অষ্টম পরিচ্ছেদ
০১.
ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে তোমাদের কেমন লাগছে?–করিডন জনের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করল।
হাত নাড়বে না। জনের চোখ দুটো চকচক করে উঠল আর রনলির কাছে গিয়ে বলল, তুমি বসে পড়।
রনলি বসে পড়ল। তাকে খুশি বলেই মনে হল। মনে হচ্ছে রনলিকে অনুসরণ করে তোমরা এখানে এসেছ?করিডন বলল।
হা–জিনি বলল, বেশী নড়াচড়া করো না। তোমার বন্দুকটা নিচ্ছি। বাধা দিলে জন গুলি ছুঁড়বে।
যেভাবে খুশী নিয়ে যাও। তোমাদের পরিণতি আমি দেখতে পাচ্ছি। করিডন বলল, তোমরা নিশ্চয়ই জানো পুলিশ এখনো আশেপাশেই আছে?
জিনি তার পকেটে হাত ঢুকিয়ে অটোমেটিক পিস্তলটা বের করে নিল। একটু তফাতে গিয়ে দাঁড়াল।
পুলিশের কথা আমার জানা আছে। সেচটপট জবাব দিল, করিডন কোনরকম চালাকি করবার চেষ্টা করো না। রনলি তুমিও না।
করিডনের চারিদিকে জিমি ঘুরতে লাগল। অটোমেটিক পিস্তলটা নিজের ট্রেঞ্চ কোটের পকেটে ভরে রাখল।
আমার পিস্তলের নিশানার বাইরে সরে দাঁড়াও।জন বিরক্তি জড়ান কণ্ঠে বলল, একপাশে সরে দাঁড়াও।
গুলি ছুঁড়ো না। এখন আমরা একই সমস্যায় পড়েছি। সকলের উচিৎ হবে মিলেমিশে কাজ করা। জিনি বলল।
তোমাদের অসুবিধের ব্যাপারে আমি মোটেই নেই।করিডন বলল, পুলিশকে গুলি করে মেরে সমস্যার সমাধান করা যায় বলে আমার বিশ্বাস হয় না। এ কাজ করার অর্থ মাত্র একটাই, নিজের বিপদ ডেকে আনা। ক্রিডের মৃত্যুর সাথে তোমরা আর আমাকে জড়াতে পারছনা। কারণ পিস্তলে আমার আঙ্গুলের ছাপ আর নেই।
কিন্তু পুলিশ রীটা অ্যালেনের মৃতদেহ আবিষ্কার করেছে। জিনি বলল, ওরা তোমায় খুঁজছে।
পুলিশ শুধু ওকে খুঁজছেনা-রনলি বলল, আমাদেরও খুঁজছে। এখান থেকে আমাদের কেটে পড়া দরকার।
পুলিশ আমাদের সর্বত্র খুঁজছে।–জিনি বলল, আমরা দিনের আলোয় যেতে পারব না।
যদি আমরা এক্ষুনি এখান থেকে সরে না পড়ি তাহলে ইঁদুরের মত ফাঁদে পড়তে হবে।
সেই ফাঁদ পাতুক।হেসে বলল করিডন। ইঁদুর বলার জন্য প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
রনলি হিংস্র চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল, এখান থেকে আমাদের যেতেই হবে। এখানে একমুহূর্ত থাকা ঠিক হবে না। পুলিশ দুটো আবার ফিরে আসবে।
উত্তেজিত হয়ো না। পুলিশ আর ওই হোলরয়েড আমাকে এখানে দেখেছে। এখন আমাদের উচিৎহবে ওই হোলরয়েডের স্টুডিওতে ঢুকে রাত নানামা পর্যন্ত কাটান। পুলিশ যদি আবার এখানে আসে, দেখবে জায়গাটা শূন্য। ভাববে আমি তাদের চোখে ধুলো দিয়েছি। যদি এখানকার স্টুডিওগুলোয় তারা তল্লাশি চালায়, আমার ধ্রুব বিশ্বাস জন হোলরয়েডকে মিথ্যা কথা বলতে বাধ্য করাতে পারবে।
হোলরয়েড কে?–জিনি জানতে চাইল।
এখানকার একজন প্রতিবেশী। রাস্তার ওপাশে থাকে।
ম্যালোরীর বোন কোথায়?
তার কথা জানলে কি করে?
সময় নষ্ট করো না। কোথায় সে?
হাত-পা বাধা অবস্থায় বেডরুমে পড়ে আছে। জিনি রনলিকে জিজ্ঞাসা করল, মেয়েটা তোমায় দেখেছে?
হা।
তাহলে ওকে তো এখানে রেখে দেওয়া যাবে না।
করিডন বুঝতে পারল, জিনি ঠিক কথাই বলেছে, তবু তার কথা সমর্থন করতে চাইল না। সে বলল, আমার মনে হয় ওকে হোলরয়েডের স্টুডিওতে নিয়ে যেতে হবে। সমস্যা বেড়ে যাবে
ওই দেখ হোলরয়েড আসছে।অনলি বলল, ওর নজর এদিকেই।
লোকটার ভার আমার উপর ছেড়ে দাও। জিনি বলল, ম্যালোরী মেয়েটাকে নিয়ে আমার পিছু পিছু এস। তোমার জিনিষপত্র সাথে আনবে। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে সে হোলরয়েডের দিকে এগোতে থাকল।
কি ঘটে দেখবার জন্য করিডন অপেক্ষা করল না। সে অ্যানের বেডরুমে ঢুকল। মেয়েটা বিছানায় শুয়ে আছে। দেখে বুঝতে পারল নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করছে। অ্যান তার দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকাল।
ঘটনা ঘটতে আরম্ভ করেছেকরিডন বলল, এখন তোমাকে মুক্ত করতে পারছি না। গোটা দলটাই এখানে এসে উপস্থিত। আমরা সবাই হোলরয়েডের বাংলোয় যাচ্ছি, কারণ যে কোন সময় পুলিশ আসতে পারে। কোন গোলমাল করো না। সে মেয়েটার পায়ের বাঁধন খুলে টেনে তুলে দাঁড় করাল।
রনলি দরজার সামনে এসে দাঁড়াল–চলে এস, জিনি ওই বাংলোয় ঢুকে পড়েছে।
রনলি, টুপি আর কোট নিয়ে এস আমার। করিডন বলল, আমার রুকস্যাকটা আনতে ভুলো না। সে অ্যানের বাহু ধরল, ভয় পেও না তোমার কোন ক্ষতি হতে দেব না।
কিন্তু এবার করিডন অ্যানের মনে আশ্বাস জন্মাতে সক্ষম হলো না। মেয়েটা ছিটকে দূরে সরে গেল। সে শান্ত কণ্ঠে বলল, শোন, বুঝবার চেষ্টা করো।
জন রনলিকে একপাশে সরিয়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকে দাঁত খিঁচিয়ে বলল, সময় নষ্ট করছ। তোমাকে আসতে বলা হয়েছে, তুমি আসবে। তাড়াতাড়ি কর,মুখের সামনে জন পিস্তলটা নাচাতে লাগল। অ্যান ভয়ে সিঁটিয়ে গেল।
চলে এস।–করিডন বলল, গোলমাল না করলে ভালই থাকবে।
মুখ থেকে ওটা বার করে ফেল।–জন বলল, লোকের নজরে পড়বে। যদি চিৎকার করে আমি গুলি ছুঁড়ব। ওর কাঁধের উপর একটা কোট ঝুলিয়ে দাও। করিডন পোশাকের আলমারির কাছে গেল একটা কোট খুঁজতে।
রক্তাক্ত চোখ তুলে তাকিয়ে অ্যানকে উদ্দেশ্য করে জন বলল, যদি চালাকি করবার চেষ্টা কর, তোমায় খুন করব। একজন বিশ্বাসঘাতকের বোনকে খুন করলে আমাদের কিছু যাবে আসবে না।
করিডন তাদের দুজনের মাঝে এসে দাঁড়িয়ে জনকে কাঁধের ধাক্কায় সরিয়ে দিল, অ্যানের মুখ থেকে পাকান রুমালটা বের করে নিল। একটা কোট তার কাঁধে ঝুলিয়ে দিল যাতে তার বাধা হাত দেখা না যায়।
ওর কথায় কান দিও না।–অ্যানের বাহু ধরে সে বলল, চলে এস।
চল চল, এখান থেকে বের হও। জন রনলিকে বলল। রনলি প্রথমে গেল এবং করিডন আর অ্যান তাকে অনুসরণ করল।
.
০২.
হোলরয়েডের স্টুডিও ঘর অগোছাল আর নোংরা বাজে অয়েল পেন্টিং-এ ভর্তি। একটা ধুলো জমা পুরানো আর্ম চেয়ারে বসে করিডন চিন্তা করতে লাগল।
করিডনের সামনাসামনি অপরিষ্কার আর একটা চেয়ারের হাতলের উপরে জিনি বসেছে। তার শক্তিধর বাদামী রংয়ের হাত চেপে ধরেছে নিজের হাঁটু। তার চোখেমুখে চাঞ্চল্য। সে অস্থিরভাবে একবার করিডনের দিকে আর একবার পর্দা ফেলা জানলার দিকে তাকাচ্ছে।
রান্নাঘরে রনলির হেঁটে-চলে বেড়াবার শব্দ তারা শুনতে পাচ্ছে। তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয় এমন ধরনের খাবার তৈরি করছে। বেকন ভাজার গন্ধ নাকে যেতেই করিডনের মনে পড়ল খিদে পেয়েছে।
স্টুডিও পেরিয়ে তারপর বেডরুম। বন্ধ ঘরে জন অনিচ্ছাকৃতভাবে অ্যান আর হোলরয়েডকে পাহারা দিচ্ছে।
তারা জিনির মুখোমুখি হয়েছিল অ্যানকে সাথে করে এই বাংলোয় ঢুকতে। নিঃশব্দে পরস্পরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়েছিল। জিনির চোখে মুখে ভয়ঙ্কর ঘৃণার ছাপ ফুটে উঠেছিল। করিডন অ্যানকে তাড়াতাড়ি বেডরুমে নিয়ে গিয়েছিল।
এই মুহূর্তে জিনির মনে হল করিডন অ্যানের কথা ভাবছে। তাই সে বলল, ওর সাথে তোমার কথাবার্তা বলা উচিৎ। দ্বীপটা খুঁজে বের কর। মেয়েটাকে আমরা সাথে করে নিয়ে যাবো।
করিডন ভাবল, অ্যান যদি তাদের বলে দেয় দ্বীপটা, তাহলে পুলিশের কাছে মুখ খুলবার জন্য তাকে বাঁচিয়ে রাখবে না জিনির দলবল।
আমিও তাই ভাবছি। করিডন একটা সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করে নিল, হোলরয়েডের কি হল? ওকে নিয়ে আমরা কি করব?
