ময়তা)। তখন মন ও গ্লাসটি অভিন্ন হইয়া যায়। উভয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য দেখি না। তখন সকল ইন্দ্রিয় কর্মবিরত হয় এবং যে-সকল শক্তি অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের মধ্য দিয়া ভিন্ন ভিন্ন পথে ক্রিয়া করে, সেগুলি (মনেতেই কেন্দ্রীভূত হয়)। তখন গ্লাসটি পুরাপুরিভাবে মনঃশক্তির অধীনে আসিয়াছে। ইহা উপলব্ধি করিতে হইবে। যোগিগণের অনুষ্ঠিত ইহা একটি প্রচণ্ড শক্তির খেলা। … ধরা যাক—বাহিরের বস্তু বলিয়া কিছু আছে। সে ক্ষেত্রে যাহা বাস্তবিকই আমাদের বাহিরে রহিয়াছে, তাহা—আমরা যাহা দেখিতেছি, তাহা নয়। যে গ্লাসটি আমাদের চোখে ভাসিতেছে, সেটি নিশ্চয়ই আসল বহির্বস্তু নয়। গ্লাস বলিয়া অভিহিত বাহিরের আসল বস্তুটিকে আমি জানি না এবং কখনও জানিতে পারিব না।
কোন কিছু আমার উপর একটি ছাপ রাখিল; তৎক্ষণাৎ আমি আমার প্রতিক্রিয়া জিনিষটির দিকে পাঠাইলাম এবং এই উভয়ের সংযোগের ফল হইল ‘গ্লাস’। বাহিরের দিক্ হইতে উৎপন্ন ক্রিয়া—‘ক’ এবং ভিতর হইতে উত্থিত প্রতিক্রিয়া—‘খ’। গ্লাসটি হইল ‘ক-খ’। যখন ‘ক’-এর দিকে তাকাইতেছ, তখন উহাকে বলিতে পার ‘বহির্জগৎ’, আর যখন ‘খ’-এর দিকে দৃষ্টি দাও, তখন উহা ‘অন্তর্জগৎ’। … কোন্টি তোমার মন আর কোন্টি বাহিরের জগৎ—এই পার্থক্য উপলব্ধি করিতে চেষ্টা করিলে দেখিবে, এরূপ কোন প্রভেদ নাই। জগৎ হইতেছে তুমি এবং আরও কিছুর সমবায় …।
অন্য একটি দৃষ্টান্ত লওয়া যাক। তুমি একটি হ্রদের শান্ত বুকে কতকগুলি পাথর ছুঁড়িলে। প্রতিটি প্রস্তর নিক্ষেপের পরেই দেখা যায় একটি প্রতিক্রিয়া। প্রস্তরখণ্ডটিকে বেড়িয়া সরোবরের কতকগুলি ছোট ছোট ঢেউ ওঠে। এইরূপেই বহির্জগতের বস্তুনিচয় যেন মন-রূপ সরোবরে উপলরাশির মত নিক্ষিপ্ত হইতেছে। অতএব আমরা প্রকৃতপক্ষে বাহিরের জিনিষ দেখি না …; দেখি শুধু তরঙ্গ …।
মনে উত্থিত তরঙ্গগুলি বাহিরে অনেক কিছু সৃষ্টি করে। আমরা আদর্শবাদ (Idealism) ও বাস্তববাদের (Realism) গুণ-সকল আলোচনা করিতেছি না। মানিয়া লইতেছি—বাহিরের জিনিষ রহিয়াছে, কিন্তু যাহা আমরা দেখি, তাহা বাহিরে অবস্থিত বস্তু হইতে ভিন্ন, কেন-না আমরা যাহা প্রত্যক্ষ করি, তাহা বহিঃস্থ বস্তু ও আমাদের নিজেদের সত্তার একটি সমবায়।
মনে কর—আমার প্রদত্ত যাহা কিছু, তাহা গ্লাসটি হইতে উঠাইয়া লইলাম। কি অবশিষ্ট রহিল? প্রায় কিছুই নয়। গ্লাসটি অদৃশ্য হইবে। যদি আমি আমার প্রদত্ত যাহা কিছু, তাহা এই টেবিলটি হইতে সরাইয়া লই, টেবিলের আর কি থাকিবে? নিশ্চয়ই এই টেবিলটি থাকিবে না, কারণ ইহা উৎপন্ন হইয়াছিল বহির্বস্তু ও আমার ভিতর হইতে প্রদত্ত কিছু—এই দুই লইয়া। (প্রস্তরখণ্ড) যখনই নিক্ষিপ্ত হউক না কেন, হ্রদ বেচারীকে তখনই উহার চারিপাশে তরঙ্গ তুলিতে হইবে। যে-কোন উত্তেজনার জন্য মনকে তরঙ্গ সৃষ্টি করিতেই হইবে। মনে কর … আমরা যেন