তেজপুর থেকে শিলচরে চলে আসার পর কেটে গেল সাতটা দিন। এর মধ্যে কাকাবাবু আর সার্কিট হাউস থেকে বেরোলেনই না। শুধু বিছানায় শুয়ে-শুয়ে বিশ্রাম। এর মধ্যে সন্তু আর জোজো বেড়িয়ে এল দুটো চা বাগানে। সেখানে তাদের খাতির যত্ন করে খুব খাওয়ানো-দাওয়ানো হয়েছে। চা-বাগানের আতিথেয়তা খুব বিখ্যাত।
ঘর থেকে না বেরোলেও কাকাবাবু টেলিফোনে নানা রকম খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। জলিল শেখের বাড়ির কাছে গোপনে পুলিশ পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে হঠাৎ এসে তাকে কেউ না মারতে পারে। কেউ আসেনি এ-পর্যন্ত। তবে দুঃখের বিষয় তার মেয়েটিকে খুঁজে পাওয়া যায়নি এখনও।
টিকেন্দ্রজিতের কোনও পাত্তা নেই। তেজপুরে তাকে আর দেখাই যাচ্ছে না। কাকাবাবু মণিপুর রাজ্যের পুলিশের বড় কর্তাকে ফোন করেছিলেন। ইম্ফল শহর থেকে খানিকটা দূরে তার একটা বাড়ি আছে বটে, কিন্তু সেখানে ফেরেনি টিকেন্দ্রজিৎ। সে বাড়ির লোকেরা তার কোনও সন্ধান জানে না।
কাকাবাবু সেসব শুনে আপনমনে মাথা নাড়তে নাড়তে বলেন, দেখা হবে, ঠিক ওর সঙ্গে আবার দেখা হবে।
সকালবেলা কাকাবাবু দোতলার বারান্দায় একটা ইজিচেয়ারে বসলেন। পায়ের ওপর রোদ এসে পড়েছে, ভারী আরাম লাগছে। স্থানীয় একটা খবরের কাগজ দিয়ে গেছে। তার প্রথম পাতাতেই বড়বড় অক্ষরে খবর, কাজিরাঙার জঙ্গলে চিরুনি-তল্লাশ। ফরেস্ট গার্ড ও পুলিশবাহিনী সমস্ত জঙ্গলে অভিযান চালাচ্ছে দিনের পর দিন। বেআইনিভাবে গাছ কাটার জন্য ধরা পড়েছে পাঁচজন লোক, জেলখানা থেকে পলাতক দুজন আসামী এক জায়গায় লুকিয়ে ছিল, তারাও ধরা পড়েছে। একটা আহত লেপার্ডকে উদ্ধার করে চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়েছে, সব কাজই চলছে বেশ ভালভাবে। এই কদিন বিশ্রাম নিয়ে কাকাবাবু আবার চাঙ্গা হয়ে উঠেছেন। দু-একবার তিনি শূন্যে ঘুসি চালিয়ে দেখলেন, হাতের জোর ঠিক আছে কি না।
সন্তু আর জোজো নদীর ধারে বেড়াতে গিয়েছিল। ফিরে এল ব্রেকফাস্টের সময়। রোজ-রোজ টোস্ট আর ওমলেটের বদলে খানসামা আজ দিয়ে গেল গরম-গরম পুরি আর আলু-ফুলকপির তরকারি। তরকারিটার দারুণ স্বাদ হয়েছে, জোজো দু বার চেয়ে নিল। কাকাবাবু বললেন, কলকাতায় ফিরে গিয়ে ওজন নিলে দেখা যাবে, আমাদের তিনজনেরই ওজন বেড়ে গেছে। বাইরে বেড়াতে এলে বেশি খাওয়া হয়ে যায়।
জোজো বলল, আমার কোনও প্রবলেম নেই। একদিন এমন যোগব্যায়াম করে নেব যে, তাতেই আবার অনেকটা ওজন কমে যাবে।
সন্তু বলল, তুই মোটে একদিন যোগব্যায়াম করবি?
জোজো বলল, একদিন যথেষ্ট। এ তোদের এলেবেলে যোগ ব্যায়াম নয়। বাবার সঙ্গে যখন তিব্বতে গিয়েছিলাম, তখন একজন আসল লামা আমাকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন। এক দিনেই এক বছরের কাজ হয়ে গেছে।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তিব্বতেও গেছ বুঝি?
জোজো বলল, বাঃ, যেবারে চায়না গেলাম, সেবারই তো। জানেন কাকাবাবু, একটুর জন্য আমার লেভিটেশান শেখা হল না। তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে হল যে!
সন্তু বলল, লেভিটেশান মানে মাটি থেকে ওপরে উঠে যাওয়া?
জোজো বলল,। তুই মানেটা জানিস দেখছি। মাটিতে পদ্মাসনে বসে আছিসতো, যোগবলে পুরো শরীরটাই মাটি থেকে একটু-একটু ওপরে উঠে যাবে।
সন্তু বলল, যাঃ, তা কখনও হয় নাকি? মাধ্যাকর্ষণ আছে না?