এখানে রেখে যাবো, আমাদের সম্পর্কে লোকটা কিছুই জানে না। তাছাড়া কোন একজনের জানা প্রয়োজন যে, ম্যালোরী মেয়েটাকে আমরা সঙ্গে করে নিয়ে গেছি। সব শুনে ম্যালোর আমাদের খোঁজে আসবে। আমি মেয়েটাকে টোপ হিসাবে ব্যবহার করতে চাই।
তুমি এত নিশ্চিন্ত হলে কি করে যে বোনের খোঁজে সে আসবে?
তাই আমার মনে হচ্ছে।
তার আগে আমাদের অনেক কাজ করবার আছে। দ্বীপটা কোথায় জানতে হবে। অনেক পথ এগোতে হবে আর কাজটা নির্বিঘ্নে হবে না। এদেশের প্রত্যেকটা পুলিশ আমাদের খোঁজে অতন্দ্র থাকবে।
তুমি কি ভাবছ এই নিয়ে আমি খুব চিন্তা করছি? আমরা গেস্টাপোর চোখে যখন ধুলো দিতে পেরেছি, ইংরেজ পুলিশের চোখেও ধুলো দিতে পারব।
মেয়েটার অনুমান ওর দাদা মারা গেছে। এয়ার মিনিস্ট্রি তাকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে যে, যখন গেস্টাপোর হাত থেকে পালাচ্ছিল তখন গুলি করে মারা হয়। তোমার স্থির বিশ্বাস যে ম্যালোর বেঁচে আছে?
তবে কি ওর প্রেতাত্মা হ্যারিস আর লুবিসকে খুন করেছে আর রীটা অ্যালেনকে সিঁড়ির উপর থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছে? আমাদের হাত থেকে রেহাই পেতে হলে নিজেকে মৃত বলে প্রচার করতেই হবে। তারপর একদিন যাদুমন্ত্রের বলে বেঁচে উঠবে।
করিডন কাধ ঝাঁকাল। তারপর জিনির যুক্তি স্বীকার করে বলল, ঠিক বলেছ। মেয়েটার সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন। আমাদের প্রথম কাজ হবে দ্বীপটা খুঁজে বের করা। প্রতিশোধ তুমি নিতে পারবে।
কিন্তু এখনো ওকে খুঁজে বের করতে পারিনি। শীতল নিঃশব্দ হাসি হাসল জিনি। হয়ত কোন দিনই ওকে ধরা যাবে না।
করিডন পাশের ঘরে এল, অ্যান আর হোলরয়েড বসে আছে চেয়ারে। আর জন বিছানায় শুয়ে সিগারেট টানছে, পাশে পড়ে আছে পিস্তলটা। সে তাকিয়ে আছে করিডনের দিকে।
হোলরয়েডকে নিয়ে তুমি এখান থেকে চলে যাও–করিডন বলল।
জন বিছানা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে বলল, তোমার মতলবটা কি শুনি?
মেয়েটার সাথে কিছু কথা আছে।
তুমি আমার সাথে এস। জন পিস্তল তুলে হোলরয়েডকে বলল।
হোলরয়েডের চোখমুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। চেয়ার ছেড়ে কাঁপা পায়ে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা, করে পড়ে যাচ্ছিল। করিডন তাকে ধরে ফেলল।
মনে জোর আন। –করিডন বলল, তোমার কোন ভয় নেই। কয়েক ঘণ্টা পরে আমরা চলে যাবো। তারপর তো তুমি হবে এখানকার একচ্ছত্র নায়ক।
ভয়ে কম্পমান হোলরয়েডকে সে দরজার দিকে ঠেলে দিল।
ভাল বোধ করবে বাঁধন খুলে দিলে-করিডন অ্যানের হাতের বাঁধন খুলতে খুলতে বলল, তোমার সঙ্গে কথার এটাই উপযুক্ত সময়, কি বল?
অ্যান হাতের সাহায্যে কব্জি ঘঁষে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করবার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু কোন কথা বলল না।
তোমার সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা করতে চাই। করিডন বলল, পুরুষটা খুনে। ওকে সাবধান। মেয়েটা পাগল, রনলি লোকটা ক্ষতিকারক নয়। খুনের অপরাধে তিনজনকেই পুলিশ খুঁজছে। জন দুজন পুলিশ আর ক্রিড নামে একজনকে খুন করেছে।
যদি তোমার কথা সত্যি হয়, অ্যান বলল, তাহলে তুমি এদের দলে কেন?
ক্রিডের খুনের অপরাধ ওরা আমার মাথায় চাপাবার চেষ্টা করছে।
কিছুই পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারছি না। সবই উদ্ভট মনে হচ্ছে।
তুমি যা বলেছ কি করে বিশ্বাস করব বল?
পালাবার চেষ্টা কর না, আমি আসছি।করিডন স্টুডিওতে এসে হোলরয়েডের জমিয়ে রাখা খবরের কাগজের স্তূপ থেকে ক্রিডের মৃত্যুর খবর ছাপা হয়েছে যে সংখ্যায় সেটা নিয়ে অ্যানের কাছে ফিরে এসে বলল, পড়ে দেখ। আমার চেহারার বর্ণনা এতে পাবে।
কাগজে ছাপা বিবরণ অ্যান পড়ল। তারপর সে বলল, কিন্তু কি করে বুঝব তুমি খুন করনি?
তোমায় বিশ্বাস করতে বলছি না। আমাকে তুমি খুনী ভাবলেও আমার কিছু যাবে আসবে না। তবে এখন এসব ব্যাপারে পুলিশ আমায় দায়ী করতে পারবে না।
তা আমার ভাইকে এসব ব্যাপারে কি করতে হবে?
আমি তো বলিনি ওকে কিছু করতে হবে বলেছি নাকি?
তাহলে আমার কাছে এসেছ কেন? ওর সম্পর্কে এত জিজ্ঞাসাবাদই বা করছ কেন? একটুও। বিশ্বাস হয় না যে ওর বন্ধু তুমি। ওই লোকটা দাদাকে বিশ্বাসঘাতকই বা বলল কেন? লোকটা কি বলতে চাইল?
তোমার দাদা তো মৃত, ওর কথা থাক।
ওদের ধারণাও কি তাই?
না।
ওরা কি দাদাকে খুজছে?–আমাকে দয়া করে বল, দাদা কি জীবিত?
ওরা তাই ভাবে।–করিডন বলল।
তাহলে ওরা দাদার বন্ধু নয়?
না।
কেন?
কারণ আছে। তুমি না জানলেই ভাল।
দাদা জীবিত আছে কিনা জানতে চাই, তুমি বল।
আমি যা জানি তুমিও তাই জান। এদের অনুমান তোমাকে যদি সঙ্গে করে নিয়ে যায়, তোমার ভাই সেখানে যাবে।
এইভাবে এরা আমায় ফাঁদে ফেলতে চায়।
বাকিটুকুও বল।–অ্যান শান্ত কণ্ঠে বলল, বলবার মত আর বেশী কিছুই নেই কি বল?
তুমি অদূর ভবিষ্যৎ-এ সবই জানবে, তবু বলে রাখি ঘটনা খুব সুখকর নয়। ম্যালোরীর বিশ্বাসঘাতকতার কথা করিডন শোনাল।
গল্প বলা শেষ হলেই অ্যান সহসা বসে পড়ল, তার চোখ মুখের চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। সে অস্ফুটস্বরে বলল, না মিথ্যে কথা। দাদা কোনদিন কারও সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি।
করিডন একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, ওরা আমায় যা বলেছে, আমি তাই তোমাকে বলেছি। ওরা মিথ্যা কথা বলবে কেন? কেন ওরা এত কাণ্ড করেছে ম্যালোরীর বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য?
এসব আমি বিশ্বাস করি না।
কেউ বলেনি তোমায় বিশ্বাস করতে। ওরা বিশ্বাস করে, এই যথেষ্ট।
ঠিক আছে, দাদা যদি সত্যিই বিশ্বাসঘাতকতা করে থাকে তাহলে তার ভালমন্দ নিয়ে আমি ভাববো না। তবে আমি জানি এ ধরনের কাজ করতে পারে না।
অ্যান এসব কথা বলে আর কোন লাভ নেই।
অ্যান ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল, ব্রায়ান কি বেঁচে আছে?
হা। সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
তাহলে ওর সামনে বিপদ?
সঠিক বলতে পারছি না। তবে যদি ওকে এরা কোণঠাসা করে হাতের মুঠোয় আনতে পারে তাহলে গুলি করে হত্যা করবে।
আমাকে নিয়ে তোমরা কি করতে চাও?
আচ্ছা, দুনবারে তোমার দাদার একটা দ্বীপ আছে না?
হ্যাঁ,আছে।–অ্যানের চোখে বিস্ময়, তুমি জানলে কি করে?
জায়গাটা ঠিক কোথায় জান?
নিশ্চয়ই জানি। ওই দ্বীপটা এখন আমার। তুমি জিজ্ঞাসা করছ কেন?
ওখানে আমরা যাচ্ছি। তুমিও আমাদের সঙ্গে যাবে।
ভাবছ, ব্রায়ান ওখানে আছে?
তা জানি না। তবে এদের ধারণা তোমার পিছু পিছু ম্যালোরীও ওখানে যাবে।
অ্যানের চোখ দুটো চৰ্চ করতে লাগল। সে বলল, যদি একবার জানতে পারে ওখানে আছি তাহলে ঠিক গিয়ে উপস্থিত হবে।
নাও যেতে পারে। ওকে গত চার বছর দেখনি।
ও আসবেই। অধিকার সম্পর্কে ও যথেষ্ট সজাগ। কিছু সময় চিন্তা করে অ্যান বলল, একটা প্রশ্ন করব তোমাকে? তুমি ওদের পক্ষে, না আমার দিকে?
তোমার কি মনে হচ্ছে?