মন বশীভূত করিতে পারি। তৎক্ষণাৎ আমরা মনের প্রভু হইব। আমরা বাহিরের ঘটনাগুলিকে আমাদের যাহা কিছু দেয়, তাহা দিতে অস্বীকার করিলাম …। আমি যদি আমার ভাগ না দিই, বাহিরের ঘটনা থামিতে বাধ্য। অনবরত তুমি এই বন্ধন সৃষ্টি করিতেছ। কিরূপে? তোমার নিজের অংশ দিয়া। আমরা সকলেই নিজেদের শৃঙ্খল গড়িয়া বন্ধন রচনা করিতেছি…। যখন বহির্বস্তু ও আমার মধ্যে অভিন্ন বোধ করার ভাব চলিয়া যাইবে, তখন আমি আমার (দেয়) ভাগটি তুলিয়া লইতে পারিব এবং বস্তুও বিলুপ্ত হইবে। তখন আমি বলিব, ‘এখানে এই গ্লাসটি রহিয়াছে,’ আর আমি আমার মনটি উহা হইতে উঠাইয়া লইব, সঙ্গে সঙ্গে গ্লাসটিও অদৃশ্য হইবে …। যদি তুমি তোমার দেয় অংশ উঠাইয়া লইতে সমর্থ হও, তবে জলের উপর দিয়াও তুমি হাঁটিতে পারিবে। জল আর তোমাকে ডুবাইবে কেন? বিষই বা তোমার কি করিবে? আর কোনপ্রকার কষ্টও থাকিবে না। প্রকৃতির প্রত্যেক দৃশ্যমান বস্তুতে তোমার দান অন্ততঃ অর্ধেক এবং প্রকৃতির অর্ধাংশ। যদি তোমার অর্ধভাগ সরাইয়া লওয়া যায় তো দৃশ্যমান বস্তুর বিলুপ্তি ঘটিবে।
… প্রত্যেক কাজেরই সমপরিমাণ প্রতিক্রিয়া আছে …। যদি কোন লোক আমাকে আঘাত করে ও কষ্ট দেয়—ইহা সেই লোকটির কার্য এবং (বেদনা) আমার শরীরের প্রতিক্রিয়া …। মনে কর আমার শরীরের উপর আমার এতটা ক্ষমতা আছে যে, আমি ঐ স্বয়ংচালিত প্রতিক্রিয়াটি প্রতিরোধ করিতে সমর্থ। ঐরূপ শক্তি কি অর্জন করা যায়? ধর্মশাস্ত্র (যোগশাস্ত্র) বলে, যায় …। যদি তুমি অজ্ঞাতসারে হঠাৎ ইহা লাভ কর, তখন বলিয়া থাক—‘অলৌকিক’ ঘটনা। আর যদি বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে শিক্ষা কর, তখন উহার নাম ‘যোগ’।
মানসিক শক্তির দ্বারা লোকের রোগ সারাইতে আমি দেখিয়াছি। উহা ‘অলৌকিক কর্মী’র কাজ। আমরা বলি, তিনি প্রার্থনা করিয়া লোককে নীরোগ করেন। (কিন্তু) কেহ বলিবেন, ‘না, মোটেই না, ইহা কেবল তাঁহার মনের শক্তির ফল। লোকটি বৈজ্ঞানিক। তিনি জানেন, তিনি কি করিতেছেন।’
ধ্যানের শক্তি আমাদিগকে সব কিছু দিতে পারে। যদি তুমি প্রকৃতির উপর আধিপত্য চাও, (ইহা ধ্যানের অনুশীলনেই সম্ভব হইবে)। আজকাল বিজ্ঞানের সকল আবিষ্ক্রিয়াও ধ্যানের দ্বারাই হইতেছে। তাঁহারা (বৈজ্ঞানিকগণ) বিষয়বস্তুটি তন্ময়ভাবে অনুধ্যান করিতে থাকেন এবং সব-কিছু ভুলিয়া যান—এমন কি নিজেদের সত্তা পর্যন্ত, আর তখন মহান্ সত্যটি বিদ্যুৎপ্রভার মত আবির্ভূত হয়। কেহ কেহ ইহাকে ‘অনুপ্রেরণা’ বলিয়া ভাবেন। কিন্তু নিঃশ্বাসত্যাগ যেমন আগন্তুক নয় (নিশ্বাস গ্রহণ করিলেই উহার ত্যাগ সম্ভব), সেইরূপ ‘অনুপ্রেরণা’ও অকারণ নয়। কোন কিছুই বৃথা পাওয়া যায় নাই।