জোজো বলল, নিশ্চয়ই হয়। নাহলে লেভিটেশান কথাটা তৈরি হল কী করে?
তুই নিজের চোখে দেখেছিস কোনও লামাকে সে রকম ওপরে উঠতে?
আলবাত দেখেছি। আমার গুরুই তো করে দেখালেন।
বাজে কথা, টিনটিন ইন টিবেট বইতে এরকম একটা ছবি আছে, তুই সেটা দেখে বলছিস!
কাকাবাবু হাসতে লাগলেন।
কথা ঘোরাবার জন্য জোজো বলল, কাকাবাবু, পূর্ণিমা কবে?
কাকাবাবু বললেন, কালকে।
জোজো বলল, তা হলে আজ কি আমরা তেজপুরে ফিরে যাব?
কাকাবাবু বললেন, আমরা রওনা হব কাল সকালে। তেজপুরে যাব না, সোজা জঙ্গলে ঢুকব।
সন্তু বলল, জানো কাকাবাবু, জোজোর ধারণা, সব জায়গায় একই দিনে পূর্ণিমা হয় না। আমার সঙ্গে তর্ক করছিল।
কাকাবাবু বললেন, সে কী হে জোজো! আকাশে কি একটার বেশি চাঁদ আছে নাকি?
জোজো বলল, তা নয়। গরম কিংবা শীত যেমন এক-এক জায়গায় কম বা বেশি হয়, তেমনই জ্যোৎস্নাও কম-বেশি হতে পারে না?
কাকাবাবু বললেন, অনেকদিন আগে একটা মজার কথা শুনেছিলাম। রাস্তা দিয়ে একটা লোক হেঁটে যাচ্ছে, আর এক জন লোক তাকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা দাদা, আকাশে ওটা কী, চাঁদ না সূর্য? প্রথম লোকটা আকাশের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, আমি ঠিক বলতে পারছি না। আমি এখানে নতুন এসেছি।
সন্তু হা-হা করে হেসে উঠল। তারপর বলল, নিশ্চয়ই ওই লোকটা জোজো!
কাকাবাবু বললেন, না রে, জোজো কখনও কোনও ব্যাপারে আমি জানি বলে না।
জোজো মুচকি হেসে বলল, আমি সব ব্যাপারই সন্তুর থেকে একটু-একটু বেশি জানি তো, তাই সন্তু আমাকে হিংসে করে।
সন্তু বলল, আমি মোটেই সবজান্তা হতে চাই না। জ্যাক অব অল ট্রেস, মাস্টার অব নান।
কাকাবাবু বললেন, এ কী রে, তোরা ঝগড়া করছিস নাকি?
জোজো বলল, এখানে আমাদের কোনও কাজ নেই তো, তাই মাঝে-মাঝে একটু ঝগড়া করতে ইচ্ছে করে।
কাকাবাবু একটুক্ষণ চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, তোমাদের কিছু একটা কাজ দরকার, তাই না? শিলচর শহরে আর কিছু দেখবার নেই। একটা কাজ করতে পারো। সন্তু, তোর জাটিঙ্গার কথা মনে আছে তো?
সন্তু কিছু বলার আগেই জোজো বলল, জাটিঙ্গার পাখি তো? সেই যে রাত্তিরবেলা আগুন জ্বাললে ওপর থেকে ঝুপঝুপ করে পাখি এসে পড়ে! হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেটা আজ দেখে আসি।
কাকাবাবু বললেন, এখন আর পাখি দেখা যাবে না। আগুন জ্বালা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে জায়গাটা সুন্দর, নদীর ধার দিয়ে দিয়ে রাস্তা, বেড়াতে ভাল লাগবে। তোমরা দুজনে ঘুরে আসতে পারো।
জোজো বলল, কী করে যাব? আপনি পুলিশকে বলে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দিন।
কাকাবাবু সন্তুর দিকে তাকিয়ে বললেন, আমরা যখন ওখানে গিয়েছিলাম তখন বিশেষ কিছুই ছিল না। এখন একটা ভাল হোটেল হয়েছে। তোমরা সেই হোটেলে গিয়ে উঠতে পারো। শুনেছি, সেই হোটেলের মালিক হিম্মত রাও।
এই নামটা শুনেই সন্তু সচকিত হয়ে উঠল।
কাকাবাবু বললেন, আমি গেলে আমার এই খোঁড়া পা আর গোঁফ দেখে চিনে ফেলতে পারে। তোমাদের হয়তো চিনবে না। তোমরা ভাব দেখাবে যেন পাহাড়ে বেড়াতে গেছ। গাড়ির বদলে ট্রেনে করে চলে যাও কাল ভোরে ফিরে আসবে।
