০৮. জন্মতিথি উৎসব

সত্যই চিত্রাঙ্গদা দেবীর জন্মতিথি উৎসব রাত পোহানোর সঙ্গে সঙ্গেই সানাইয়ের মাঙ্গলিক দিয়ে শুরু হয়ে গিয়েছিল।

বিখ্যাত সানাই বাজিয়ে রহিম এসেছিল।

ভোর হল, চিত্রাঙ্গদা দেবী তার ঘরে স্নান করে একটা দুধ-গরদের থান পরে এসে বসলেন—একে একে সকলে তাঁকে শুভকামনা জানিয়ে যায়।

সকলকেই হাসি মুখে চিত্রাঙ্গদা দেবী সম্ভাষণ জানান—এ যেন এক নতুন চিত্রাঙ্গদা। প্রশান্ত সৌম্য সুন্দর হাস্যময়ী —আভিজাত্য ও দম্ভের খোলসটা যেন আজ তিনি খুলে ফেলে দিয়েছেন।

সকাল থেকে সারাটা দিন দলে দলে কত যে লোক আসে চিত্রাঙ্গদাকে শুভকামনা জানাতে! কেউ কিছু ফুল, কেউ অন্য কোন উপটৌকন, কেউ কিছু মিষ্টি। চিত্রাঙ্গদাও উদ্যানে বড় বড় দুটো তাঁবুতে অতিথি অভ্যাগতদের জলযোগ আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেছিলেন। দুদিন ধরে হালুইকরেরা সব মিষ্টান্ন তৈরি করেছে—ভারে ভারে সব মিষ্টান্ন।

তারপর ক্রমশঃ সন্ধ্যা নামল। লাল-নীল সবুজ হলুদ-হরেক রকম আলোয় সারা ইন্দ্ৰালয় যেন ইন্দ্রপুরীর মতই ঝলমল করে ওঠে।

প্রথম দিন যাত্রার ব্যবস্থা ছিল। সারটা রাত ধরে যাত্রাগান হল। দ্বিতীয় দিনও অতিথি-অভ্যাগতদের ভিড়। রাত্রে বসল। গানের আসর। অনেক সব বড় বড় ওস্তাদ গাইয়েরা এসেছে।

পর পর তিন রাত্ৰি এবার গানের জলসা চলবে।

প্রথম রাত্রে আধুনিক, দ্বিতীয় রাত্রে রাগসঙ্গীত ও রবীন্দ্রসঙ্গীত, তৃতীয় রাত্রে ওস্তাদদের আসর।

রাত আটটা থেকেই আসর বসেছিল। কিরীটিও উপস্থিত ছিল আসরে।

চিত্রাঙ্গদা দেবীকেও কিরীটি দেখেছে। আসরে বসে গান শুনতে। তারপর যে কখন একসময় আসর ছেড়ে উঠে গেছেন, টের পায়নি। কিরীটী—গানের সুরে বোধ হয় তন্ময় হয়ে গিয়েছিল।

রাত তখন বোধ হয় এগারোটা বেজে কয়েক মিনিট হবে

বড়ে গোলাম আলি মাত্র কিছুক্ষণ আগে আসরে নেমেছেন—গণেশ এসে কিরীটীর পাশে দাঁড়াল।

বাবুজী!

ফিস ফিস করে ডাকে গণেশ।

কে, গণেশ! কি খবর?

জয়ন্ত দাদাবাবু আপনাকে এখুনি একবার ডাকছেন!

জয়ন্তবাবু! কোথায় তিনি?