যীশুখ্রীষ্টের কার্যের মধ্যে আমরা তথাকথিত শ্রেষ্ঠ ‘অনুপ্রেরণা’ দেখিতে পাই। তিনি পূর্ব পূর্ব জন্মে যুগ যুগ ধরিয়া কঠোর কর্ম করিয়াছিলেন। তাঁহার ‘অনুপ্রেরণা’ তাঁহার প্রাক্তন কর্মের—কঠিন শ্রমের ফল …। ‘অনুপ্রেরণা’ লইয়া ঢাক পিটান অনর্থক বাক্যব্যয়। যদি তাহাই হইত, তবে ইহা বর্ষাধারার মত পতিত হইত। যে-কোন চিন্তাধারায় প্রত্যাদিষ্ট ব্যক্তিগণ সাধারণ শিক্ষিত (ও কৃষ্টিসম্পন্ন) জাতিসমূহের মধ্যেই আবির্ভূত হন। প্রত্যাদেশ বলিয়া কিছু নাই। … অনুপ্রেরণা বলিয়া যাহা চলিতেছে, তাহা আর কিছুই নয়—যে সংস্কারগুলি পূর্ব হইতেই মনের মধ্যে বাসা বাঁধিয়া আছে, সেগুলির কার্যপরিণত রূপ অর্থাৎ ফল। একদিন সচকিতে আসে এই ফল! তাঁহাদের অতীত কর্মই ইহার কারণ।
সেখানেও দেখিবে ধ্যানের শক্তি—চিন্তার গভীরতা। ইঁহারা নিজ নিজ আত্মাকে মন্থন করেন। মহান্ সত্যসমূহ উপরিভাগে আসিয়া প্রতিভাত হয়। অতএব ধ্যানাভ্যাসই জ্ঞানলাভের বিজ্ঞানসম্মত পন্থা। ধ্যানের শক্তি ব্যতীত জ্ঞান হয় না। ধ্যানশক্তির প্রয়োগে অজ্ঞান, কুসংস্কার ইত্যাদি হইতে আমরা সাময়িকভাবে মুক্ত হইতে পারি, ইহার বেশী নয়। মনে কর, এক ব্যক্তি আমাকে বলিয়াছে যে, এই বিষ পান করিলে মৃত্যু হইবে এবং আর এক ব্যক্তি রাত্রে আসিয়া বলিল, ‘যাও, বিষ পান কর!’ এবং বিষ খাইয়াও আমার মৃত্যু হইল না (যাহা ঘটিল তাহা এই)—ধ্যানের ফলে বিষ ও আমার নিজের মধ্যে একত্ববোধ হইতে সাময়িকভাবে আমার মন বিচ্ছিন্ন হইয়াছিল। অপর পক্ষে সাধারণভাবে বিষ পান করিতে গেলে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী ছিল।
যদি আমি কারণ জানি এবং বৈজ্ঞানিক উপায়ে আমাকে ধ্যানের অবস্থায় উন্নীত করি, তবে যে-কোন লোককেই আমি বাঁচাইতে পারি। এই কথা (যোগ)-গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে, কিন্তু ইহা কতখানি নির্ভুল, তাহার বিচার তোমরাই করিও।
লোকে আমাকে জিজ্ঞাসা করেঃ তোমরা ভারতবাসীরা এ-সব জয় কর না কেন? অন্যান্য জাতি অপেক্ষা তোমরা শ্রেষ্ঠ বলিয়া সর্বদা দাবী কর। তোমরা যোগাভ্যাস কর এবং অন্য কাহারও অপেক্ষা দ্রুত অভ্যাস কর। তোমরা যোগ্যতর। ইহা কার্যে পরিণত কর! তোমরা যদি মহান্ জাতি হইয়া থাক, তোমাদের যোগপদ্ধতিও মহান্ হওয়া উচিত। সব দেবতাকে বিদায় দিতে হইবে। বড় বড় দার্শনিকদের চিন্তাধারা গ্রহণ করিবার সঙ্গে সঙ্গে দেবতাদের ঘুমাইতে দাও। তোমরাও বিশ্বের অন্য সকলের মত কুসংস্কারাচ্ছন্ন শিশু মাত্র। তোমাদের সব কিছু দাবী নিষ্ফল। তোমাদের যদি সত্যি দাবী থাকে, সাহসের সহিত দাঁড়াও, এবং স্বর্গ বলিতে যাহা কিছু—সব তোমাদের। কস্তুরীমৃগ তাহার অন্তর্নিহিত সৌরভ লইয়া আছে, এবং সে জানে না—কোথা হইতে সৌরভ আসিতেছে। বহুদিন পর সে সেই সৌরভ নিজের মধ্যেই খুঁজিয়া পায়। এ-সব দেবতা ও অসুর মানুষের মধ্যে আছে। যুক্তি, শিক্ষা ও সংস্কৃতির শক্তিতে জান যে, তোমার মধ্যেই সব আছে। দেবতা ও কুসংস্কারের আর প্রয়োজন নাই। তোমরা যুক্তিবাদী, যোগী, যথার্থ আধ্যাত্মিকতা-সম্পন্ন হইতে চাও।