জোজো বলল, আমি চোখে সান গ্লাস আর মাথায় একটা টুপি পরে নেব, কেউ চিনতে পারবে না।
কাকাবাবু বললেন, তোমাদের বিশেষ কিছু করতে হবে না। ভাল করে খাবে, কাছাকাছি স্টেশনে, বাজারে ঘোরাঘুরি করবে। শুধু কান খোলা রেখে শুনবে। কেউ টিকেন্দ্রজিৎ সম্পর্কে কিছু বলে কি না। খবরদার, তোমরা নিজে থেকে টিকেন্দ্রজিতের নাম একবারও উচ্চারণ করবে না, কোনও আগ্রহ দেখাবে না। অন্যরা কেউ কিছু বললে শুনে আসবে। কাল সকাল নটার মধ্যে ফিরে আসা চাই। ভোর পাঁচটায় ফেরার ট্রেন আছে।
মিনিট দশেকের মধ্যে তৈরি হয়ে সন্তু আর জোজো কাঁধে দুটো ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
এই ট্রেনটা বেশ মজার। সরু লাইন, তার ওপর ছোট ট্রেন। দূর থেকে মনে হয় খেলনা গাড়ি। কিন্তু দিব্যি কু-ঝিক-ঝিক শব্দ করতে করতে চলে। কামরার মধ্যে শুধু মুখোমুখি দুটি বেঞ্চ। এদিককার ট্রেনে নানা জাতের মানুষ দেখা যায়। কত রকম পোশাক, কত রকম ভাষা। টুকটুকে ফরসা দু-তিনটে বাচ্চা ছোটাছুটি করছে, ঠিক যেন জ্যান্ত পুতুল।
জানলার ধারে মুখোমুখি বসেছে দুজনে। পাহাড়ের পর পাহাড় চলেছে। নদীটাকে মাঝে-মাঝে দেখা যায়, শীতকাল বলে জল খুব কম। বর্ষার সময় এই নদী দেখে চেনাই যাবে না।
জোজো বলল, শোন সন্তু, কাকাবাবু না থাকলে আমি দলের লিডার। কারণ তোর থেকে আমি দু মাস দশ দিনের বড়। আমার কথা শুনে চলবি। দ্যাখ না ওই ব্যাটা বদমাশ টিকেন্দ্রজিৎটা সম্পর্কে কত খবর জোগাড় করে আনব।
সন্তু ঝুঁকে জোজোর হাঁটুতে জোরে একটা চিমটি কাটল।
জোজো অবাক হয়ে তাকাতেই সন্তু বলল, কাকাবাবু ওই নামটা উচ্চারণ করতে বারণ করে দিয়েছেন না? তুই এর মধ্যেই শুরু করলি?
জোজো বলল, ও, স্যরি, স্যরি। ঠিক আছে, এখন থেকে বলব শুধু টি, তা হলে কেউ বুঝতে পারবে না। ওই টি ব্যাটা কাকাবাবুকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল।
সন্তু বলল, আমার মনে হয় কাকাবাবু শব্দটাও আমাদের উচ্চারণ করা ঠিক নয়। ওই নামটাও অনেকে চিনে গেছে।
জোজো বলল, আমরা তো বাংলায় বলছি, কে বুঝবে?
সন্তু বলল, এখানে অনেকেই বাংলা বোঝে।
জোজোর পাশেই বসে আছে মাথায় পাগড়ি ও মুখভর্তি দাড়ি গোঁফওয়ালা এক মাঝবয়েসী সর্দারজি। তিনি গোঁফের ফাঁক দিয়ে হেসে বলেন, আমি বাংলা বুঝতে পারি!
জোজো সঙ্গে-সঙ্গে বলল, ও, আপনি বাংলা বুঝতে পারেন? আসলে কি হয়েছিল জানেন, আমাদের কাকাবাবুর খাবারের থালায় একটা টিকটিকি পড়ে গিয়েছিল, উনি দেখতে পাননি। সেই খাবার খেয়ে ওঁর অসুখ হয়ে গেল, একেবারে মরো-মরো অবস্থা। যাই হোক বেঁচে গেছেন শেষপর্যন্ত। সেই থেকে টিকটিকিদের ওপর আমাদের খুব রাগ।
সদারজি হাসিটাকে চওড়া করে বলেন, আমি বাংলা বুঝতে পারি। আমি বাংলা বুঝতে পারি! আই নো ওনলি দিস সেন্টেন্স ইন বেঙ্গলি।
এবার সন্তুও হাসতে লাগল।
নদীর নাম জাটিঙ্গা, সেই নামেই স্টেশন। তার আগে একটা স্টেশনের নাম হারাংগাজাও। নামগুলো শুনলেই কেমন যেন রোমাঞ্চ হয়।
সন্তু এদিকে আগে এসেছে, তার সব চেনা। এখান থেকে হাফলং পাহাড়ের ওপরের শহরটায় যাওয়া যায়। আগের বার সেখানে কী সাঙ্ঘাতিক কাণ্ডই না হয়েছিল!