তোমার উপর আস্থা রাখতে বলেছ। কিন্তু কেন বলছ?
তোমার জন্য আমার কষ্ট হয়েছিল। করিডন বলল, তোমাকে সাহায্য করতে চেয়েছি। মনে হয়েছিল আমার জন্য তুমি এদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছ।
এখনো আমাকে সাহায্য করতে চাও?
অবশ্যই। তোমার যাতে কোন ক্ষতি না হয় সেদিকে নজর রাখব।
তুমি বলেছ, ওদের সঙ্গে আছখুমের দায় থেকে অব্যাহতি লাভের আশায়। এর একটাই মানে দাঁড়ায়, তুমি ওদের বিপক্ষে। আমিও তাই। তাহলে এদের দলে যোগ দেওয়াই কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে না?
হবে। তুমি তো আর বোকা নও, কি বল? আসলে তুমি দাদাকে যে কোন উপায়ে খুঁজে বের করতে চাও।যদি সে বেঁচে থাকে আর বিপদে পড়ে তাহলে বলে রাখছি তাকে আমি সাহায্য করব।
আমিও চাই তুমি তাকে সাহায্য কর। তার বিরুদ্ধে তোমার তো কোন অভিযোগ নেইনাকি আছে?
করিডন ইতস্ততঃ করল। সে বলতে পারলো না যে ম্যালোরী একজন খুনী। সে বলল, তাকে। যাতে গুলি না করা হয় তা আমি দেখব।
গোর্ভিলের সাথে সে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। অ্যান ধীর কণ্ঠে বলল, যদি হার্মিট দ্বীপে তার সঙ্গে তোমার দেখা হয় তাহলে ঠিক জানতে পারবে।
ওটাই সেই দ্বীপের নাম?
হ্যাঁ। বাসরকের থেকে বারো মাইল দূরে। বাসরক আর দুনবারের মাঝে অবস্থিত।
ওখানে আমাদের নিয়ে যেতে পারবে?
অ্যান ঘাড় নেড়ে বলল, হ্যাঁ পারব।
ঠিক নিয়ে যাবে তো?
অবশ্যই।
করিডন অ্যানের ফ্যাকাসে, স্থির প্রতিজ্ঞ আর বিস্মিত চোখমুখের দিকে তাকিয়ে বলল, কি হল?
আমি চাই ব্রায়ানের সাথে এই তিনজনের ওখানে দেখা হোক। কল্পনাও করতে পারবে না ওই দ্বীপে প্রতিপদে কত বিপদ। ওখানে লুকিয়ে থাকার মত স্থান প্রচুর আছে। মাঝে মাঝে হঠাৎকুয়াশা এসে দ্বীপটা ঢেকে দেয়। দ্বীপটার চরিত্র ব্রায়ান আর আমার নখদর্পণে।–অ্যানের চোখে বিদ্যুৎ, ওরা এসব জানেনা। হ্যাঁ,হলফ করে বলছি। ওদের আমি ঠিক নিয়ে যাব, তবে গিয়ে ওরা অনুশোচনা করবে।
.
নবম পরিচ্ছেদ
০১.
নোংরা স্টুডিওতে তারা অপেক্ষা করতে লাগল কখন রাতের অন্ধকার নামবে এই আশায়।
জন দেওয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাত দুটো ট্রেঞ্চ কোটের পকেটে আর দু ঠোঁটের মাঝে জ্বলন্ত সিগারেট। তার কাছে একটা আর্ম-চেয়ারে বসে আছে জিনি। মাঝে মাঝে যখন ঘুম ভাঙ্গছে সে ধড়ফড় করে উঠে বসছে। রনলি তাদের সামনে মাথায় হাত রেখে বসে আছে। সে বিকেল পর্যন্ত কোন কথা বলেনি। ঘরের এককোণে সোফায় পাশাপাশি বসে আছে করিডন আর অ্যান। ঘরে একটা থমথমে ভাব বিরাজ করছে। করিডন সব সময় চেষ্টা করছে অ্যানকে জিনির দৃষ্টির সামনে থেকে সরিয়ে রাখতে। তার ধারণা, যদি এই দুজন কোনভাবে মুখোমুখি হয় তাহলে কোন দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
অ্যানের কাছ থেকে দুনবারে যাওয়ার রুট করিডন জেনে নিয়েছে। অবশেষে ঠিক হয়েছে সকলে অ্যানের গাড়ি করে যাবে। অ্যান বলেছে, দুনবারে একটা মোটর-বোট আছে। মোটর-বোটটা এই দ্বীপে যাতায়াতের জন্যই রাখা আছে। এখন তাদের আর কোন কিছু করবার নেই, শুধু রাতের অন্ধকার নামবার অপেক্ষা করা ছাড়া। পুলিশ আর ফিরে আসেনি। করিডন মনে মনে ধন্যবাদ দিল এই ভেবে, যে পুলিশ দুজন হোলরয়েডকে সঙ্গে নিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে তারা খবরের কাগজের চেহারার বর্ণনার সঙ্গে তাকে জড়ায়নি।
প্রতি আধঘণ্টা অন্তর জানলার সামনে থেকে সরে স্টুডিও পেরিয়ে বেডরুমে গিয়ে হোলরয়েডকে দেখে আসছে। এখানে হোলরয়েড হাত-পা বাধা অবস্থায় পড়ে আছে। করিডন আর অ্যান সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় প্রতিবার অ্যানের দিকে সে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে, তার দুচোখে ঘৃণা।
সাতটার কিছু পরে রাতের অন্ধকার নামতে শুরু করল। রনলি উঠে দাঁড়িয়ে বিড় বিড় করে রান্না করবার কথা বলে রান্নাঘরে চলে গেল।
অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হয়ে করিডন জানলার সামনে এসে দাঁড়াল। যখন সে যাচ্ছে, জিনি তার আসন থেকে উঠে দাঁড়াল।
এখন কি সময় হয়েছে?–সে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল।
এখনো হয়নি। করিডন বলল, ঘণ্টাখানেক পরে অন্ধকার আরো ঘন হবে।
তিনজন একসাথে কালো আকাশের দিকে তাকাল। ঘন মেঘ আকাশ ছেয়ে ফেলেছে, বাতাসে শীতলতা।
বৃষ্টি নামবে–করিডন বলল, সৌভাগ্য বলতে হবে, বৃষ্টি নামলে পথ জনশূন্য থাকবে।
অন্য দুজন কিছু বলল না। সে তাদের বৈরাগ্য আঁচ করতে পেরে কাঁধ ঝাঁকিয়ে রান্না ঘরে ঢুকল। এখানে রনলি খাবার তৈরি করতে ব্যস্ত।
সব ঠিক আছে তো? করিডন জিজ্ঞাসা করল, তোমাকে সাহায্য করব নাকি?
ফিসফিস করে রনলি বলল, ওরা আমার সাথে কোন কথা বলছে না। ক্রিড কি যন্ত্রণা ভোগ করেছিল আমি বুঝতে পারছি।
তুমি একটু বেশী চিন্তা কর। করিডন বলল, আড়চোখে রান্না ঘরের দরজার দিকে তাকাল। সে দেখতে পেল, জন জানলা দিয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে আছে–দুজনের বিরুদ্ধে এখন আমরা তিনজন। অ্যান আমাদের পক্ষে।
এই দুজনের বিরুদ্ধে গিয়ে ও কি এখন সাহায্য করতে পারবে। অনলি জিজ্ঞাসা করল।
দ্বীপটাতে পৌঁছনোর পর ওর প্রয়োজন হবে, যদি আমরা ওখানে পৌঁছই। তোমার চেয়ে ওদের আমি বেশী চিনি। ওরা জঘন্য প্রকৃতির। আমাকে মোটেই বিশ্বাস করে না–একটা চিৎকারের শব্দ ভেসে আসতেই রনলি থেমে গেল। করিডন চমকে মুখ তুলে তাকাল।
করিডন স্টুডিওতে এসে দেখল, অ্যানের বাহু চেপে ধরে জিনি তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। তার চোখমুখে হিংস্রতা। ঘন ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করছে। দুচোখে পাগলের দৃষ্টি।
জিনিকে টেনে সরিয়ে দিয়ে করিডন বলল, খুব হয়েছে। চুপচাপ বসগে, আমি নাটুকেপনা দেখতে চাই না
কয়েক মুহূর্ত জিনি তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, যেন চিনতে পারছে না। তারপর হাত তুলল তাকে মারবার জন্য। কিন্তু করিডন তার হাত ধরে ফেলে সজোরে ধাক্কা দিল। জিনি ছিটকে গিয়ে দেওয়ালে ধাক্কা খেল।
আগেই তোমাকে নিষেধ করেছিলাম। করিডন বলল, এসব বন্ধ কর, কেমন?
জিনি দেওয়ালে পিঠ রেখে কিছু বলবার চেষ্টা করল। কিন্তু গলা দিয়ে কথা বের হলো না। তারপর ঝুঁকে হাঁপাতে শুরু করল, চোখ মুখের দৃষ্টি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। মুখ থেকে হিস্ হিস্ শব্দ বেরিয়ে আসতে লাগল।
জিনি কয়েক মুহূর্ত বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ল। তাকিয়ে দেখা-রনলি চিৎকার করে উঠল। ওর দিকে দেখ। এর আগেও ওর এমন অবস্থা হতে দেখিনি আমি।
করিডন এক পা পিছিয়ে এল। অ্যান ভয়ে সিঁটিয়ে গেল। হাত তুলে আঙ্গুলগুলো কাঁপিয়ে জিনি তার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল।
জন চুপচাপ দেখছিল। সহসা সে জিনি আর করিডনের মাঝে এসে দাঁড়াল। কোনরকম দ্বিধা না করে জিনির গালে সজোরে একটা চড় মারল, মেয়েটা পড়ে যাওয়ার উপক্রম হতেই তাকে ধরে ফেলল। তারপর সন্তর্পণে তাকে মেঝের উপর শুইয়ে দিল। খুব সাবধানে আলতো করে মেয়েটার একটা চোখের পাতা তুলে দেখল আর নাড়ির গতি পরীক্ষা করে উঠে দাঁড়াল।
ওর মাথায় একটা বালিশ দিয়ে দাও।-এনলিকে জন বলল। করিডন হাতের কাছে যে বালিশটা পেল সেটা রনলির হাতে তুলে দিল।
করিডন দেখল জন বালিশটা জিনির মাথার তলায় দিল। পকেট থেকে রুমাল বের করে জিনির চোখমুখ মুছিয়ে দিল। সে এই প্রথম বুঝতে পারল মেয়েটা পাগল।
ওকে কি একটু পানীয় দেব?করিডন জিজ্ঞাসা করল। অসুস্থ মানুষকে দেখলে সে দিশেহারা হয়ে পড়ে।
এখনি ঠিক হয়ে যাবে।–জন বলল, কিছুক্ষণ ঘুমোবে। মাঝে মাঝেই এমন হয়। খুব কম মেয়েছেলেই এই কষ্ট সহ্য করতে পারে।
কিন্তু ব্যাপারটা গুরুতর। করিডন তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল।
জিনিকে কিছু জানিও না। এসব ওর মনে থাকে না। ব্যাপারটা এমন কিছু মারাত্মকনয়নার্ভের রোগ।
বোকার মত কথা বলল না। ওর কাণ্ডকারখানা বিপদজনক উন্মাদের মত। রীতিমত সেবা শুশ্রূষার প্রয়োজন।
তাই বুঝি?–জন হাসলনা, এত ভাবতে হবে না। ম্যালোরীকে খুঁজে পেলেই ও সুস্থ হয়ে উঠবে।
জনের স্মিত আর ভয়ঙ্কর হাসি দেখে অ্যানের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা রক্তস্রোত প্রবাহিত হল।
.