(আমার উত্তর এইঃ তোমাদের নিকট) সব-কিছুই জড়। সিংহাসনে সমাসীন ঈশ্বর অপেক্ষা বেশী জড় আর কি হইতে পারে? মূর্তিপূজক গরীব বেচারীকে তো তোমরা ঘৃণা করিতেছ। তার চেয়ে তোমরা বড় নও। আর ধনের পূজারী তোমরাই বা কী! মূর্তিপূজক তাহার দৃষ্টির গোচরীভূত কোন বিশেষ কিছুকেই দেবতাজ্ঞানে পূজা করিয়া থাকে, কিন্তু তোমরা তো সেটুকুও কর না। আত্মার অথবা বুদ্ধিগ্রাহ্য কোন কিছুর উপাসনা তোমরা কর না! তোমাদের কেবল বাক্যাড়ম্বর। ‘ঈশ্বর চৈতন্যস্বরূপ!’ ঈশ্বর চৈতন্যস্বরূপই। প্রকৃত ভাব ও বিশ্বাস লইয়া ঈশ্বরের উপাসনা করিতে হইবে। চৈতন্য কোথায় থাকেন? গাছে? মেঘে? ‘আমাদের ঈশ্বর’—এই কথার অর্থ কি? তুমিই তো চৈতন্য। এই মৌলিক বিশ্বাসটিকে কখনই ত্যাগ করিও না। আমি চৈতন্যস্বরূপ। যোগের সমস্ত কৌশল এবং ধ্যানপ্রণালী আত্মার মধ্যে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করিবার জন্য।
এখনই কেন এই সমস্ত বলিতেছি? যে পর্যন্ত না তুমি (ঈশ্বরের) স্থান নির্দেশ করিতে পারিবে, এ-বিষয় কিছুই বলিতে পার না। (তাঁহার) প্রকৃত স্থান ব্যতীত স্বর্গে এবং মর্ত্যের সর্বত্র তুমি তাঁহার অবস্থিতি নির্ণয় করিতেছ। আমি চেতন প্রাণী, অতএব সমস্ত চেতনার সারভূত চেতনা আমার আত্মাতে অবশ্যই থাকিবে। যাহারা ভাবে ঐ চেতনা অন্য কোথাও আছে, তাহারা মূর্খ। অতএব আমার চেতনাকে এই স্বর্গেই অন্বেষণ করিতে হইবে। অনাদিকাল হইতে যেখানে যত স্বর্গ আছে, সে-সব আমারই মধ্যে। এমন অনেক যোগী ঋষি আছেন, যাঁহারা এই তত্ত্ব জানিয়া ‘আবৃত্তচক্ষু’ হন এবং নিজেদের আত্মার সমস্ত চেতনার চেতনাকে দর্শন করেন। ইহাই ধ্যানের পরিধি। ঈশ্বর ও তোমার নিজ আত্মা সম্বন্ধে প্রকৃত সত্য আবিষ্কার কর এবং এইরূপে মুক্ত হও।
সকলেই জীবনের পিছু পিছু ছুটিয়া চলিয়াছে, শেষে আমরা দেখি—ইহা মূর্খতামাত্র। জীবন অপেক্ষা আরও মহত্তর কিছু আছে। পাঞ্চভৌতিক (এই জীবন) নিকৃষ্টতর। কেন আমি বাঁচিবার আশায় ছুটিতে যাইব? জীবন অপেক্ষা আমার স্থান যে অনেক উচ্চে। বাঁচিয়া থাকাই সর্বদা দাসত্ব। আমরা সর্বদাই (অজ্ঞানের সহিত নিজেদের) মিশাইয়া ফেলিতেছি …। সবই দাসত্বের অবিচ্ছিন্ন শৃঙ্খল।
তুমি যে কিছু লাভ কর, সে কেবল নিজের দ্বারাই, কেহ অপরকে শিখাইতে পারে না। অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়া (আমরা শিক্ষা করি) … ঐ যে যুবকটি—উহাকে কখনও বিশ্বাস করাইতে পারিবে না যে, জীবনে বিপদ-আপদ আছে। আবার বৃদ্ধকে বুঝাইতে পারিবে না যে, জীবন বিপত্তিহীন, মসৃণ। বৃদ্ধ অনেক দুঃখকষ্টের অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছেন। ইহাই পার্থক্য।