স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটু এগোতেই চোখে পড়ল একটা নতুন দোতলা বাড়ি। সেটাই হোটেল। বাইরে সাইনবোর্ড লেখা আছে রিভারভিউ হোটেল। ফুডিং অ্যান্ড লজিং।
সন্তু ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, ইস, ইংরেজি ভুল। ফুডিং আবার হয় নাকি? ফুড অ্যান্ড লজিং!
জোজো বলল, তোকে মাস্টারি করতে হবে না। ইন্ডিয়ান ইংরেজিতে ওসব চলে!
গেট দিয়ে ঢুকেই অফিস ঘর। কাউন্টারে একটি লোক বসে আছে, তার পেছনের দেওয়ালে একজন বিশাল চেহারার লোকের ছবি বাঁধানো। হিম্মত রাও। এই হোটেলের মালিক কে, তা আর বলে দিতে হবে না।
ওরা দুটো বিছানাওয়ালা একটা ঘর নিল দেড়শো টাকায়। দোতলার ওপর ঘর। সামনে একটা গোল বারান্দা। সেই বারান্দায় দাঁড়ালে প্রায় একেবারে নীচেই দেখা যায় নদীটাকে। তার ও পাশে পাহাড়। পাহাড়ের ওপর দিয়ে এঁকেবেঁকে একটা গাড়ি চলার রাস্তা চলে গেছে। জায়গাটা সত্যি সুন্দর!
জোজো বলল, কাকাবাবু আমাদের ভাল করে খেতে বলেছেন। এখন দুপুর সাড়ে বারোটা, তা হলে খাবারের অর্ডার দেওয়া যাক।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, তুই চান করবি না? বেশ পরিষ্কার বাথরুম আছে।
জোজো বলল, এই শীতের মধ্যে প্রত্যেক দিন চান করতে হবে তার কোনও মানে নেই।
দু-তিন বার বেল টিপতে একজন বেয়ারা এসে দাঁড়াল দরজার কাছে।
খাটের ওপর বসে জুতো খুলতে-খুলতে জোজো জিজ্ঞেস করল, হাঁ ভাই, দুপুরের খাবার কী পাওয়া যাবে?
বেয়ারাটি বলল, কী খাবেন বলুন? চিকেন, মটন, এগ কারি।
জোজো বলল, মাছ পাওয়া যাবে না?
বেয়ারাটি বলল, না, এখানে বোজ মাছ আসে না। কাল পেতে পারেন।
জোজো বলল, তা হলে আমরা চিকেন আর মটন দুটোই খাব। আর ডালের সঙ্গে ফুলকপির তরকারি আর বেগুন ভাজা হবে তো?
সন্তু বলল, ওরে জোজো, আমি তোর মতন তিব্বতি যোগ ব্যায়াম জানি। আমি অত খেতে পারব না।
জোজো সেকথায় কান না দিয়ে বলল, এক প্লেটে ক টুকরো চিকেন থাকে?
বেয়ারাটি বলল, হাফ প্লেট দু টুকরো, ফুল প্লেট চার টুকরো।
জোজো বলল, তা হলে ফুল প্লেট। চিকেন, মটন, দুটোই ফুল প্লেট।
বেয়ারাটি বলল, ডাইনিং হলে গিয়ে খাবেন, না ঘরে খাবেন?
জোজো বলল, ঘরে, ঘরে। এখন কোথাও যেতে পারব না। কতক্ষণে খাবার আনতে পারবে?
বেয়ারাটি বলল, এক ঘণ্টা তো লাগবেই। মাংস এখনও চাপেনি।
জোজো প্রায় আঁতকে উঠে বলল, ওরে বাবা, এক ঘণ্টা দেরি! দারুণ খিদে পেয়েছে। ট্রেন জার্নি করলেই আমার খিদে পায়। তুমি তা হলে ততক্ষণে দুটো ডাবল ডিমের ওমলেট করে নিয়ে এস। তাতে তো দেরি হবে না।
জামার পকেট থেকে একটা পাঁচ টাকার নোট বের করে বেয়ারাটির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, তোমার নাম কী ভাই?
বেয়ারাটি টাকা নিয়ে ছোট্ট সেলাম জানিয়ে বলল, আমার নাম সেলিম।
জোজো উঠে এসে তার কাঁধ চাপড়িয়ে বলল, বাঃ, বেশ নাম। দেখো, ওমলেট দুটো যেন নরম-নরম হয়। আচ্ছা সেলিম, তুমি টিকেন্দ্রজিৎকে চেনো?
সেলিম বলল, কে?
সন্তু কটমট করে তাকাল জোজোর দিকে।
জোজো অমনই গলা নিচু করে বলল, ত্রিলোকচাঁদজি, তাই না? নামগুলো উলটোপালটা হয়ে যায়। ত্রিলোকচাঁদজি কাঠের ব্যবসা করেন, তিনি কি এই হোটেলে উঠেছেন?
সেলিম বলল, জানি না তো!
জোজো বলল, আচ্ছা, ঠিক আছে, যাও, ওমলেট নিয়ে এসো!