রাণীমার ঘরে।

কিরীটী নিঃশব্দে সঙ্গীতের জমাটি আসর ছেড়ে উঠে পড়ল। প্রায় শতাধিক শ্রোতাসবাই গানের সুরের মধ্যে ড়ুবে রয়েছে।

কিরীটীর পূর্বেই স্বাতী ও তার ছোটদা শচীন্দ্র ছাড়া মণীন্দ্র, জগদীন্দ্র ও ফণীন্দ্র আসরেই উপস্থিত আছে। তারাও তন্ময় হয়ে গান শুনছিল।

চিত্রাঙ্গদা দেবীও তাঁর আসনে বসেছিলেন, কিন্তু আসর ছেড়ে যাবার সময় তাঁকে দেখা গেল না। তাঁর আসনটি শূন্য। কখন যে এক সময় তিনি উঠে চলে গেছেন, সে জানতে পারেনি।

আগের দু-রাত্রিতেও চিত্রাঙ্গদা দেবী যাত্রাগান শেষ হবার আগেই মাঝামাঝি সময় উঠে চলে গিয়েছিলেন যাত্রাগানের আসর ছেড়ে।

আজও হয়তো গেছেন—

যেতে যেতে লক্ষ্য পড়ল, সুধন্যও একপাশে শ্রোতাদের মধ্যে বসে গান শুনছে।

কিরীটী চিন্তা করতে করতে অগ্রসর হয়, এত রাত্রে চিত্রাঙ্গদা দেবীর ঘরে কেন তার ডাক পড়ল!

জয়ন্ত চৌধুরী ডেকে পাঠিয়েছে তাকে।

আজ সন্ধ্যার সময় জয়ন্ত চৌধুরী একবার তার ঘরে এসেছিল, বলেছিল কাল সকালেই সে নাকি কলকাতা ফিরে যাবে।

চিত্রাঙ্গদা দেবীর সঙ্গে সেই যে প্রথম দিন। এখানে পৌঁছবার পর সন্ধ্যায়। তাঁর ঘরে আলাপ শুরু হতেই ঘরে সুধন্যর আবির্ভাব ঘটল এবং চিত্রাঙ্গদা দেবী একটু পরে ঘর ছেড়ে হঠাৎ চলে গেলেন, তারপর আর চিত্রাঙ্গদা দেবীর সঙ্গে কোন আলাপ বা কথাবাত হয়নি। যদিও গত দুদিন যাত্রার আসরে ও আজ সঙ্গীতের আসরে দূর থেকে তাঁকে সে দেখেছে।

সাধারণের সিঁড়িপথেই কিরীটী গণেশকে অনুসরণ করে দোতলায় গিয়ে হাজির হল একসময়। সিঁড়ির আলোতে ও বারান্দার উজ্জ্বল আলোয় সব কিছু চোখে পড়ে-নির্জন, একেবাবে খাঁ খাঁ করছে চারদিক।

দূর থেকে গানের সুর ভেসে আসছে।

বসবার ঘরের দিকে নয়, গণেশ চিত্রাঙ্গদার শয়নঘরের দিকেই এগিয়ে গেল—

কিরীটিও এগোয়।

দরজাটা ভেজানো ছিল।

গণেশ হঠাৎ ভেজানো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে কিরীটীর দিকে চেয়ে নিম্নস্বরে বললে, ভেতরে যান, জয়ন্ত দাদাবাবু ভেতরেই আছেন।

কিরীটী দরজা ঠেলে ঘরের মধ্যে পা দিল।

ঘরের মধ্যেও আলো জ্বলছিল—এবং ঘরে পা দিয়ে সামনের দিকে ভূমিতলে দৃষ্টি পড়তেই কিরীটী যেন আচমকা নিজের অজ্ঞাতেই থমকে দাঁড়ল। তার গলা দিয়ে অস্ফুট একটা শব্দ বের হয়ে এল শুধু-তারপরই সে যেন বোবা হয়ে গেল।

ধবধবে সাদা মার্বেল পাথরের মসৃণ মেঝের ওপর পড়ে আছে চিত্রাঙ্গদার দেহটা। পরনে সেই সন্ধ্যার দুধ-গরদ থান। সাদা মার্বেল পাথরের মেঝের অনেকটা জায়গা ও পরনের দুধ-গরদ থান রক্তে একেবারে লাল-যেন রক্তস্রোতের মধ্যে ভাসছে একটি শ্বেতপদ্ম।

উপুড় হয়ে মেঝের ওপর পড়ে আছেন মুখ থুবড়ে চিত্রাঙ্গদা দেবী। ডান হাতটা সামনের দিকে ছড়ানো, বঁ হাতটা ভাঁজ করা বুকের কাছে।