০২.
জিনি চোখ মেলল, দেখল জন তার পাশে হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে তাকে মৃদু নাড়া দিচ্ছে।
চোখ মেল।–জনকে বলতে শুনল, কেমন বোধ করছ?
জিনির মনে হলো জনের কথাগুলো বহুদূর থেকে ভেসে আসছে। তার বেশ মনে আছে মাথার মধ্যে ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছিল, শরীরের অবসন্নতাভাব তাকে ভয়ার্ত করে তুলেছিল।
জনের গোল মুখ আর ধূসর চোখ তার কাছে খুব পরিচিত মনে হল। সে উঠে বসবার চেষ্টা করল। অনুভব করল জনের দুটি হাত তার পিঠে, তাকে উঠে বসতে সাহায্য করছে।
তুমি জ্ঞান হারিয়েছিলে।–জন মোলায়েম স্বরে বলল, ভাল না লাগলে শুয়ে থাক। কোন তাড়া নেই। করিডন গাড়ির ব্যবস্থা করতে গেছে।
জ্ঞান হারিয়েছিলাম!–সে জীবনে কখনো জ্ঞান হারায়নি। তুমি মিথ্যে কথা বলছ।বাদামী হাত দুটো জনের বাহু শক্ত করে চেপে ধরে বলল, কি ঘটেছিল?
জন চুপ করে রইল।
অবস্থা কি খুব খারাপ হয়েছিল? জিনি জানতে চাইল, কতক্ষণ এ অবস্থা ছিল?
তেমন খারাপ কিছু না। প্রথমে মনে হয়েছিল তুমি জ্ঞান হারিয়েছ।তার দু-চোখে ভয় জমতেই সে বলল, হয়ত আর কখনো এমন হবে না, ভয়ের কিছু নেই।
গালের যে জায়গায় জন চড় মেরেছিল সেই জায়গায় হাত বুলিয়ে ভয় পেয়ে বলল–এখানে ব্যথা লাগছে। আমাকে আঘাত করতে হয়েছিল?
না।–জন হাত নেড়ে বলল, তোমায় তো বললাম তেমন কিছু নয়।
আমাকে তোমায় আঘাত করতে হয়েছিল–সে বিমর্ষ ভাবে বলল,জন, আমার কি হয়েছিল? আমি কিছু বুঝতে পারছি না। মাথাটা কেমন যেন ধরা। আমার ভয় করছে।
মনের উপর চাপ আর দুশ্চিন্তার ফল–ভেবে দেখ তুমি কিভাবে দিনগুলো কাটাচ্ছ–তোমার বিশ্রামের প্রয়োজন। বলছি তো চিন্তা করবার মত কিছু নয়।
আমার ভাগ্যে কি আছে কে জানে, সে আবার বলল। ম্যালোরীকে খুঁজে বের না করা পর্যন্ত আমাদের পরিণতি ভেবে কি হবে? আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না। তোমার করে? হাতে মাথা রেখে কপাল টিপে ধরে জিনি বলল। কিন্তু ম্যালোরীকে কি আমরা খুঁজে পাব? ওর মৃত্যুর পর আমাদের বেঁচে থাকার প্রয়োজন হবে না। আমাদের বাঁচার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে।
কার্লোটের মৃত্যুর সাথে সাথে আমার জীবনও শেষ। জন মৃদুকণ্ঠে বলল, তবে এখন এসব কথা আলোচনা করবার সময় না। সামনে আমাদের অনেক কাজ।
আবার জিনি জনের হাত চেপে ধরল। সে বলল, জন তুমি না থাকলে আমি কি করব? আমরা ঝগড়া করি, আমাদের মতান্তর হয়, কখনও বা পরস্পরকে ঘৃণা করি। কিন্তু নিজের প্রয়োজনে তোমাকে সবসময় কাছে পেয়েছি।
যে তোমার শত্রু সে আমারও শত্ৰুজন বলল, তাছাড়া প্রকৃত বন্ধুরা ঝগড়া করেই থাকে। বন্ধুদের পরীক্ষা এভাবেই হয়।
জিনি উঠে দাঁড়িয়ে জনের কাছ থেকে সরে গেল। সে জিজ্ঞাসা করল,বর্তমান অবস্থা কি বলত?
করিডন আর মেয়েটা গেছে গাড়িটা আনতে। জন বলল, রনলি খাবার গুছিয়ে নিচ্ছে।
জিনি বিরক্ত হয়ে বলল, ওদের একসাথে যেতে দিলে?
কি করব, আমাকে যে তোমার কাছে থাকতে হল।–জন বলল, একজনকে তো গাড়িটা আনতে যেতেই হত।
কিন্তু ওরা গাড়ি নিয়ে আমাদের ছেড়ে পালাতে পারে। জিনি বলল, এদিকটা ভেবে দেখেছ?
যদি পালায় তাতে আমাদের কিছু যাবে আসবেনা।ওদের সাহায্য ছাড়াই কাজ হাসিল করতে পারব।
না, তুমি ভুল করছ। করিডনকে বাদ দিয়ে কোন কাজ করা যাবেনা। ম্যালোরীর কাছে একমাত্র ও আমাদের নিয়ে যেতে পারবে। ওকে চোখের আড়াল করা ঠিক হবে না।
জন রেগে গিয়ে বলল, আগাগোড়া এই কথা বলে আসছ, আমার উপর আস্থা রেখে দেখ। এই করিডনের উপরেই শুধু নির্ভর করছ কেন বলতে পার?
তা জানি না, বলতে পারব না। তবে আমার বিশ্বাস করিডনই পারবে ম্যালোরীকে খুঁজে বের করতে।
ঠিক আছে। ফলেন পরিচয়তে। তবে তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি, লোকটা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।
জানি–উপায়হীনের মত জিনি বলল, ওকে আমি ঘৃণা করি, ওর হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে পারি। তবুও আমার স্থির বিশ্বাস এই লোকটা আমাদের ম্যালোরীর কাছে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে।
রনলিকে দেখে আসি প্রসঙ্গ পরিবর্তন না করলে ক্রোধ প্রশমিত হবে না বলে জন বলল, চুপচাপ অপেক্ষা কর। গাড়ি এসে যাবে। অত ভেবনা।সে রান্নাঘরে এসে জিজ্ঞাসা করল, রনলি তুমি প্রস্তুত?
রনলি চোরা আর অস্বস্তিকর চোখে তার দিকে একবার তাকাল। তারপর সে বলল, যা পেয়েছি সব গুছিয়ে নিয়েছি। জিনি কেমন আছে?
ভাল আছে। গাড়িটা আসতে দেখেছ নাকি?
না, রনলি মাথা নাড়ল, আর হোলরয়েড কেমন আছে?
জানি না। ওর কাছে যেতে পারিনি। তোমাকে দিয়ে কোন ভাল কাজ হবে না নাকি? রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে স্টুডিও পার হয়ে জন বেডরুমে ঢুকল।
জিনি শুনল জনের গলা থেকে অস্ফুট আর্তনাদ ছিটকে বেরিয়ে এল। সে জনের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে?
লোকটা পালিয়েছে। রনলিটা বোকা ওর ওপর নজর রাখতে পারেনি। দেখ লোকটা ঠিক পুলিশ ডেকে আনবে।
এদিকে করিডন অ্যানের বাংলোয় ঢুকে বলল, আলো জ্বেলল না মনে কর আমরা গ্যারেজেই আছি।দেখ তোমাকে আমি কিছু বলতে চাই। ওই মেয়েটা সাংঘাতিক। একেবারে বদ্ধ পাগল। আমাদের সাথে তোমার আসা নিরাপদ হবে না।
অন্ধকারে অ্যান করিডনকে দেখতে পাচ্ছে না, তবে তার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে।
প্রতিজ্ঞা কর কাউকে বলবে না, আমরা কোথায় যাচ্ছি।করিডন বলল, এবার তুমি পালাও, আমি ওদের বলব তুমি পালিয়ে গেছ।
আমি তোমার সঙ্গে যাব–কোনরকম দ্বিধা না করে অ্যান বলল, যদি ব্রায়ান বেঁচে থাকে তাহলে ওকে সাহায্য করতে আমাকে যেতেই হবে।
কিন্তু ভাবনা এই পাগল মেয়েটাকে নিয়ে।–চিন্তিত কণ্ঠে করিডন বলল, সব সময় তোমার কাছাকাছি থাকা সম্ভব হবে না। একা পেয়ে তোমার ক্ষতি করতে পারে।
আমাকে ঝুঁকি নিতেই হবে। জানি, নিজেকে রক্ষা করার দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে। তবু আমি তোমার সাথে যাবো। মন প্রস্তুত করে ফেলেছি।
বেশ, যা ভাল বোঝ কর। স্বীকার করছি তোমার উপস্থিতি আমাদের কাজে লাগবে। জায়গাটা সম্বন্ধে তোমার অভিজ্ঞতা আমাদের রক্ষা করবে বার বার। তুমি স্থির নিশ্চিত তো?