সেলিম চলে যেতেই জোজো রামভক্ত হনুমানের মতন হাতজোড়া করে রইল সন্তুর দিকে।
সন্তু বলল, তুই যে ডোবাবি দেখছি! তুই আবার …
জোজো বলল, ক্ষমা চাইছি তো! এবারকার মতন মাফ করে দে। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। কী করব! আমার মাথায় সব সময় ওই নামটা ঘুরছে। কাকাবাবুর ওপর অত্যাচার করেছে, ওর কথা ভাবলেই আমার রাগে গা জ্বলে যায়। একবার কাছাকাছি পেলে ওর টুটি চেপে ধরব।
সন্তু বলল, তুই ঘরে খাবার দিতে বললি। ঘরে বসে থাকলে আমরা অন্য লোকের কথা শুনব কী করে? ডাইনিং হলে খেতে গেলে অন্য লোকজন দেখা যেত।
জোজো বলল, ঠিক আছে, ওমলেটটা দিয়ে যাক। অন্য খাবার ডাইনিং হলে গিয়েই খাব। একটা কথা ভেবে দ্যাখ সন্তু। এখানে কেউ নেই, এখন টিকেন্দ্রজিতের নাম উচ্চারণ করা যায়। টিকেন্দ্রজিৎ তো কাকাবাবুকে মেরে ফেলতেই চেয়েছিল, জঙ্গলের মধ্যে কাকাবাবু সারাদিন হাত-পা বাঁধা অবস্থায় রইলেন, ভালুক-টালুক এল, তবু কাকাবাবু মরলেন না কেন বল তো? আমার বাবার জন্য!
সন্তু বলল, তার মানে?
জোজো বলল, আমার বাবা বলেছিলেন না, কাকাবাবুর ইচ্ছামৃত্যু! উনি নিজে মরতে না চাইলে কেউ ওঁকে মারতে পারবে না!
সন্তু অন্যমনস্কভাবে বলল, হুঁ!
এক ঘণ্টা বাদে ওরা একতলার ডাইনিং হলে এসে দেখল, বেশি লোক নেই। একটা টেবিলে একা একজন আর অন্য একটা টেবিলে তিনজন নারী-পুরুষ বসে খাচ্ছে। হোটেলটার অনেক ঘর খালি।
দূরের টেবিলের তিনজন বাঙালি। তারা লামডিং থেকে আসবার পথে হাতি দেখেছে, সেই গল্প করে যাচ্ছে উত্তেজিতভাবে।
জোজো বলল, ওদের সঙ্গে আলাপ করব?
সন্তু বলল, না। আমাদের কাজ শুধু শুনে যাওয়া।
সেই তিনজন খালি হাতির গল্পই করে যাচ্ছে। আর কোনও কথা নেই।
জোজো বলল, আদেখলা! আর যেন কেউ কখনও হাতি দেখেনি।
অন্য টেবিলের একলা লোকটি গম্ভীরভাবে খেয়ে চলেছে। ওরা এবার তার দিকে মনোযোগ দিল। ওর চেহারাটা রুক্ষ ধরনের। একটা খয়েরি রঙের ঢোলা পাঞ্জাবি পরা।
জোজো বলল, ওই লোকটার পকেটে রিভলভার আছে।
সন্তু বলল, কী করে বুঝলি?
জোজো বলল, দ্যাখ না, বারবার ডান পকেটে হাত দিয়ে দেখছে।
সন্তু বলল, ওর মানিব্যাগে অনেক টাকা থাকতে পারে।
জোজো বলল, টিকেন। সন্তু সঙ্গে-সঙ্গে বলল, আবার?
জোজো বলল, টিকে টিকে! আমি বলছিলাম, আগে আমাদের পক্সের টিকে নিতে হত না? এখন আর নিতে হয় না। কী মজা! অবশ্য গঙ্গাসাগরে যেতে হলে কলেরার টিকে নিতে হয়। খুব লাগে!
সন্তু বলল, কী পাগলের মতন কথা বলছিস!
জোজো বলল, মিঃ টি যে এখানে আসবেই, তার কোনও মানে নেই। হয়তো এখানে কেউ তাকে চেনেই না। আমাদের শুধু-শুধু আসাটাই সার হবে।
সন্তু বলল, বেড়ানো তো হচ্ছে। শুধু-শুধু শিলচরে বসে থাকলে কী লাভ হত?