মাথার কেশভার খানিকটা পিঠের ওপর পড়ে ও খানিকটা দুপাশে ছড়িয়ে আছে। আর অদূরে দাঁড়িয়ে জয়ন্ত চৌধুরী।

দৃশ্যটা এমনি মর্মদ্ভদ ও আকস্মিক যে কিরীটী কয়েকটা মুহুর্ত বিহ্বল বোবাদৃষ্টিতে সামনের দিকে কেমন যেন অসহায়ের মত তাকিয়ে থাকে।

কোন শব্দই তার মুখ দিয়ে বের হয় না। তারপর একসময় নিজের সম্বিৎ ফিরে পেয়ে জয়ন্ত চৌধুরীর দিকে তাকায়, ধীরে ধীরে এগিয়ে ভূপতিত রক্তাক্ত দেহটার সামনে কুঁকে পড়ে প্রথমে শ্বাস-প্রশ্বাস পরীক্ষা করে, যদিও ভূপতিত দেহটার দিকে তাকিয়েই সে বুঝতে পেরেছিল চিত্রাঙ্গদা দেবী আর বেঁচে নেই।

তবু একবার ক্ষণেকের জন্য ভূপতিত দেহটা পরীক্ষা করে ধীর ধীরে উঠে দাঁড়াল কিরীটী।

কখন জানতে পারলেন। আপনি মিস্টার চৌধুরী?

কিছুক্ষণ আগে ঘরে ঢুকেই। মৃদুকণ্ঠে বললে জয়ন্ত চৌধুরী।

কখন আপনি এ ঘরে এসেছেন?

এগারোটা বাজবার বোধ হয় মিনিট কয়েক আগে—কারণ ঘরে ঢুকে ওই দৃশ্য দেখবার একটু পরেই বারান্দার ঘড়িতে এগারোটা বেজেছিল। আমিও ঠিক আপনার মত প্রথমটায় হতভম্ব হয়ে গেছলাম, মিস্টার রায়। কি করব বুঝতে পারিনি, তারপর হঠাৎ আপনার কথা মনে পড়ল—গণেশকে দ্বিয়ে আপনাকে ডাকতে পাঠাই।

গণেশ কোথায় ছিল?

গণেশ আমাকে ডাকতে গিয়েছিল।

আপনি কোথায় ছিলেন?

ঘরে। সন্ধ্যেবেলা থেকেই মাথাটা ধরেছিল, তাই দোতলায় নিজের ঘরে শুয়েছিলাম।

আপনি গানের আসরে যাননি?

না।

হুঁ। গণেশ আপনাকে ডাকতে গিয়েছিল কেন?

বড়মা ডেকে পাঠিয়েছিলেন আমাকে। শুয়ে শুয়ে বোধ হয় একটু তন্দ্ৰামত এসেছিল, গণেশের ডাকাডাকি ও দরজার গায়ে ধাক্কার শব্দে ঘুম ভেঙে উঠে পড়ি।

তারপর?

আমার আসতে বোধ হয় মিনিট দশ বারো লেগে থাকবে। এসে দেখি, ঘরের দরজাটা ভেজানো। দরজা ঠেলে ঘরে পা দিয়েই দেখি ওই বীভৎস দৃশ্য। তখনো প্ৰাণটা একেবারে বের হয়ে যায়নি, মাঝে মাঝে মৃদু মৃদু আক্ষেপ করছেন যন্ত্রণায়। ঝুকে পড়ে ওঁর মুখের দিকে তাকালাম, কিন্তু বার দুই ঠোঁটটা কাঁপাল, তারপরেই সব শেষ হয়ে গেল।

গণেশ জানে ব্যাপারটা?

জানে।

তাকে ডাকুন তো একবার। কোথায় সে? বোধ হয় বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। জয়ন্ত ডাকল অতঃপর, গণেশ-গণেশ—

গণেশ ভেতরে এল। তার দু চোখে জল। বেচারী কাঁদছিল তখনো।