ধ্যানের শক্তিদ্বারা এ-সবই ক্রমে ক্রমে আমাদের বশে আনিতে হইবে। আমরা দার্শনিক দৃষ্টিতে দেখিয়াছি যে, আত্মা মন ভূত (জড় পদার্থ) প্রভৃতি নানা বৈচিত্র্যের (বাস্তব সত্তা কিছু নাই)। … যাহা আছে, তাহা ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’। বহু কিছু থাকিতে পারে না। জ্ঞান এবং বিজ্ঞানের অর্থ ইহাই। অজ্ঞানের জন্যই বহু দেখি। জ্ঞানে একত্বের উপলব্ধি …। বহুকে একে পরিণত করাই বিজ্ঞান …। সমগ্র বিশ্বের একত্ব প্রমাণিত হইয়াছে। এই বিজ্ঞানের নাম বেদান্ত-বিদ্যা। সমগ্র জগৎ এক। আপাত প্রতীয়মান বৈচিত্র্যের মধ্যে সেই ‘এক’ অনুস্যূত হইয়া রহিয়াছে।
আমাদের পক্ষে এখন এই-সকল বৈচিত্র্য রহিয়াছে, আমরা এগুলি দেখিতেছি—অর্থাৎ এগুলি আমরা বলি পঞ্চভূত—ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম্ (পাঁচটি মৌলিক পদার্থ)। ইহার পরে রহিয়াছে মনোময় সত্তা, আর আধ্যাত্মিক সত্তা তাহারও পরে। আত্মা এক, মন অন্য, আকাশ অন্য একটি কিছু ইত্যাদি—এরূপ কিন্তু নয়। এই-সকল বৈচিত্র্যের মধ্যে একই সত্তা প্রতীয়মান হইতেছে; ফিরিয়া গেলে কঠিন অবশ্যই তরলে পরিণত হইবে। যেভাবে মৌলিক পদার্থগুলির ক্রমবিকাশ হইয়াছিল, সেভাবেই আবার তাহাদের ক্রমসঙ্কোচ হইবে। কঠিন পদার্থগুলি তরলাকার ধারণ করিবে, তরল ক্রমে ক্রমে আকাশে পরিণত হইবে। নিখিল জগতের ইহাই কল্পনা—এবং ইহা সর্বজনীন। বাহিরের এই জগৎ এবং সর্বজনীন আত্মা, মন, আকাশ, মরুৎ, তেজ, অপ্ ও ক্ষিতি আছে। মন সম্বন্ধেও একই কথা। ক্ষুদ্র জগতে বা অন্তর্জগতে ‘আমি’ ঠিক ঐ এক। আমিই আত্মা, আমিই মন। আমিই আকাশ, বায়ু, তরল ও কঠিন পদার্থ। আমার লক্ষ্য আমার আত্মিক সত্তায় প্রত্যাবর্তন। একটি ক্ষুদ্র জীবনে ‘মানুষকে’ সমগ্র বিশ্বের জীবন যাপন করিতে হইবে। এরূপে মানুষ এ-জন্মেই মুক্ত হইতে পারে। তাহার নিজের সংক্ষিপ্ত জীবৎকালেই সে বিশ্বজীবন অতিবাহিত করিবার ক্ষমতা লাভ করিবে।
আমরা সকলেই সংগ্রাম করি। … যদি আমরা পরম সত্যে পৌঁছিতে না পারি, তবে অন্ততঃ এমন স্থানেও উপনীত হইব, যেখানে এখানকার অপেক্ষা উন্নততর অবস্থাতেই থাকিব। এই অভ্যাসেরই নাম ধ্যান। (সব কিছুকে সেই চরম সত্য—আত্মাতে পর্যবসিত করা।) কঠিন দ্রবীভূত হইয়া তরলে, তরল বাষ্পে, বাষ্প ব্যোম্ বা আকাশে আর আকাশ মনে রূপান্তরিত হয়। তারপর মনও গলিয়া যাইবে। শুধু থাকিবে আত্মা—সবই আত্মা।
যোগীদের মধ্যে কেহ কেহ দাবী করেন যে, এই শরীর তরল বাষ্প ইত্যাদিতে পরিণত হইবে। তুমি শরীর দ্বারা যাহা খুশী করিতে পারিবে—ইহাকে ছোট করিতে পার, এমন কি বাষ্পেও পরিণত করিতে পার, এই দেওয়ালের মধ্য দিয়া যাতায়াতও সম্ভব হইতে পারে—এই রকম তাঁহারা দাবী করেন। আমার অবশ্য তাহা জানা নাই। আমি কখনও কাহাকেও এরূপ করিতে দেখি নাই। কিন্তু যোগশাস্ত্রে এই-সব কথা আছে। যোগশাস্ত্রগুলিকে অবিশ্বাস করিবার কোন হেতু নাই।
হয়তো আমাদের মধ্যে কেহ কেহ এই জীবনে ইহা সাধন করিতে সমর্থ হইবেন। আমাদের পূর্বকৃত কর্মের ফলে বিদ্যুৎপ্রভার ন্যায় ইহা প্রতিভাত হয়। কে জানে এখানেই হয়তো কোন প্রাচীন যোগী রহিয়াছেন, যাঁহার মধ্যে সাধনা সম্পূর্ণ করিবার সামান্যই একটু বাকী। অভ্যাস!