খাওয়ার পর ওরা বেরিয়ে পড়ল হোটেল থেকে।
এখানকার বাজার খুবই ছোট, কয়েকখানা মাত্র দোকান। একটু ঘোরাঘুরি করলেই আর দেখার কিছু থাকে না।
এখানে টিকেন্দ্রজিতের সন্ধান পাওয়া যাবে কী করে? কেউ তো চেঁচিয়ে কোনও গল্প করছে না। ওরা বেড়াতে গেল পাহাড়ের দিকে।
তাও বেশিদূর যাওয়া গেল না। হঠাৎ টিপিটিপি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। একেই দারুণ শীত, তার ওপর বৃষ্টি যেন সুচের মতন বিধতে লাগল। ওরা দুজনে দৌড় লাগাল হোটেলের দিকে।
সন্তু বলল, রেস দিবি, জোজো? কে আগে হোটেলে পৌঁছতে পারে—
জোজো বলল, আমার ফার্স্ট হতে ভাল লাগে না। সবাই বড্ড হিংসে করে। কিন্তু সেকেন্ড আমি হবই।
নিজেদের ঘরে এসে জোজো ধপাস করে শুয়ে পড়ল বিছানায়। সন্তু ব্যাগ থেকে বের করল একটা ক্যাসেট প্লেয়ার। এখন গান শুনে সময় কাটাতে হবে।
পাহাড়ের দিকে বৃষ্টি সহজে থামে না। বৃষ্টি ছাড়ল সেই শেষ-বিকেলে। সন্তু এসে দাঁড়াল বারান্দায়। এখন আকাশ একেবারে পরিষ্কার, সূর্য ড়ুবে যাচ্ছে পাহাড়ের আড়ালে। গাছপালাগুলো পরিচ্ছন্ন। সেদিকে তাকিয়ে থাকলে চোখের আরাম লাগে।
জোজো এখনও পড়ে-পড়ে ঘুমোচ্ছে, সন্তু দু-তিন বার ডেকেছে, তবু ওঠেনি।
পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে সন্তু একসময় দেখতে পেল একজন লোক ঘোড়ায় চড়ে ওপরের রাস্তা দিয়ে নেমে আসছে। এর আগে দু-একটা ট্রাক আর গাড়ি গেছে ওই রাস্তা দিয়ে, কিন্তু ঘোড়া ছুটতে দেখলে সব সময় ভাল লাগে।
এক সময় সেই অশ্বারোহী থেমে গিয়ে রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল। নদীর দিকে মুখ।
সন্তু এবার ঘরের মধ্যে গিয়ে জোর করে ঠেলে তুলল জোজোকে।
জোজো চোখ মুছতে-মুছতে বাইরে এসে বলল, বাঃ, কী সুন্দর ছবি!
সন্তু বলল, ঘোড়ার পিঠে একজন লোককে দেখতে পাচ্ছিস?
জোজো বলল, ওকেও এই ছবিটার সঙ্গে মানিয়ে গেছে। হে নীল ঘোড়াকা সওয়ার!
সন্তু বলল, ওই লোকটা টিকেন্দ্রজিৎ নয় তো?
জোজো বলল, ধুত! তোর মাথায় খালি ওই নাম ঘুরছে। আমি তো মুছে ফেলেছি। আমি বুঝে গেছি ওই টিকেন্দ্রজিৎ না ফিকেন্দ্রজিৎ এখানে কখনও আসেনি, কেউ তাকে চেনেও না। হিম্মত রাও-এর হোটেল বলেই টিকেন্দ্রজিৎকে এখানে আসতে হবে কেন?
সন্তু বলল, অনেকটা দূর। লোকটাকে ভাল করে দেখা যাচ্ছে না অবশ্য।
জোজো বলল, আর কোনও লোক বুঝি ঘোড়ায় চাপতে পারে না? দুপুরবেলা আমরা বাজারে দুটো লোককে ঘোড়ায় চড়ে যেতে দেখলাম না? তুই চা খেয়েছিস? চল, ডাইনিং রুমে গিয়ে চা খেয়ে আসি।
সন্তুর এই বারান্দা ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। জোজো জোর করল বলে যেতে হল।
এবারেও ঠিক সেই এক টেবিলে তিনজন আর অন্য একটা টেবিলে আর-একজন। বাঙালি তিনজন তিন প্লেট পকোড়া নিয়েছে।
সেলিম এসে কাছে দাঁড়াবার পর জোজো জিজ্ঞেস করল, ওরা কীসের পকোড়া খাচ্ছে?
সেলিম বলল, মাশরুম পকোড়া। খুব ভাল, দেব আপনাদের?
জোজো বলল, নিশ্চয়ই দেবে। আমাদের জন্যও তিন প্লেট নিয়ে এসো!
সন্তু বলল, অ্যাঁ তিন প্লেট কী হবে? আমরা তো দুজন!
জোজো বলল, আনুক না। তোর আর আমার এক প্লেট করে। তার পর আমাদের দুজনের জন্য এক প্লেট।
সেলিম চলে যাওয়ার পর জোজো বলল, তুই এত কিপ্টেমি করছিস কেন রে! কা-আ-আ, মানে আঙ্কেলবাবু আমাদের ভাল করে খেতে বলেছেন না। অনেক টাকা দিয়ে দিয়েছেন।
সন্তু বলল, তার জন্য না। দুপুরে অত খেয়েছি, এখন শুধু চা খেতেই ইচ্ছে করছিল। যা ঠাণ্ডা পড়েছে!