নিশ্চয়ই।
তাহলে সাথে যা নিতে চাও চটপট গুছিয়ে নাও। ফোনটা কোথায়? একটা ফোন করতে চাই।
জানলার কাছে আছে।
করিডন ফোনে টেলিগ্রাম অফিসের সাথে যোগাযোগ করল। সে অপারেটারকে বলল, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ডিটেকটিভ সার্জেন্ট রলিন্সকে একটা টেলিগ্রাম পাঠাতে হবে। টেলিগ্রামটা এইরকম হবেঃ ক্রিডকে আর এনফিল্ড হোটেলে দুজন পুলিশকে যে বুলেটের সাহায্যে হত্যা করা হয়েছে সেগুলো পরীক্ষা করুন। জন হল মসার পিস্তলের মালিক। এই লোকটা তার দুজন সাথীর সঙ্গে এনফিল্ড হোটেলে ছিল। অনুসন্ধান করলে জানা যাবে যে, এই তিনটে মানুষ ক্রিডের সাথে তার ফ্ল্যাটে তিন দিনের মতো ছিল। করিডন। ঠিক মত লিখেছেন?–হ্যাঁ, একবার পড়ে শোনান–অপারেটর পড়ে শোনাতেই করিডন বলল, চমৎকার। তাহলে ছাড়লাম।
করিডন রিসিভার নামিয়ে রাখলো। সহসা বাইরে কারো চলাফেরার শব্দ শুনে সজাগ হয়ে উঠল সে। জানলা দিয়ে দেখল চার পাঁচটা লোক ভোলা জায়গা পেরিয়ে হোলরয়েডের বাংলোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
অ্যান–করিডন চাপাগলায় ডাকল, কোথায় তুমি?
অ্যান কাছে এসে বলল কি হয়েছে? গোছানর কাজ প্রায় শেষ করে এনেছি
বাইরে পুলিশ। সব ফেলে রাখ। খিড়কির দরজা আছে?
হ্যাঁ আছে। আমার সাথে এস।–অ্যান করিডনের হাত চেপে ধরে অন্ধকারে এগিয়ে চলল।
একটু অপেক্ষা কর। কোথায় গিয়ে পড়ব বল তো?
গ্যারেজে। এখান থেকে রীলে স্ট্রীটে পড়ে কিংস স্ট্রীটে যাওয়া যাবে।
ঠিক আছে। আমার গা ঘেঁষে চল। যদি পুলিশ আমাদের দেখে ফেলে তাহলে মাটিতে সোজা শুয়ে পড়বে ওদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থাকবে। বুঝেছ?
হা।
সাবধানে খিড়কির দরজা খুলে অন্ধকারে করিডন উঁকি দিয়ে দেখল। ঠিক সেই সময়ে গুলি ছোঁড়ার শব্দ কানে এল। পর পর তিনটে গুলির শব্দে রাতের নিস্তব্ধতা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল।
জনের কাজ –করিডন ফিসফিস করে বলল, আমার হাতটা ধর। তাড়াতাড়ি এস।
দুজন অন্ধকারে এগিয়ে চলল, আবার গুলি ছোঁড়ার শব্দ হল। মানুষের চিৎকার শোনা গেল।
এস।
অ্যানের হাত চেপে ধরে দ্রুতপায়ে হাঁটতে হাঁটতে তারা রীলে স্ট্রীটে এসে পড়ল। করিডন বলল, ওরা এই রাস্তা ঘিরে ফেলতে পারে। যদি আমরা বাধা পাই তাহলে দায়দায়িত্ব আমার ওপর ছেড়ে দেবে।
তারা দ্রুত পায়ে আলোকোজ্জ্বল কিংস স্ট্রীটের দিকে এগোতে লাগল। অন্ধকারে ঢাকা অর্ধেকটা পথ অতিক্রম করার পরকরিডন একজন পুলিশকে দেখতে পেল। সেদাঁড়ালনা, অ্যানের হাত ধরে আগের মত হাঁটতে লাগল।
পুলিশ আমাদের পথ রোধ করতে পারে আবার নাও পারে–চাপা কণ্ঠে করিডন বলল, যদি পথ রোধ করে তাহলে দৌড়তে শুরু করবে। এছাড়া অন্য কোন পথ দেখছি না, তুমি দেখছ?
না,চাপাকণ্ঠে অ্যান বলল।
পুলিশটা হাঁটতে হাঁটতে তাদের কাছাকাছি এসে পড়ল। একটু দাঁড়াও-হাত তুলে পুলিশটা বলল।
আমি বললেই দৌড়তে থাকবে। করিডন ফিসফিসিয়ে বলল।
তারপর গলার স্বর চড়িয়ে পুলিশটার উদ্দেশ্যে বলল, আমায় বলছেন? পুলিশটা থমকে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল। করিডন তার গালে একটা ঘুষি মেরে রাস্তার উপর ফেলে দিয়ে বলল, ঠিক আছে–দৌড়ও। অ্যানকে একটা ধাক্কা মারল।
.
০৪.
জন চকিতে এক নজর তাকিয়েই বুঝতে পারল হোলরয়েড পালিয়েছে। অগোছালো বিছানা, দুটো দড়ির টুকরো মাটিতে পড়ে আছে। খোলা জানালা পথে হাওয়া ঢুকে পর্দা ওড়াচ্ছে। কতক্ষণ আগে হোলরয়েড পালিয়েছে, দশ, পনের না কুড়ি মিনিট আগে, পুলিশের গাড়ি এসে পড়ার আগে এই সময়টুকু যথেষ্ট।
জিনি আর রনলি এসে দাঁড়িয়েছেদরজার কাছে ঠিক জনের পিছনে। তারা তাকিয়ে আছে শূন্য বিছানার দিকে। জিনির চোখে শূন্য দৃষ্টি। জনের চোখেমুখে দুশ্চিন্তা। আগে যতবার জরুরী অবস্থা উপস্থিত হয়েছে জিনি সামলেছে, কিন্তু এখন তাকে সেরকম মনে হলো না। এখনো তার মধ্যে আগের ভাব রয়ে গেছে। এই মুহূর্তে জন ভাবল তাকে দিয়ে আর কিছু হবে না। রনলির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। লক্ষ্য করল, সে নিজেও বিচলিত হলেও রনলির মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া নেই।
এতক্ষণে পুলিশের এসে পড়া উচিৎ। রনলি বলল, হোলরয়েড যদি ফোন করে থাকে কয়েক মিনিটের মধ্যেই এসে পড়বে।
হ্যাঁ। আর এবার আসবে অস্ত্রশস্ত্র সঙ্গে নিয়ে, জন বলল, এনফিল্ড হোটেল থেকে যত সহজে পালিয়েছি তত সহজে এখান থেকে পালান যাবে না।
জানালা দিয়ে লক্ষ্য রাখ। রনলি বলল, দরজার দিকে আসতে পারে।
জন খাপ থেকে পিস্তলটা বের করে হাতে নিল। তারপর জিনিকে বলল, করিডনের পিস্তলটা রনলিকে দাও।
সহসা রনলি জিনির কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে পিস্তলটা তুলে নিল। জন কয়েক পা পিছিয়ে গেল।
আমার মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। কপাল চেপে ধরে যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠে জিনি বলল।
পেছনের দিকটা দেখে আসি,এনলি বলল, আমি না ফেরা পর্যন্ত এখানে থাক।
রনলি চলে যেতেই জন স্টুডিওর জানালার পর্দা টেনে দিয়ে বাইরে অন্ধকারে চোখ রাখল। কিছুই নজরে পড়ল না। খানিকক্ষণ পরে দেখতে পেল, পুলিশ এসে গেছে, তারা সন্তর্পণে বাংলোর দিকেই এগিয়ে আসছে। রনলি ফিরে এসে জানলার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, পুলিশ এসে গেছে। চারজন পিছন দিকটা পাহারা দিচ্ছে। সামনের দিকে আছে আটজন।-জন বলল, সংখ্যায় আরো বেশী হতে পারে।
আমরা তিনজন ওদের সাথে পেরে উঠবে না, জন-অনলি বলল, জিনিকে নিয়ে পিছনের দিকে পালাতে পার কিনা দেখ। পরে দেখা করব।
পরে দেখা করবে?-রনলির কথা বিশ্বাস করতে না পেরে জন বলল, তার মানে?
দয়া করে যাও বলছি। অনলি মিনতি করল। এটা একমাত্র সুযোগ। দুজনে যা পারব, তিনজন হলে সেটুকুও ভেস্তে যাবে। জিনিকে নিয়ে তুমি যাও।
যাচ্ছি। কিন্তু রনলি, বাঁচার অধিকার আমার যেমন আছে, তোমার তেমনি আছে।
জনকে ধাক্কা দিয়ে রনলি বলল, আঃ, জিনিকে নিয়ে যাও বলছি। গুলির শব্দ শুনলেই বুঝতে পারবে।
তুমি আমার সুহৃদ।জন বলল, তারপর সে রনলিকে একা রেখে চলে গেল।
কিছুক্ষণ রনলি একা দাঁড়িয়ে রইল। নিজের জীবন উৎসর্গ করতে চলেছে সে। জন সম্পর্কে তার কোন মাথা ব্যথা নেই। আজ হোক আর দু-দিন পরেই হোক জন তাকে খুন করবে, হয়তো তার ছোঁড়া একটা গুলি মাথা ভেদ করে যাবে, কিম্বা পিছনে ছোরা বসিয়ে দেবে, তার চেয়ে এই ভাল হল। ওরা দুজনে যতদিন বাঁচবে ততদিন তাকে মনে রাখবে। সহসা তার মনে হল জনকে সে হারিয়ে দিয়েছে।
বন্দুকের নল দিয়ে জানালার পর্দা সামান্য সরিয়ে দিল রনলি। এখন বন্দুক থেকে গুলি ছোঁড়ার অর্থ মৃত্যুকে ডেকে আনা। জন আর জিনি কি চলে গেছে? ম্যালোরীর ভাগ্যে কি আছে কে জানে। এই মানুষটার কথা ভাবলে দুঃখে মনটা ভরে যায়।
রনলি শুনতে পেল জন পেছনের দরজা খুলে বন্ধ করল। হাতে ধরা বন্দুকটাকে প্রচণ্ড ভারী বলে মনে হল তার। প্রচণ্ড কষ্টে বন্দুক ধরে রাখল। জনকে ফিসফিস করে বলতে শুনল, আমরা প্রস্তুত।
রনলি একটানে পর্দা সরিয়ে ফেলে জানলার সামনে দাঁড়াল। অন্ধকারে একের পর এক গুলি চালাতে লাগল।
.