একটি চিন্তাধারার মাধ্যমে ধ্যানে পৌঁছিতে হয়। ভূতপঞ্চকের শুদ্ধীকরণ-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়া যাইতে হয়—এক-একটিকে অপরটির মধ্যে দ্রবীভূত করিয়া স্থূল হইতে পরবর্তী সূক্ষ্মে, সূক্ষ্মতরে, তাহাও আবার মনে, মনকে পরিশেষে আত্মায় মিশাইয়া দিতে হয়। তখন তোমরাই আত্মস্বরূপ।*
জীবাত্মা সদামুক্ত, সর্বশক্তিমান্, সর্বজ্ঞ। অবশ্য জীবাত্মা ঈশ্বরাধীন। ঈশ্বর অনেক হইতে পারেন না। এই মুক্তাত্মাগণ বিপুল শক্তির আধার, প্রায় সর্বশক্তিমান্, (কিন্তু) কেহই ঈশ্বরতুল্য শক্তিমান্ হইতে পারেন না। যদি কোন মুক্ত পুরুষ বলেন, ‘আমি এই গ্রহটিকে কক্ষচ্যুত করিয়া ইহাকে এই পথ দিয়া পরিভ্রমণ করিতে বাধ্য করিব’ এবং আর একজন মুক্তাত্মা যদি বলেন, ‘আমি গ্রহটিকে এই পথে নয়, ঐ পথে চালাইব’ (তবে বিশৃঙ্খলারই সৃষ্টি হইবে)।
তোমরা যেন এই ভুল করিও না। আমি যে ইংরেজীতে বলি, ‘আমি ঈশ্বর (God)’, তাহার কারণ ইহা অপেক্ষা আর কোন যোগ্যতর শব্দ নাই। সংস্কৃতে ‘ঈশ্বর’ মানে সচ্চিদানন্দ, জ্ঞান—স্বয়ংপ্রকাশ অনন্ত চৈতন্য। ঈশ্বর অর্থে কোন পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিবিশেষ নয়। তিনি নৈর্ব্যক্তিক ভূমা। …
আমি কখনও রাম নই, ঈশ্বরের (ঈশ্বরের সাকার ভাবের) সহিত কখনও এক নই, কিন্তু আমি (ব্রহ্মের সহিত—নৈর্ব্যক্তিক সর্বত্র-বিরাজমান সত্তার সহিত) এক। এখানে একতাল কাদা রহিয়াছে। এই কাদা দিয়া আমি একটি ছোট ইঁদুর তৈরী করিলাম আর তুমি একটি ক্ষুদ্রকায় হাতী প্রস্তুত করিলে। দুই-ই কাদার। দুইটিকেই ভাঙিয়া ফেল। তাহারা মূলতঃ এক—তাই একই মৃত্তিকায় পরিণত হইল। ‘আমি এবং আমার পিতা এক।’ (কিন্তু মাটির ইঁদুর আর মাটির হাতী কখনই এক হইতে পারে না।)
কোন জায়গায় আমাকে থামিতে হয়, আমার জ্ঞান অল্প। তুমি হয়তো আমার চেয়ে কিছু বেশী জ্ঞানী, তুমিও একস্থানে থামিয়া যাও। আবার এক আত্মা আছেন, যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ। তিনিই ঈশ্বর, যোগাধীশ (স্রষ্টারূপে সগুণ ঈশ্বর)। তখন তিনি সর্বশক্তিমান্ ‘ব্যক্তি’। সকল জীবের হৃদয়ে তিনি বাস করেন। তাঁহার শরীর নাই—শরীরের প্রয়োজন হয় না। ধ্যানের অভ্যাস প্রভৃতি দ্বারা যাহা কিছু আয়ত্ত করিতে পার, যোগীন্দ্র ঈশ্বরের ধ্যান করিয়াও তাহা লভ্য। একই বস্তু আবার কোন মহাপুরুষকে, অথবা জীবনের ঐকতানকে ধ্যান করিয়াও লাভ করা যায়। এগুলিকে বিষয়গত ধ্যান বলে। সুতরাং এইভাবে কয়েকটি বাহ্য বা বিষয়গত বস্তু লইয়া ধ্যান আরম্ভ করিতে হয়। বস্তুগুলি বাহিরেও হইতে