জোজো বলল, তা হলে চা দিয়ে শুরু করলেই হয়।
জোজো দৌড়ে উঠে গিয়ে সেলিমকে আগে চা দেওয়ার জন্য বলে এল।
বাঙালি তিনজন কী গল্প করছে, ওরা কান খাড়া করে শোনবার চেষ্টা করল। এখন চলছে খাওয়ার গল্প। চাইনিজ ভাল, না মোগলাই রান্না? চিকেন চাওমিন আর চিকেন বিরিয়ানির মধ্যে কোনটা রান্না করা বেশি শক্ত? একজন ভদ্রমহিলা আর ভদ্রলোকের মধ্যে এই তর্ক চলছে তো চলছেই। চোদ্দ-পনেরো বছরের একটি মেয়ে চুপ করে শুধু খেয়ে যাচ্ছে।
খানিকক্ষণ শোনার পর জোজো বলল, হ্যাংলা! বেড়াতে এসেও শুধু খাওয়ার কথা!
সন্তু বলল, আস্তে, শুনতে পাবে!
জোজো বলল, ওই মেয়েটা তোর দিকে আড়চোখে দেখছে। তোকে বোধ হয় চিনে ফেলেছে সন্তু।
সন্তু বলল, আমায় কী করে চিনবে? তুই হচ্ছিস বিশ্বভ্রমণকারী জোজো, তোকেই নিশ্চয়ই চিনেছে।
জোজো বলল, তা হতে পারে। হয়তো আমাকে অন্য কোথাও দেখেছে। চিনে কিংবা মঙ্গোলিয়ায়।
সেলিম শুধু চা দিয়ে গেছে। ওঁদের এক কাপ করে চা শেষ হয়ে গেছে, এখনও মাশরুম পকোড়ার পাত্তা নেই।
অন্য টেবিলের একা লোকটি বসে কিছুই খাচ্ছে না, বসে আছে চুপচাপ।
জোজো হাত তুলে সেলিমকে ডাকতে যাচ্ছে, তখনই বাইরের দরজা খুলে ঢুকল একজন লোক। সেদিকে তাকিয়ে সন্তু আর জোজোর চক্ষুস্থির হয়ে
গেল।
লোকটি ছ ফুটের বেশি লম্বা, কালো রঙের প্যান্ট আর শার্টের ওপর পরে আছে চামড়ার জ্যাকেট। মাথায় টুপি। চোখ দুটি যেন ঝকঝক করছে। অনেক লোকের মধ্যে মিশে থাকলেও এর দিকেই সকলের প্রথম চোখ পড়বে।
জোজো ফিসফিস করে বলল, টিকেন … টিক … টিক।
সন্তু টেবিলের তলা দিয়ে তাকে একটা লাথি কষিয়ে বলল, ওদিকে তাকাবি। চায়ে চুমুক দে!
টিকেন্দ্রজিৎ ঘরে ঢুকে প্রথমে চারদিকে তাকিয়ে দেখল।
একলা বসে থাকা গোমড়ামুখো লোকটার মুখে এবার হাসি ফুটেছে। সে টিকেন্দ্রজিতের অপেক্ষাতেই বসে ছিল বোঝা গেল।
টিকেন্দ্রজিৎ তার দিকে এগোবার আগেই সেলিম বেয়ারার কাছে গিয়ে কী যেন বলতে লাগল গুজগুজ করে। টিকেন্দ্রজিতের ভুরু উঠে গেল। সেলিম আঙুল দিয়ে সন্তু-জোজোর দিকেই দেখাচ্ছে।
এবার টিকেন্দ্রজিৎ এগিয়ে আসতে লাগল ওদের টেবিলের দিকে।
জোজোর বুকের মধ্যে ধড়াস-ধড়াস শব্দ হচ্ছে। সে বলেছিল বটে যে, টিকেন্দ্রজিৎকে দেখামাত্র তার টুটি চেপে ধরবে; এখন সে বুঝতে পারছে, টিকেন্দ্রজিৎ একা তার মতন দশটা জোজোকে ঢিট করে দিতে পারে। জোজোর ধারণা হল, টিকেন্দ্রজিতের দু পকেটে দুটো রিভলভার আছে। কাছেই এসেই সে ফস করে রিভলভার দুটো বের করে ঢিসুম ঢিসুম করে গুলি চালাবে। বিশ্বাসঘাতক সেলিম তাদের চিনিয়ে দিয়েছে, আর নিস্তার নেই!
সন্তুর মুখোনাও আড়ষ্ট হয়ে গেছে। সে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। টিকেন্দ্রজিৎকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তার গায়ে অসম্ভব জোর, তারা দুজনে মিলেও ওকে ধরে রাখতে পারবে না। তা ছাড়া এখানে টিকেন্দ্রজিতের দলের লোক আছে। তবু সন্তু মনে-মনে ঠিক করে ফেলল, কিছুতেই টিকেন্দ্রজিতের হাতে ধরা দেওয়া চলবে না। যেমন করে হোক, ওর হাত ছাড়িয়ে পালাতেই হবে।
জুতো মশমশিয়ে টিকেন্দ্রজিৎ ওদের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল, কোমরে দু হাত দিয়ে একটুক্ষণ ওদের দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, আমায় কে খোঁজ করছে?