দশম পরিচ্ছেদ
০১.
এমিথিস্ট ক্লাবের দিকে যাওয়ার একমুখো রাস্তার মুখে ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল। বৃষ্টি ঝরে চলেছে। বেশ শীত পড়েছে, রাস্তার আলোগুলো যেন ধুলো পরানো। ক্রিম স্ট্রীট জনশূন্য। করিডন এমনই আশা করেছিল।
ট্যাক্সি ভাড়া চুকিয়ে দিল করিডন। তারপর সে আর অ্যান গাড়ি থেকে দ্রুতপায়ে এগিয়ে চলল।
ক্লাবের পিছনে একটা দরজায় ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। অ্যান আর করিডন ভেতরে ঢুকে একটা আবছা আলোকিত প্যাসেজে এল, এখানে আবর্জনার দুর্গন্ধ বাতাসে ভাসছে।
যার শেষ ভাল, তার সব ভাল। এফির সাথে দেখা হলে বুঝবে কয়েক ঘণ্টার জন্য তারা নিশ্চিন্ত। কোট থেকে বৃষ্টির জল ঝেড়ে ফেলতে ফেলতে করিডন বলল, মেয়েটাকে খুঁজতে যাচ্ছি, তুমি এখানে অপেক্ষা করবে?-খুব একটা সময় লাগবে না।
আচ্ছা-অ্যান বলল, কিন্তু যদি কেউ এসে পড়ে? বলবে তুমি এফির বান্ধবী। তবে আমার বেশিক্ষণ লাগবে না। তোমাকে দেখে মনে হয়েছে প্রতিদিনই এ ধরণের কাজ করতে অভ্যস্ত।
যাও, এদিকে খোঁজোতো, প্রশংসা পরে করলেও চলবে।
করিডন রান্নাঘরের সামনে এল। দেখল এফি গুন গুন করে গান গাইছে আর আলুর খোসা ছাড়াচ্ছে।
এফি-দরজার সামনে থেকে করিডন ডাকল, আশে পাশে কেউ নেই। খোসা ছাড়ান ছুরিটা নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়াল এফি। তার চোখমুখে বিস্ময়, সে অস্ফুট কণ্ঠে বলল, আরে মিঃ করিডন
ঘরে ঢুকে করিডন বলল, এফি আমি বিপদে পড়েছি। তোমার সাহায্য প্রয়োজন।আমায় সাহায্য করবে?
নিশ্চয়ই। কি হয়েছে, মিঃ করিডন?
তোমার ঘরে যেতে পারি? একজন বন্ধু আছে সাথে। আমরা এখানে আছি জনি জানুক, সেটা চাই না। ও কোথায়?
ক্লাবে। এক্ষুনি আলুগুলো ছাড়াতে হবে, তাছাড়া রাতে ব্যস্ত থাকব। তুমি নিজে যেতে পারবে?
পারব। যত তাড়াতাড়ি পার চলে এস। একটা টাইম-টেবিল আনতে পারবে? আর কিছু খাবার অবশ্যই সঙ্গে করে আনবে। কিন্তু আমাদের কথা কাউকে জানাবে না।
না জানাব না। তুমি উপরে যাও মিঃ করিডন। দশ মিনিটের বেশী সময় লাগবে না। করিডন এফিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি কি ভাল এফি। জানতাম তুমি আমায় সাহায্য করবে।
এর মধ্যে পুলিশ জড়িয়ে আছে নাকি, মিঃ করিডন?
হ্যাঁ আছে, তবে ভয় পেয়ো না। নিজেই সামলে নিতে পারব। তোমার আসতে দেরী হবে। নাকি?
করিডন অ্যানের কাছে ফিরে এল। দেখল মেয়েটা ময়লা দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে বলল, আমরা উপরে যাব। এফি ওর ঘর আমাদের জন্য ছেড়ে দিয়েছে। ..
এফির ঘরে যাওয়ার পথে কারো সঙ্গে তাদের দেখা হল না। আলো জ্বালাবার আগে জানালার খড়খড়ি টেনে দিল।
অ্যানকে কোট খুলতে সাহায্য করে নিজের কোটও গা থেকে খুলে ফেলল সে। তারপর কোট দুটো দরজার পেছনে হুকে ঝুলিয়ে রাখল। বলল, বিছানায় বস।
অ্যান বিছানায় বসে পড়ে বলল, ভাবছি ওই তিনজনের কথা, ওরা পালাতে পেরেছে বলে মনে হয়?
পালাবার সুযোগ আছে। আকস্মিক সংকট থেকে নিজেদের মুক্ত করতে ওরা পটু। আচ্ছা, তুমি কি আমার সঙ্গ ত্যাগ করবে না বলে ঠিক করেছ? আমার সঙ্গে তুমি থাকলে ঝামেলায় পড়বে।
মনে হচ্ছে আমার সংস্পর্শ এড়াতে চাইছ তুমি। ঝামেলা আমি পছন্দ করি আর নিজের দায়িত্ব নিজে নেওয়ার ক্ষমতা আমার আছে। ব্রায়ানের খোঁজে আমি যাবই।
কিন্তু নিজেকে পুলিশের সঙ্গে জড়িও না। যদি হার্মিট দ্বীপে যাবেই ঠিক করে থাক, তাহলে একা যাও।
ভেবেছিলাম আমরা দলবদ্ধভাবে যাব।
পুলিশ আসার আগে সেরকম ভেবেছিলাম, করিডন অনুত্তেজিত কণ্ঠে বলল, এখন থেকে ব্যাপারটা খুবই খারাপ হয়ে পড়বে।
তোমাদের তিনজন চোখের আড়াল হয়েছে, কিন্তু তোমাকে চোখের আড়াল হতে দেব না। তাছাড়া আমি সঙ্গে না থাকলে তুমি দ্বীপটা খুঁজে বের করতে পারবেনা। আমি চাই ওই তিনজনের আগে দ্বীপে তুমি পৌঁছাও, অবশ্য ওরা যদি আসার সুযোগ পায়।
ঠিকমত তোমাকে বোঝাতে পারছি না। তোমার আচার ব্যবহার অন্য মেয়েদের মত নয়। তুমি আমার সম্বন্ধে কিছুই জান না। অথচ আমার সঙ্গে থাকতে চাও। ব্যাপারটা আমাকে ভাবায়। তোমাকে একেবারে বুঝতে পারছি না।
যুদ্ধের সময়কার কথা ভাব। তুমি ভাবছ তখন আমি নিষ্কর্মা হয়ে ঘরে বসেছিলাম?যুদ্ধ আমাকে নতুন ভাবে বাঁচতে শিখিয়েছে, অথবা বলা যেতে পারে কতকগুলো বাজে অভ্যাসের দাস করেছে আমায়। তারপর থেকে আমি স্বাভাবিক জীবন-যাপন করবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু ব্যাপারটা অত সোজা নয়। তবে তুমি যখন সহসা এসে পড়লে, থেমে গিয়ে অ্যান হাসল, আমি উত্তেজিত হওয়ার সুযোগ হারাতে রাজি নই।
তুমি কি করেছ যুদ্ধের সময়?–করিডন জানতে চাইল।
তুমি যা করতে। তোমাকে প্রথমে পাত্তা দিইনি, তবে এখন চিনেছি। মাঝে মাঝে তোমার কথা শুনতাম, তুমি তো রীবির কাছে ট্রেনিং নিয়েছ? আমি ট্রেনিং নিয়েছি ম্যাসিংহামের কাছে। ততদিনে তোমার ট্রেনিং শেষ হয়ে গেছে।
ম্যাসিংহাম? কি আশ্চর্য। ওর দুঃসাহসী কুমারী মেয়েদের মধ্যে তুমি ছিলে একজন?করিডনের চোখের দৃষ্টি উজ্জ্বল হল।
হা। দশবার প্যারাসুট নিয়ে লাফিয়েছিলাম। এর জন্য আমি গর্বিত।
আমি যখন শুনলাম প্যারাসুটে মেয়েদের নেবার জন্য একটা দল তৈরী করা হয়েছে, ভাবিনি ম্যাসিংহাম মহিলা সৈনিকের একটা দল তৈরী করেছেন। ভদ্রলোক প্রত্যেকটি মেয়েকে যথেষ্ট ভালবাসতেন। তাই না? তাহলে ম্যাসিংহামের তৈরী দলের তুমি একজন?
অত অবাক হয়োনা।–অ্যান বলল, দয়া করে আমার সম্পর্কে আগ্রহ প্রকাশ করোনা। নিজের সম্পর্কে নিজেই ভাবব।
দরজায় টোকা মেরে এফি ঘরে ঢুকল, হাতের ট্রেতে খাবার। অ্যানকে দেখে কাছের একটা টেবিলে ট্রেনামিয়ে রাখল। তীক্ষ্ণ হল চোখের দৃষ্টি। চোখ মুখ কুঁচকে যাওয়ায় তাকে কুশ্রী দেখাল।
এস এফি। করিডন বলল, অ্যান ম্যালোরীর সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দি, অ্যান এ হল এফি–আমার বন্ধু।
পরিবেশ স্বাভাবিক করে নিতে চাইলেও এফির চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক হলোনা। এমনকি অ্যান যখন বলল, ঘর ছেড়ে দিয়ে তুমি যথেষ্ট দয়ার পরিচয় দিয়েছ, এফি মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকাল।
অ্যানকে দেখামাত্র সে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বীর আভাস পেয়েছে, তাই সঙ্গে সঙ্গে তাকে ঘৃণা করতে শুরু করেছে।
তুমি টাইম-টেবিল পেয়েছ? করিডন প্রশ্ন করল। নিজের হাত ঘড়িতে সময় দেখল। দশটা বেজে কয়েক মিনিট।
এক্ষুনি নিয়ে আসছি, মিঃ করিডন। এফি বলল। খাবারের ট্রে বিছানার উপর রেখে বাইরে চলে গেল।
করিডন মৃদু হেসে বলল, খেতে শুরু কর। আমরা যত শীঘ্র সম্ভব চলে যাব।
অ্যান একটা চিকেন স্যান্ডউইচ তুলে নিয়ে প্লেটটা করিডনকে দিল। তারপর সে বলল, মেয়েটা কি তোমায় ভালবাসে?