পারে, ভিতরেও হইতে পারে। যদি তুমি একটি দীর্ঘ বাক্য গ্রহণ কর, তবে তাহা মোটেই ধ্যান করিতে পারিবে না। ধ্যান মানে পুনঃপুনঃ চিন্তা করিয়া মনকে ধ্যেয় বস্তুতে নিবিষ্ট করার চেষ্টা। মন সকল চিন্তাতরঙ্গ থামাইয়া দেয় এবং জগৎও থাকে না। জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত হয়। প্রতিবারেই ধ্যানের দ্বারা তোমার শক্তি বৃদ্ধি হইবে। … আরও একটু বেশী কঠোর পরিশ্রম কর—ধ্যান গভীরতর হইবে। তখন তোমার শরীরের বা অন্য কিছুর বোধ থাকিবে না। এইভাবে একঘণ্টা ধ্যানমগ্ন থাকার পর বাহ্য অবস্থায় ফিরিয়া আসিলে তোমার মনে হইবে যে, ঐ সময়টুকুতে তুমি জীবনে সর্বাপেক্ষা সুন্দর শান্তি উপভোগ করিয়াছ। ধ্যানই তোমার শরীরযন্ত্রটিকে বিশ্রাম দিবার একমাত্র উপায়। গভীরতম নিদ্রাতেও ঐরূপ বিশ্রাম পাইতে পার না। গভীরতম নিদ্রাতেও মন লাফাইতে থাকে। কিন্তু (ধ্যানের) ঐ কয়েকটি মিনিটে তোমার মস্তিষ্কের ক্রিয়া প্রায় স্তব্ধ হইয়া যায়। শুধু একটু প্রাণশক্তি মাত্র থাকে। শরীরের জ্ঞান থাকে না। তোমাকে কাটিয়া টুকরা টুকরা করিয়া ফেলিলেও তুমি টের পাইবে না। ধ্যানে এতই আনন্দ পাইবে যে, তুমি অত্যন্ত হালকা বোধ করিবে। ধ্যানে আমরা এইরূপ পূর্ণ বিশ্রাম লাভ করিয়া থাকি।
তারপর বিভিন্ন বস্তুর উপরে ধ্যান। মেরুমজ্জার বিভিন্ন কেন্দ্রে ধ্যানের প্রণালী আছে। (যোগিগণের মতে মেরুদণ্ডের মধ্যে ইড়া ও পিঙ্গলা নামক দুইটি স্নায়বীয় শক্তিপ্রবাহ বর্তমান। অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী শক্তিপ্রবাহ এই দুই প্রধান পথে গমনাগমন করে।) শূন্যনালী (যাহাকে বলে সুষুম্না) মেরুদণ্ডের মধ্য দিয়া চলিয়া গিয়াছে। যোগীরা বলেন, এই সুষুম্না-পথ সাধারণতঃ রুদ্ধ থাকে, কিন্তু ধ্যানাভ্যাসের ফলে ইহা উন্মুক্ত হয়, (স্নায়বীয়) প্রাণশক্তিপ্রবাহকে (মেরুদণ্ডের নীচে) চালাইয়া দিতে পারিলেই কুণ্ডলিনী জাগরিত হয়। জগৎ তখন ভিন্নরূপ ধারণ করে। … (এইরূপে ঐশ্বরিক জ্ঞান, অতীন্দ্রিয় অনুভূতি ও আত্মজ্ঞান লাভ করিবার একমাত্র উপায় হইতেছে কুণ্ডলিনীর জাগরণ।)
সহস্র সহস্র দেবতা তোমার চারিদিকে দাঁড়াইয়া রহিয়াছেন। তুমি তাঁহাদিগকে দেখিতে পাইতেছ না, কারণ তোমার জগৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য। আমরা কেবল এই বাহিরটাই দেখিতে পারি; ইহাকে বলা যাক ‘ক’। আমাদের মানসিক অবস্থা অনুযায়ী আমরা সেই ‘ক’-কে দেখি বা উপলব্ধি করি। বাহিরে অবস্থিত ঐ গাছটিকে ধরা যাক। একটি চোর আসিল, সে ঐ মুড়া গাছটিকে কি ভাবিবে? সে দেখিবে—একজন পাহারাওয়ালা