দুজনেই মাথা নিচু করে রইল, কোনও উত্তর দিল না।
টিকেন্দ্রজিৎ এবার হেসে বলল, খালি কাপে চুমুক দিচ্ছ কেন? চা ফুরিয়ে গেছে বুঝি?
সত্যি! ওদের দুজনের কাপই একদম খালি।
টিকেন্দ্রজিৎ জোজোর পিঠে এক চাপড় মেরে বলল, এই যে, চুপ করে আছ কেন? তোমার নাম কী?
জোজো মুখ তুলে কাঁপাকাঁপা স্বরে বলল, আমি, আমি তো ত্রিলোকচাঁদজির খোঁজ করছিলাম!
টিকেন্দ্রজিৎ হেসে ফেলে বলল, ত্রিলোকচাঁদ, হা-হা-হা-হা, ওই নামে ত্রিসীমানার মধ্যে কেউ নেই।
এই সময় বাইরে একটা গাড়ি থামার শব্দ হল।
সেলিম জানলার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল, সে উঁকি মেরেই ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে বলল, পুলিশ! পুলিশ এসেছে!
টিকেন্দ্রজিৎ এবার নিজে গিয়ে জানলার কাছে দেখল।
তারপর সেলিমকে ধমক দিয়ে বলল, পুলিশ দেখলে ঘাবড়াবার কী আছে? পুলিশরা হোটেলে খেতে আসতে পারে না? আমার খাবারটা ওপরে দিয়ে আসবি।
টিকেন্দ্রজিৎ জানলার কাছ ছেড়ে শান্ত পায়ে এগিয়ে গেল ওপরের সিঁড়ির দিকে। একবার শুধু জ্বলন্ত চোখে জোজো-সন্তুকে দেখল।
সন্তু সিঁড়িটা পুরো দেখতে পাচ্ছে। টিকেন্দ্রজিৎ দ্রুত টকটক করে উঠে গেল সিঁড়ি দিয়ে। সিঁড়িটা যেখানে বাঁক নিয়েছে সেখানে একটা গোল ব্যালকনি। সাকাসের খেলোয়াড়ের মতন ব্যালকনির রেলিং টপকে সে লাফিয়ে পড়ল হোটেলের পেছন দিকটায়। তারপরই শোনা গেল ঘোড়া ছোটার খটাখট শব্দ।
এবার দরজা ঠেলে ঢুকল পুরোদস্তুর পোশাক-পরা একজন পুলিশ।
জোজো অমনই উঠে দাঁড়িয়ে বলল, এসেছেন? এত দেরি করলেন কেন?
পুলিশটি বলল, আপনারাই তো সন্তুবাবু আর জোজোবাবু? বর্ণনা ঠিক মিলে গেছে। চলুন, আপনাদের আজই শিলচর ফিরতে হবে।
জোজো বলল, আমাদের নিতে এসেছেন তো, ঠিক আছে। দাঁড়ান, আগে মাশরুম পকোড়া খেয়ে যাই। অনেকক্ষণ অর্ডার দিয়েছি।
তারপর সে গর্বিতভাবে বাঙালি তিনজনের দিকে তাকাল। যেন তাদের বুঝিয়ে দিতে চায়, পুলিশ জোজোকে ধরতে আসেনি, বরং সে পুলিশের ওপর হুকুম করতে পারে।
সন্তু তাড়াতাড়ি পুলিশটিকে বাইরে টেনে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন, আমাদের আজই ফিরতে হবে কেন? কাল সকালে ফেরার কথা ছিল। কী হয়েছে?
পুলিশটি বলল, এদিকের মেইন রোডে ধস নেমেছে, কোনও গাড়ি যেতে পারছে না। আপনাদের অন্য রাস্তা দিয়ে ঘুরে-ঘুরে তেজপুর যেতে হবে, তাই আজ শেষ রাত্রেই বেরিয়ে পড়া দরকার। সেই জন্য নিতে এসেছি।
কাকাবাবুর আর কোনও বিপদ হয়নি জেনে নিশ্চিন্ত হয়ে সন্তু বলল, একটু পরে ফিরলেও হবে। শুনুন, আপনি আসবার আগে এখানে টিকেন্দ্রজিৎ ছিল। এইমাত্র পালাল। এখনও তাকে তাড়া করে গেলে ধরা যেতে পারে।
পুলিশটি বলল, টিকেন্দ্রজিৎ, ওরে বাবা! না, না, আমি ওকে তাড়াটাড়া করতে পারব না।
সন্তু বলল, কেন পারবেন না? আপনার কাছে তো রিভলভার আছে। আমরা তিনজনে মিলে ওকে ধরে ফেলতে পারি।
পুলিশটি বলল, আমার ওপর সে রকম অর্ডার নেই। শিলচরে আপনাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা, ফিরিয়ে নিয়ে যাব, ব্যস! জিনিসপত্র গুছিয়ে নিন!
সন্তু হতাশভাবে বলল, দুর ছাই!