কে? এফি?-করিডন কাধ ঝাঁকাল, তাই মনে হয়। মেয়েটা খুব ভাল। মাঝে মাঝে মনে হয় আমারই দোষ। ওকে অনেকদিন থেকে চিনি।বলেছি ওর কাটা ঠোঁট ঠিক করে দেব। আমার জীবনে অকৃত্রিম বান্ধবী। এর থেকে বেশী কিছু নয়।
অ্যান প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বলল, আমাদের খোঁজ নেওয়া উচিৎ ওই তিনজনের ভাগ্যে কি ঘটল।
আমি খোঁজ নেব।
এফি টাইম টেবিল নিয়ে ফিরে এল।
এফি, শোন। করিডন বলল, আমাকে লন্ডনে যেতে হবে। আমি বিস্তারিতভাবে তোমায় কিছু বলব না, কারণ যত কম জানবে ততই ভাল। আমরা আজ রাতে স্কটল্যান্ডে যাব। পথে খাদ্যের প্রয়োজন হবে আর আমি চাই তুমি আমাদের সঙ্গে গিয়ে টিকিট কাটবে। পুলিশ আমাদের খোঁজে নজর রাখবে। ওদের চোখে ধুলো দিয়ে ট্রেনে উঠতে পারলে ভাল হবে। করবে তো?
করব মিঃ করিডন।এফি গম্ভীর মুখে বলল। করিডনের স্কটল্যান্ডে চলে যাওয়ার অর্থ তার বুকে ছোরা বসিয়ে আত্মহত্যার সামিল।
করিডন টাইম-টেবিলের পাতা উল্টোতে উল্টোতে বলল, তুমি যাবার প্রস্তুতি কর আর ম্যাক্সকে কি একবার পাঠিয়ে দেবে? জনি যেন জানতে না পারে।
চেষ্টা করব।–এফি চলে গেল।
মেয়েটা ভাবছে আমি ওর প্রতিদ্বন্দ্বী। অ্যান বলল, তুমি ওকে আশ্বস্ত করলে ভাল হয় না কি?
এ কাজ করা যাবে না।–টাইম-টেবিলের পাতায় চোখ রেখে করিডন বলল, আমি নিজেই নিশ্চিন্ত নই।
সামান্য সময় অ্যান সবিস্ময়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে, কিন্তু কোন কথা বলল না।
দরজা ঠেলে ম্যাক্স ঘরে প্রবেশ করল। অ্যানকে দেখে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাল।
ডেকেছ আমাকে?–সে প্রশ্ন করল।
করিডন বলল, শোন, চেইনী ওয়াকের গুলি ছোঁড়াছুড়ি সম্বন্ধে কিছু জান নাকি?
জানি বৈকি,–ম্যাক্স হেসে বলল, লোকে বলাবলি করছে। সেই তিনজনের কথা বলছ তো?
হা কি হয়েছে?
দুজন পালিয়েছে আর হাতকাটা লোকটা পুলিশের গুলিতে মারা গেছে। তবে পুলিশের বক্তব্য অন্যরকম লোকটা মরেনি–আহত হয়েছে আর সকলে পালাতে সক্ষম হয়েছে।
করিডন আর অ্যান পরস্পরের দিকে নিঃশব্দে তাকাল।
.
০২.
চার্চের ছাদের নীচে মাত্র একটা ইলেকট্রিক আলো জ্বলছে। বেদীর দুপাশে জ্বলছে দুটো মোমবাতি। এই হলদে আলোর শিখায় ক্রুশবিদ্ধ যীশুমূর্তি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। চার্চের ভেতরে পিছন দিকে একজন বৃদ্ধা মহিলা দু হাতে মাথা গুঁজে বসে আছে। বাতাসের শব্দ চার্চের নিঃস্তব্ধ পরিবেশ নষ্ট করছে। দুজন মানুষ এক পাশে পাতা বেঞ্চের উপর বসে আছে।
জন আর জিনি চঞ্চল মনে বৃদ্ধার চলে যাওয়ার প্রতীক্ষা করছে। কিন্তু মহিলাটির মধ্যে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ব্যস্ততা নেই। আহত জনের গা ঘেঁষে জিনি বসে আছে। তার দু চোখ চকচকে ক্রুশবিদ্ধ যীশুমূর্তির দিকে নিবদ্ধ, জনের দিকে তাকাচ্ছে না। জিনির ব্যবহারের ব্যতিক্রম জনকে রাগিয়ে দিল, মন হতাশায় ভরিয়ে দিল।
তারা অলৌকিক উপায়ে পালাতে সমর্থ হয়েছে। জিনিকে দিয়ে কোন কাজ হয়নি। জন তাকে ঠেলে এনেছে একটা পুতুলের মত। জিনির হাত ধরে সাবধানে পালাবার সময়ে পুলিশের ছোঁড়া একটা গুলি জনের বাহুতে এসে লেগেছে। পুলিশের তাড়া খেয়ে জিনির হাত চেপে ধরে ছুটতে ছুটতে এই চার্চের সামনে এসে পড়েছে।
জিনির হাত ধরে রক্তাক্ত জন পবিত্র আর নিরাপদ চার্চে ঢুকে পড়ে উপাসকের বসবার আসনে বসে পড়ল। তাদের সামনে বসে আছে একজন বৃদ্ধা, উপাসনা করছে না-ঘুমচ্ছে।
জন বোতাম খুলে গা থেকে কোট খুলে ফেলল। যন্ত্রণায় কাতরে উঠল।
জিনি জনের রক্তাক্ত শার্টের হাতার দিকে তাকাল। ছুরিটা আমাকে দাও। জিনি বলল, স্কার্ফটা খুলে ফেল।
জন ছুরিটা তার হাতে দিল, দেখল জিনি তার জামার হাতটা কাটছে। দুজনেই দেখল কালচে আর ফুলে ওঠা ক্ষতস্থান।
একটা প্যাড চাপা দিয়ে শক্ত করে বাঁধজন বলল, রক্তপাত বন্ধ করতে হবে।
একটা রুমাল ভাজ করে প্যাডের মত করে ক্ষতস্থানে চাপা দিয়ে স্কার্ফ দিয়ে শক্ত করে জিনি বেঁধে দিল।
চমৎকার হয়েছে জন বলল, এবার কোটটা পরতে আমায় সাহায্য কর।
তারপর চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগল, পিস্তলটা হাতের কাছে রাখল। পা দুটোতে যেন একেবারেই শক্তি নেই। এই মুহূর্তে পুলিশ যদি এখানে হানা দেয় তাহলে পালাতে পারবে না, তবে তাকে জীবিত ধরতে পারবে না।
জন হাতে-বাধা ঘড়িতে সময় দেখল। রাত পৌনে এগারটা। করিডন আর ম্যালোরী মেয়েটার কি হল তাই ভাবতে লাগল। করিডনের ধারণা মত ম্যালোরীকে সত্যই সেই দ্বীপে পাওয়া সম্ভব? তাকে যদি খুঁজে বার করতে হয় এখনি সেখানে গিয়ে খোঁজা শুরু করতে হবে। এখন একমাত্র ভরসা এই দ্বীপটা।
মধ্যরাতে ঠিক করল চার্চ ছেড়ে যাবে, বৃদ্ধাটি অনেকক্ষণ আগেই চলে গেছে, ঘুম-জড়ান চোখে তাদের সে লক্ষ্য করেনি।
নিঃশব্দ চার্চের পরিবেশ, আর এখানে পড়ে থাকার প্রয়োজন নেই। জিনিকে আলতো ভাবে স্পর্শ করে জাগাল।
যাওয়ার সময় হয়েছে।–জন জিজ্ঞাসা করল, তোমার শরীর ঠিক আছে তো?
হ্যাঁ, ঠিক আছে। জিনি নিজের চুলে বিলি কেটে বলল, আর তুমি? তোমার হাতের অবস্থা কি?
ভাল। যাওয়ার সময় হয়েছে। দ্বীপে যেতে হবে। জন বলল, কি করে যাবে?
কিংক্রশ থেকে ট্রেনে স্কটল্যান্ডে যাওয়া যায়।
কিংক্রশ কোথায়?
গ্রেস ইন বার্ডের কাছে। হেঁটে পৌঁছতে হবে। জন আস্তে আস্তে অলস পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল।
সে বলল, তোমার মন বলছে আমরা দ্বীপে পৌঁছতে পারব?
পারব।–রূপোর যীমূর্তির দিকে তাকিয়ে জিনিবলল, জন, আমাকে একটু সময় দাও।হয়ত আর কখনো চার্চে ঢোকার সুযোগ জীবনে আসবে না।
তাড়াতাড়ি কর।-মুখের ঘাম মুছে জন বলল।
হাঁটুতে ভর দিয়ে বসল জিনি। ভাবল কি ভাবে প্রার্থনা করবে। কোন এক সময় সে ভগবানকে বিশ্বাস করত, কিন্তু এখন আর সেই বিশ্বাস নেই। ঈশ্বর কি তার কোন প্রার্থনা পূর্ণ করবেন না? তার একমাত্র কামনা যে কোন ভাবেই হোক না কেন, ম্যালোরীকে খুন করা।
.
একাদশ পরিচ্ছেদ
০১.
উত্তরমুখী ধাবমান ট্রেন নির্দিষ্ট সময় সকাল সাড়ে আটটার কিছু পরে বারউইক স্টেশনে পৌঁছাল।
বারউইক হল দুনবারের আগের স্টেশন। করিডন তৃতীয় শ্রেণীর কামরা থেকে জানলা দিয়ে গলা বাড়িয়ে দেখে নিল কোন পুলিশ প্ল্যাটফর্মে আছে কিনা।
প্রত্যেক স্টেশনে করিডন লক্ষ্য রেখেছে পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে কিনা। কিন্তু সন্দেহজনক কিছু নজরে পড়েনি।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে করিডন প্ল্যাটফর্মে নেমে চোখের সামনে খবরের কাগজ মেলে ধরে অপেক্ষা করতে লাগল। কাগজের প্রথম পাতায় ছাপা নিজের ছবি দেখে তার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল রক্তস্রোত প্রবাহিত হল। ফটোর মাথায় ক্যাপসান লেখা আছে : আপনি কি এই লোকটাকে চেনেন?