দাঁড়াইয়া আছে। শিশু উহাকে মনে করিল—একটা প্রকাণ্ড ভূত। একটি যুবক তাহার প্রেমিকার জন্য অপেক্ষা করিতেছিল; সে কি দেখিল? নিশ্চয়ই তাহার প্রিয়তমাকে। কিন্তু এই স্থাণু বা মুড়া গাছটির তো কোন পরিবর্তন হয় নাই। ইহা যেরূপ ছিল, সেইরূপই রহিল। স্বয়ং ঈশ্বরই কেবল আছেন, আমরাই আমাদের নির্বুদ্ধিতার জন্য তাঁহাকে মানুষ, ধূলি, বোবা, দুঃখী ইত্যাদি-রূপে দেখিয়া থাকি।
যাহারা একইভাবে গঠিত, তাহারা স্বভাবতঃ একই শ্রেণীভুক্ত হয় এবং একই জগতে বাস করে। অন্যভাবে বলিলে বলা যায়—তোমরা একই স্থানে বাস কর। সমস্ত স্বর্গ এবং সমস্ত নরক এখানেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যাইতে পারে—কতকগুলি বড় বৃত্তের আকারে সমতল ক্ষেত্রসমূহ যেন পরস্পর কয়েকটি বিন্দুতে ছেদ করিয়াছে … । এই সমতল ভূমির একটি বৃত্তে অবস্থিত আমরা আর একটি সমতলের (বৃত্তকে) কোন একটি বিন্দুতে স্পর্শ করিতে পারি। মন যদি কেন্দ্রে পৌঁছে, তবে সমস্ত স্তরেরই তোমার জ্ঞান হইতে থাকিবে। ধ্যানের সময় কখনও কখনও তুমি যদি অন্য ভূমি স্পর্শ কর, তখন অন্য জগতের প্রাণী, অশরীরী আত্মা এবং আরও কত কিছুর সংস্পর্শে আসিতে পার।
ধ্যানের শক্তি দ্বারাই এই-সব লোকে যাইতে পার। এই শক্তি আমাদের ইন্দ্রিয়গুলিকে পরিবর্তিত এবং পরিমার্জিত করে। যদি তুমি পাঁচদিন ঠিক ঠিক ধ্যান অভ্যাস কর, এই (জ্ঞান) কেন্দ্রগুলির ভিতর হইতে একপ্রকার ‘সংবেদনা’ অনুভব করিবে—তোমার শ্রবণশক্তি সূক্ষ্মতর হইতেছে। … (জ্ঞানেন্দ্রিয়গুলি যতই মার্জিত হইবে, অনুভূতিও ততই সূক্ষ্ম হইবে। তখন অধ্যাত্মজগৎ খুলিয়া যাইবে।) এইজন্য ভারতীয় দেবতাগণের তিনটি চক্ষু কল্পনা করা হইয়াছে। তৃতীয় বা জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হইলে বিবিধ আধ্যাত্মিক দর্শন উপস্থিত হয়।
কুণ্ডলিনী শক্তি মেরুমজ্জার মধ্যস্থিত এক কেন্দ্র হইতে কেন্দ্রান্তরে যতই উঠিতে থাকে, ততই ইন্দ্রিয়গুলির পরিবর্তন সাধিত হয় এবং জগৎ ভিন্নরূপে প্রতীত হইতে আরম্ভ করে। পৃথিবী তখন স্বর্গে পরিণত হয়। তোমার কথা বন্ধ হইয়া যায়। তারপর কুণ্ডলিনী অধস্তন কেন্দ্রগুলিতে নামিলে তুমি আবার মানবীয় ভূমিতে আসিয়া পড়। সমস্ত কেন্দ্র অতিক্রম করিয়া কুণ্ডলিনী যখন মস্তিষ্কে সহস্রারে পৌঁছিবে, তখন সমগ্র দৃশ্য জগৎ (তোমার অনুভূতিতে) বিলীন হয় এবং এক সত্তা ব্যতীত কিছুই অনুভব কর না। তখন তুমিই পরমাত্মা; সমুদয় স্বর্গ তাঁহা হইতেই সৃষ্টি করিতেছ; সমস্ত জগৎও তাঁহা হইতেই রচনা করিতেছ। তিনিই একমাত্র সত্তা; তিনি ছাড়া আর কিছুই নাই।