এ ধরনের কিছু আশা করেনি করিডন। যে কোন সময় কেউ না কেউ তাকে চিনে ফেলতে পারে।
দেখি কি লিখেছে। করিডন কাগজ লুকিয়ে ফেলার আগে অ্যান কাছে এসে বলল।
ইতস্ততঃ করল করিডন। সে অ্যানকে জানতে দিতে চায় না যে রীটা অ্যালেন মৃত। তবে এটা ঠিক যে একদিন অ্যান ঠিক জানবে। অন্যের কাছ থেকে না জেনে তার কাছ থেকে জানাই ভাল হবে। তাই খবরের কাগজটা পকেট থেকে বের করে তার হাতে দিল।
অ্যান ফটোটা দেখল খুঁটিয়ে। তারপর সেবলল,হ্যাঁ ফটোটা তোমারই। একেবারে হুবহু তোমার চেহারা। ত্রিশ মিনিটের মধ্যে দুনবারে পৌঁছে যাব। কি করবে কিছু ঠিক করেছ?
ঝুঁকি নেব। করিডন বলল কঠিন কঠে, তবে আমার সম্পর্কে তোমার ভাল করে জানা। প্রয়োজন। কোন মানুষের বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে উচ্চ ধারণা করবার প্রয়োজন নেই। পুলিশ আমাকে লক্ষ্য নাও করতে পারে।
কাগজে রীটার খবর পড়বার সঙ্গে সঙ্গে অ্যানের চোখমুখ কঠিন হয়ে এল, শক্ত হাতে কাগজ চেপে ধরল।
মেয়েটা তো মারা গেছে।–অ্যান বলল, অস্ফুট কণ্ঠে। লিখেছে ও খুন হয়েছে।
ঠিকই লিখেছে–করিডন মৃদুকণ্ঠে বলল, পুলিশের ধারণা এ কাজ আমার। তখন মেয়েটার ওখানেই ছিলাম কিনা। সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছিল।
অ্যানের সারা মুখে ভীতি আর অবিশ্বাস ফুটে উঠল। করিডন একটা সিগারেট ধরাল–তুমি কি ভাবছ জানি। যদি তুমি আমার সম্বন্ধে ভুল ধারণা কর তাহলে আমার বাবার কিছু নেই। আমরা পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। তুমি ট্রেন ধরে লন্ডনে ফিরে যাও। তোমার দ্বীপে আমি একাই যাব। তুমি শুধু পুলিশকে আমার গতিবিধি সম্বন্ধে কিছু বল না।
এই ঘটনাগুলোর পিছনে অন্য ঘটনা আছে বলে মনে হচ্ছে। তুমি কিছু লুকোচ্ছ। কি লুকোচ্ছ বল তো?
ঠিক বলেছ, এই ঘটনাগুলোর পেছনে অন্য ঘটনা আছে। তোমাকে বলতে চাইছিলাম না, তবে বলা প্রয়োজন। তোমার মনে আছে নিশ্চয় যে গোর্ভিলের দলে মোট নজন গুপ্তঘাতক ছিল?
গোর্ভিল, কালোট আর জর্জকে গেস্টাপোরা গুলি করে হত্যাকরে। তোমার দাদার কোন হদিস পাওয়া যায় না। বাকী পাঁচজনের ধারণা, তোমার দাদা গোর্ভিলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তারা লন্ডনে আসে। তাদের মধ্যে দুজন–হ্যারিস আর লুবিস কোন ক্রমে তোমার দাদার কাছে যায়। দুজনইনৃশংসভাবে মারা যায়। একজন চলন্ত ট্রেন থেকে পড়ে গিয়ে আর অপর জন পুকুরে ডুবে মরে। তোমার দাদার খবর জানতে রীটাঅ্যালেনের কাছে গিয়েছিলাম। আমি ঘরে বসা অবস্থায় তাকে সিঁড়ি থেকে কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। ফলে ঘাড় ভেঙ্গে সে মারা যায়।
তোমার অনুমান ব্রায়ানই ওদের খুন করেছে?
হ্যাঁ
ব্রায়ান সম্পর্কে তোমার অনেক অভিযোগ তাই না?
হ্যাঁ। তোমার দাদার সঙ্গে আমাকে দেখা করতেই হবে।
এসব আগে বলনি কেন?
আমি চেয়েছিলাম তোমার সাহায্যে ওকে খুঁজে বের করতে।
তাহলে হঠাৎ তোমার মন পালটে গেল কেন? তোমাকে এখন অন্যরকম মনে হচ্ছে।
তাই বুঝি।
এখন সবই জেনেছ। দুনবারে পৌঁছানোর পর বাড়ি ফিরে যাও।আমার কথা ভুলে যাও। তোমার দাদার উপর সুবিচারই করব। তোমাকে কথা দিচ্ছি।
.
০২.
ট্রেনের করিডর দিয়ে করিডন যখন দ্রুত পায়ে হেঁটে চলেছে, ঠিক তখনই প্রথম শ্রেণীর কামরা থেকে একজন বিরাট চেহারার মানুষ তার সামনে এসে দাঁড়াল। লোকটি ডিটেকটিভ সার্জেন্ট রলিন্স।
গোলমাল করো না বন্ধু। লোকটি হেসে বলল, হাডসন ঠিক তোমার পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে। আড় চোখে দেখল করিডন। সত্যিই তার পিছনে ডিটেকটিভ কনস্টেবল হাডসন পথ অবরোধ করে দাঁড়িয়ে আছে।
অপ্রত্যাশিতভাবে কোচের কোন দরজা দিয়ে বাইরে লাফিয়ে পড়তে পারত করিডন, কিন্তু ট্রেন এত দ্রুতগতিতে ছুটছে যে লাফ দেওয়ার ঝুঁকি নিতে পারল না সে। এভাবে পালাবার চেষ্টা আত্মহত্যার সামিল।
সে বলল, হ্যালো, রলিন্স। এখানে তোমাকে দেখব আশা করিনি। আমার টেলিগ্রাম পেয়েছ?
পেয়েছি।–কোনরকম ইতস্ততঃনা করে রলিন্স বলল ক্রিডের খুন নিয়ে তোমায় মাথা ঘামাতে হবে না। তোমার তার পাওয়ার আগেই সব জেনেছি। তোমার কাছে পিস্তল আছে তাই না?
হ্যাঁ, আছে। পকেট থেকে তুলে নাও হাডসন, ওটা আমার ডানদিকের পকেটে আছে।
হাডসন গম্ভীর মুখে পকেট থেকে অটোমেটিক পিস্তলটা তুলে নিল।
এর পারমিট আছে? রলিন্স জানতে চাইল।
নিশ্চয়ই। করিডন বলল, ওটা ব্যাগে আছে দেখবে নাকি?
এক্ষুনি দেখব না। তোমাকে লক-আপে পোরার মত সুযোগ নিশ্চয়ই দেবে না?
ভেব না এবারে আমায় লক-আপে রাখবার মত সুযোগ তুমি পাবে করিডন হেসে বলল, কারণ আমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই।
সকলে তাই বলছে বটে।রলিন্স বলল, তোমাকে দেখে অবাক হই করিডন। তোমার সুবিধার জন্য কিছু যাত্রীকে আমরা ট্রেন থেকে নামিয়ে দিয়েছি আর তোমাকে লন্ডনে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য দুনবারে একটা গাড়ি ঠিক করে রেখেছি।
কিন্তু আমি তো লন্ডনে ফিরব না।
দুঃখিত বুড়ো শালিক, পুলিশ তোমার সাথে লন্ডনে কথা বলতে চায়।পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে রলিন্স বলল, এই ধরনের কোন ব্যাপার আর কি। মরতে চাও নাকি?
রলিন্সের দেওয়া সিগারেট ধরাল করিডন আর রলিন্সকেও ধরাতে সাহায্য করল।
আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছ নিশ্চয়ই?
যদি আমায় বাধ্য না কর। তবে তোমার কাছে আমি সহযোগিতা প্রত্যাশা করছি।
কি অভিযোগ জানতে পারি?
ইচ্ছা করলে অনেক চার্জই তো গঠন করা যায়। তবে আমি চাই লোকটাকে ধরবার ব্যাপারে তুমি আমায় সাহায্য কর।
অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে আমার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করবার মত কোন অভিযোগ তোমার নেই। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি কোন চার্জ আমার বিরুদ্ধে গঠন করতে পারবে না।
বেশ দেখা যাবে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে একদিন ফাঁদে তোমাকে ফেলবই। রীটা অ্যালেনের কথা ভুলে গেছ-সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে ওর ঘাড় ভাঙ্গার ঘটনা?
ও নামে কাউকে চিনি না। কার কথা বলছ? এই সময়ে একটি মেয়ে দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকল। রলিন্স তার দিকে তাকাল। করিডনের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল রক্তস্রোত বইল। মেয়েটা অ্যান।
অ্যান দরজার সামনে থমকে দাঁড়াল। করিডনের দিকে তাকাল না, বরং রলিন্সের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, আপনার আপত্তি না থাকলে আমি ভেতরে আসতে পারি?
রলিন্স ব্যস্তভাবে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, দুঃখিত ম্যাডাম, এই কামরাটা সংরক্ষিত। একটু এগিয়ে গেলে জায়গা পাবেন। অসুবিধে করলাম বলে দুঃখিত। আমরা পুলিশ অফিসার।
আমি বুঝতে পারিনি। ভীষণ দুঃখিত। সত্যিই যদি আপনি পুলিশ অফিসার হন,রলিন্সকে আড়াল করে করিডনের দিকে তাকাল অ্যান, একটা প্রশ্ন করতে পারি?
নিশ্চয়ই। রলিন্স বলল, প্রশ্নটা কি?
আমার ভাই বলেছে, চেন টানলে পাঁচ পাউন্ড জরিমানা হয় না, কথাটা স্রেফ মিথ্যে। চেন টানলে ফাইন করে থাকে, কি বলেন?
হ্যাঁ, করে থাকে। রলিন্স বলল, আর কিছু বলবেন?
না। আশা করি কিছু মনে করেন নি? করিডনের বুকের মধ্যে হাতুড়ি পিটতে লাগল। মেয়েটা কি চেন টেনে ট্রেন থামাতে চাইছে? এখন নিজেকে ঠিক করতে হবে এ সুযোগ সে গ্রহণ করবে কিনা।